//
//

বাংলা গদ্যের বিকাশে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান আলোচনা কর।

শ্রীরামপুর মিশন ও বাংলা গদ্য

বাংলা গদ্যের চর্চার ক্ষেত্রে শ্রীরামপুর মিশনের অবদান অনেকখানি। প্রধানত বঙ্গদেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্যই কলকাতার নিকটবর্তী হুগলির শ্রীরামপুরে এই মিশন প্রতিষ্ঠা করেন ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান মিশনারীরা। ইংরেজ শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনের কাজকর্মে এবং জীবিকার প্রয়োজনে শিক্ষার গুরুত্ব দ্রুতবেগে বাড়তে থাকে। ইংরেজরা শাসনকার্য পরিচালনার জন্য গদ্য চর্চা করতে থাকেন। বিশেষ প্রয়োজনবোধকে সামনে রেখেও মিশনারীরা লেখ্য গদ্যভাষা গড়ে তোলার যে প্রত্যক্ষ প্রয়াসে আত্মনিয়োগ করেছিলেন তাতে বাংলা গদ্যের উদ্ভব পর্ব স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের জন্য বঙ্গদেশে এলেন উইলিয়াম কেরি ও টমাস। পরে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে কেরীকে সাহায্য করার জন্য এসেছিলেন ওয়ার্ড, বানসন, গ্রান্ট ও মার্শম্যান প্রমুখ ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা। প্রথমে এঁরা কলকাতাকে প্রচার কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সেজন্য ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন (১০জানুয়ারী) ও শ্রীরামপুর মিশনের প্রেসের কাজ (মার্চ মাসে) আরম্ভ হয়। এই প্রেস থেকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ (১৮০১), কাশীদাসী মহাভারত (১৮০২) প্রথম মুদ্রিত হয়।

শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে উইলিয়াম কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড এই তিনজনের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে বাংলা গদ্যচর্চার জন্য। শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠার পর কেরী ও তার সহযোগীরা দেশীয় ভাষায় বাইবেল অনুবাদের কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। তারা মনে করেছিলেন একদিকে রামায়ণ ও মহাভারত ছেপে প্রকাশ করলে ও অন্যদিকে দেশীয় ভাষায় বাইবেল লিখে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করলে তারা হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হবে। তাই শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাংলাসহ প্রায় কুড়িটি ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করেছিলেন মিশনারীরা। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়েছিল। যে হিন্দুধর্ম ও সমাজ দীর্ঘকাল ধরে সুদৃঢ় ঐতিহ্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে, বহু আঘাত সহ্য করেও তা টলেনি, তাকে দুটি টেস্টামেন্টের অনুবাদের দ্বারা যে বিচ্যুত করা যায় না তা বোধ হয় কেরী প্রমুখ উপলব্ধি করতে পারেননি। তবুও বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিশেষত গদ্য ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসে এঁদের এবং এই মিশনের দান স্বীকার করতেই হয়।

শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ, প্রচার পুস্তিকা

পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ

শ্রীরামপুর মিশন বাংলা গদ্যে প্রথম পাঠ্যপুস্তক ব্যাকরণ, রামায়ণ ও মহাভারত মুদ্রণ করে প্রকাশ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কেরীর সংস্কৃত ব্যাকরণ, ব্যোপদেবের মুগ্ধবোধ, কোলব্রুকের সম্পাদনায় অমরকোষ প্রভৃতি। এছাড়া কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীদাসী মহাভারত প্রকাশ করে মিশনারীরা বাংলা ও বাঙালির উপকার করেছিলেন।

বাইবেলের অনুবাদ ও প্রচার পুস্তিকা প্রকাশ

মূলত উইলিয়াম কেরীর চেষ্টায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কাজ শুরু হওয়ার আগেই শ্রীরামপুর মিশন থেকে মঙ্গল সমাচার মতিউর রচিত Gospel of St. Mathews (১৮০০, ৭ ফেব্রুয়ারী মূল গ্রীক থেকে অনূদিত হয়। তারপর ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ বাইবেল ‘ধর্মপুস্তক’) প্রকাশিত হয়। এছাড়া খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধীয় বহু পুস্তক প্রণীত ও প্রচারিত হয়। এসব কাজে মিশনারীদের সাহায্য করেন রামরাম বসু। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই প্রায় আশিটি পুস্তক রচিত হয় ও সাত লক্ষ কপি বিতরিত হয়।

ইতিহাস-সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞান মূলক রচনার প্রকাশ

