//
//

শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা সম্পর্কে আলোচনা কর।

শাহ মুহম্মদ সগীর: ইউসুফ জোলেখা

বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলমান কবি হিসেবে শাহ মুহম্মদ সগীর বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। তিনি গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৯৩ ১৪১৯ সাল) ইউসুফ-জোলেখা কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি পনের শতকের প্রথম দশকে রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। কবি কীবে রাজবন্দনা অংশে লিখেছেন—

মনুষ্যের মৈদ্ধে জেহ্ন ধর্ম অবতার। 

মহা নরপতি গোছ পিরথিম্বীর সার।।

মহানরপতি গ্যেছ বলে যাকে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ বলে মনে করা হয়ে থাকে। কবি রাজবন্দনা করলেও কাব্যে কবির ব্যক্তিগত কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। মধ্য যুগের কাব্যে কবিগণের যে আত্মবিবরণী দেখা যায় তাঁর কাব্যে তা অনুপস্থিত। কবির শাহ উপাধি থেকে অনুমান করা যায় যে, তিনি কোন দরবেশ বংশে জনুগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর কাব্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কতিপয় শব্দের ব্যবহার লক্ষ করে ড. মুহম্মদ এনামুল হক তাকে চট্টগ্রামের অধিবাসী বিবেচনা করেছেন। রাজবন্দনার ‘মোহাম্মদ ছগীর তান আজ্ঞাক অধীন’—এই কথা থেকে ধারণা করা হয় যে তিনি সম্ভবত সুলতানের কর্মচারী ছিলেন।

শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ-জোলেখা কাব্যে সুপ্রাচীন প্রণয়কাহিনি উপজীব্য করা হয়েছে। বাইবেল ও কুরআন শরীফে নৈতিক-উপাখ্যান হিসেবে সংক্ষেপে এই কাহিনি বর্ণিত রয়েছে। ইরানের মহাকবি ফেরদৌসী (মৃত্যু ১০২৫ সাল) এবং সুফিকবি জামী (মৃত্যু ১৪৯২ সাল) মূল কাহিনি পল্লবিত করে ইউসুফ-জোলেখা নামে কাব্য রচনা করেছিলেন। ফেরদৌসীর কাব্য ছিল রোমান্স জাতীয়, আর জুমীর কাব্য ছিল রূপক শ্রেণির। অনুবাদগত ও বিষয়বস্তুর পরিবেশনার দিক থেকে শাহ মুহম্মদ সগীরের কাব্যের সঙ্গে তাঁদের কাব্যের তেমন কোন মিল নেই। জামী শাহ মুহম্মদ সগীরের পরবর্তী কবি বলে তাকে অনুসরণের কোন প্রশ্ন ওঠে না। বরং ফেরদৌসীর কাব্যের রোমান্টিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে শাহ মুহম্মদ সগীরের কাব্যের যথেষ্ঠ সামঞ্জস্য বিদ্যমান। তাই ড. মুহম্মদ এনামুল হক অনুমান করেন—‘‘কুরআন ও ফেরদৌসীর কাব্য ব্যতীত মুসলিম কিংবদন্তিতে ও স্বীয়-প্রতিভায় নির্ভর করিয়াই শাহ মুহম্মদ সগীর তাহার ইউসুফ-জোলেখা কাব্য রচনা করিয়াছিলেন।’’ ড. ওয়াকিল আহমদ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন—‘‘মুহম্মদ সগীর কুরআনকে ভিত্তি করে ইসলামি শাস্ত্র, ইরানের আধ্যাত্মিক কাবা ও ভারতের লোককাহিনির মিশ্রণে ইউসুফ-জোলেখা কাব্যের পূর্ণাঙ্গ কাহিনি নির্মাণ করেন।’’

