শব্দ ও বাক্যাংশের বিশেষ-অর্থে প্রয়োগের বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা কর।
শব্দ ও বাক্যাংশের বিশেষ-অর্থে প্রয়োগ
বাংলায় বিভিন্ন শব্দকে বিভিন্ন অর্থে এবং বিভিন্ন রূপে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এক-একটি শব্দের এক-একটি অর্থ থাকে। কিন্তু অনেক সময় সেই সকল অর্থে শব্দকে ব্যবহার না করে বিভিন্ন বিশেষ বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাকেই বলা হয় একই শব্দের বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার। এখানে বিভিন্ন প্রকার শব্দের বিভিন্ন অর্থে বিশিষ্ট প্রয়োগের উদাহরণ প্রদত্ত হল:
বিশেষ্য পদের বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার
অঙ্ক>অঙ্কে কাঁচা [গণিতে কাঁচা]: ছেলেটি অঙ্কে কাঁচা। মাতৃ-অঙ্ক [মায়ের কোল]: ‘তব অঙ্ক শঙ্কাশূন্য বৈকুণ্ঠ-সমান।’ পঞ্চাঙ্ক [নাটকের পাঁচটি অংশ]: ‘মেবার পতন’ একখানি পঞ্চাঙ্ক নাটক। অঙ্কপাত করা [দাগ কাটা]: মাটিতে অঙ্কপাত করে সন্ন্যাসী তার ভবিষ্যৎ গণনা করলেন। পদাঙ্ক [পদচিহ্ন]: প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে।
আলাপ>বাক্যালাপ [কথাবার্তা]: তার সঙ্গে আমার বাক্যালাপ বন্ধ। আলাপ করা [পরিচয় করা]: আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম। সুরের আলাপ [সুর ভাঁজা]: বড়ে গোলাম আলি প্রথমেই ভৈরব রাগে আলাপ শুরু করলেন।
উত্তর>উত্তর দেওয়া [জবাব দেওয়া]: ‘উত্তর দাও আদি পিতা ভগবান।’ উত্তর দিক [দিক-বিশেষ]: শীতকালে উত্তর দিক থেকে হিমেল বাতাস বইতে থাকে। উত্তর পুরুষ [বংশধর]: সেখানে এখন কবির উত্তরপুরুষেরা বাস করেন। উত্তর কাল [পরবর্তীকাল]: আজ যা সাহিত্যরূপে সৃষ্টি হচ্ছে, উত্তরকালেই হবে তার যথার্থ মূল্যায়ন। অষ্টোত্তর [আটের অধিক] শত: এ পূজায় যে অষ্টোত্তর শত বিল্বপত্রের প্রয়োজন। লোকোত্তর [অসাধারণ]: রবীন্দ্রনাথ ছিলেন লোকোত্তর প্রতিভার অধিকারী। দেবোত্তর [দেবত্র বা দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত]: ওটা আমার দেবোত্তর সম্পত্তি, ওতে হাত দিও না।
কাগজ>লেখার কাগজ [লেখার উপকরণ]: আমার লেখার কাগজ নেই। কাগজ বাহির করা [পত্রিকা প্রকাশ করা]: ‘নন্দ একদা হঠাৎ একটা কাগজ করিল বাহির।’ কোম্পানীর কাগজ [সরকার কর্তৃক গৃহীত ঋণের দলিল]: তিনি পঞ্চাশ হাজার টাকার কোম্পানীর কাগজ কিনেছিলেন।
মুখ>মুখে আনা [বলা]: এমন কথা আর কখনো মুখে এনো না। মুখ খারাপ করা [অশ্লীল ভাষায় গালাগালি দেওয়া]: এখানে মুখ খারাপ করো না কিন্তু, ভালো হবে না তাহলে। মুখ সামলানো [সংযতভাবে কথা বলা]: মুখ সামলিয়ে কথা বলে। মুখ খোলা [কথা বলতে শুরু করা]: আজ তিনি মুখ খোলেননি। মুখ বন্ধ করা [চুপ করা]: তুমি এখন মুখ বন্ধ করবে কিনা? মুখ চুন [লজ্জায় মলিন]: সব শুনে বাবুরা সব মুখ চুন করে বসে রইলেন। মুখ রাখা [সম্মান বজায় রাখা]: ঠাকুর, খোকা যেন আমার মুখ রাখে। মুখ তুলে চাওয়া [প্রসন্ন হওয়া]: দেবতা যদি একবার মুখ তুলে চান, তাহলে আমার কোন অভাবই আর থাকবে না। মুখ করা [গালি দেওয়া]: লোকটা তোমাকে মুখ করে চলে গেল, আর তুমি কিছু বললে না? মুখ নাড়া দেওয়া [কটু ভৎসনা করা]: তিনি তো দিনরাত আমাকে মুখ নাড়া দিচ্ছেন। মুখে আগুন [মৃত্যু কামনা করা]: যে এমন কথা বলে, তার মুখে আগুন। মুখে ফুল-চন্দন পড়া [আশীর্বাদ বা শুভ কমনা করা]: তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। মুখ দেখানো [সসম্মানে চলা]: কাজটা যদি না করতে পারি, তাহলে মুখ দেখানো যাবে না। মুখের কথা [অত্যন্ত সহজ]: বিলেত যাওয়া কি মুখের কথা? মুখ পোড়ানো [সুনাম নষ্ট]: তুমি আমার মুখ পুড়িয়েছ, আর বেশী বকো না।
বুক>বুক ফাটা [বেদনাতে অন্তর বিদীর্ণ হওয়া]: ওদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। বুক দশহাত হওয়া, বুক ফুলে ওঠা [গর্বিত বা আনন্দিত হওয়া]: ছেলের কৃতিত্বে বাবার বুক দশহাত হয়ে গেল [ফুলে উঠলো]। বুক দিয়ে পড়া [সর্বশক্তি নিয়ে উদ্যোগী হওয়া]: ভাইকে বাঁচাবার জন্যে তিনি বুক দিয়ে পড়লেন। বুক ফোলানো [গর্ব প্রকাশ করা]: ওকে নিয়ে এত কাণ্ড হয়ে গেল, তবু সে এখনও বুক ফুলিয়ে চলে। বুক বাঁধা [ধৈর্য ও সাহস অবলম্বন করা]: এত ঝড়-ঝাপ্টা সত্ত্বেও তিনি কী করে বুক বেঁধে রয়েছেন, তাই ভাবি। বুক ভাঙ্গা [অত্যন্ত মনঃকষ্ট হওয়া]: একমাত্র ছেলে তার বুক ভেঙে দিয়ে চলে গেছে। বুকের রক্ত দেওয়া [প্রাণ দেওয়া]: স্বাধীনতার বেদীমূলে দেশের ক্ষুদিরামের দলই বুকের রক্ত দিয়েছে। বুকে হাত দিয়ে বলা [সাহস বা আন্তরিকতার সঙ্গে): বুকে হাত দিয়ে বলল তো, তুমি ভয় পাওনি।
মাথা>মাথা পেতে নেওয়া [শিরোধার্য করা]: তিনি যদি আমাকে কোন শাস্তি দিতেন, আমি তা মাথা পেতে নিতাম। মাথা কেনা [আজ্ঞা বহন করা]: আমি কেন তাকে হক কথা বলতে পারবো না? তিনি কি আমার মাথা কিনেছেন? মাথা কাটা যাওয়া [অপমান বোধ করা]: এত লোকের মাঝখানে সে এমন কাণ্ড করলো যে, লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। মাথা খাওয়া [দিব্যি দেওয়া]: ‘মাথা খাও, ভুলিয়ো না, খেয়ো মনে করে।’ মাথা খাওয়া [স্বভাব নষ্ট করে দেওয়া]: তুমিই তো আবার প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে ছেলেটার মাথা খেয়েছো। মাথায় তোলা [অত্যন্ত প্রশ্রয় দেওয়া]: যেমন তাকে মাথায় তুলেছে, তেমনি এখন তার ফল ভোগ করো। মাথা ব্যথা [দুশ্চিন্তা]: পাড়ায় কার কি হলো, না হলো, তোমার তাতে এত মাথাব্যথা কেন? মাথা হেঁট হওয়া [অপমান বোধ করা]: এমন কিছু করো না, যাতে লোকের কাছে আমার মাথা হেঁট হয়। মাথা খাটানো [বুদ্ধি খাটানো]: লোকটা মাথা খাটিয়ে কলটা বানিয়েছে বেশ, তাই না? মাথা ঘামানো [চিন্তা করা]: ওই সব বাজে কথায় মাথা ঘামিয়ে কোন লাভ আছে কি? মাথা [প্রধান]: তিনি গাঁয়ের মাথা, তাকে সব কথা বলতে হবে বৈ-কি? মাথা [বোধশক্তি]: দেখতে অমন হলে কি হবে, লেখাপড়ায় ছেলেটার খুব মাথা আছে। মাথা গরম করা [চটে যাওয়া]: অত সহজে আমি মাথা গরম করি না হে। মাথা ঠাণ্ডা করা [উত্তেজনা দূর করা]: মাথা ঠাণ্ডা করে একবার কথাটা ভেবে দেখো। মাথায় হাত বুলানো [ঠকানো]: সে তার মাথায় হাত বুলিয়ে তার অমন দামী ঘড়িটা হাতিয়ে নিয়েছে। মাথায় হাত [দুশ্চিন্তাগ্রস্ত]: বন্ধুর বুদ্ধিতে চলতে গিয়ে সর্বস্ব খুইয়ে এখন তার মাথায় হাত। মাথায় বাড়ি [সর্বনাশ]: আমার মাথায় বাড়ি, আমি কি অমন কথা বলেছি। মাথায় ওঠা, মাথায় চড়া [প্রিয় পাওয়া]: অতিরিক্ত আবদারে ছেলেটা মাথায় উঠেছে [মাথায় চড়েছে]। মাথার ওপর কেউ না থাকা [অভিভাবকহীন হওয়া]: ‘ছেলেটার মাথার ওপর কেউ নেই বলে তুমি ওকে যা খুশি তাই বলবে?’ মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গা [প্রবঞ্চনা করে আদায় করা]: ধনীরা চিরকাল গরীবদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে আরও ধনী হয়েছে। মাথা ঠেকানো [প্রণাম করা]: স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা। মাথা [কিছু না]: গান শিখে কী হবে, মাথা?, মাথায় করে রাখা [সযত্নে পালন করা]: মন দিয়ে লেখাপড়া কর, আমি তোমাকে মাথায় করে রাখবো। মাথা তোলা, মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা [নবচেতনায় জাগরিত হওয়া]: আজ এশিয়া আফ্রিকার পরাধীন দেশগুলি একে একে মাথা তুলে উঠে দাঁড়াচ্ছে। [মাথা চাড়া দিয়ে জেগে উঠছে]: মাথা বিক্রি করা [বশ্যতা স্বীকার করা]: আপনার আপিসে চাকরি করি বলে কি আপনার কাছে মাথা বিক্রি করেছি? মাথার ঘাম পায়ে ফেলা [কঠোর পরিশ্রম করা]: মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা ফসল ফলায়, তারা ফসলের মালিক নয় কেন?
হাত>হাত করা [বশে আনা]: বড়বাবুকে হাত করে সে দিব্যি ছুটির ব্যবস্থা করে নিয়েছে। হাত কামড়ান [আপশোস করা]: তখন চাকরিটা নিলাম না, এখন তাই হাত কামড়াচ্ছি। হাত খালি [রিক্ত হস্ত]: এখন তার একেবারে হাত খালি। তার কাছে চেয়ে এখন কিছু পাবে না। হাত-খরচ [খুচরা ব্যয়]: তার এখন হাত-খরচেরই টাকার অভাব। হাত-খোলা [দানশীল]: তার মতো হাত-খোলা মানুষ এ অঞ্চলে একটিও নেই। হাত গুটান [নিরস্ত হওয়া]: টাকার দাম কমে যাওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী এখন হাত গুটিয়ে বসেছে। হাত গোনা, হাত দেখা [ভাগ্য বিচার করা]: ঠাকুর মশাই আমার হাত দেখে হাত গুনে বলেছেন, আমি পাস করবো। হাতটান [ছিচ্কে চুরির অভ্যাস]: লোকটাকে একটু চোখে-চোখে রেখো, এর একটু হাতটান আছে। হাত তোলা [প্রহার করা]: তুমি ওর গায়ে হাত তুলেছ কোন সাহসে? হাত পাকান [অভ্যাস দ্বারা পটু হওয়া]: ছোটবেলা থেকে লিখে লিখে সে পদ্য লেখায় বেশ হাত পাকিয়েছে। হাত-পা বাঁধা [নিরুপায়]: ও-ব্যাপারে আমার হাত-পা বাঁধা, কিছু করবার আমার উপায় নেই। হাত-বদল [অধিকার পরিবর্তন]: ওপর তলায় জমি হাত বদল হয়ে গেছে, কৃষকেরা যে তিমিরে, সেই তিমিরে। হাতে খড়ি [প্রথম শিক্ষা]: ইস্কুলেই আমার কবিতা লেখার হাতে খড়ি। হাতে ধরা [সনির্বন্ধ অনুরোধ করা]: আমি তাকে আমার বাড়ি আসার জন্যে হাতে ধরে বলেছি, তাতেও কি উনি আসবেন না? হাতে নয় ভাতে মারা [প্রহার না করে অন্য উপায়ে দুর্বল করা]: ভারতীয়রা ইংরেজদের হাতে নয় ভাতে মেরেছিল। হাতে-নাতে [বমাল]: চোরটা হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। হাতে পাওয়া [আয়ত্তে পাওয়া]: তোমারে যখন একবার হাতে পেয়েছি, তখন সহজে ছাড়ছি না। কপালে হাত দেওয়া [ভাগ্যের দোহাই দেওয়া]: সক্ষম থাকতে দাড়াবার কোন চেষ্টা করোনি, এখন কপালে হাত দিলে হবে কি? কাঁচা হাত [অপটু হাত]: ছবিটা নিতান্তই কাঁচা হাতের আঁকা। পাকা হাত [পটু হস্ত]: দেখলেই বোঝা যায়, এটা পাকা হাতের কাজ। হাতে-কলমে [নিজে পরীক্ষা করে]: হাতে-কলমে যা শেখা যায়, তা কেউ কখনো ভুলতে পারে না। হাত পাতা [ভিক্ষা করা]: খাদ্যের জন্যে আজ আমাদের আর বিদেশীর কাছে হাত পাততে হয় না। হাত যশ [দক্ষ বা পারদর্শী বলে খ্যাতি]: মানসিক রোগের চিকিৎসায় আমাদের ডাক্তারবাবুর খুব হাতযশ।
গা>গা করা, গা দেওয়া [মনোযোগ দেওয়া]: আপনি যদি একটু গা করেন [গা দেন] তাহলে কাজটা হয়। গা-গতর [সর্বাঙ্গ]: সারাদিন খেটে খেটে গা-গতর ব্যথা হয়ে গেছে। গা জুড়ানো [শান্তি পাওয়া বা শ্রান্তি দূর করা]: সে মরলে আমার গা জুড়োয়। এখানে বাতা বসে একটু গা জুড়োই। গা-জোরি, গা-জরি [জবরদস্তি]: গা-জোরি করলে তো চলবে না আইনমতো চলতে হবে। গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা [জড়তা ত্যাগ করিয়া কাজে লাগা]: এখনই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়াতে হবে আমাদের। গা-জ্বালা করা [বিরক্তির উদ্রেক হওয়া]: রকম-সকম দেখে আমার গা-জ্বালা করে। গা ঢাকা দেওয়া [আত্মগোপন করা]: পুলিশ আসতেই চোরটা অন্ধকারে গা ঢাকা দিল। গা ঢেলে দেওয়া [শয়ন করা]: সারাদিনের ক্লান্তির পর বিছানায় এইমাত্র গা ঢেলে দিয়েছি; এখন আর উঠতে পারবো না। গা তোলা [ওঠা]: বেলা অনেক হয়েছে, এবার গা তোলো। গা-সহা, গা-সওয়া [অভ্যস্ত]: সব রকমের অপমানই এখন তার গা-সওয়া হয়ে গেছে। গায়ে কাঁটা দেওয়া [আতঙ্কে রোমাঞ্চ হওয়া]: কী ভয়ানক লড়াই হলো মা, যে শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা। গায়ের জ্বালা [ঈর্ষা]: সে ভাল চাকরি পেয়েছে, তাতে তোমার গায়ের জ্বালা কেন? গায়ের ঝাল ঝাড়া, গায়ের ঝাল মেটান [প্রচণ্ড ক্রোধ, প্রকাশ করা]: ওকে একবার সামনে পেলে প্রাণের আনন্দে গায়ের ঝাল ঝাড়বো [মেটাবো]। গায়ে থুতু দেওয়া [অত্যন্ত ঘৃণা প্রকাশ করা]: কারখানার লোহা-লক্কড়ের গায়ে থুতু দিয়ে সে গায়ে ফিরে এলো। গায়ে পড়ে [অযাচিতভাবে]: তুমি আবার গায়ে পড়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে এলে কেন? গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ান [পরিশ্রম-বিমুখ হয়ে চলা]: কতদিন এভাবে গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াও, আমি দেখবো। গায়ে মাখা [আমল দেওয়া]: ছেলেমানুষ—কিছু জানে না; ওর কথা গায়ে মাখবেন না। গায়ে মাস লাগা [হৃষ্টপুষ্ট হওয়া]: দেওঘরে গিয়ে ওর গায়ে মাস লেগেছে, দেখছি। গায়ে হাত তোলা [প্রহার করা]: কোন সাহসে তুমি ওর গায়ে হাত তুলেছো?