উইলিয়াম কেরীর যোগ্যতম সহকর্মী ছিলেন জশুয়া মার্শম্যান। সংস্কৃত রামায়ণের ইংরেজি অনুবাদে তিনি কেরীকে সাহায্য করেন। মার্শম্যান ইংরেজি ও বাংলা দু ভাষাতেই রচনা করেন ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ দুখণ্ড (১৮৩১), ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (১৮৪৮) ইত্যাদি। এছাড়া শ্রীরামপুর প্রেস স্কুল বুক সোসাইটি থেকে মুদ্রিত হয় লসন, পিয়ার্স, ওয়েঙ্গার, কিথ, বাটন প্রমুখদের রচনা।

শ্রীরামপুর মিশনের প্রধান পুরুষ কেরী বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত ও মারাঠী ভাষায় অভিজ্ঞ ছিলেন। তবে তার বাইবেলের অনুবাদে বাংলা ভাষা স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল হতে পারেনি। কেরী সাহেব অনুবাদের ক্ষেত্রে যে স্বচ্ছন্দ হতে পারেননি তার কারণ অনুবাদে ইংরেজি বাক্য গঠনের রীতি গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া নিকৃষ্ট তৎসম শব্দের বাহুল্য, জটিল ও আড়ষ্ট বাক্য গঠনরীতি, যতিস্থাপনে দুর্বলতা, পদান্বয়ের ত্রুটি কেরীর গদ্যানুবাদের প্রধান ক্রটি। কেরীর বাইবেলের অনুবাদের নমুনা—‘‘তখন ঈশ্বর বলিলেন দীপ্তি হউক স্বর্গের আকাশের মধ্যে দিবারাত্রি বিভিন্ন করিতেও তাহা হউক চিহ্ন ও কান ও দিবস ও বৎসর নিরুপণের কারণ। তাহারাও দীপ্তি হউক স্বর্গের আকাশে উজ্জ্বল করিতে পৃথিবীর উপর। তাহাতে সেই মত হইল।”

শ্রীরামপুর মিশনের গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য

শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত অনুবাদের ক্ষেত্রে গদ্যের এমন কোন বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় না। তবুও বাংলা গদ্যের উদ্ভবের ক্ষেত্রে এই ধরনের অনুবাদ পরবর্তী পর্যায়ের ভিত্তিভূমি হিসাবে সূচিত হয়েছে। কেরী মূলত আক্ষরিক অনুবাদ করেছে। সেজন্য বাইবেলের অনুবাদের ভাষা দুর্বোধ্য ও অমসৃণ। অনুবাদের মধ্যে রয়েছে ইংরেজি ভাষার অন্বয়রীতির প্রভাব। এমনকি অন্বয়রীতিও যথার্থ নয়। অতিরিক্ত সংস্কৃত তৎসম শব্দের প্রাধান্য গদ্যের দুর্বোধ্যতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আদর্শ গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য শ্রীরামপুর মিশন প্রকাশ করতে না পারলেও শ্রীরামপুর মিশনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট। যেমন—

  • শ্রীরামপুর মিশনের প্রতিষ্ঠা মূলত ধর্মপ্রচারের জন্য এবং সেই উদ্দেশ্যেই তারা গদ্য রচনা করেছিলেন। তাই খ্রিস্টানদের প্রসঙ্গকে দেশবাসীদের বোধগম্য ও উপভোগ্য করে তোলার তাগিদে তারা গদ্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। ফলে তাঁদের অন্তরের কৌতূহল ভাষার মৌল প্রবণতার অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছিল। তাদের এই চেষ্টাই পরবর্তী বাংলা গদ্যের মুক্তির সম্ভাবনাকে গতিদান করেছিল।
  • পুরাতন বাংলা কাব্য, মূল সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ, রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা প্রকাশের ফলে এবং ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হওয়ার ফলে তা দেশীয় মানুষদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।
  • মুদ্রাযন্ত্রের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আধুনিক যুগের বাঙালি জীবন ও সংস্কৃত প্রভাবিত হতে পেরেছে।
  • বাঙালির মধ্যে পরোক্ষ আত্মসচেতনতা বৃদ্ধির সুযোগ করে দেবার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব যথেষ্ট।
  • গোপাল হালদার শ্রীরামপুরের মিশনের গুরুত্ব সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন—“সত্যই যদি বাইবেল স্বচ্ছন্দ বাঙলায় অনূদিত হত তাহলে বাঙলা লেখকের ভাব-জগতের মধ্যে হয়ত যীশুর উক্ত কথা বা গল্প ও ধারণা এমন বেমানান ঠেকত না। কারণ, আরবদের আরব্য রজনী’র মত য়িহুদীদের ওল্ড টেস্টামেন্টও পৃথিবীর একখানা মহৎ গ্রন্থ, আর যীশুর কাহিনী সবল, সরল ও অপূর্ব ভাব-সম্পদ। সে রস খাঁটি বাঙলায় পরিবেশিত হলে সাহিত্য হত।” (বাঙালা সাহিত্যের রূপরেখা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৯, ১৯৮৭)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!