‘ইউসুফ-জোলেখা’ কাব্যের বিষয়বস্তু ইউসুফ ও জোলেখার প্রণয়কাহিনি। কাব্যের আরম্ভে আল্লাহ ও রাসুলের বন্দনা, মাতাপিতা ও গুরুজনের প্রশংসা এবং রাজবন্দনা স্থান পেয়েছে। তৈমুস বাদশাহের কন্যা জোলেখা আজিজ মিশরের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও ক্রীতদাস ইউসুফের প্রতি গভীরভাবে প্রেমাসক্ত হন। নানাভাবে আকৃষ্ট করেও তিনি ইউসুফকে বশীভূত করতে পারেননি। বহু ঘটনার মধ্যে দিয়ে ইউসুফ মিশরের অধিপতি হন। ঘটনাক্রমে জোলেখা তখনও তার আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করেননি এবং পরে ইউসুফের মনেরও পরিবর্তন ঘটে। ফলে তাদের মিলন হয়। কাব্যে এই প্রধান কাহিনির সঙ্গে আরও অসংখ্য উপকাহিনি স্থান পেয়েছে।

শাহ মুহম্মদ সগীর ‘ইউসুফ-জোলেখা’ কাব্যে দেশি ভাষায় ধর্মীয় উপাখ্যান বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন। কবি স্বীয় উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখেছেন—

বচন রতন মণি যতনে পুরিয়া।

প্রেমরসে ধর্মবাণী কহিমু ভরিয়া॥

ভাবক ভাবিনী হৈল ইছুফ জলিখা।

ধর্ম ভাবে করে প্রেম কিতাবেতে লেখা॥

কবি প্রেমরস অবলম্বনে ধর্মবাণী প্রচার করতে চাইলেও তা কাব্যে মানবীয় প্রেমকাহিনি হিসেবেই রূপলাভ করেছে। ইরানের সুফী কবিরা ইউসুফ জোলেখার প্রেমকাহিনিতে যে রূপক উপলব্ধি করেছিলেন শাহ মুহম্মদ সগীর তাকেই কাব্যের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর মতে ইউসুফ-জোলেখা ভাবুক-ভাবিনী অর্থাৎ আত্মা ও পরমাত্মা । প্রেমের মাধ্যমে উভয়ের মিলন সম্ভব। ইউসুফ ‘মাশুক তথা পরমাত্মা’, জোলেখা ‘আশিক তথা জীবাত্মা’। ইউসুফের রূপের প্রতি জোলেখার আকাঙ্ক্ষা আশিক-মাশুকের মিলন কামনারই নামান্তর। কাব্যে দেখানো হয়েছে রূপজমোহ পার্থিব ভোগতৃষ্ণার বিষয়। ইন্দ্রিয় সম্ভোগবাসনার দ্বারা অতীন্দ্রিয় পরমাত্মাকে পাওয়া যায় না, অন্তরের প্রেম দ্বারাই তাকে পাওয়া সম্ভব। বিচ্ছেদের মধ্যে ত্যাগ-তিতিক্ষার দ্বারা জোলেখা যেদিন সেই প্রেম সাধনায় জয়ী হয়েছেন, সেদিন পরমাত্মা নিজেই এসে ধরা দিয়েছেন। উভয়ের মিলন হয়েছে। তবে কবি যেভাবে বক্তব্য পরিবেশন করেছেন তাতে মানবিক প্রণয়োপাখ্যান হিসেবেই কাব্যটি গ্রহণযোগ্য। জোলেখার মনে প্রেমের প্রভাবে যে চৈতন্য জাগে তাতে আবাল্যের আরাধ্য দেবীমূর্তি ভেঙে ফেলে প্রেমাস্পদের ধর্মে তার দীক্ষা লাভ ঘটে। জোলেখার এ মনোভাব ব্যক্ত করে কবি লিখেছেন—

