বাংলা থিয়েটারে শিশিরকুমার ভাদুড়ির অবদান আলোচনা কর।

শিশিরকুমার ভাদুড়ি ও বাংলা থিয়েটার

(১৯২১-১৯৫৯)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে শিশিরকুমার ভাদুড়ির (২ অক্টোবর, ১৮৮৯-৩০ জুন, ১৯৫৯) আবির্ভাব। কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে পুরোপুরি নট ও নির্দেশকের জীবন গ্রহণ করলেন তিনি। এতদিন রঙ্গমঞ্চে নটজীবন নিন্দিত ও সমাজে অপাংক্তেয় ছিল। অধ্যাপনার সম্মানের নিশ্চিন্ত জীবন ত্যাগ করে তিনি নিন্দিত রঙ্গমঞ্চকে নতুন সম্মানের জীবন দান করতে এগিয়ে এলেন। বাংলা রঙ্গমঞ্চ সত্যিকারের প্রাণস্পন্দিত হলো। অভিনয়ের নতুন রীতিতে, মঞ্চোপস্থাপনার নবতর আঙ্গিকে, নাট্যনির্দেশনার সুরুচি-সম্মত শিল্পবোধে-সর্বোপরি নাটকের নতুন ভাবনায় তিনি বাংলা রঙ্গমঞ্চে নাটকাভিনয়ের নতুন প্রাণদান করলেন। রুচি, শিল্পবোধ, নাট্যজ্ঞান ও ব্যক্তিত্বে তিনি যে আকর্ষণীয় নবত্ব সৃষ্টি করলেন তাতে সে যুগের শিক্ষিত শ্রেষ্ঠ, সুরুচিসম্পন্ন ও পরিশীলিত, বিদগ্ধ নাট্যরসিকেরা তার ন্যটাশালায় হাজির হলেন।

তাঁর আবির্ভাবকালে গতানুগতিক থিয়েটার নিম্নমানের এবং জীবনবিমুখ হয়ে পড়েছিল। ১৯ শতকের ধারা বেয়ে বিশ শতকের দুটো দশক অবধি সেই বাংলা নাট্যাভিনয়ের ধারা একই খাতে প্রবাহিত হচ্ছিল। ১৯ শতকের নাট্যজগতের প্রথম সারির ব্যক্তিত্ব যাঁরা ছিলেন তাঁদের অনেকেই এই সময়ের মধ্যে মারা গেছেন। অর্ধেন্দুশেখর (১৯০৮), গিরিশ (১৯১২), নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল (১৯১৩), অমরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৯১৬) একে একে চলে গেলেন এই সময়েই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু (১৯১৪-১৮) হয়ে গেল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে বাংলা থিয়েটারের দৈন্য আরো প্রকট হয়ে পড়ল। ক্ষীরোদপ্রসাদ ছাড়া আর জীবিত নাট্যকার নেই। সেরা অভিনেতা ও নির্দেশকেরা চলে গেছেন। একমাত্র গিরিশ-পুত্র সুরেন্দ্রনাথ (দানীবাবু অভিনয় করছেন, অমৃতলাল বৃদ্ধ হয়েছে (মৃত্যু: ১৯২৯)। অভিনেত্রী সুশীলাবালা পুরনো রীতির অভিনয় চালাচ্ছেন। ১৯ শতকের অবশিষ্ট অভিনেতৃকুল কোনোক্রমে বাংলা থিয়েটারের পূর্ববর্তী ধারার জের চালিয়ে যাচ্ছেন। নতুন উদ্যম, ভাবনা কিংবা নাট্যপ্রচেষ্টা কোনো দিক দিয়েই দেখা যাচ্ছিল না। বাংলা থিয়েটারের তখন প্রায় ‘অজন্মা’ অবস্থা চলছিল।

এই সময়ে কলকাতায় তিনটি থিয়েটার চলছিল। মনোমোহন পাড়ের মনোমোহন থিয়েটারে দানীবাবু অধ্যক্ষ ও অভিনেতারূপে জড়িত ছিলেন। মিনার্ভা তখন ধুকছে। স্টার থিয়েটারে অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তারাসন্দুরী চেষ্টা করছেন থিয়েটারকে বাঁচাতে। থিয়েটারের এই দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে পার্শি ব্যবসায়ি ম্যাডান কোম্পানীর নামে কর্ণওয়ালিস থিয়েটার খুলে ব্যবসা জমাতে চাইছে। রঙঢঙ, হাল্কা রসিকতা, অশ্লীলতা, জাকজমক, নৃত্যগীত-ইত্যাদিতে ভরিয়ে দিয়ে ব্যবসা জমাতে চাইছে। কিন্তু অন্যদের মতো তারাও ব্যর্থ হলো।

প্রথম শ্রেণীর অভিনেতার অভাব, ভাল নাট্যকার ও নাটকের অভাব, প্রযোজনাগত একঘেয়েমি এবং নির্দেশনার চর্বিত-চর্বণ বাংলা রঙ্গালয়ের জরাজীর্ণ অবস্থাকে আরো বাড়িয়ে তুললো। সেই একঘেয়ে ঐতিহাসিক নাটকের নামে সস্তা ভাবাবেগ ও উদ্দীপনাময় রোমান্স, পৌরাণিক নাটকের নামে ভক্তির তারল্য, প্রহসনগুলিতে ভাড়ামো এবং হাল্কা নাচগানের গীতিনাট্যের পসরার বিরক্তিকর সৌষ্ঠবহীনতা।

এই সময় (১৯২১) ম্যাডান কোম্পানীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এক হাজার টাকা মাস মাইনেতে শিশির ভাদুড়ি বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ে এলেন। নাট্যকার রইলেন ক্ষীরোদপ্রসাদ।

শিশিরকুমার তখন অবধি শৌখিন শিল্পীরূপে অভিনয় করেছেন। ছাত্রাবস্থায় স্কটিশচার্চ কলেজে শেক্সপীয়রের নাটকে অভিনয় করেছেন। পরে ইউনিভারসিটি ইনস্টিটিউটে তার শিক্ষিত বন্ধুবান্ধবদের সহযোগে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছেন। নাট্য শিক্ষালাভ করেছেন অধ্যাপক মন্মথমোহন বসু, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মত রসিক ও বিদগ্ধজনের কাছে। ‘মেরি গোল্ড ক্লাব’ তৈরি করে সেখানে হ্যামলেট (১৯০৯), কুরুক্ষেত্র (১৯০৯), বুদ্ধদেব চরিত (১৯১০), চন্দ্রগুপ্ত (১৯১১), বৈকুণ্ঠের খাতা (১৯১২), জনা (১৯১২) প্রভৃতি নাটকের একাধিকবার অভিনয় করেন। এইসব নাটকে হ্যামলেট, চাণক্য, কেদার, প্রবীর প্রভৃতি চরিত্রে তাঁর অভিনয় বিদগ্ধ ও রসিক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বৈকুণ্ঠের খাতায় কেদারের অভিনয় দেখে শিশিরকুমারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। চন্দ্রগুপ্ত নাটকের চাণক্য অভিনয় দেখে নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল শিশিরকে মাল্যভূষিত করেন এবং শিশিরের বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয়ের প্রশংসা করে বলেন—“আমি কল্পনায় যে চিত্র এঁকেছি তার চেয়েও এগিয়ে গিয়েছে ইতিহাসের চাণক্য আমার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

শৌখিন থিয়েটারের এই নবীন প্রতিভা ম্যাডান কোম্পানীতে যোগ দিয়ে ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘আলমগীর’ নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে সাধারণ রঙ্গালয়ে পদার্পণ করলেন, ১০ই ডিসেম্বর, ১৯২১। সঙ্গে রইলেন তুলসীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (কামবক্সের ভূমিকায়), প্রভাদেবী প্রমুখ।

