//
//

সংস্কৃত রামায়ণের বিষয় সম্পর্কে আলোচনা কর।

রামায়ণ

‘অথ ভগবান্ প্রাচেতসঃ প্রথমং মনুষ্যেষু শব্দব্রহ্মণস্তাদৃশং বিবর্তমিতিহাসং রামায়ণং প্রণিনায়’—‘উত্তররামচরিতে’ ভবভূতি শুধু বাল্মীকিকেই আদিকবি বলেননি, কালিদাসও বাল্মীকিকেই আদিকবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই রামায়ণ ‘আদি কাব্য’, বাল্মীকি ‘আদি কবি’। বাল্মীকির কবিত্বলাভের বিবরণটিও সুন্দর। একটি বনে ক্রৌঞ্চ ও ক্রৌঞ্চী খেলা করছিল, ক্রৌঞ্চটি একটি ব্যাধের শরে নিহত হলে ক্রৌঞ্চী সেই দুঃখে যখন কাতর তা দেখে মহর্ষির অন্তরে করুণার সঞ্চার হল। উদ্বেলিত শোকভরে তিনি অতর্কিতে বলে ফেললেন—

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বম গমঃ শাশ্বতী সমাঃ।

যং ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধী কামমোহিতম্।।

(বালকাণ্ড)

 —ওহে নিষাদ! যেহেতু তুই ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে কামমোহিত অবস্থায় বধ করলি, সেইজন্য অনন্তকাল তুই প্রতিষ্ঠালাভ করতে পারবি না।

একথা বলেই তিনি ভাবলেন, এ আমি কি বললাম, ‘কিমিদং ব্যাহৃতং ময়া’। শিষ্যকে ডেকে বলেন, শোকের আবেগে এই যে পাদবদ্ধ, সমাক্ষরবিশিষ্ট, লয়সমন্বিত বাক্য উচ্চারিত হল, তা ‘শ্লোক’ নামে খ্যাত হোক। ব্রহ্মাও এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন—‘শ্লোক এবাস্ত্বয়ং বদ্ধ্যে নাত্র কার্যা বিচারণা’—সংশয় করো না, তোমার এই ছন্দোবদ্ধ বাক্য শ্লোক নামে বিখ্যাত হবে।

রামায়ণের বিষয়

বাল্মীকি রামায়ণ সাতকাণ্ডে, পাঁচশ সর্গে ও চব্বিশ হাজার শ্লোকে গ্রথিত। রামায়ণের সাতটি কাণ্ড হল—বালকাণ্ড, অযোধ্যাকাণ্ড, অরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, সুন্দরকাণ্ড, যুদ্ধকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড। রামায়ণের বালকাণ্ডে তাই বলা হয়েছে—

চতুর্বিংশৎ সহস্রাণি শ্লোকানামুক্তবান ঋষিঃ।

তথাসর্গশতা পঞ্চষট্‌কাণ্ডাণি তথোত্তরম্।।

রামায়ণের বালকাণ্ডের সূচনায় প্রথম চার সর্গে বাল্মীকির কবিত্বলাভের বর্ণনা, পঞ্চম সর্গ থেকে অযোধ্যা নগরীর ও রাজা দশরথের বিবরণ নিয়ে মূল কাহিনীর আরম্ভ। এই কাণ্ডে আছে প্রধানত ঋষ্যশৃঙ্গের উপাখ্যান, রামাদির জন্ম, তাড়কা বধ, বিশ্বামিত্র-বশিষ্ঠের কাহিনী, অহল্যা-মোচন, হরধনুভঙ্গ, রামসীতার বিবাহ ও পরশুরামের দর্পচূর্ণ প্রভৃতি কাহিনী।

অযোধ্যাকাণ্ডের প্রধান ঘটনা— রামাভিষেকের আয়োজন, মন্থরার মন্ত্রণা, রামের নির্বাসন, রাম-ভরত মিলন, জাবালির নাস্তিকতা, রামচন্দ্রের পাদুকাভিষেক ও রামের চিত্রকূট ত্যাগ। অভিষেকের আনন্দোজ্জ্বল ক্ষণে রামের নির্বাসন এক মর্মান্তিক কাহিনী। এই কাহিনী অশ্রুবিধৌত।