পাষাণ ভাঙ্গিয়া আজি করিমু চৌখণ্ড। 

ব্যর্থ সেবা কৈলু তোক জানিলুঁ তু ভণ্ড॥

প্রতিমাক পাছাড়িয়া কৈল খণ্ড খণ্ড।

ভূমিতলে খেপি তাকে কৈল লগু ভণ্ড॥

কান্দিয়া পশ্চিম দিকে করিলেন্ত মুখ। 

পরম ঈশ্বর সেবা করেন্ত মনসুখ॥

ইউসুফ-জোলেখা কাব্যের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ড. ওয়াকিল আহমদ মন্তব্য করেছেন— ‘‘অবলীলাক্রমে গল্প লিখতে পেরেছেন—এটাই সগীরের কৃতিত্ব। গল্পের ঘনঘটায় চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করা রোমান্টিক কবিদের লক্ষ্য ছিল। দর্শনচিন্তা, তত্ত্বচিন্তা অথবা চরিত্রচিত্রণের প্রতি তারা জোর নজর দেননি। সরস গল্প সৃষ্টি করে নিছক আনন্দের ভোজে পাঠকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সগীরের কলাম সে পথ বেছে নিয়েছে। গল্পরচনা কবির লক্ষ্য বলে ঘটনার গ্রহণ বর্জনের কোন হিসেব করেননি।’’ 

ইউসুফ জোলেখা কাব্যের রূপায়ণে কবি শাহ মুহম্মদ সগীর ফারসি উৎসের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য দেখাননি বলে কাব্যে কবিপ্রতিভার মৌলিকতার নিদর্শন বিদ্যমান। ফেরদৌসীর কাব্যের ঘটনার সঙ্গে সগীরের অনৈক্য অনেক স্থানেই লক্ষ করা যায়। বিশেষত ইবিন আমি ও বিধুপ্রভার প্রণয় ও পরিণয় কাহিনি শাহ মুহম্মদ সগীরের নিজস্ব। শাহ মুহম্মদ সগীর রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করতে গিয়ে কিছু অলৌকিক উপাদান সংযোজন করেছেন। কাব্যে আছে অনেক স্বপ্নের কথা, আকাশবাণী, শিশু ও পশুর মুখে কথা বলানো ইত্যাদি অপ্রাকৃত ঘটনা, কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি কবির নিজের রোমান্সসুলভ খেয়ালী কল্পনার বহিঃপ্রকাশ বলে বিবেচনা করা যায়।

শাহ মুহম্মদ সগীরের কাব্যে প্রেমরসে ধর্মবাণীর পরিবর্তে প্রেমরসে মানববাণী প্রচার মুখ্য হয়ে উঠেছে। রোমান্টিক কাব্যে প্রেম প্রতিপাদ্য বিষয় বলে উপাখ্যানটির ধর্মীয় পটভূমি থাকলেও তা হয়ে উঠেছে মানবিক প্রেমোপাখ্যান। এই কাব্যে রূপজ ও মোহজ প্রেমের বৈশিষ্ট্য রূপায়িত হয়ে উঠেছে। ইউসুফ টাইপ ধরনের চরিত্র। তাকে নীতিধর্মের শুষ্ক কুশপুত্তলিকাবৎ মনে হয়। সংযমশীলতা ও নীতিবাক্যের আদর্শবাদী ইউসুফ যেন রক্তমাংসের মানবসত্তার অধিকারী নন। জোলেখা এর বিপরীত। সজীবতায় ও বাস্তবতায় সে উজ্জ্বল। জোলেখা মানবিক কামনাবাসনায় বাঙ্ময় মূর্তি। তার রূপের নেশা ও ভোগের আকাঙ্ক্ষা এক চিরঞ্জীব শাশ্বত প্রেমে উত্তীর্ণ হয়েছে।

শাহ মুহম্মদ সগীর ব্যতীত ইউসুফ জোলেখা কাব্যের অন্যান্য রচয়িতা হচ্ছেন আবদুল হাকিম, গরীবুল্লাহ, গোলাম সফাতউল্লাহ, সাদেক আলী ও ফকির মুহম্মদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!