শিশিরকুমারের আবির্ভাবে বাংলা মঞ্চে সাড়া পড়ে গেল। মঞ্চাভিনয়ের এই পরিকল্পনা, এই অভিনয়, এই উপস্থাপনা বাংলামঞ্চে নতুনের আস্বাদ এনে দিল। বাংলা থিয়েটারে যেন প্রাণ ফিরে এলো। অন্য মঞ্চগুলিও এবার নতুনদের দিকে নজর দিলেন। মিনার্ভায় উপেন্দ্রনাথ মিত্র এই নতুন পরিবর্তনে আগ্রহী হয়ে নিয়ে এলেন শিশিরের সহযোগী শৌখিন অভিনেতা রাধিকানন্দ মুখোপাধ্যায় ও নরেশ মিত্রকে। স্টার নিয়ে এলো তারাসুন্দরীকে, সঙ্গে নির্মলেন্দু লাহিড়ী। স্টারে অপরেশ মুখখাপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র গুহের কৃতিত্বে ‘আর্ট থিয়েটার’ ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘কর্ণার্জুন’ নাটক দিয়ে মাতিয়ে দিল। নতুন সব মুখ—অহীন্দ্র চৌধুরী, তিনকড়ি চত্রবর্তী, দুর্গাদাস বন্দে!পাধ্যায়, নরেশ মিত্র, নীহারবালা, নিভানী, কৃষ্ণভামিনী।

মিনার্ভা পুড়ে গেল। মনোমোহন থিয়েটার ‘বঙ্গেবর্গী’ ও ‘ললিতাদিত্য’ নাটক নিয়ে, দানীবাবুর অভিনয় দিয়েও চালাতে পারল না। শিশির সম্প্রদায় ও আর্ট থিয়েটারের দাপটে তখন মনোমোহন টিকতে পারল না।

ম্যাডানের কর্ণওয়ালিস থিয়েটারে শিশিরকুমার তিনটি নাটক, আলমগীর, রঘুবীর এবং চন্দ্রগুপ্ত অভিনয় করেন। এখানেও আলমগীর, রঘুবীর ও চাণক্যের অভিনয়ে তিনি প্রথম শ্রেণীর অভিনেতার মর্যাদা পেলেন। কিন্তু ম্যাডানের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত হওয়ায় তিনি ১৯২২-এর আগস্ট মাসে ম্যাডান থিয়েটার ছেড়ে দেন। কিছুদিন রইলেন মঞ্চের বাইরে। এই সময়ে তিনি নবাগত চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিচালনা ও অভিনয় করতে থাকেন।

ইডেন গার্ডেনে তখন একটি বৃহৎ প্রদর্শনী চলছিল। সেখানে শিশিরকুমার দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সীতা’ মঞ্চস্থ করেন (ডিসেম্বর, ১৯২৩) তাঁর ওল্ড মেরী ক্লাবের সহযোগীদের নিয়ে। বিশ্বনাথ ভাদুড়ি, ললিতমোহন লাহিড়ী, রমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, যোগেশ চৌধুরী, তুলসীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি রায়, জীবন গঙ্গোপাধ্যায়। অভিনেত্রীরা এলেন সাধারণ রঙ্গালয় থেকে—খ্যাতিময়ী মালিনী, নীরদাসুন্দরী, প্রভাদেবী, শেফালিকা (পুতুল) প্রভৃতি। তাঁর এই নবগঠিত সম্প্রদায় অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ‘সীতা’ অভিনয় করে সুধীজনের প্রচুর সমাদর লাভ করলো। প্রযোজনা, পরিচালনা এবং অভিনয়ে নতুন ভাবধারার সৃষ্টি হলো।

উৎসাহিত শিশিরকুমার তার এই নবগঠিত নাট্যদলকে নিয়ে সাধারণ রঙ্গালয়ে ফিরে এলেন—হ্যারিসন রোডে ‘আলফ্রেড থিয়েটার’-এ সীতা অভিনয় শুরু করবেন ঠিক করলেন। তিনি নিজে অভিনয় করেছিলেন রামচন্দ্রের ভূমিকায়। এই সময়েই আর্ট থিয়েটার চক্রান্ত করে সীতার স্বত্ত্ব কিনে নিয়ে শিশিরকুমারের সীতা অভিনয় আইনের চালে বন্ধ করে দিলেন, নিজেরাও করলেন না। ব্যর্থ হয়ে শিশিরকুমার মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে লিখিয়ে ‘বসন্তলীলা’ অভিনয়ের ব্যবস্থা করলেন (মার্চ, ১৯২৪)। তারপরে পুরনো নাটক আলমগীর, রঘুবীর, চন্দ্রগুপ্ত ওই ১৯২৪ সালেই পরপর অভিনয় করলেন।

মনোমোহন থিয়েটার ১৯২৪-এ বন্ধ হয়ে গেলে শিশিরকুমার আলফ্রেড ছেড়ে এই মনোমোহন থিয়েটার ভাড়া নিলেন মাসিক তিন হাজার টাকায়। নবগঠিত নাট্যদল নিয়ে এখানে উদ্বোধন করলেন তাঁর নাট্যমন্দির (৬ আগস্ট, ১৯২৪)। দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সীতা’র স্বত্ব হারিয়ে তিনি যোগেশ চৌধুরীকে দিয়ে নতুন করে ‘সীতা’ লেখান। তাড়াহুড়ো করে লেখনোর ফলে নাটকটি অকিঞ্চিৎকর হলো। কিন্তু নাট্যাভিনয়ের গুণে মাত করে দিলেন তিনি। সীতা অভিনয়ে যথার্থ প্রয়োগকর্তার কুশলতা তিনি দেখালেন। অভিনয়, দৃশ্যপট রচনা, সাজসজ্জা, দৃশ্যসজ্জা, আলোর ব্যবহার এবং সঙ্গীত—সবকিছুর মধ্যেই প্রয়োগকর্তার সুনিপুণ স্বাক্ষর লক্ষ করা গেল। এই প্রথম বাংলা থিয়েটারে একটি ছন্দোবদ্ধ নাট্যাভিনয়ের প্রকাশ দেখা গেল। তাছাড়া শেষদৃশ্যে প্রায় পঞ্চাশজন মতো লোক নিয়ে যে জনতার দৃশ্য তৈরি হয়েছিল, তা সবাইকে মুগ্ধ করে দিল। সাজসজ্জা, দৃশ্য পরিকল্পনা, অভিনয় এবং প্রয়োগ কৌশলে সীতার অভিনয় প্রায় কিংবদন্তী সৃষ্টি করল। রবীন্দ্রনাথ নাটক হিসেবে সীতাকে অতি সাধারণ বলেছেন, কিন্তু এর অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।

মনোমোহন তাঁর ‘নাট্যমন্দির’ মঞ্চে তিনি সীতা ছাড়া দ্বিজেন্দ্রলালের পাষাণী (১০ই ডিসেম্বর, ১৯২৪), গিরিশের জনা (৩ জুন, ১৯২৫) এবং শ্রীশ বসুর ‘পুণ্ডরীক’ (১৩ই আগস্ট, ১৯২৫) অভিনয় করেন। কিন্তু এই সময়েই ‘ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’ নতুন রাস্তা তৈরি করার জন্য মনোমোহন থিয়েটার বাড়ি ভেঙে ফেলে। নাট্যমন্দির উঠে যায়।

শিশির আবার ফিরে এলেন ম্যাডানদের কর্ণওয়ালিস থিয়েটারে। সেখানেও নাট্যমন্দির নাম দিয়ে তিন বছরের লীজ নিয়ে অভিনয় শুরু করলেন। উদ্বোধন হল ‘সীতা’ নাটক দিয়ে, ১৯২৬ এর ২৩ জুন। এই সময়ে তাঁর ‘নাট্যমন্দির’ লিমিটেড কোম্পানীতে রূপান্তরিত হয়। এবং তাঁর থিয়েটারের নাম রাখা হলো ‘নাট্যমন্দির লিমিটেড’। এই নাট্যমন্দিরে তিনি ১৯২৯ পর্যন্ত অভিনয় করেছেন। এখানে তিনি পর পর অভিনয় করলেন: বিসর্জন (রবীন্দ্রনাথ, ২৬ জুন, ১৯২৬)। পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস (গিরিশ, ১ জুলাই, ১৯২৬)। নরনারায়ণ (ক্ষীরোদপ্রসাদ, ১ ডিসেম্বর, ১৯২৬)। প্রফুল্ল (গিরিশ, জুন, ১৯২৭)। সধবার একাদশী (দীনবন্ধু, জুলাই, ১৯২৭)। ষোড়শী (শরৎচন্দ্রের দেনা-পাওনার নাট্যরূপ, ৬ আগস্ট, ১৯২৭)। শেষরক্ষা (রবীন্দ্রনাথ, ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯২৭)। সাজাহান (দ্বিজেন্দ্রলাল, নভেম্বর, ১৯২৭)। বলিদান (গিরিশচন্দ্র, ২৫ জানুয়ারি, ১৯২৮)। বিদ্বমঙ্গল (গিবিশ, ২৯ মে, ১৯২৮)। হাসনেহানা (বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত, ২৫ আগস্ট, ১৯২৮), দিগ্বিজয়ী (যোগেশ চৌধুরী, ১৪ ডিসেম্বর, ১৯২৮)। বিবাহ-বিভ্রাট (অমৃতলাল বসু, ৩ মে, ১৯২৯)। বুদ্ধদেব (গিরিশ, ৮ জুন, ১৯২৯)। রমা (শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজ-এর নাট্যরূপ, আগস্ট, ১৯২৯)। শঙ্খধ্বনি (‘The Bells’ নাটকের রূপান্তর: ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ২ নভেম্বর ১৯২৯)। তপতী (রবীন্দ্রনাথ, ডিসেম্বর, ১৯২৯)।

১৯৩০ সালের মার্চ মাসে কর্ণওয়ালিস থিয়েটারে নাট্যমন্দিরের ‘লীজ’ শেষ হলো। এখানে শেষ অভিনয়, সীতা ও ষোড়শী, ১৯৩০ এর ২৫ মার্চ। পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য শেষের দিকের কয়েকটি নাটক, বিশেষ করে ‘তপতী’ প্রচুর লোকসান করে দিল। প্রায় শূন্য অডিটোরিয়ামেও একেক দিন অভিনয় করতে হলো। আর্থিক দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গতি না থাকায় নাট্যমন্দির বন্ধ করে দিতে হলো। ম্যাডানদের হাতে কর্ণওয়ালিস থিয়েটার চলে গেল।

সঙ্গতিবিহীন শিশিরকুমার কিছুদিন আর্ট থিয়েটারে যোগ দেন, স্টার থিয়েটারের মঞ্চে তিনি আর্ট থিয়েটারের হয়ে ১৯৩০-এর কয়েক মাসে অভিনয় করলেন রবীন্দ্রনাথের চিরকুমার সভা, অনুরূপা দেবীর উপন্যাসের নাট্যরূপ মন্ত্রশক্তি, দ্বিজেন্দ্রলালের সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত এবং অপরেশ মুখখাপাধ্যায়ের কর্ণার্জুন। এর কয়েকটি আবার আমন্ত্রণমূলক ছিল। চন্দ্রবাবু, চাণক্য, ঔরঙ্গজেব, কর্ণ প্রভৃতি ভূমিকায় তার অভিনয় এখানে খুবই প্রশংসিত হলো।

এরপর শিশিরকুমার চলে যান আমেরিকায়, ১৯৩০-এর সেপ্টেম্বর মাসে। স্কচ অভিনেতা এরিক ইলিয়ট কলকাতায় সীতার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে আমেরিকার শিল্পসংগঠক মিস মারবেরিকে জানান। তারই আমন্ত্রণে শিশিরকুমার দলবল নিয়ে নিউইয়র্ক যান। কিন্তু সেখানে মিস মারবেরি চুক্তি ভঙ্গ করলেন। তখন অসহায় শিশির ওখানে সতু সেনের সাহায্যে ভ্যানডার বিল্ট থিয়েটারে ‘সীতা’ মঞ্চস্থ করেন (১২ জানুয়ারি, ১৯৩১)। পরপর কয়েকটি অভিনয় করলেন। তারপর আমেরিকা থেকে ফেরার পথে বড়লাট লর্ড আরউইনের অনুরোধে দিল্লীতে সীতা অভিনয় করলেন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানরূপে, ২০ মার্চ, ১৯৩১।

আমেরিকায় তিনি প্রায় ব্যর্থ হয়েছিলেন বলা যায়। দলের সব অভিনেতা-অভিনেত্রীকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয়নি। দৃশ্যপট, মঞ্চসজ্জা ও সাজসজ্জার সমস্ত উপকরণ নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে দুর্বল অভিনয়, অঙ্গহীন দৃশ্যসজ্জা, অপ্রস্তুত অভিনেতা—সব মিলিয়ে তাঁর এই সফর তাঁর খ্যাতি কোনো অংশেই বাড়াতে পারেনি। সতু সেন চেষ্টা করে মুখরক্ষা করেছিলেন মাত্র।

ওখান থেকে ফিরে নিজস্ব থিয়েটার না থাকায় আবার ভাড়াটে অভিনেতা হয়েই অভিনয় করতে লাগলেন। নাট্যনিকেতন, রঙমহল প্রভৃতি মঞ্চে অভিনেতা ও নাট্যশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৩১-এর আগস্ট থেকে আট মাস এই ভাবে অভিনয় চালিয়ে শিশির রঙমহল ছেড়ে (ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২), প্রবোধ গুহের নাট্যনিকেতনে যোগ দেন। সেখানে চন্দ্রশেখর (১৯৩২), গৈরিকপতাকা (১৯৩২), দক্ষযজ্ঞ (১৯৩২) নাটকে অভিনয় করেন। শিবাজী ও দক্ষের অভিনয়ে কৃতিত্ব দেখান।

১৯৩৩-এ নাট্যনিকেতন ছেড়ে দিয়ে স্টারে যোগ দেন। এখানে বৈকুণ্ঠের খাতা, রমা এবং রিজিয়া (মনোমোহন রায়) নাটকে ওই এক বছরেই অভিনয় করেন।

১৯৩৩-এর মাঝামাঝি স্টার মঞ্চে আর্ট থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেল। শিশিরকুমার স্টার থিয়েটারের বাড়ি গ্রহণ করে সেখানে নবনাট্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন, ১৯৩৪-এর জানুয়ারি মাসে। নবপ্রতিষ্ঠিত ‘নবনাট্য মন্দির’ অনেকদিন বাদে শিশিরের নিজস্ব থিয়েটার হল। যদুনাথ খাস্তগীরের লেখা ‘অভিমানিনী’ নাটক দিয়ে এই নবনাট্য মন্দিরের প্রথম অভিনয় শুরু হল, ১৯ জানুয়ারি, ১৯৩৪।

নতুন উদ্যমে শিশিরকুমার আবার নিজের প্রযোজনায় নিজের নাট্যাভিনয় শুরু করলেন। পরপর অভিনয় করলেন: অভিমানিনী (যদুনাথ খাস্তগীর, ১৯ জানুয়ারি, ১৯৩৪)। ফুলের আয়না (নরেন্দ্রদেব, ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪)। বিরাজ বৌ (শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ, ২৮ জুলাই, ১৯৩৪)। মায়া (সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪)। সরমা (সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪)। প্রতাপাদিত্য (ক্ষীরোদপ্রসাদ, নভেম্বর, ১৯৩৪)। দশের দাবী (শচীন সেনগুপ্ত, ২৪ নভেম্বর, ১৯৩৪)। বিজয়া (শরশ্চন্দ্রের ‘দত্তা’র নাট্যরূপ, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৩৪)। শ্যামা (সত্যেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৩৫)। রীতিমত নাটক (জলধর চট্টোপাধ্যায়, ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৩৫)। অচলা (শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’র নাট্যরূপ, ২২ অক্টোবর, ১৯৩৬)। যোগাযোগ (রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নাট্যরূপ, ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৩৬)।

১৯৩৭ এর জুন মাসে স্টার থিয়েটারের মালিকের সঙ্গে মামলায় হেরে গিয়ে শিশির ভাদুড়ি ওখান থেকে উচ্ছেদ হন। নবনাট্যমন্দির বন্ধ হয়ে যায়। জুন, ১৯৩৭। এখানে তিনি মূলত রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের বেশ কয়েকটি উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় করেন। হাতের কাছে ভালো নাট্যকার ও নাটক না থাকাতে কে এই কাজ করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির নাট্যরূপ দর্শকদের দেখিয়ে, কাহিনী ও চরিত্রের নতুন সম্ভার তাদের কাছে হাজির করেন।

আবার ১৯৩৭ থেকে ১৯৪১, এই সময় কালে শিশিরের নিজস্ব কোনো মঞ্চ ছিল না। কিন্তু সম্মিলিত অভিনয় করা ছাড়া তিনি ও তাঁর দলের কোনো কাজ ছিল না। শিশির এই সময়ে কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাঁর নির্দেশনায় ও অভিনয়ে সীতা, দস্তুরমত টকী (রীতিমত নাটকের চিত্রপ), চাণক্য মুক্তি পায় ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯-এর মধ্যে।