চোখ>চোখ ওঠা [চক্ষুরোগবিশেষ হওয়া]: ‘বোধ হয় রূপসীর চক্ষু উঠিয়াছে।’ চোখ খোলা, চোখ ফোটা (প্রকৃত জ্ঞানলাভ করা]: সমস্ত দেখে-শুনে এতদিনে তার চোখ খুলেছে [চোখ ফুটেছে]। চোখ পাকানো, চোখ রাঙান [রাগ দেখানো]: আপনি এভাবে আমাদের চোখ পাকাচ্ছেন [ চোখ রাঙাচ্ছেন] কেন? চোখ টেপা, চোখ ঠারা [ইশারা করা]: তিনি চোখ টিপে [চোখ ঠেরে] আমাকে বসে পড়তে বললেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো [স্পষ্ট প্রমাণসহ বোঝানো]: ব্যাপারটা তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে, নইলে তিনি বিশ্বাস করবেন না। চোখে চোখে রাখা [সতর্ক দৃষ্টি রাখা]: নতুন চাকরটাকে একটু চোখে চোখে রেখো। চোখে মুখে কথা বলা [বাচালতা করা]: ছেলেটা যেন চোখে মুখে কথা বলছে। চোখের বালি [চক্ষুঃশূল ব্যক্তি]: আমি যেন ওঁর চোখের বালি, আমাকে উনি একেবারেই সইতে পারেন না। চোখে সরষে ফুল দেখা [দিশাহারা হওয়া]: বাবা মারা যাবার পর বিমল চোখে সরষে ফুল দেখলো। চোখের মাথা খাওয়া [অন্ধের মতো আচরণ করা]: কিছু দেখতে পাচ্ছো না; চোখের মাথা খেয়েছে নাকি? চোখ কপালে ওঠা [অত্যন্ত আশ্চর্য হওয়া]: বাজারে জিনিসপত্রের দাম শুনে মদনবাবুর চোখ কপালে উঠলো। চোখ টাটানো [ঈর্ষা হওয়া]: তোমার উন্নতি দেখে আজ সবার চোখ টাটাচ্ছে। চোখের চামড়া, চোখের পর্দা [লজ্জা-সরম]: লোকটার চোখের চামড়া [পর্দা] বলতে কিছুই নেই, নইলে আমার এই বিপদের দিনে টাকা চাইতে আসে? চোখে পড়া [দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠা]: চোখে পড়বার মতো চেহারা সব্যসাচীর ছিল না।
কান>কান কাটা [সম্পূর্ণ পরাস্ত করা]: মেয়েটা সব বিষয়েই বেশী নম্বর পেয়ে ছেলেদের কান কেটেছে। কান কাটা [নির্লজ্জ)]: রামুর মতো কানকাটা লোক আমি একটাও দেখি নি; কিছুতেই ওর লজ্জা নেই। কান দেওয়া [শোনা, গ্রাহ্য করা]: ওই বাচাল লোকটার কথায় তুমি কান দিচ্ছো কেন? কান-পাতলা [অপরের কথায় সহজে আস্থা-স্থাপনকারী]: তিনি ভারী কান-পাতলা লোক; যে যা-ই বলে, তাই তিনি সত্যি বলে বিশ্বাস করে বসেন। কান পাতা [কোনো কিছু শুনতে প্রস্তুত হওয়া]: ‘আমি কান পেতে রই আমার আপন হৃদয়গহন-দ্বারে।’ কান ভাঙানো [কারও বিরুদ্ধে কিছু বলে মনোমালিন্য সৃষ্টি করা]: জানি, আমার বিরুদ্ধে নানা কথা বলে সে তোমার কান ভাঙিয়ে দিয়েছে। কান ভারী করা [কারও বিরুদ্ধে অন্যের মন বিষাক্ত করে দেওয়া]: তার নিন্দা করে তুমি আমার কান ভারী করতে এসেছো? কানে আঙুল দেওয়া [অশ্রাব্য কিছু শুনতে না চাওয়া]: সে যা বলেছে, শুনলে তুমি কানে আঙুল দেবে। কানে ওঠা [কর্ণগোচর হওয়া]: কথাটা যখন একবার কর্তার কানে উঠেছে, তখন তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। কানে তালা লাগা [ভয়ানক উচ্চ গোলমালের জন্যে শুনতে না পাওয়া]: পূজা-বাড়ীর হৈ-হট্টগোলে কানে তালা লাগার উপক্রম হয়েছে। কানে তোলা [শোনানো, গ্রাহ্য করা]: পুরুষ মানুষের কানে কি বাড়ির সব কথা তুলতে আছে? সে আমার কথা কানেই তুললো না। কানে যাওয়া [শুনতে পাওয়া]: কানের মাথা খাওয়া [শুনতে না পাওয়া]: এত ডাকছি, তবু তোমার কানে গেল না; বলি কানের মাথা খেয়েছো নাকি!
গলা>গলা টিপলে দুধ বেরোয় [নিতান্ত শিশু বা অজ্ঞ]: গলা টিপলে যার দুধ বেরোয়, সেই বাপ্পার মুখে কিনা এই কথা! গলায় গলায় [অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ]: চন্দন আর রঞ্জনের এখন গলায় গলায় ভাব। গলাবাজি [চেঁচামেচি, বক্তা]: আমরা গান শুনতে এসেছি, কারও গলাবাজি শুনতে আসিনি। গলায় পড়া [গলগ্রহ হওয়া]: দিদি-জামাইবাবু গত হলেন, আর শেষে ভাগনেটা আমার গলায় এসে পড়লো। গলায় দড়ি [ধিক্কারসূচক উক্তি]: তোমার মুখে আমাকে এই কথা শুনতে হলো? আমার গলায় দড়ি!
নাক>নাক উঁচান, নাক বাকান, নাক সিটকানো [ঘৃণা প্রকাশ করা]: আমাদের কাজ দেখে সে নাক উঁচিয়ে [নাক বেঁকিয়ে বা নাক সিটকিয়ে] চলে গেল। নাক মলা, নাকে খত দেওয়া [স্বকৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করা]: এই আমি নাক মলছি নাকে খত দিচ্ছি, আর যদি ওদের হয়ে কোন কথা বলি। নাক গলান [অনধিকারচর্চা করা]: তুমি বিজ্ঞানের লোক; সাহিত্যের ব্যাপারে নাক গলাতে এসেছ কেন? নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো [অত্যন্ত বশীভূত করে ফেলা]: কটা টাকা ধার দেবে বলে সে ওকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা [নিজের সমূহ ক্ষতি করে পরের অসুবিধা সৃষ্টি করা]: পাড়ার ছেলেরা খেতো বলে অমন সোনার মতো জমি লোকটা জলের দামে বিক্রি করে দিলে। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা আর কাকে বলে?
