সংস্কৃত নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে শূদ্রকের অবদান আলোচনা কর।
নাট্যকার শূদ্রক ও মৃচ্ছকটিক
নাট্যকার শূদ্রক সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে একটি প্রহেলিকা। প্রহেলিকা কারণ শূদ্রকের ব্যক্তিপরিচয়, জন্মপরিচয়, বাসস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে প্রায় কোনো তথ্য জানা যায় না। অনেকেই অনুমান করেন খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে বাণভট্টের যুগে শূদ্রক দক্ষিণ ভারতের একজন সম্মানীয় রাজা ছিলেন। সম্ভবত শুদ্রবংশীয় ছিলেন বলেই তাঁর নাম শূদ্রক। কিন্তু এই বিষয়ে সঠিক এবং পরিচ্ছন্ন কোনো এঁতিহাসিক প্রমাণ অদ্যবধি পাওয়া যায়নি। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে শূদ্রক বিখ্যাত তাঁর ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের জন্য।
প্রকারভেদ
নাটকের প্রকারভেদ অনুসারে ‘মৃচ্ছকটিক’ হল প্রকরণ। বিশ্বনাথ কবিরাজ তাঁর ‘সাহিত্যদর্পণ’ গ্রন্থে প্রকরণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যেমন প্রকরণের কাহিনি হবে কাল্পনিক, মূল রস হবে শৃঙ্গার। প্রকরণের নায়ক হবেন বিপ্র, অমাত্য বা বণিক। নায়িকা হবেন কুলনারী বা বেশ্যা। ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে এই বিশেষত্বগুলি প্রায় সব দেখা যায়। এই নাটকের নায়ক বণিক, নায়িকা গণিকা, কাহিনি কাল্পনিক।
নামকরণ
‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের নামকরণে ঈষৎ বিশেষত্ব আছে। সাধারণত সংস্কৃত কাব্য ও নাটকে নামকরণ হয় নায়ক-নায়িকার নামে। যেমন—‘মালতী-মাধব’, ‘শকুস্তলা’ ইত্যাদি। কিন্তু ‘মৃচ্ছকটিক’-এ এই ধারা অনুসরণ করা হয়নি। ‘মৃচ্ছকটিক’ শব্দটি এসেছে ‘মৃৎ-শকটিক’ থেকে, যার অর্থ মাটির খেলনাগাড়ি। এই নামকরণ একটি বিশেষ রূপককে অনুসরণ করেছে, যা নাটকের ষষ্ঠ অংকে একটি গৌণ ঘটনার মধ্যে বিবৃত হয়েছে। এমন রূপক-সংকেতধর্মী নামকরণ সংস্কৃতসাহিত্যে বিরল।
কাহিনি
‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের প্রেক্ষাপট উজ্জয়িনী নগর। নাটকের নায়ক চারুদত্ত, একজন সৎচরিত্র, সুশীল, উদার হৃদয় মানুষ। চারুদত্ত পেশায় বণিক। একসময় বহু অর্থ উপার্জন করেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের বিপর্যয়ে ঘোর অর্থদৈন্যে পতিত হন। কামদেবের মন্দির সংলগ্ন উদ্যানে চারুদত্তকে দেখে মুগ্ধ হন নাটকের নায়িকা বসন্তসেনা। বসন্তসেনা পরমাসুন্দরী, বিস্তবতী এবং পেশায় পণ্যাঙ্গনা। কিন্তু বসন্তসেনার চারুদত্তের প্রতি আকর্ষণ দৈহিক নয়, মানসিক। কিন্তু মিলনের পথ খুব সহজ নয়। বসন্তসেনার অনুরাগীর সংখ্যা উজ্জয়িনীতে বড়ো কম নয়। তাদের মধ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিও প্রচুর, অন্যতম হলেন রাজশ্যালক শকার। ফলে শকার প্রমুখের বিরূপতা অতিক্রম করে চারুদত্ত এবং বসন্তসেনার মিলন ক্রমশ কঠিনতর হয়ে ওঠে। তাছাড়া এই সম্পর্ক সামাজিকভাবে স্বীকৃতও নয়। একদিকে চারুদত্ত বিবাহিত, পুত্রের জনক। অন্যদিকে বসন্তসেনা বারাঙ্গনা। ফলে একজন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে পতিতা এক নারীর সম্পর্ককে সমাজ খুব ভালো চোখে দেখেনি। তবু নাটকের শেষে বহু বাধাবিপ্ন অতিক্রম করে চারুদত্ত এবং বসন্তসেনার মিলন ঘটে। শুধু তাই নয়, চারুদত্ত এবং বসন্তসেনাকে কাহিনির কেন্দ্রে রেখে উজ্জয়িনী নগরেও ব্যাপক সমাজবিপ্লবৰ ঘটান নাঢ্যকার। প্রজাদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে দুঙ্কৃতকারা রাজা পালক এবং পালকের সহচরবৃন্দ ক্ষমতা হারান। ফলে মৃচ্ছকটিক নিছক নায়ক-নায়িকার প্রণয়, সম্পর্ক, বিরহের কাহিনি নয়, তা সাধারণ মানুষকেও সহানুভূতির সঙ্গে চিত্রিত করে। নাটকের এই ঘরানা সংস্কৃতসাহিত্যের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। যে কারণে সুকুমারী ভট্টাচার্যের মতো বহু প্রথিতযশা সমালোচকই ‘মৃচ্ছকটিক’-কে সংস্কৃতনাটকের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দিয়েছেন।