১৯৪১ সালে প্রবোধ গুহের নাট্যনিকেতন বন্ধ হয়ে গেলে শিশিরকুমার এই রাজকিষেণ স্ট্রিটের নাট্যনিকেতন থিয়েটার বাড়ি লীজ নিয়ে তাতে খোলেন—‘শ্রীরঙ্গম’। এখন সেখানে বিশ্বরূপা থিয়েটার। শ্রীরঙ্গম মঞ্চের উদ্বোধন হলো ১৯৪১-এর ২৮ নভেম্বর তারাকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘জীবনরঙ্গ’ নাটক দিয়ে। শিশিরকুমার অভিনয় করলেন নাট্যাচার্য অমরেশের ভূমিকায়। শ্রীলঙ্গম মঞ্চে অভিনয় তালিকা: জীবনরঙ্গ (তারাকুমার মুখোপাধ্যায়, ২৮ নভেম্বর, ১৯৪১)। উড়োচিঠি (নিতাই ভট্টাচার্য, ১১ মার্চ, ১৯৪২)। দেশবন্ধু (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২)। মাইকেল (নিতাই ভট্টাচার্য, ২৩ এপ্রিল, ১৯৪৩)। বিপ্রদাস (শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ, ২৫ নভেম্বর, ১৯৪৩)। (বিপ্রদাসের পরিচালনা ও নামভূমিকায় ছিলেন বিশ্বনাথ ভাদুড়ি। প্রথমে শিশিরকুমার অভিনয় করেননি, পরে কয়েকবার বিপ্রদাস চরিত্রে অভিনয় করেন।) তাইতো (বিধায়ক ভট্টাচার্য, ডিসেম্বর, ১৯৪৩)। বন্দনার বিয়ে (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ১৯৪৩) (এটিরও পরিচালনা ও মুখ্য চরিত্রে বিশ্বনাথ ভাদুড়ি।) দুঃখীর ইমান (তুলসী লাহিড়ী, ১৯৪৬) (পরিচালনা করেন শিশিরকুমার কিন্তু অভিনয় করেননি। বিন্দুর ছেলে (শরৎচন্দ্রের গল্পের নাট্যরূপ দেবনারায়ণ গুপ্ত, ডিসেম্বর, ১৯৪৪)। সিরাজদৌল্লা (গিরিশ, ডিসেম্বর, ১৯৪৭)। পরিচয় (জিতেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ১০ আগস্ট, ১৯৪৯)। ষোড়শী (শরৎচন্দ্রের ‘দেনা পাওনা’র নাট্যরূপ, ১৯৫১)। তখত-এ-তাউস (প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, ১০ মে, ১৯৫০)। আলমগীর (ক্ষীরোদপ্রসাদ, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৫১)। (শিশিরকুমারের অভিনয় জীবনের ত্রিশ বৎসর পূর্তিতে এই দিন তার প্রথম নাটক আলমগীর পুনরভিনয় কবেন)। প্রশ্ন (তারাকুমার মুখোপাধ্যায়, ৩ জানুয়ারি, ১৯৫৩)।

এর পরে প্রায় তিন বছর শ্রীরঙ্গমে নতুন কোনো নাটকের অভিনয় করেননি। পুরনো নাটকগুলির পুনরভিনয় করেন। শেষের দিকে তিনি আর অভিনয়ে অংশ গ্রহণ করতেন, পরিচালনা করতেন। তবে আলমগীরে আলমগীর এবং রাজসিংহ ও সাজাহান নাটকে সাজাহান ও ঔরঙ্গজেব-এর ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৫৬ এর গোড়াতে নতুন নাটক ধরলেন—মিশরকুমারী (বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত, ২২ জানুয়ারি, ১৯৫৬)। তারপরে আবার পুরনো নাটক চন্দ্রগুপ্ত (দ্বিজেন্দ্রলাল ২৩ জানুয়ারী, ১৯৫৬)। প্রফুল্ল (গিরিশ, ২৪ জানুয়ারি, ১৯৫৬)।

শ্রীরঙ্গমে শিশিরকুমারের শেষ অভিনয় প্রফুল্ল নাটকে যোগেশ চরিত্রে, ১৯৫৬-এর ২৪ জানুয়ারি। বাড়ি ভাড়ার দায়ে মঞ্চ ছেড়ে দিতে হলো। ২৮ জানুয়ারি, ১৯৫৬, ঐ বাড়িতে তৈরি হল বিশ্বরূপ থিয়েটার। শ্রীরঙ্গমে শিশিরকুমার ছিলেন একটানা চৌদ্দ বংসব। এই সময়ে তিনি চৌদ্দটি নাটকের অভিনয়ের ব্যবস্থা করেন এখানে।

১৯৫৬-এর পর থেকে শিশিরকুমারের অভিনয় প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। মাঝে মাঝে ইতস্তত অভিনয় করেছেন। মিনার্ভা মঞ্চে ‘জবিরঙ্গ’ (ভুমিকা: অমরেশ)। ভবানীপুরে থিয়েটার সেন্টারের ক্ষুদ্র প্রেক্ষাগৃহে সধবার একদশী (নিমচাঁদ); এন্টালি কালচারাল কনফারেন্সে মাইকেল (মাইকেল) অভিনয় করে। আমন্ত্রিত অভিনয়ও করেছেন কলকাতার বাইরে গিয়েও

এই সময়ে কিছু তরুণ লেখক শিল্পী সাংবাদিক সমালোচক ও নাট্যামোদী ব্যক্তি গড়ে তাোলেন ‘নব্য বাংলা নাট্য পরিষদ’। শিশিরকুমারকে মধ্যমণি করে এই সংস্থা তার কাজ শুরু করে। শিশিরকুমার এখানে অভিনয় এবং আলোচনা করতেন। এই দলবল নিয়ে কলকাতার বাইরে গিয়ে সফর করতেন, নাট্যাভিনয় করেন।

১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে পরপর চারদিন তিনি ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট মঞ্চে তিনটি নাটকের অভিনয়ের ব্যবস্থা করেন। মাইকেল (দুদিন), ষোড়শী ও বিজয়া। তিনি অভিনয়েও অংশ নেন। জীবন, রাসবিহারী এবং মাইকেল চরিত্র তাঁর শেষ জীবনের অভিনয়ের সাক্ষী।

১৯৫৯-এর ২৬ জানুয়ারি তাঁকে ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি দেন। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। রাষ্ট্রীয় সম্মানের চেয়ে তিনি স্বাধীন রাষ্ট্রের কাছে একটি ‘থিয়েটার হল’ চেয়েছিলেন, যেখানে তিনি নিজের মনের মতো করে অভিনয়ের ব্যবস্থা কবতে পারবেন।

১৯৫৯-এর ৮ মে, মহাজাতি সদনে ‘আলমগীর’ নাটক এবং ১৮ মে রীতিমত নাটক’ অভিনয় করেন। রীতিমত নাটকে প্রফেসর দিগম্বরের ভূমিকায় অভিনয়ই তার জীবনের শেষ অভিনয়।।

১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন শেষ রাত্রে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

শিশির ভাদুড়ি শৌখিন অভিনয় করতে করতে পেশাদার রঙ্গালয়ে এসেছিলেন। তাঁর সময়ে বাংলা থিয়েটার গতানুগতিকতায় ধুঁকছে। এই সময়ে সিনেমা এদেশে নবাগত হলেও, তার ধরন, অভিনয় কৌশল এবং সর্বোপরি এদেশের কাছে একেবারে বিস্ময়কর উপস্থাপন—নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এই সিনেমাগুলিও বৈচিত্র্য সৃষ্টি ছাড়া শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। একঘেয়ে মৃতপ্রায় থিয়েটার এবং সিনেমার শিল্পহীন অভিনবত্ব রুচিশীল শিক্ষিত সূক্ষ্মভাবের দর্শকের আগ্রহসৃষ্টি করতে পারেনি। আবার সাধারণ দর্শক গতানুগতিক থিয়েটার যেমন দেখে, তার চেয়ে বেশি ভিড় করে সিনেমায়। ফলে সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় থিয়েটার ক্রমশ হেরে যেতে থাকলো।

শিশির ভাদুড়ি থিয়েটারের এই উভয়ত দুর্যোগের সময়ে উদিত সূর্যের আলোক প্রতিভা নিয়ে রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন। থিয়েটারকে উন্নত করে রুচিশীল দর্শকের শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা পেলেন। রবীন্দ্রনাথ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে সেই সময়কার সমস্ত বিদগ্ধ মানুষ শিশির ভাদুড়িকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। মনোমোহন থিয়েটারে নাট্যমন্দিরে ‘সীতা’ নাটকের অভিনয়ের খবর দিয়ে ‘নাচঘর’ পত্রিকা (১ ভাদ্র, ১৩৩১) লিখেছিল—‘‘গত রবিবারের সীতার অভিনয় দেখবার জন্যে মনোমোহন নাট্যমন্দিরে যত শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সেবক ও কলাবিদের সমাগম হয়েছিল এর আগে বাংলা রঙ্গালয়ে আমরা তা দেখিনি।