মন>মন ওঠা [আশা মেটা]: অত পেয়েও ছেলেটার কিছুতেই মন ওঠে না। মন করা [সঙ্কল্প করা]: করিলাম মন শ্রীবৃন্দাবন বারেক আসিব ফিরি। মন কষাকষি [পরস্পর মনোমালিন্য]: এখন দুই শরিকের খুব মন কষাকষি চলেছে। মন কেমন করা [অস্থির বা ব্যাকুল হওয়া]: সকাল থেকে মায়ের জন্য মন কেমন করছে। মন খারাপ হওয়া [বিষাদগ্রস্ত হওয়া]: তার কথা শুনে কাল থেকে আমার মন খারাপ হয়ে গেছে। মন-খোলা [সরল]: মন-খোলা লোক আজকালকার দিনে সত্যিই বিরল। খোলা মন [সংস্কারহীন মন]: খোলা মন নিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। মন খোলা [মনের কথা খুলে বলা]: তোমাকে আমার সব কথাই মন খুলে বললাম, এখন যা করার করো। মন গলা [করুণাপরবশ হওয়া]: তাকে সমস্তই বললাম, তবুও তার মন গললো না। মন জোগানো [মনের মতো কাজ করে প্রসন্ন করা]: নতুন বউ এখন শাশুড়ির মন জুগিয়ে চলবে, এইটেই আশা করেছিলাম। মন-মরা [বিষণ্ন]: সারাদিন তুমি এমন মনমরা হয়ে থাকো কেন? মনে করা [কল্পনা করা]: মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে। মনে দাগ কাটা [স্থায়ী স্মৃতি থাকা]: তার কথা আমাদের মনে দাগ কেটেছে। মনে ধরা [পছন্দ হওয়া]: ছেলেটিকে বাবা-মার খুব মনে ধরেছে। মনে পড়া [স্মরণ হওয়া]: আজ মনে পড়ছে, ১৩৪৮ সালের বাইশে শ্রাবণের কথা। মনের আগুন [শোকদুঃখাদিজনিত মানসিক যন্ত্রণা]: মনের আগুন কি চোখের জলে নেভে? মনের কালি [মনোমালিন্য]: ভালোবাসাতেই মানুষের মনের কালি দূর হবে। মনের জোর [আত্মবিশ্বাস]: শুধু মনের জোরেই এতখানি পথ একদিনে হেঁটে হাসতে পেরেছি। মনের ঝাল ঝাড়া, মনের ঝাল মিটান [অন্তরের ক্রোধ প্রকাশ করা]: অনেক দিন পরে আমাকে কাছে পেয়ে উনি মনের ঝাল ঝাড়লেন [মেটালেন]। মনের মতো [পছন্দসই]: শুধু এই লাইব্রেরীতেই আমি আমার মনের মতো বই পাই। মনের মানুষ [পছন্দসই ব্যক্তি]: আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যে রে? মনের মিল [সদ্ভাব]: ওদের ভাইদের মধ্যে আশ্চর্য মনের মিল দেখেছি।
কথা>কথা কাটাকাটি [তর্ক-বিতর্ক]: মিছামিছি কথা কাটাকাটি করে কী লাভ? কথা দেওয়া [প্রতিশ্রুতি দেওয়া]: কথা দিলাম, সামনের শনিবার ওখানে যাবো। কথা চালা, কথা পাড়া [প্রস্তাব করা]: তখন অবস্থা বুঝে আমি কথাটা চাললাম [পাড়লাম]। কথাবার্তা [আলাপ-আলোচনা]: ওর সঙ্গে সেদিন ও বিষয়ে কোন কথাবার্তাই হয়নি। কথা রাখা [প্রতিজ্ঞা পালন করা]: জীবন দিয়েও আমি আমার কথা রাখবো। কথা শোনা [কথা মান্য করা]: ছেলেরা আজকাল আর আমার কথা শোনে না। কথায় কথায় [প্রসঙ্গক্রমে]: কথায় কথায় সেদিন ওরা ঝগড়া বাধিয়ে বসলো। কথার কথা [মূল্যহীন কথা]: ওটা বলেছি কথার কথা, ওটাকে অত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন? ছোট মুখে বড় কথা [সামান্য ব্যক্তির বৃহৎ ব্যাপারে মন্তব্য করা]: আর যা-ই হোক, ছোট মুখে বড় কথা মানায় না। কথার মতো কথা, লাখ কথার এক কথা [উচিত কথা]: সেদিন সে যা বলেছে কথার মতো কথা [লাখ কথার এক কথা)।
বিশেষণ পদের বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার
বড়>বড় কথা [প্রধান কথা, স্পর্ধিত উক্তি]: খুব বড় কথা বলেছো তুমি। ছোট মুখে বড় কথা ভালো শোনায় না। বড় কুটুম [সম্বন্ধী]: ওকে চিনতে পারলে না? তোমার বড় কুটুম গো। বড় গলা [উঁচু গলা]: সেদিন সে নিজের ছেলের কথা খুব যে বড় গলায় বলে এসেছিল, আজ কি হলো? ওর ছেলে যে একটি চোর, তা যে সবাই জেনে ফেলেছে। বড় জোর [খুব বেশী হয়তো]: কতোই বা ওর বয়েস হবে? বড় জোর কুড়ি। বড় বাড়ি [বড় শরিকের বাড়ি]: বড় বাড়িতে আজ সকলের নেমন্তন্ন। বড় লোক [ধনী ব্যক্তি]: বড়লোকেরা গরীবদের কথা একেবারেই ভাবে না। বড় মানুষী, বড় মান্ষি [ধনী লোকের অভিনয়]: আমরা গরীব বলে বড় মান্ষি করতে এসো না, মেজবউ। বড় হওয়া [খ্যাতিমান্ হওয়া]: দেখো, তোমার ছেলে কত বড় হবে। বড় মানুষ [মহাপুরুষ]: বিদ্যাসাগর মশাই যে কত বড় মানুষ ছিলেন, তা বুঝিয়ে বলবার প্রয়োজন নেই। বড় মুখ করে আসা [প্রত্যাশা নিয়ে আসা]: সে তোমার কাছে সেদিন কত বড় মুখ করে এসেছিল, আর তুমি কিনা তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলে? বড়বাবু [প্রধান বাবু]: হেড-আপিসের বড়বাবু লোকটি বড় শান্ত।
ছোট>ছোট নজর [ঘৃণা]: তোমার যে এত ছোট নজর হবে, তা আমি আগে ভাবতে পারিনি। ছোট কাজ [হেয়]: ছোট কাজ করে বলে মানুষটাকে ছোট ভেবো না। ছোট জাত [অবনত সম্প্রদায়]: সমাজের ছোট কাজগুলো করে বলেই কি হাড়ি-মুচি-ডোম—এরা ছোট জাত? ছোট আদালত [ক্ষমতায় নিম্নতর]: ছোট আদালতে জিতেছো তো কি হয়েছে? আমি আবার আপীল করবো। ছোট হয়ে যাওয়া [সম্মান নষ্ট হওয়া]: তুমি কথাটা বলাতে আমি ওর কাছে ছোট হয়ে গেলাম। ছোট হওয়া [নম্র]: ‘বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে।’ মুখ ছোট হয়ে যাওয়া [সংকুচিত হওয়া]: দেখলে না, আমাকে দেখে ওর মুখ কেমন ছোট হয়ে গেল। ছোট করা [মর্যাদায় হানি করা]: তুমি ওভাবে আমাকে ওর কাছে ছোট করলে কেন? ছোট লোক [অভদ্র]: ‘ছি! ছি! আমাকে ও এত ছোট লোক মনে করে!