অরণ্যকাণ্ডের ঘটনাগুলি যেমন ভয়াবহ, তেমনি করুণ। এই কাণ্ডের প্রধান উপজীব্য বিষয়—শূর্পনখা সংবাদ, মায়ামৃগ কথা, সীতাহরণ, জটায়ু বধ, রামবিলাপ ও শবরীর স্বর্গারোহণ।

কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের অন্যতম ঘটনা— রাম-সুগ্রীবের মৈত্রী, বালিবধ, তারাবিলাপ ও সীতা অন্বেষণে হনুমানের সাগর লঙ্ঘনের উদ্যোগ।

সুন্দরকাণ্ডের প্রধান বর্ণনীয় বিষয় লঙ্কার বর্ণনা, অশোক বনে শোকার্তা সীতার চিত্র, সীতার সঙ্গে হনুমানের সাক্ষাৎ লঙ্কাদাহ ও সীতার অভিজ্ঞানসহ হনুমানের প্রত্যাবর্তন। এই কাণ্ডের সূচনা হয়েছে হনুমানের সাগর লঙ্ঘন বৃত্তান্ত দিয়ে।

যুদ্ধকাণ্ডের বিষয় যেমন ঘটনাবহুল তেমন ভয়ঙ্কর। একদিকে বানরসৈন্যের জয়ধ্বনি অন্যদিকে রাক্ষসবংশের হুঙ্কার ও আর্তনাদ। রামসেনার সমুদ্র-দর্শন, রামের সঙ্গে বিভীষণের মৈত্রী, নলের সেতুবন্ধন, কুম্ভকর্ণ ও রাবণের নিধন এই কাণ্ডের প্রধান ঘটনা। লক্ষ্মণ যখন শেলাহত হয়ে ভূতলে পতিত হলেন তখন রামচন্দ্র আহত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে যা বলেছিলেন তা প্রবাদে পরিণত হয়েছে—

দেশে দেশে কলত্রাণি দেশে দেশে চ বান্ধবাঃ।

তং তু দেশং ন পশ্যামি যত্র ভ্রাতা সহোদরঃ।।

(যুদ্ধ কাণ্ড)

অর্থাৎ দেশে দেশে স্ত্রী মেলে, বান্ধবও মেলে, কিন্তু এমন দেশ নেই যেখানে সওদর ভ্রাতা মিলতে পারে।

উত্তরকাণ্ডের বিষয় রামচন্দ্রের উত্তরজীবনের কাহিনী। সীতার বনবাস, কুশ ও লবের জন্ম, শত্রুঘ্নের লবণ বধ, রাম কর্তৃক শম্বুকের শিরচ্ছেদ, রামচন্দ্রের অশ্বমেধ যজ্ঞ, লবকুশের রামায়ণ গান, সীতার পাতাল প্রবেশ, লক্ষ্মণ বর্জন এবং রামের মহাপ্রস্থান। প্রসঙ্গক্রমে এই কাণ্ডে বিভিন্ন পুরাবৃত্ত বর্ণিত হয়েছে। যেমন রক্ষোবংশের ইতিহাস, রাবণের দ্বিগ্বিজয়, দণ্ডকারণ্যের ইতিহাস, বানরবংশের পূর্ববৃত্তান্ত ইত্যাদি। অশ্বমেধ যজ্ঞে দীক্ষার জন্য স্বর্ণসীতার পরিকল্পনা এই কাণ্ডের উল্লেখযোগ্য বিষয়। তাছাড়া সীতার পাতাল প্রবেশের ঘটনা ও সীতার অন্তর্ধানে রামচন্দ্রের শোকাকুল অবস্থার বর্ণনা বেশ মর্মস্পর্শী। অবিস্মরণীয় সী, সেই উক্তি—

মনসা কর্মণা বাচা যথা রামং সমৰ্চয়ে।

তথামে মাধবী দেবী বিবরং দাতুমর্হতি।।

সীতার নির্বাসন থেকে রামচন্দ্রের মহানির্বাণ পর্যন্ত ঘটনা সমূহ করুণ রসের, নির্ঝর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!