রবীন্দ্রনাথ শিশিরকুমারকে ‘নটরাজ’ উপাধিতে সম্বর্ধিত করেছিলেন। যে সাধারণ রঙ্গালয় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ এতদিন মুখ ফিরিয়েছিলেন; শিশিরকুমারের জন্যই তার প্রতি তাঁর আস্থা ফিরে এসেছে এবং সাহিত্যিক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে (১২ ভাদ্র, ১৩৩১) স্পষ্ট জানিয়েছিলেন—‘‘শিশির ভাদুড়ির প্রয়োগ নৈপুণ্য সম্বন্ধে আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আছে। সেই কারণেই ইচ্ছাপূর্বক আমার দুই একটা নাটক অভিনয়ের ভার তার হাতে দিয়েছি।’’ শিশিরকুমারের নাট্যনৈপুণ্য দেখেই রবীন্দ্রনাথ পেশাদার বাংলা রঙ্গালয়ের দিকে হন। এবং আশ্বাস দেন যে, তাঁর জন্য তিনি অর্জুনকে নিয়ে একখানি পৌরাণিক নাটক রচনা করবেন। অবশ্য সে কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। (হেমেন্দ্রকুমার রায়—গল্পভারতী, রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ সংখ্যা, ১৩৬৮)

‘প্রয়োগনৈপুণ্য’ শব্দটি রবীন্দ্রনাথ প্রথম ব্যবহার করলেন। এবং শিশিরকুমারের নাট্য প্রযোজনার সম্বন্ধেই এই কথাটি তিনি ব্যবহার করলেন। প্রয়োগকর্তা বা প্রয়োগকুশলতা বাংলা থিয়েটারে প্রথম। এর আগে এভাবে কেউ ভাবেনি। পূর্ববর্তী বাংলা থিয়েটারে ছিল অভিনয় শিক্ষক, মঞ্চাধ্যক্ষ, নাট্যাচার্য কিংবা মোশন মাস্টার—কিন্তু প্রয়োগকর্তা ছিলেন না কেউ। যিনি নাট্য প্রযােজনার সব কয়টি দিক-মঞ্চ পরিকল্পনা, অভিনয়, দৃশ্য সৌন্দর্য, সাজসজ্জা, আলোক সম্পাত, সঙ্গীত, নৃত্যগীতবাদ্য ইত্যাদি সব কিছুর সামগ্রিক সম্মিলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ নাট্য প্রযোজনা উপস্থিত করতে পারেন তিনিই তো সার্থক প্রয়োগকর্তা। বাংলা থিয়েটারে এই সর্বাঙ্গীণ প্রয়োগ নৈপুণ্য শিশিরকুমারের থিয়েটারেই প্রথম লক্ষিত হলো।

প্রযোজনার বিভিন্ন দিকে সহায়তা করার জন্য তাঁর সহযোগী হিসেবে সেই সময়ের স্বক্ষেত্রে বিখ্যাত কয়েকজন মানুষ তাঁর সঙ্গে ছিলেন। যেমন দৃশ্যপট ও সাজপোষাক দেখতেন প্রখ্যাত শিল্পী চারু রায়। সঙ্গীত রচনা করতেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। সঙ্গীত পরিচালনা করতেন কৃষ্ণচন্দ্র দে এবং গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। নৃত্যপরিকল্পনায় হেমেন্দ্রকুমার রায় ও মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়। প্রাসঙ্গিক সঙ্গীত দেখাশোনা করতেন নৃপেন্দ্র মজুমদার, যিনি পরে কলকাতা আকাশবাণীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে খ্যাতিলাভ করেন। উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।

এরা সবাই তৎকালীন পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের বাইরেকার লোক। তাই গতানুগতিক একঘেয়ে মঞ্চব্যবস্থার রোমন্থন এঁদের মধ্যে ছিল না। এঁদের শিক্ষা, রুচি, শিল্পবোধ ও নাট্যরস ভাবনা শিশিরকুমারকে সাহায্য করেছিল। সর্বোপরি প্রয়োগকর্তা শিশিরকুমারের নিয়ন্ত্রণে সঙ্ঘবদ্ধ শিল্পের ঐকতান সৃষ্টি হতে পেরেছিল।

১৯ শতকের গতানুগতিকতার ধারা থেকে বাংলা থিয়েটারে অভিনয়ের এই দিক পরিবর্তনের কথা সবাই মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছেন। তার মধ্যে থেকে এখানে অমৃতলাল বসুর মন্তব্য উদ্ধার করি, কেননা তিনি সাধারণ রঙ্গালয়ের উদ্বোধন মুহূর্ত থেকেই অভিনেতা, প্রযোজক ও নির্দেশকের দায়িত্ব নিয়ে নানাভাবে নানা সময়ে রঙ্গশালায় বিচিত্র গতিপ্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নতুন যুগের দিক পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বললেন—‘‘কিছুদিন পূর্বে আমাদের দেশে নাট্যকলা অত্যন্ত হীন হয়ে পড়েছিল। সারা জীবন ধরে আমি এই কলার সাধনা করে এসেছি। শেষে আমার ওই বৃদ্ধ বয়সে নাট্যকলার এই অবনতি দেখে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমাকে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হচ্ছিল। সে বেদনা থেকে এরা আমায় মুক্তি দিয়েছেন। যাঁদের সঙ্গে একসঙ্গে এই কাজে আমি নেমেছিলাম, তারা একে একে সকলেই এই সংসার থেকে বিদায় নিয়েছেন—আমি ভাবছিলাম, ঈশ্বর কি আমাকে রঙ্গালয়ের এই হীন অবস্থা দেখবার জন্যই জীবিত রেখেছেন। কিন্তু আজ আমি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করছি এরা আমায় সে আশঙ্কা থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’’ (মনোমোহন নাট্যমন্দিরে ‘সীতা’ নাটকের উদ্বোধনের দিনে (৬-৮-১৯২৪) অমৃতলালের উদ্বোধনী ভাষণ।)

শিশিরকুমার বাংলা রঙ্গালয় ও নাট্যাভিনয়কে নতুন প্রাণে উজ্জীবিত করলেন। গত শতকের নাট্যাভিনয়ের রোমান্টিক ভাববিলাস, অবাস্তবতা, বীর, করুণ, হাস্যরসের উপস্থাপনের ‘হাস্যকর’ প্রচেষ্টা, নৃত্যগীত বাহুল্য, ধর্মীয় ভাবালুতা, অসংযত আচরণ এবং সাধারণ দর্শকের স্কুলরুচি, অভদ্র আচরণ ও চাহিদা—এইসব দিক থেকেই তিনি বাংলা নাট্যশালাকে মুক্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে সার্থকও হয়েছিলেন। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে এই কারণে তিনি চিরকাল স্মরণীয়।

নাটক তিলোত্তমাশিল্প (composite art)। নট্যপ্রযোজনায় এই মিশ্র শিল্পের কয়েকটি অবশ্য প্রয়োজনীয় দিকে শিশিরকুমারের প্রচেষ্টা ও সার্থকতা আলোচনা করা যেতে পারে।

দৃশ্যপট

আগে দৃশ্যপট হিসেবে আঁকা সিনের প্রচলন ছিল। যে দৃশ্য শুরু হত সেই দৃশ্য উপযোগী সিন এঁকে পেছনে টাঙিয়ে দেওয়া হতো, তাতে বোঝাবার চেষ্টা হতো এটি রাজপ্রাসাদ, কি মন্দির, না রাস্তা, না বনপথ। শিশিরকুমার এই প্রচলিত আঁকা সিন ব্যবহার পালটে দিলেন। তার আগে অমরেন্দ্রনাথ দত্ত কিছু সেট-সিনের প্রচলন করেন। কিন্তু সব দৃশ্য নয়, কোনো কোনো দৃশ্য তিনি বাস্তব সম্মত করতে পুরো খাট-বিছানা, আলমারি, চেয়ার-টেবিল সব মঞ্চে বসিয়ে দিতেন। আবার কোনো দৃশ্যে আঁকসিন ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। তাই কোনো কোনো দৃশ্যে আচমকা এই ধরনের ব্যবহার বিসদৃশ হতো। সেখানে প্রয়োগকর্তার কোনো হাত থাকতো না। শিশির ভাদুড়ি সবকিছুকে একসূত্রে বাঁধলেন। দৃশ্য অনুযায়ী সেট তৈরি করলেন। যে যুগের নাট্যকাহিনী—তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেট তৈরি করা হতে লাগলো। এই ব্যাপারে শিল্পী চারু রায়ের সহায়তাকে তিনি পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছিলেন।