কাঁচা>কাঁচা পথ [মাটির তৈরী]: দশ মাইল কাঁচা পথ গোরুর গাড়িতে করে যেতে হবে। কাঁচা বয়স [তরুণ]: তোমাদের কাঁচা বয়েস, তোমরা এখন রাতকে দিন করতে পারো। কাঁচা বুদ্ধি [অপরিণত]: তোমার যে এমন কাঁচা বুদ্ধি হবে, তা কি আমি আগে জানতাম? কাঁচা লেখা [অপটু]: এটা বড় কাঁচা লেখা, পত্রিকায় ছাপা যাবে না। কাঁচা কাজ [অদক্ষভাবে কৃত]: সব জেনেও তুমি এমন কাঁচা কাজ করলে কেন? অঙ্কে কাঁচা [অদক্ষ]: রমেন অঙ্কে বড় কাঁচা। কাঁচা কথা [অনির্ভরযোগ্য প্রতিশ্রুতি]: জানো, রাখতে পারবে না, তবু এমন কাঁচা কথা তাকে দিয়ে এলে কেন? কাঁচা খাতা [খসড়া]: হিসাব কাঁচা খাতায় তুলেছে, অথচ পাকা খাতায় তোলেনি। কাঁচা রং [অস্থায়ী]: এ তো কাঁচা রং, জলে ধুলেই উঠে যাবে। কাঁচা সোনা [বিশুদ্ধ]: ওটা কাঁচা সোনার গয়না। কাঁচা পয়সা [সহজলভ্য]: তার হাতে এখন কাঁচা পয়সা আসছে কিনা, তাই সে ধরাকে সরাজ্ঞান করছে। কাঁচা ঘুম [অপূর্ণ]: কাঁচা ঘুম থেকে উঠে ছেলেটা খালি কাঁদছে। কাঁচামাল [স্বাভাবিক উৎপন্ন দ্রব্য]: কাঁচামালের অভাবে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যাবার মুখোমুখি। কাঁচা হাত [অপটু হাত]: ছবিটা কাঁচা হাতের আঁকা।
পাকা>পাকা চোর [অভিজ্ঞ চোর]: ‘বাবু কন হেসে, বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়।’ পাকা ছেলে [ঝানু]: হারু বড় পাকা ছেলে। পাকা কাজ [নিপুণভাবে কৃত]: তোমার কাছ থেকে এই রকম পাকা কাজই আশা করেছিলাম। পাকা লেখা [নির্দিষ্ট ধরন-প্রাপ্ত]: এ রকম পাকা লেখা তোমার ছাড়া আর কার হবে? পাকা খাতা [চূড়ান্ত হিসাবের খাতা]: হিসেবটা পাকা খাতায় তুলেছে তো? পাকা রং [স্থায়ী]: কাপড়টার রং পাকা, কাচলে উঠবে না। পাকা পাঁচ সের [পাকা ওজন]: গাইটা দুধ দিত পাকা পাঁচ সের। পাকা বাড়ি [দগ্ধ ইটের তৈরি]: ঝড়ের দিন সবাই রায়বাবুদের পাকা বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। পাকা কথা [অপরিবর্তনীয়]: আমি তোমাকে পাকা কথাই দিলুম, ওর কোন নড়চড় হবে না। পাকা দলিল [আইনানুসারে সম্পাদিত]: বাকি টাকাটা দিয়ে আমি পাকা দলিল করিয়ে নেব। পাকা সোনা [খাঁটি]: দেখছো কি, সমস্ত গয়নাই পাকা সোনার। পাকা হাড় [শ্রমে অভ্যস্ত]: পাকা হাড়, তাই এত ঝড়-ঝাপটায় ভাঙেনি। পাকা ফলার [লুচি-মিঠাইসহ]: রায়বাড়িতে সেদিন হয়েছিল পাকা ফলারের আয়োজন। পাকা দেখা [বর বা কনেকে আশীর্বাদ]: সেদিন ছিল রায়বাবুর মেয়ের পাকা দেখা। পাকা ঘুঁটি কেঁচে যাওয়া [সম্পন্ন-প্রায় কাজ পণ্ড]: আর দুটো দিন হলেই কাজ হাসিল হয়ে যেত। কিন্তু তার আগেই বুড়োর ছেলে এসে গেল; আর পাকা ঘুঁটি একেবারে কেঁচে গেল। পাকা ধানে মই [সুসম্পন্ন কাজ পণ্ড]: তুমি আমাকে দেখতেই পারো না কেন? আমি কি তোমার পাকা ধানে মই দিয়েছি? পাকা মাথা [প্রধান ব্যক্তি]: কোন কাজ করবার আগে পাকা মাথার বুদ্ধি নিও। পাকা হাত [নিপুণ]: স্পষ্ট বোঝা যায়, এটা পাকা হাতের কাজ। পাকা মাথায় সিঁদুর পরা [প্রবীণ বয়স পর্যন্ত সব থাকা]: আশীর্বাদ করি, পাকা মাথায় সিঁদুর পরো।
খোলা>খোলা মাঠ [উন্মুক্ত মাঠ]: দিল খোলা [উদার হৃদয়]: ‘খোলা মাঠের উপদেশে দিল-খোলা হই তাই রে।’ খোলা মন [সংস্কারহীন মন]: খোলা মন নিয়ে চিন্তা করুন, দেখবেন এগুলি অর্থহীন। মুখ খোলা [অকপট]: এমন মুখ-খোলা লোক আমি আর দেখিনি। খোলা হাওয়া [মুক্ত বাতাস]: ভোরের খোলা হাওয়ায় একটু বেড়িয়ে এসো।
বাসি>কাপড় বাসি করা [ধোলাই করা]: ধোপাকে কাপড়টা বাসি করে আনতে বলেছো তো? বাসি ভাত [পূর্ব দিনে প্রস্তুত]: বাসি ভাত খাও, বাছা, ঐ ঢাকা রয়েছে। বাসি খবর [অতি পুরাতন]: মহাশূন্য থেকে মানুষ ঘুরে এসেছে, ওটা তো বাসি খবর। বাসি কাপড় [পূর্ব রাত্রে পরিহিত বস্ত্র]: বাসি কাপড়ে পূজার ফুল তুলো না। বাসি ঘর [দিনের মধ্যে যে ঘর সাফ করা হয়নি]: ঝাঁট পড়েনি, বাসি ঘর এখনও পড়ে আছে। বাসি জল [পূর্ব দিনে তোলা জল]: এক গেলাস বাসি জল খেয়ে নাও, দেখি। বাসি দুধ [পূর্ব দিনে যে দুধ দোহন করা হয়েছে]: বাসি দুধ কখনও খাবে না। বাসি ফুল [পূর্ব দিনের তোলা ফুল]: বাসি ফুলে কোন পূজো হয় না। বাসি বিয়ে [হিন্দু বিবাহের পরদিন আচরণীয় অনুষ্ঠান]: পাড়ার মেয়েরা দল বেঁধে বাসি বিয়ে দেখতে এলো। বাসি মড়া [যে শব গত রাত্রির মধ্যে দাহ করা হয়নি]: বড় ছেলে ছিল দিল্লীতে; তাই সরকার মশাইয়ের মৃতদেহ বাসি মড়া হয়ে গেল। বাসি মুখ [প্রভাতে নিদ্রা-ভঙ্গের পর যে মুখ প্রক্ষালিত হয়নি]: তুমি বাসি মুখে চা খাও?
