শাক্ত পদাবলির উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।
শাক্ত পদাবলী
উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হল পদাবলি সাহিত্য। গীতিকবিতাধর্মী এই পদাবলি সাহিত্য মূলত দুই ভাগে বিভক্ত— বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্ত পদাবলি। আঙ্গিকগত মিল থাকলেও বিষয়গত দিক থেকে উভয় পদাবলির বেশ কিছু পার্থক্য আছে। বৈষ্ণপ পদাবলি ভাববৃন্দাবনে অনুষ্ঠিত অপ্রাকৃত রাধা-কৃষ্ণের সূক্ষ্ম রসোত্তীর্ণ প্রেমগীতিকা। অন্যদিকে শাক্ত পদাবলি বাংলাদেশের মায়ের বেদনার গান। বৈষ্ণপ পদাবলির মূল রস আদি রস যে শেষপর্যন্ত ভক্তিতে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে শাক্ত পদাবলির মূল রস বাৎসল্য রস। তাও শেষপর্যন্ত ভক্তিতে পরিণত হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শাক্ত পদাবলির সমৃদ্ধি সূচিত হলেও, দীর্ঘকাল পূর্বে এর সূচনা হয়েছিল।
শাক্ত পদাবলির মূল উৎস নিহিত তন্ত্রশাস্ত্রের মধ্যে। তাই তন্ত্রকে শক্তিপূজার বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে। শক্তি বিষয়ক তন্ত্রগুলির মধ্যে অন্যতম হল—কালীতন্ত্র, তারাতন্ত্র, মহানির্বাণতন্ত্র, কুলার্ণবতন্ত্র প্রভৃতি। শাক্ত পদাবলি শক্তিতত্ত্বের সাহিত্যরূপ বলে এখানে অনেক তান্ত্রিক বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান প্রবেশ করেছে। তন্ত্রে বর্ণিত ‘দশমহাবিদ্যা’ এবং ‘ভুবনেশ্বরী’র রূপ বর্ণনা শাক্ত কবিরা অনুবাদ করেছেন। তন্ত্রের শক্তিপূজা পদ্ধতি, মানসপূজা, উপাস্য-উপাসনাতত্ত্বের অনেককিছু শাক্ত পদাবলিতে লক্ষ করা যায়। তবেই তন্ত্রশাস্ত্রকেই শাক্ত পদাবলির একমাত্র উৎস বলা চলে না। শাক্ত পদাবলির উৎসসূত্রে বেদ, সহজিয়াদর্শন, চর্যাপদাবলি ও বিভিন্ন পুরাণাদির প্রভাব বিদ্যমান। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যেও শাক্ত পদাবলির উৎস বিরাজমান। এছাড়া সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় রচিত প্রকীর্ণ কবিতাবলিতেও শাক্ত পদাবলির উৎস নিহিত আছে। সদুক্তিকর্ণামৃত-য় কালীবিষয়ক কয়েকটি শ্লোক আছে। মহাভারতে উমা-মহেশ্বর সংক্রান্ত নানা তথ্য পাওয়া যায়। মহাভারতের বিরাট ও ভীষ্মপর্বে দুর্গাস্তবে দেবীকে কালী, কপালী, করালী, ভদ্রকালী, মহাকালী, চণ্ডী, তারিণী ইত্যাদি বলা হয়েছে। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডেও শিব-শক্তির উল্লেখ আছে। বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে ঋগ্বেদ-এর দেবীসূক্ত, রাত্রিসূক্ত এবং সামবেদ-এর রাত্রিসূক্তে শক্তিবাদের সন্ধান পাওয়া যায়। বেদান্তের ‘মায়া, সাংখ্যদর্শনের ‘প্রধান’ প্রভৃতিকেও শাক্ত পদাবলীর উৎস হিসাবে গণ্য করা হয়। পুরাণের মধ্যে দেবীভাগবত, কালিকাপুরাণ, মার্কণ্ডেয়পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণগুলিতে দেবী সম্পর্কে যে-সমস্ত তথ্য আছে সেগুলি শাক্ত পদাবলির কায়া নির্মাণে সাহায্য করেছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই শক্তি সাধনাকে কেন্দ্র করে যে-সমস্ত পদ রচিত হয়েছিল সেগুলিকেই শাক্ত পদাবলি বলা হয়। শক্তি অর্থাৎ উমা-পার্বতী-দুর্গা-কালিকাকে কেন্দ্র করে যে-সমস্ত গান রচিত হয়, তাকে বলা হয় শাক্তগান। শাক্ত পদাবলিতে দেবী মূলত দুটি ধারায় অর্চিতা। একদিকে তিনি উমা, অন্যদিকে তিনি শ্যামা। তাই শাক্ত পদাবলির দুটি ধারা— উমাসঙ্গীত এবং শ্যামাসঙ্গীত। এই দুটি ধারায় জগজ্জননীকে দুইভাবে উপাসনা করার কথা বলা হয়েছে—কন্যারূপে, ও মাতৃরূপে। উমাকে কেন্দ্র করে আগমনী ও বিজয়ার অংশ এবং শ্যামাকে কেন্দ্র করে ভক্তের আকুতি অংশ রচিত। এই উমা-পার্বতী, সতী, দুর্গা, চণ্ডিকা ইত্যাদি নানা নামে অভিহিতা। পার্বতী, উমা, সতী, দুর্গা, চণ্ডিকার মিলিত ধারা শেষপর্যন্ত মহাদেবীতে পরিণত হয়। এরসঙ্গে আবার একটি ধারা মিলিত হয়েছে কালিকা বা কালীর ধারায়। বাংলাদেশের শক্তি সাধনার ক্ষেত্রে এই কালী বা কালিকাই প্রধান বা সর্বেশ্বরী।
শাক্ত পদাবলিকে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়— বাল্যলীলা, আগমনী, বিজয়া, জগজ্জননীর রূপ, মা কি ও কেমন, ভক্তের আকুতি, মনোদীক্ষা, ইচ্ছাময়ী মা, করুণাময়ী মা, কালভয়হারিণী মা, লীলাময়ী মা, ব্রহ্মময়ী মা, মাতৃপূজা, সাধনশক্তি, নামমহিমা, চরণ-তীর্থ ইত্যাদি। শাক্ত সংগীতকে তিনভাগে ভাগ করা যায়— লীলাসংগীত, ভক্তিসংগীত ও তত্ত্বসংগীত। বিষয়ের দিক থেকেও শাক্ত পদাবলিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়— লীলাপর্ব, উপাস্য তত্ত্ব ও উপাসনা তত্ত্ব।
Leave a Reply