আলো

আলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি চিন্তাভাবনা করলেন। শুধু মঞ্চকে আলোকিত কিংবা অন্ধকার করা অথবা আলো দিয়ে কৌশলে চমকপ্রদ কিছু সৃষ্টি করে দর্শককে চমকে দেওয়া, এসবের জন্যই শুধু আলোর ব্যবহার তিনি করলেন না। পূর্বে মঞ্চের সামনে পাদপ্রদীপ তার আলো নিয়ে ঝলমল করতো। তিনি পাদপ্রদীপ তুলে দিলেন। উইংসের পাশ থেকে, ওপর থেকে নানাভাবে আলো ফেলার ব্যবস্থা করলেন। পরিস্থিতি ও চরিত্রের ‘মুড’ অনুযায়ী আলো ব্যবহারের ভাবনা চিন্ত তিনি করতে থাকেন।

সাজসজ্জা

দৃশ্যসজ্জা অনুযায়ী পোষাক, সাজসজ্জা সবই পরিকল্পিত হয়েছিল। যুগ অনুযায়ী পোষাক পরিচ্ছদ তৈরি করা হতে পোষাক পরিচ্ছদের ব্যবহারে পূর্বে কোন বোধ কাজ করেনি। রাজার পোষাক, চার পোষাক, সাধুর পোষাক—এইভাবে নির্দিষ্ট পোষাক দিয়ে চরিত্রদের সাজানো হতো। কিন্তু যুগে যুগে পোষাকের যে বিবর্তন হয় এবং মনুষ্য চরিত্রের বৈচিত্র্য অনুযায়ী পোষাকের যে ছাপ মারা থাকতে পারে না—নিয়ে শিশির কুমার ভেবেছেন। রাম কীরকম পোষাক পরতে পারেন, ঔরঙ্গজেব বা সিরাজদৌল্লা কী ধরনের সাজসজ্জা করতেন—ইতিহাস থেকে তিনি তার পরিকল্পনা সংগ্রহ করলেন। গতানুগতিক প্রথা ভেঙে তিনি যুগ ও চরিত্রোপযোগী সাজসজ্জা ব্যবহার করলেন। সাহায্য পেলেন ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

সঙ্গীত

সঙ্গীতে থিয়েটারি যে রীতি ছিল, তাতে সুরের মিশ্র প্রাধান্য ছিল। কথার মর্যাদা ছিল না। দ্বিজেন্দ্রলাল নিজে গান লিখতেন ও সুর দিতেন বলে তিনি কথাকে খেলাপ করেননি। রবীন্দ্রনাথের গানে কথা ও সুর অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। সেখানে সুর কখনোই কথাকে নষ্ট করে দেয় না। শিশির ভাদুড়ি থিয়েটারের সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথের গানের রীতি ব্যবহার করলেন। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় ও কৃষ্ণচন্দ্র দে এই কাজে দক্ষভাবে তাঁকে সাহায্য করলেন। তাছাড়া দৃশ্যান্তরের মাঝখানে, আগে কনসার্ট বাজানো হতো যার সঙ্গে মূল নাটকের ঐ দৃশ্যের কোনো ভাবগত বা সুরগত মিল থাকতো। শিশিরকুমারই প্রথম দুটি দৃশ্যের মাঝে সুনিয়ন্ত্রিত সুর ব্যবহার করে অভিনয়ের রস ঘনীভূত করার জন্য যন্ত্রসঙ্গীতের সাহায্য নিয়েছিলেন। এছাড়া কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কণ্ঠমাধুর্যও স্বীকার করতে হবে। এগুলিকে ব্যবহার করে তিনি আবার প্রয়োগ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। শিশিরকুমারের ওপর ভরসা থাকার জন্যই রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটকে লেখা গান সংযোজন বা বর্জন করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

নৃত্য

নৃত্যের ক্ষেত্রে বাংলা থিয়েটারে তো একেবারে ছাপমারা বন্দোবস্ত ছিল। ‘সখীর দল’ সব থিয়েটারেই থাকতো। কারণে অকারণে হাত-পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে তারা নেচে যেত। অন্য চরিত্রের নৃত্যও মূল নাটকের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ থেকে যেত। লোকে নাচটা দেখত, মূল নাটকের ধারার সঙ্গে সঙ্গতি কেউ খুঁজত না। বোধকরি খুজলে পেত-ও না। থিয়েটারে গতানুগতিক নৃত্য ভাবনা পালটে ভাবানুযায়ী, চরিত্র অনুযায়ী ভারতীয় মুদ্রার ব্যবহার তিনি চালু করলেন। রাগতাল দিয়ে ভাব অনুষঙ্গের নৃত্য পরিকল্পনা করা হল। শিল্পীদের সেইভাবে তৈরি করা হতে লাগলো।

অভিনয়

অভিনয় (acting)-এর ক্ষেত্রে শিশিরকুমার একটি উচ্চাঙ্গের মান তৈরি করতে পেরেছিলেন। অনুপুঙ্খরূপে নাট্য শিক্ষকের দায়িত্ব তিনি পালন করতেন। নাটকের বিষয় ও ভাব অনুযায়ী চরিত্রের গঠন ও বিকাশ কIভাবে অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা যায়, তা নিয়ে তিনি বিস্তর ভেবেছেন। নিজে তৈরি হতেন, সেইমত অন্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের তৈরি করতেন। তিনি জানতেন, একক অভিনেতার অভিনয়ে নাটক গঠিত হতে পারে না। আগের যুগে সেটাই অপরিহার্য ছিল। শিশিরকুমার সব সহযোগী অভিনেতাকে পারস্পরিক সংযোগের মধ্যে দিয়ে ‘স্কেলে’ দাঁড় করানোর চেষ্টা করতেন। সেই কারণে ধৈর্য সহকারে সবকিছু প্রস্তুত করার যে অধ্যবসায় ও নিষ্ঠা প্রয়োজন, শিশির কুমারের তা ছিল। এই কারণে তিনি আধুনিক থিয়েটারের রীতি অনুযায়ী মহলার (Rehearshal) ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিতেন।

অভিনয় শিক্ষক

প্রয়োজনে তিনি আনকোরা নতুন নট-নটীদের দক্ষ অভিনয় শিক্ষা দিতেন। তাতে অচিরাৎ তারা বড় অভিনেতা-অভিনেত্রীরূপে তৈরি হয়ে যেতেন। তাঁর এই অভিনয় শিক্ষা-গুণে পরবর্তী অনেক বড় অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরি হয়েছে। তাই অনেকেরই মনে হতে পারে যে, শিশিরকুমার বড় অভিনেতা, না, বড় অভিনয়-শিক্ষক। সীতার অভিনয় দেখে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নাচঘর’ পত্রিকায় লিখেছিলেন—“কি অভিনয় করার দক্ষতা, কি অভিনয় শিক্ষা দেবার ক্ষমতা, দুই দিক দিয়ে শিশিরবাবুর পরিচয় নেবার সৌভাগ্য হয়ে গেল আমার সেদিন।’’

অভিনয় রীতি

অভিনয় ধারায় তিনি আমূল পরিবর্তনের চেষ্টা করলেন। পুরনো যুগের ‘সেনসেসেনাল’ এবং ‘ইমোশনাল’ অভিনয় রীতিকে তিনি বর্জন করলেন। অভিনয়ে ‘ইনটেলেক্ট’ বা মননশীলতা তিনিই প্রথম বাংলা থিয়েটারে নিয়ে এলেন। আগের যুগে অর্ধেন্দুশেখরের অভিনয়ে যার সূত্রপাত হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। শিশিরকুমার ভাবাবেগ দিয়ে চরিত্র প্রকাশ না করে যুক্তি ও মননশীলতা দিয়ে চরিত্র সৃষ্টির দিকেই জোর দিলেন। চরিত্রটিকে বুঝে নিয়ে তার অন্তর্ধর্মকে প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বুদ্ধিবৃত্তির ওপর জোর দিলেন। যে অর্থে চরিত্র-সৃষ্টি কথাটি ব্যবহৃত হয়, শিশির সেই আধুনিক অর্থেই চরিত্রকে স্বাভাবিকতার পর্যায়ে নিয়ে এসে নিজের মতো করে তাকে তৈরি করে নিতে পারতেন। তখন তা আর অভিনয় থাকতো না, হয়ে যেত সৃষ্টি। অভিনয়ের সঙ্গে নাটকের চরিত্রটিকে তিনি বিশ্লেষণ করে যেতেন। ফলে অন্তরে বাইরে একটা গোটা মানুষের চরিত্রকে মঞ্চের ওপর দেখতে পাওয়া যেত। ‘দিগ্বিজয়ী’ নাটকে ‘নাদিরশাহ’র ভূমিকায় তার অভিনয় দেখে ‘নাচঘর’ পত্রিকা লিখেছিল—‘‘শিশিরকুমারের আর্টের একটা মস্ত বিশেষত্ব হচ্ছে, একাধারে তা অভিনয় ও চরিত্র বিশ্লেষণ।’’