সাদা>সাদা মন [সংস্কারহীন মন]: সাদা মন নিয়ে ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখুন। সাদা কথা [সহজ কথা]: সাদা কথায় বলে, মরা হাতি লাখ টাকা। সাদা হাত [নিরাভরণ হাত]: মেয়েটার সাদা হাতের দিকে তাকানো যায় না। সাদাসিধে [বিলাস-বর্জিতা]: লোকটি অত্যন্ত সাদাসিধে। সাদা-মাঠা [কারুকার্যহীন]: উনি পত্রিকার জন্যে একটা সাদা-মাঠা গল্প লিখেছেন।
ক্রিয়াপদের বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার
কাটা>কথা কাটাকাটি [তর্ক-বিতর্ক করা]: মিছিমিছি কথা কাটাকাটি করে তো কোন লাভ নেই। ফোড়ন কাটা [বিদ্রুপ করা]: ওরা ফোড়ন কাটতেই ওস্তাদ; কাজটা করুক দেখি। ভুল কাটা [দাগ দিয়ে বাতিল করা): মাস্টার মশাই কত আর ভুল কাটবেন? পুকুর কাটা [খনন করা]: রামবাবুরা তেলিপাড়ার মাঠে একটা পুকুর কাটবেন। আঁক কাটা [অঙ্কন করা]: বইয়ের পাতায় আঁক কেটেছে কে? ছড়া কাটা [সুর করে বলা]: পদ্মবুড়ির মত ছড়া কাটতে কেউ পারে না। তিলক কাটা [দেহের নানা স্থানে চন্দনের ছাপ আঁকা]: সারা গায়ে তিলক কাটলে হবে কী? লোকটা আসলে ভণ্ড। চেক কাটা [লিখে দেওয়া]: বলা মাত্রই তিনি এক হাজার টাকার একখানা চেক কেটে দিলেন। পথ কাটা [তৈরী করা]: ‘চলার বেগে পথ কেটে চল, করিস্ নে আর দেরি।’ খাল কাটা [খনন করা]: তখনই বলেছিলাম, খাল কেটে কুমীর এনো না। ছানা কাটা [তৈরি করা]: বাড়িতে ছানা কাটিয়ে সন্দেশ বানাতে তো আর বাধা নেই। টেরি কাটা [চুল বিন্যাস করা]: সারাদিন ছেলেটার টেরি কাটা ছাড়া আর কোন কাজই নেই। টেঁক কাটা, গাঁট কাটা [চুরির উদ্দেশ্যে কাটা]: টেঁক-কাটা টেক কাটে, গাঁট-কাটা গাঁট কাটে। তাল কাটা [সমতাচ্যুত হওয়া]: তাল কেটে যাচ্ছে, গানটা আবার ধরো। মেঘ কাটা [আকাশ পরিষ্কার হওয়া]: আকাশের মেঘ কেটে যাচ্ছে। নেশা কাটা [নেশা তিরোহিত হওয়া]: নেশা কাটলে, দেখলো, সে রাস্তার ধারে পড়ে আছে। ভয় কাটা [সাহস হওয়া]: তোমাকে দেখে আমার ভয় কাটলো। মাল কাটা [বিক্রী হওয়া]: বাজার বড় মন্দা, মাল কাটছে না তেমন। সাঁতার কাটা [সাঁতার দেওয়া]: সে রোজ সকালে সাঁতার কাটে।
ওঠা>ওঠা [জাগরিত হওয়া]: ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী, উঠ জগতজনপূজ্যা। দাঁত ওঠা [গজান]: শিশুটির দাঁত উঠেছে। কানে ওঠা [শুনতে পাওয়া]: একবার যখন কথাটা তার কানে উঠেছে, তখন নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। কথা ওঠা [প্রসঙ্গে আসা]: সেদিন মিটিঙে সবার মাইনে বাড়াবার কথা উঠেছিল। বাজারে ওঠা [আমদানি হওয়া]: বাজারে এখন কাঁঠাল উঠেছে। ফসল ওঠা [কাটা শেষ হয়ে যাওয়া]: মাঠের ধান উঠে গেছে, এখন তো কলাই বুনতে পারো। রং ওঠা [মুছে যাওয়া]: কাপড়টার রং উঠে গেছে। জাতে ওঠা [পতিত অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ]: সে এখন জাতে উঠেছে। অন্ন ওঠা [জীবিকা-রহিত হওয়া]: তুমি এখান থেকে আমার অন্ন উঠিয়ে তবে ছাড়লে দেখছি। মন ওঠা [সন্তোষ জন্মানো]: কোন জিনিসেই, তোমার মন ওঠে না। চোখ ওঠা [চক্ষুরোগ-বিশেষ হওয়া]: ‘বোধ হয় রূপসীর চক্ষু উঠিয়াছে। দোকান উঠে যাওয়া [কারবার স্থগিত হওয়া]: চুনীবাবুর দোকান উঠে গেছে। প্রথা উঠে যাওয়া [রহিত হওয়া]: কে বলে, পণপ্রথা এখন উঠে গেছে? ভাড়াটে উঠে যাওয়া [বাড়ি বদল করা]: তারা এখন এখান থেকে বালিগঞ্জে উঠে গেছেন।
তোলা>প্রসঙ্গ তোলা [উত্থাপন করা]: এখন ও প্রসঙ্গ তুলছো কেন? ঘুম থেকে তোলা [জাগান]: ওকে ঘুম থেকে তোলে কার সাধ্য? জাতে তোলা [উন্নত করা]: প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে তাকে জাতে তোলা হল। বাড়ি তোলা [নির্মাণ করা]: বস্তির পাশে সে এখন পাঁচতলা বাড়ি তুলেছে। বাড়ি থেকে ভাড়াটে তোলা [উচ্ছেদ করা]: বাড়ি থেকে ভাড়াটে তোলবার জন্যে তিনি কি কম চেষ্টা করেছেন? দুধ তোলা [বমন করা]: ছেলেটা কাল থেকে দুধ তুলছে। হাই তোলা [ত্যাগ করা]: ‘ডান পা তুলিয়ে তোলে হাই। মাথা তোলা [অবস্থার উন্নতি করা]: আজ দেখি, পরাধীন জাতিগুলি একে একে মাথা তুলছে। হাত তোলা [প্রহার করা]: তুমি ওর গায়ে হাত তুলো না। পিঠের চামড়া তোলা [বেদম প্রহার করা]: সে বলছে, ওখানে গেলে এবার সে তোর পিঠের চামড়া তুলে নেবে। কথা তোলা [প্রসঙ্গে আনা]: ও কথা এখন আর তুলে কি হবে? প্রথা তুলে দেওয়া [রহিত করা]: জমিদারী প্রথা এখন তুলে দেওয়া হয়েছে। পটোল তোলা [মারা যাওয়া]: কৃপণ বুড়োটা কাল রাতে পটোল তুলেছে। মাথায় তোলা [প্রশ্রয় দেওয়া]: তখন বলেছিলাম, ছেলেটাকে এত মাথায় তুলো না। সিকেয় তোলা [স্থগিত রাখা]: এখন তোমার প্রস্তাবটা সিকেয় তোলা থাক। লাইন তোলা [উদ্ধৃত করা]: সে লাইন তুলে দেখিয়েছে, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনার সঙ্গে তার রচনার কতো মিল।