শূদ্রকের নাট্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য
- তথাকথিত সংস্কৃত নাটক এবং কাব্যে যে ধরনের দৈবশক্তির প্রভাব দেখা যায় ‘মৃচ্ছকটিক’-এ তা নেই। নাট্যকার শূদ্রক সচেতনভাবেই সমস্ত ধরনের অলৌকিকত্ব এবং দেবদেবীর প্রাদুর্ভাবকে নাটকে এড়িয়ে গেছেন। ‘মৃচ্ছকটিক’-এ সংঘাত, সমস্যা ও তার নিরসন সবই ঘটেছে মানবিক জগতে। এই নাটকে অন্যায়-অমঙ্গলের দায় মানুষের। রাজা পালক, রাজশ্যালক শকার ইত্যাদি ক্ষমতাবান মানুষ বিবিধ পাপাচার করে গেছেন। আবার সেই অন্যায়ের প্রতিকারও করেছে মানুষই। আর্যক, শর্বিলক, দরুক, রেভিল ইত্যাদি সাধারণ প্রজা রাষ্ট্বিপ্নবের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়েছে। দৈবশক্তির এই অনুপস্থিতি ‘মৃচ্ছকটিক’-কে আলাদা মাত্রা দান করেছে।
- সংস্কৃত নাটকে সাধারণত টাইপ চরিত্রের রমরমা দেখা যায়। অর্থাৎ সেখানে আগে থেকেই ঠিক থাকে চরিত্ররা কেমন হবে। নায়ক মানেই ধীরোদাত্ত, ধীরোদ্ধত, ধীর ললিত। বিদূষক মাত্রি হাস্যকর। নায়িক মাত্রেই রূপের আঁটি। কিন্তু ‘মৃচ্ছকটিক’-এ জীবনবোধের গভীর মূল্যায়ন দেখতে পাওয়া যায়। নাটকের নায়ক চারুদত্ত বিবাহিত এবং দরিদ্র। নায়িকা বসন্তসেনা পতিতা। মৈত্রেয় প্রচলিত বিদূষকের মতো হাস্যস্পদ নয়, বরং চারুদত্তের প্রতি সহানুভূতিশীল। এইসব চরিত্র বিবিধ টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে নাটকের উপসংহারে সম্পূর্ণতা পায়। টাইপ চরিত্র থেকে বহুমুখী চরিত্রের দিকে এই যাত্রা ‘মৃচ্ছকটিক’-এর জরুরি বৈশিষ্ট্য।
- ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে বিভিন্ন ধরনের মানুষের খোঁজ পাওয়া যায়। রাজা থেকে চণ্ডাল, শিশু থেকে বৃদ্ধ, ধনী থেকে নির্ধন, সজ্জন থেকে দুর্জন নানা ধরনের মানুষ হাস্যরস, কবিত্ব, মূল্যবোধ এবং বহুবিচিত্র ঘটনার সমাবেশ। সব মিলিয়ে সমাজ ও মানবজীবনের একটি বৃহৎ চালচিত্র, সজীব মানুষের একটি অফুরন্ত চিত্রশালা ধরা পড়ে ‘মৃচ্ছকটিক’-এ, যা অভূতপূর্ব।
- ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ঠ্য। যেহেতু বহুধরনের চরিত্র নাটকে দেখতে পাওয়া যায়, তাদের ভাষাও বিভিন্ন রকমের হয়। চারুদত্ত, আর্যক প্রমুখের মুখে শোনা যায় সাধু সংস্কৃত ভাষা। বসন্তসেনা, সূত্রধর, মদনিকা প্রমুখ কথা বলে শৌরসেনী প্রাকৃততে। মৈত্রেয়র বুলি প্রাচ্যা। সংবাহক, স্থাবরক, রদনিকা প্রমুখ কথা বলে মাগধী প্রাকৃততে। শকারের মুখে ব্যবহার করা হয় নিকৃষ্ট শাকারী ভাষা। এইভাবে ভাষার বিবিধ ব্যবহার ‘মৃচ্ছকটিক’-কে বহুমাত্রিকতা দান করেছে।
- এই নাটকে দাক্ষিণাত্যের নানান আচার এবং সংস্কারের দেখা মেলে। সেইসঙ্গে পাওয়া যায় দাক্ষিণাত্যের বিবিধ শব্দ। যেমন— কর্ণাটকলহ, বরগু-লম্বূক, সহ্যবাসিনী ইত্যাদি। এই দাক্ষিণাত্যের যোগ থেকে অনেকেই নাটকটির মূল হিসেবে দক্ষিণভারতকে চিহিনত করেছেন।
- তথাকথিত সংস্কৃত নাটকের মত ‘মৃচ্ছকটিক’-এর মূল সুর শৃঙ্গার নয়। বরং করুণ এবং হাস্যরসের আধিপত্য দেখা যায়। এছাড়া অলঙ্কার, রূপক এবং ভাষাবৈদগ্ধ্যের ঘনিষ্ট বিবৃতিতে নাট্যকার শুদ্রকের মুনশিয়ানা ধরা পড়ে।
Leave a Reply