শিশিরকুমার নিজে তাই বড় অভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন। তার চেহারা, কণ্ঠস্বর, স্বরক্ষেপনের মাত্রাজ্ঞান, মঞ্চ ব্যবহারের দক্ষতা অসাধারণ ছিল। তার মতে, অভিনয়ের সময়ে চরিত্রের সঙ্গে ভাবাবেগে (Mood) একাত্ম হয়ে পড়া যায় না, কেননা অভিনেতাকে মঞ্চে সব সময়ে নিজের চরিত্র সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সব শিল্পীদের উপস্থিতি, আলো এবং মঞ্চোপকরণের দিকে নজর রাখতে হয়। তবেই ‘টোটাল এ্যাকটিং’ সম্ভব।

শিশিরকুমার নানা ধরনের চরিত্রের ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করতেন। কয়েকটি চরিত্র অভিনয় তো কিংবদন্তী হয়ে গেছে। যেমন, আলমগীর (আলমগীর), রাম (সীতা), রঘুবীর (রঘুবীর), চাণক্য (চন্দ্রগুপ্ত), সাজাহান ও ঔরঙ্গজেব (সাজাহান), নিমচাঁদ (সধবার একাদশী), জীবানন্দ (ষোড়শী), জয়সিংহ ও রঘুপতি (বিসর্জন), মধুসূদন (যোগাযোগ), রাসবিহারী (বিজয়া), মাইকেল (মাইকেল), নাদিরশাহ (দিগ্বিজয়ী), কেদার (বৈকুণ্ঠের খাতা), চন্দ্রবাবু (চিরকুমার সভা) প্রভৃতি নানাধরনের চরিত্রে তার অসামান্য অভিনয় সকলকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল।

দলগত অভিনয়

শুধু একক অভিনয় নয়; সব চরিত্রের পারস্পরিক আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়েই নাটকের চরিত্রগুলি এগিয়ে চলে। তাই অভিনয়ে অভিনেতাদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহযোগ্যতার অভিনয় সামগ্রিক মাত্রা পায়। বাংলা থিয়েটারে অভিনয়ে এই ‘Team-work’ তৈরির প্রচেষ্টা শিশিরকুমারই প্রথম করেন।

তাছাড়া বহু চরিত্রকে একসঙ্গে মঞ্চে এনে সবাইকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে নিয়ে যে ‘টোটালিটি’ সৃষ্টি করা যায়, শিশিরকুমার তা দেখালেন। প্রয়োজনে তিনি দর্শকদেরও এর সঙ্গে জড়িয়ে নিতেন। ‘সীতা’র যেমন শেষ দৃশ্যে তিনভাগে মঞ্চকে ভাগ করে প্রায় পঞ্চাশাধিক অভিনেতাকে দেখানো হয়েছিল। এমন সুশৃঙ্খল জনতার দৃশ্য ও তার অভিনয় বাংলা থিয়েটারে পূর্বে হয়নি। শেষ রক্ষার শেষ দৃশ্যে তিনি থিয়েট্রিক্যাল ‘ইনটিমেসি’ সৃষ্টির জন্য মঞ্চ ও প্রেক্ষাগৃহের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন। অভিনেতারা মঞ্চ থেকে নেমে এসে গদাইচন্দ্রের বিয়ের নেমন্তন্ন করতেন দর্শকদের এবং শেষে গানে সবাইকে গলা মেলাতে বলতেন।

তাই বলা যায় থিয়েটার সম্পর্কিত সামগ্রিক ধ্যানধারণায় তিনি ছিলেন এ যুগের মধ্যে আশ্চর্যরকম ব্যতিক্রম। অভিনেতা হিসেবে, পরিচালক হিসেবে আধুনিক থিয়েটার সম্পর্কিত ভাবনা চিন্তা তার মধ্যেই সচেতনভাবে দেখা গিয়েছিল। নাটককে দৃশ্যপটকে, অভিনয়কে, শব্দকে, সব কী করে একসঙ্গে নাট্যের মধ্যে ব্যবহার করতে হয়, তার শিক্ষা পরবর্তী নাট্যপ্রজন্ম তার কাছ থেকে পেয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যপ্রযোজক ও অভিনেতা শম্ভু মিত্রের মন্তব্য উদ্ধার করি—“তিনিই (শিশির ভাদুড়ি) আমাদের প্রথম নির্দেশক। এ বাংলাদেশের, আমার অনুমানে সমগ্র ভারতবর্ষের, প্রথম নির্দেশক, যিনি মঞ্চের ছবি কল্পনা করেছেন। যিনি আলো, দৃশ্যপট, অভিনয় দিয়ে থিয়েটারের একটা সামগ্রিক রূপ প্রথম এদেশে এনেছিলেন।

এই প্রসঙ্গে উৎপল দত্তের সংযত মন্তব্য স্মরণযোগ্য—‘‘সে যুগের থিয়েটারের অভিনয়ের যা কিছু ভাল সব শিশির ভাদুড়িতে এসে সংঘবদ্ধ হয়েছে, সংহত হয়েছিল। ‘মঞ্চ, আলো এবং আবহের সমন্বিত ব্যবহারে থিয়েটারকে গভীরতর মাত্রা দেবার বাস্তবায়ন ঘটল শিশিরকুমারেই প্রথম।’’

শিশিরকুমারের সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা

শিশিরকুমারের সময়ে হাতের কাছে একমাত্র ক্ষীরোদপ্রসাদ ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠিত নাট্যকার ছিলেন না। তিনি নিজেও নাটক রচনা করেননি। একে তাঁকে দিয়ে তার নাটক লিখিয়ে নিতে হতো। ফলে প্রায়ই ভালো নাটক তিনি পেতেন না। যা পেতেন সেগুলিকেই ঘষে মেজে তাকে দাঁড় করাতে হতো। সেই কারণেই তিনি পূর্ববর্তী নাট্যকারদের অনেক নাটক বারবার অভিনয় করেছেন। প্রয়োজনে সেগুলিকে পালটে নিয়েছেন। গিরিশের ‘জনা’ করতে গিয়ে নাট্যকারের ‘ফেবারিট’ চরিত্র বিদুষককে তিনি বাদ দিয়ে অভিনয় করতেন (যদিও বেশ কয়েকটি অভিনয়ের পর আবার বিদূষক চরিত্র রেখেছিলেন) এবং স্বভাবতই এযুগে অচল বলে শেষ দৃশ্যে ‘ক্রোড়-অঙ্কটি’কে বর্জন করতেন।

হাতের কাছে ভালো নাটক বা নাট্যকার না পাওয়াতে তিনি তার সময়ের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের অনেক উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে (কখনো নিজে দিয়েছেন, কখনো বা এর-তার সাহায্যে লিখিয়ে নিয়েছেন। অভিনয় করেছেন। এইভাবে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নাট্যরূপও তাকে অভিনয় করতে হয়েছে।

শিশিরকুমারই পূর্ণ মর্যাদায় রবীন্দ্রনাথের নাটক এবং উপন্যাসের নাট্যরূপকে পেশাদার মঞ্চে অভিনয় করেছেন। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে নাটকের অনেক অংশ পরিবর্তন করিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ শিশিরকুমারের নাট্য ভাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসবশত তার নাটকের পরিবর্তন করতে দ্বিধা করেননি। ‘গোড়ায় গলদ’-কে এইভাবে শেষ রক্ষা, ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’-কে এইভাবে চিরকুমার সভায় পরিবর্তন করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলির তিনি অভিনয় উপযোগী সম্পাদনা রেছেন, গান বাদ দিয়েছেন, কিংবা নতুন গান সংযোজন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ শিশিরকুমারকে সানন্দে তাঁর অনুমতি দিয়েছেন।