ধরা>বেশ ধরা [পরিধান করা]: তুমি আবার সাধুর বেশ ধরলে কবে থেকে? চোর ধরা [গ্রেপ্তার করা]: পুলিশ চোরটাকে ধরতে পারেনি। গোঁ ধর [জেদ করা]: ছেলে গোঁ ধরেছে, পাস করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। কাউকে ধরা [কোন কাজের জন্য মুরুব্বি ধরা]: রায়মশাইকে ধরো, তাহলে দেখো, কাজটা ঠিক হয়ে যাবে। রোগে ধরা [আক্রমণ করা]: ‘বিনুর বয়স বাইশ যখন রোগে ধরলো তারে।’ দোর ধরা [হত্যা দেওয়া]: তারকেশ্বরের দোর ধরে তাকে পেয়েছিলাম কোলে। ঠাণ্ডায় গলা ধরা [শব্দহীন হওয়া]: ঠাণ্ডায় তার গলা ধরে গেছে। লোনা ধরা [ছাপ লাগা]: ঘরের দেওয়ালে লোনা ধরতে শুরু করেছে। মাথা ধরা [যন্ত্রণা হওয়া]: রোজ সকালে তার মাথা ধরে। পা ধরে যাওয়া [অবশ হয়ে আসা]: রেশনের ‘কিউ’তে দাড়িয়ে দাড়িয়ে পা ধরে গেছে। ওষুধ ধরা [কার্যকর হওয়া]: কাল ধমক দিয়েছিলাম, আজ দেখছি, ওষুধ ধরেছে। বৃষ্টি ধরা [বন্ধ হওয়া]: বৃষ্টি একটু ধরলেই আমরা বেরিয়ে পড়বো। রূপ ধরা [সাজে সজ্জিত হওয়া]: ‘স্নেহময়ীর রূপ ধরে মা দাঁড়িয়ে আছে। মাঠের পরে। খুঁত ধরা [দোষ খুঁজে বের করা]: তুমি শুধু দিনরাত আমার কাজের খুঁত ধরতেই আছে। তরকারি ধরে যাওয়া [পুড়ে ওঠা]: আলুর দমটা একটু ধরে গেছে। উনান ধরা [জ্বলে ওঠা]: এখনও উনন ধরেনি, রান্না হবে কখন? বুড়ী ধরা [ছোঁয়া]: আমি আগে বুড়ী ধরেছি। মন ধরা [মনোমত হওয়া]: তোমার কথাটা তার খুব মনে ধরেছে। ভূতে ধরা [আচ্ছন্ন হওয়া]: তাকে ভূতে ধরেছে। প্রাণ ধরা [কোনোমতে বেঁচে থাকা]: বাছা, তোর জন্যেই আমি এতদিন প্রাণ ধরে আছি। মানুষের মধ্যে ধরা [গণ্য করা]: আমি তাকে মানুষের মধ্যে ধরি না। ট্রেন ধরা [যথাসময়ে আরোহণ করা]: তাড়াতাড়ি চলো, নইলে ট্রেন ধরতে পারবে না। চুলে পাক ধরা [প্রকাশ পাওয়া]: তার চুলে পাক ধরেছে। আফিম ধরা [কু-অভ্যাস করা]: সে ইদানীং আফিম ধরেছে। পোঁ ধরা [একান্ত অনুগত হওয়া]: সে তো বড়বাবুর পোঁ ধরে আছে। ম্যাও ধরা [দায়িত্ব নেওয়া]: গ্রামে দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ কাজে ম্যাও ধরবে কে? হাত-পায়ে ধরা [অত্যন্ত দীনভাবে অনুরোধ করা]: তাকে হাতে-পায়ে ধরে বললুম, কিন্তু মনিবের দয়া হল না। ট্রেন স্টেশন ধরা [থামা]: এই ট্রেনটা কোন্ কোন্ স্টেশন ধরে, বলতে পারেন? গান ধরা [আরম্ভ করা]: ‘গান ধরেছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা। আগুন ধরা [জ্বলতে থাকা]: একটা বাড়িতে আগুন ধরলে সব কটা বাড়িতেই আগুন ধরে যাবে। চাঁদ ধরা [নাগাল পাওয়া]: বামন হয়ে চাঁদ ধরতে চেয়ো না।
লাগা>আগুন লাগা [জ্বলে ওঠা]: ‘ওরে তুই ওঠ, আজি আগুন লেগেছে কোথা! মনে লাগা [ব্যথিত হওয়া]: কথাটা আমার মনে লেগেছে। চোট লাগা [আঘাত পাওয়া]: তার হাতে চোট লেগেছে। টাকা লাগা [ব্যয়িত হওয়া]: ‘লাগে লাখ টাকা দেবে গেীরী সেন।’ ভালো লাগা [পছন্দ হওয়া]: এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়। সময় লাগা [সময় ব্যয়িত হওয়া]: ওখানে পৌঁছুতে কত সময় লাগবে? কাজে লাগা [নিযুক্ত হওয়া]: মাসের পয়লা থেকেই সে কাজে লেগে গেছে। উঠে পড়ে লাগা, আদাজল খেয়ে লাগা [উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে প্রাণপণে পরিশ্রম করা]: যদি পাশ করতে চাও, তবে এখন থেকেই উঠে পড়ে [আদাজল খেয়ে] লাগো। যুদ্ধ লাগা [আরম্ভ হওয়া]: আবার যদি যুদ্ধ লাগে, তবে কেউ বাঁচবে না। বাতাস লাগা [ফাঁকি দেওয়া]: গায়ে বাতাস লাগিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়ালে চলবে? নৌকা লাগা [ভিড়া]: তীরে এসে নৌকা লাগলো। গ্রহণ লাগা [ঘটা]: কাল গ্রহণ লাগছে কখন? পিছনে লাগা [শত্রুতা করা]: তুমি আমার পিছনে লেগেছো কেন?
বাগ্ধারা
প্রত্যেক ভাষায় কতকগুলি চিরকালাগত বিশেষ বাক্-ভঙ্গিমা আছে। সেগুলি ভাষার বহুমূল্য পরম ঐশ্বর্য। সেগুলি দিয়ে মনের ভাব অলংকৃত হয়ে সুষ্ঠভাবে প্রকাশিত হয়। অথচ সেগুলি কার বা কাদের সৃষ্ট, জানা যায় না। বাগ্বিদগ্ধ বা বাগ্বিভূতি-সম্পন্ন কোন ব্যক্তি বা কোন প্রতিভার গভীর তাৎপর্যমণ্ডিত কোন উক্তি বা কোন কবির কবিতাংশ অত্যন্ত জনপ্রিয়তার কারণে লোকমুখে বহুকাল প্রচলিত থেকে প্রবাদ-প্রবচন বা বাগধারার রূপ পরিগ্রহ করে তখন তা জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়। এইভাবে সেগুলি যুগ যুগ ধরে বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে আসছে। আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ না করে তাদের মর্মনিহিত গূঢ়ার্থ গৃহীত হয়। বক্তা ও শ্রোতা সেই অর্থকেই অন্তরে গ্রহণ করে তাদের সার্থকতা দান করেন। এই বাগধারাগুলি ভাষার প্রাণ।
১. অহিনকুল সম্পর্ক [ নিদারুণ চিরশত্রুতা]: যদুর সঙ্গে মধুর তো অহিনকুল সম্পর্ক; দেখা হলেই কথা কাটাকাটি এবং হাতাহাতি।
২. অষ্টরম্ভা [কিছুই না, ফাঁকি]: সবাই সব লুটেপুটে নিয়ে গেল; আমি পেলাম অষ্টরম্ভা।
৩. আক্কেল সেলামী [বোকামির দণ্ড]: বাদলের কথা বিশ্বাস করে আমাকে আমার অমন দামী ঘড়িটা আক্কেল সেলামী দিতে হলো।
৪. আকাশ থেকে পড়া [ না-জানার ভান করে বা যথার্থ অজ্ঞতার কারণে বিস্ময় প্রকাশ করা]: আমার কথা শুনে, মনে হল, উনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
৫. আঠারো মাসে বছর [দীর্ঘসূত্রিতা]: তোমার তো আঠারো মাসে বছর; দেখা যাক্, কতদিনে কাজটা শেষ হয়।
৬. আষাঢ়ে গল্প [অবাস্তব কাহিনী]: রাখো তোমার আষাঢ়ে গল্প; গোরু কখনও গাছে চড়ে?
৭. আঁতে ঘা [মর্মান্তিক শ্লেষ করা]: ভাগনে হয়ে ও আমার আঁতে ঘা দিয়ে কথাটা বলেছে; জীবনে আমি ওর মুখদর্শন করছি না।
৮. ইঁচড়ে পাকা [বয়সে বালক, বচনে বৃদ্ধ]: ছেলেটি একেবারে ইঁচড়ে পাকা; এই বয়সে ওর যত পাকা-পাকা কথা।
৯. উত্তমমধ্যম [প্রহার]: দুমুখ লোকটাকে সবাই মিলে উত্তম-মধ্যম দিয়ে পাড়া থেকে দিল তাড়িয়ে।
১০. উভয় সঙ্কট [দুটি সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে পড়া]: এখন আমার উভয়-সঙ্কট; একদিকে মামা, অন্যদিকে পিসেমশাই কাকে ছেড়ে কাকে রাখি?
১১. একাই একশ [বহুকর্মা]: লালটু একাই একশ, ওর সঙ্গে কাউকে দরকার নেই। ও একাই কাজটা করে ফেলবে, দেখো।
১২. ওজন বুঝে চলা [নিজের ক্ষমতা বুঝে কাজ করা]: ওজন বুঝে চলতে শেখো; কারো সঙ্গে টেক্কা দিতে গিয়ে বাজে খরচে জড়িয়ে পড়ো না।
১৩. মামাবাড়ির আবদার [অযৌক্তিক দাবি]: স্কুলে একটা লাইব্রেরি নেই, অথচ চাই খেলার মাঠ, মামাবাড়ির আবদার আর কী!