গিরিশ, ক্ষীরোদপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলালের বেশ কয়েকটি নাটক তিনি অভিনয় করেছেন। এঁরা প্রতিষ্ঠিত এবং ক্ষীরোদপ্রসাদ ছাড়া অন্য দুজন তখন জীবিত নেই। তিনি জীবিত আর যাদের দিয়ে নাটক লিখিয়েছেন, তাদের মধ্যে তারাকুমার মুখোপাধ্যায়, যোগেশ চৌধুরী, নিতাই ভট্টাচার্য, তুলসী লাহিড়ী, জিতেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, জলধর চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি সকলেই শিশিরের ঘনিষ্ঠ। তারা কেউ এমন উচ্চস্তরের নাট্যকার ছিলেন না বা পরবর্তীকালে নাট্যকার হিসেবে অসামান্য সাফল্যও পাননি। নতুন ভালো নাট্যকার তিনি তৈরি করে নিতে পারেননি বা নতুন নাট্যকারদের দিয়ে পরিবর্তিত সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর নাটক লিখিয়ে নিতে পারেননি। আর পুরনো নাট্যকারদের মধ্যে গিরিশ, অমৃতলাল, দীনবন্ধু, ক্ষীরোদপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল—এঁদের প্রচলিত নাটকগুলিই করেছেন। এই প্রসঙ্গে তার বিখ্যাত রসিকতা—ভালো নাটক না পেয়ে মঞ্চে তাঁকে সারাজীবন ‘ঘুঘুবীর’ (রঘুবীর), ‘হালুমগীর’ (আলমগীর) ও ‘বাঁশবেহারী’ (রাসবিহারী: বিজয়া) অভিনয় করে যেতে হয়েছে।

ব্যতিক্রম জীবিত রবীন্দ্রনাথের নাটক। সৎসাহসের সঙ্গে তিনিই প্রথম পেশাদারি মঞ্চে যথার্থভাবে রবীন্দ্রনাটকের ও নাট্যরূপের অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু তার কমেডি বা প্রহসন ছাড়া অন্য কোনো নাটকে সাফল্য লাভ করতে পারেননি। ‘তপতী’র অকল্পনীয় ব্যর্থতার পরে তিনি আর তেমন উৎসাহের সঙ্গে রবীন্দ্র নাটকের অভিনয়ের ব্যবস্থা করেননি। তার পরিকল্পিত ‘রক্তকরবী’ বা ‘ঘরে বাইরে’র নাট্যরূপের অভিনয়ের সঙ্কল্প তিনি ত্যাগ করেন।

নাট্যকার যেমন তৈরি করতে পারেননি, তেমনি নতুন যুগচেতনার উপযোগী নাট্যবিষয়ও তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বাংলায় উপন্যাসে গল্পে, কবিতায় নানা বিষয়ের ও আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছিল এবং তার ফলে বাংলা কথাসাহিত্য ও কবিতার জগতে অসামান্য ব্যাপ্তি ও গভীরতা এসেছিল। বাংলা নাটকে সেই পরিবর্তন দেখা যায়নি। প্রথম থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ অবধি (১৯১৪-১৯৪৫) শিশিরকুমারের নাট্যজগতের স্বর্ণসীমা। অথচ এই সময়ে পেশাদারি মঞ্চ থেকে কোনো ভালো নাট্যকার উঠে আসেনি বা নাটক সৃষ্টি হয়নি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সারা পৃথিবীতে যে হতাশা, জীবনযন্ত্রণা মানুষকে জীবন সম্বন্ধে ভাবিয়ে তুলেছিল, তারই প্রকাশ প্রবন্ধে, কাব্যে ফুটে উঠেছিল। কেউ ১৯ শতকীয় জীবন ভাবনাচক্রে আবর্তিত হতে চাননি। এরা তথাকথিত জীবনের অপর পৃষ্ঠা দেখতে চেয়েছিলেন। নতুন যুগের সাহিত্যে তাই সাধারণ ও অন্ত্যজ মানুষ (বর্ণ ও অর্থগত দিক দিয়ে) তার দুঃখ দারিদ্র, বিকৃতি, ব্যভিচার, জড়ত্ব, কুসংস্কার, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, বাঁচবার তাগিদ ও লড়াই—সবকিছু নিয়ে হাজির হয়েছে। অথচ এই সময়ের বাংলা নাটকে সে পরিবর্তন ঘটলো না। এই সময়কালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ও প্রযোজক শিশিরকুমার। এ দায়ভাগ তাঁকে গ্রহণ করতেই হবে।

নাট্য প্রযোজনায় অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তা সত্ত্বেও বাংলা নাট্যাভিনয়ের আমূল পরিবর্তন তিনি করতে পারেননি। এজন্যে তাঁর আক্ষেপ ছিল। নিজের মতো একটি থিয়েটার তাই তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পরাধীন দেশে তা সম্ভব হয়নি। স্বাধীন দেশেও পাননি। সারাজীবন ভবঘুরের মতো (নিজেকে বলতেন ভাড়াটে কেষ্ট) এর তাঁর থিয়েটার ভাড়া করে তাঁকে অভিনয় করতে হয়েছে। ফলে গতানুগতিক পেশাদার থিয়েটারের ব্যবস্থার মধ্যেই নাট্যপ্রযোজনা করে যেতে হয়েছে। একটি জীর্ণ প্রচলিত মঞ্চ ব্যবস্থা ও তার বিধি-ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক বিলি ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই তাঁকে নাটক করতে হয়েছে। প্রচলিত বিধিব্যবস্থার মধ্যে থেকেই তিনি পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। সংস্কারবাদী এই প্রচেষ্টার সীমাবদ্ধতার ফলে পদে পদে ব্যর্থ হয়ে মর্মপীড়া ভোগ করতে হয়েছে। প্রতিবাদে, অভিমানে, ব্যর্থতায় তিনি গর্জন করে উঠেছেন। প্রচলিত ব্যবস্থার খাঁচায় বন্দি শিশিরকুমারের সিংহ-গর্জন এখনো কান পাতলে শোনা যায়।

তাঁর নিজের জীবনাচরণও অনেকবার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। উজ্জ্বল ও অসংযত জীবনধারা তাঁকে সুস্থির শিল্পভাবনার পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে দেয়নি।

পেশাদার থিয়েটার চালাবার পেশাদারি মনোভাব তাঁর ছিল না। নাট্যমন্দিরে শেষ রাতের অভিনয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি স্বীকার করেছিলেন—“আমি থিয়েটারই করতে শিখেছি, ব্যবসা করতে শিখিনি।’’—ফলে থিয়েটারের প্রযোজনাগত দিক সামলাতে গিয়ে থিয়েটার-প্রতিষ্ঠানগত দিকে নজর দিতে পারেননি। তাই বহু নাটক ভালো চললেও তিনি বারবার আর্থিক দেনার দায়ে পড়ে থিয়েটার ছেড়ে দিয়েছেন, মানসিকভাবে বারবার বিচলিত হয়েছেন।

তাঁর সময়ই রবীন্দ্রনাথ শৌখিনভাবে যে প্যারালাল থিয়েটারের পরীক্ষা করছিলেন বাণিজ্যিক থিয়েটারের পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকে শিশিরকুমারের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। রবীন্দ্রনাথ নিজে সাধারণ রঙ্গালয় থেকে সরে থেকে নিজের মতো নিজের থিয়েটারে নিজের নাটক অভিনয় করেছেন। বাণিজ্যিক থিয়েটারের দায়ভাগ তাঁকে নিতে হয়নি। তবুও রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের মতো একটি থিয়েটার চেয়েছিলেন, যেখানে কলাজ্ঞানের সম্পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয়। শিশিরকুমারও জাতীয় নাট্যশালার নামে তাঁর নিজের এই রকম থিয়েটার চেয়েছিলেন যেখানে টাকা নয়, রসজ্ঞান লাভ হবে।

এরকম থিয়েটার রবীন্দ্রনাথ পাননি। শিশিরকুমারও পাননি। শিশিরকুমারের সার্থকতার উৎফুল্ল উচ্ছ্বাসধ্বনি এবং ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাসের হাহাকার বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসকে যুগপৎ গৌরওজ্জ্বল ও ভারাক্রান্ত করে রেখেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!