১৪ কড়ায়-গণ্ডায় [অতি সূক্ষ্ম হিসাবে]: এখন ইচ্ছেমতো প্রকৃতিকে ধ্বংস করা হচ্ছে; কিন্তু এমন একদিন আসবে, যেদিন মানুষকে কড়ায়-গণ্ডায় মাশুল দিতে হবে প্রকৃতির এই নির্বিচার ক্ষয়ক্ষতির জন্যে।
১৫. কেউকেটা [গণ্যমান্য লোক]: আজ রাস্তাঘাট সাজিয়ে তোরণ তৈরি করা হয়েছে; নিশ্চয়ই কেউকেটা আসছেন।
১৬. কেঁচে গণ্ডুষ [নতুন করে আরম্ভ করা]: কবে অঙ্ক শিখেছিলাম, সব ভুলে বসে আছি; এখন ভাইকে বোঝাতে গিয়ে কেঁচে গণ্ডুষ করতে হচ্ছে।
১৭. গদাইলঙ্করী চাল [অত্যন্ত মন্থর গতি]: ডিপার্টমেন্টের যেমন গদাইলস্করী চাল, তাতে কবে যে কাজটা হবে, বলা মুশকিল।
১৮. ঘোড়ার ডিম [অলীক বস্তু]: অনেক তো পরিশ্রম করা হল; শেষে হল ঘোড়ার ডিম।
১৯. চাঁদের হাট [আনন্দের মেলা]: ছেলেমেয়ে নাতিনাতনী নিয়ে ভদ্রলোক এখন একেবারে চাঁদের হাট বসিয়ে দিয়েছেন।
২০. চোখে চোখে রাখা [নজর রাখা]: লোকটার রকমসকম ভালো নয়; সবাই ওকে একটু চোখে চোখে রেখো।
২১. চুনোপুটি [সামান্য লোক]: আমরা তো সব চুনোপুঁটির দল; রুই-কাতলাদের ছেড়ে আমাদের ধরে কী হবে!
২২. ছেলের হাতের মোয়া [সহজে কেড়ে নেবার জিনিস]: পাকিস্তান যতই কারসাজি করুক; কাশ্মীর ছেলের হাতের মোয়া নয়— কিছুতেই ওরা ভারতের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
২৩. জগাখিচুড়ি [নানা প্রকার বস্তুর সংমিশ্রণ]: উত্তরটা সে না-বুঝে লিখেছে; তাই নানা কথা লিখে একেবারে জগা-খিচুড়ি করে ফেলেছে।
২৪. জলের আল্পনা [ক্ষণস্থায়ী]: জলের আল্পনা জলেই যাবে হারিয়ে।
২৫. টইটম্বুর [কানায় কানায় ভরা]: বর্ষায় অবিরাম বর্ষণে খালবিল-নদী-নালা হয়ে গেছে একেবারে টইটম্বুর।
২৬. টনক নড়া [চৈতন্য হওয়া]: চিনির কিলো কুড়ি টাকা হলেও যদি সরকারের টনক না নড়ে, তাহলে কী করা যাবে!
২৭. ঠুটো জগন্নাথ [অক্ষম]: ঠুটো জগন্নাথের মতো বসে না থেকে যা করবার, এই বেলা করে ফেল।
২৮. ঠোঁটকাটা [স্পষ্ট বক্তা]: লোকটা মুখে যা আসে বলে যায়; এমন ঠোট-কাটা মানুষ, আর দেখিনি।
২৯. ডুমুরের ফুল [অদৃশ্য]: তুমি যে আজকাল ডুমুরের ফুল হয়ে গেছ হে; দেখা পাওয়াই ভার।
৩০. ঢাকের বাঁয়া [সঙ্গে থাকে, কিন্তু কাজে লাগে না, এমন বস্তু বা ব্যক্তি]: কিছু করো না, অথচ রায়বাবুর ঢাকের বাঁয়া হয়ে সঙ্গে ঘুরে বেড়াও; কী ব্যাপার বলো তো?
৩১. তাসের ঘর [ভঙ্গুর]: ক্ষ্যাপা নদীর ধারে আমাদের বাড়িটা তো একটা তাসের ঘর; যে-কোনো বর্ষায় ভেঙে চলে যাবে নদীর গর্ভে।
৩২. তীর্থের কাক [কোন কিছুর প্রত্যাশী]: বৃদ্ধা তার ছেলের পাঠানো টাকার প্রত্যাশায় সারা মাস তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন।
৩৩. দুমুখো সাপ [যার কাছে যেমন তার কাছে তেমন]: লোকটা একটা দু’মুখো সাপ; তোমার কাছে এক রকম বলে, অন্যের কাছে বলে আর-এক রকম।
৩৬. দু’নৌকায় পা [উভয় দিক বজায় রাখার চেষ্টা]: আমার এখন দু’ নৌকায় পা; একদিকে মেসো, অন্যদিকে জামাইবাবু; কাকে ছাড়ি, কাকে রাখি?
৩৫. চক্ষুশূল [যার দর্শন বিরক্তিকর]: আমি তোমার চক্ষুশূল, সামনে এলেই মুখ বেঁকাও।
৩৬. পাকা ধানে মই [সফলপ্রায় কাজ পণ্ড হওয়া]: তুমি আমার সঙ্গে শত্রুতা করছো কেন? আমি কি তোমার পাকা ধানে মই দিয়েছি?
৩৭. চোখে সর্ষে ফুল দেখা [বিপদে পড়ে দিশাহারা হওয়া]: সারা বছর ফাঁকি দিয়ে রতন পরীক্ষার আগে চোখে সর্ষে ফুল দেখছে।
৩৮. বালির বাঁধ [যা নির্ভরযোগ্য নয়]: বড়’র পিরিতি বালির বাঁধ।
৩৯. বুকের পাটা [দুঃসাহস]: এই রাত্তিরে সবার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে এসেছে; বলতে হবে, ছেলেটার বুকের পাটা আছে।
৪০. মান্ধাতার আমল [অতি প্রাচীন কাল]: মান্ধাতার আমল থেকে ডাইনি-হত্যার মতো নানা নিষ্ঠুর কুপ্রথা আমাদের দেশে চলে আসছে।
৪১. বাপের বেটা [বাবার উপযুক্ত পুত্র]: দাও দেখি দীন-দুঃখীদের তোমার ধানের গোলা বিলিয়ে; বুঝবো, তুমি কেমন বাপের বেটা।
৪২. গোড়ায় গলদ [আরম্ভেই ত্রুটি]: দেশের উন্নতি হবে কী করে? গোড়ায় গলদ থেকে গেছে। ভারতের ভূমি-ব্যবস্থায় আজও হাত দেওয়া হয়নি।
৪৩. মাটির মানুষ [অত্যন্ত সহনশীল ও শান্তপ্রকৃতির মানুষ]: মা-টি তো মাটির মানুষ; ওঁর প্রশ্রয়ে ছেলেটি মানুষ হল না।
৪৪. মিছরির ছুরি [মুখে মধু, অন্তরে বিষ]: ওর মধুর কথায় বিশ্বাস করো না; ও একটি মিছরির ছুরি— মুখে মধু কিন্তু অন্তরে বিষ।
৪৫. রাঘব বোয়াল [অত্যন্ত ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি]: যত রাঘব বোয়াল সব গেল পালিয়ে, ধরা পড়লো কিনা যত চুনোপুঁটির।
৪৬. মুখের কথা [আন্তরিকতাহীন কথা]: তুমি অর্থকষ্টে পড়লে বলেছিলুম সাহায্য করবো; কিন্তু ও তো মুখের কথা বলতে হয়, তাই বলেছি।
৪৭. রফা নিষ্পত্তি [মিটমাট]: শেষ পর্যন্ত পাত্রপক্ষ এবং কন্যাপক্ষ—উভয় পক্ষের মধ্যে দেনাপাওনা নিয়ে একটা রফা নিষ্পত্তি হয়ে গেল।
৪৮. নয়নের মণি [অতি প্রিয় জন]: একমাত্র ছেলেটি বিধবা জননীর যেন নয়নের মণি; এক মুহূর্তও কাছছাড়া করেন না।
৪৯. হযবরল [বিশৃঙ্খল অবস্থা]: যত্নের অভাবে ঘরের যত আসবাবপত্রসব হ-য-ব-র-ল হয়ে পড়ে আছে।
৫০. হাতের পাঁচ [বিনা আয়াসে যা পাওয়া যায়]: পারিবারিক ব্যবসা তো হাতের পাঁচ; আগে দেখি চেষ্টা করে, চাকরি-বাকরি কিছু একটা হয় কী না।
Leave a Reply