সর্বনামের সংজ্ঞাসহ বিভিন্ন ভাগের বর্ণনা দাও।
সর্বনাম
বার বার বিশেষ্য পদের পুনরুক্তির পরিবর্তে যে পদ ব্যবহৃত হয়, তাকে বলে সর্বনাম পদ।
নামপদের পরিবর্তে ব্যবহৃত পদকেই বলা হয় সর্বনাম পদ। নামপদের মধ্যে প্রধান হল বিশেষ্য পদ। তার পরিবর্তে যে পদ ব্যবহৃত হয়, তাইই সর্বনাম পদ। যেমন: রতন একজন কৃষক। রতন দরিদ্র। রতনের আছে সামান্য এক টুকরো জমি আর আছে। মান্ধাতার আমলের হাল বলদ। রতন মান্ধাতার আমলের হালবলদ দিয়ে জমি চাষ করে। জমি থেকে রতন ধান ফলায়। সেই ধানে রতনের সংসার চলে না।
বাক্যগুলিতে ‘রতন’, ‘মান্ধাতার আমলের হালবলদ’, ‘জমি’, ‘ধান’— এই নামপদগুলি একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে। তাতে অংশটি শ্রুতিকটু লাগছে। পুনরাবৃত্তি-জনিত সেই শ্রুতিকটুতা পরিহার করবার জন্যে যদি এইভাবে বলা যায়— রতন একজন কৃষক! সে দরিদ্র। তার আছে সামান্য একটুকরো জমি আর আছে মান্ধাতার আমলের হালবলদ। সে তা দিয়ে জমি চাষ করে। তা থেকে সে ধান ফলায়। তাতে তার সংসার চলে না। তাহলে আর শ্রুতিকটু লাগে না। কিন্তু বাক্যগুলিতে ‘রতন’, ‘মান্ধাতার আমলের হালবলদ’ ‘জমি’ ও ‘ধান’— এদের বদলে যথাক্রমে ‘সে’ [তার], ‘তা’ এবং ‘তার’ ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলি নামপদের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে বলে এদের বলা হয় সর্বনাম পদ।
সর্বনামের প্রকারভেদ
সর্বনাম পদ নানা প্রকারের। ব্যক্তিবাচক, নির্দেশক, সাপেক্ষমূলক, সাকল্যবাচক, প্রশ্নবাচক, অনির্দেশক, আত্মবাচক, ব্যতিহারিক এবং সম্বন্ধবাচক বা সংযোগমূলক।
১. ব্যক্তিবাচক সর্বনাম পদ [Personal Pronoun]
যে সর্বনাম পদে কোন ব্যক্তিকে নির্দেশ করে, তাকে বলে ব্যক্তিবাচক সর্বনাম পদ। যেমন: আমি, তুমি ও সে থেকে জাত বিভিন্ন বিভক্তি ও বচনের পদ। যেমন: আমি, আমরা, আমাকে, আমার, আমাদের, আমাতে, আমাদিগেতে, তুমি, তোমরা, তোমাকে, তোমার, তোমাদের, তোমাদিগকে, তোমাতে, তোমাদিগেতে, সে, তারা, তাহারা, তাকে, তাহাকে, তাহাদিগকে, তাহার, তার, তাহাদের, তাদের, তাহাতে, তাহাদিগেতে, তুই, তোরা, তোকে, তোর, তোদের ইত্যাদি। ব্যক্তিবাচক সর্বনাম পদ আবার দু’প্রকারের— সমার্থক ও তুচ্ছার্থক।
সমার্থক সর্বনাম
সম্ভ্রম বোঝাতে সমার্থক সর্বনাম ব্যবহৃত হয়। যেমন: আপনি, আপনারা, আপনাকে, আপনাদের, আপনাদিগকে, আপনার, আপনাতে, আপনাদিগেতে; তিনি, তাঁকে, তার, তাদের। “আপনি, জানেন না, এ ঋষিকুমার নয়। ‘তিনি’ ছিলেন তার মুরুব্বি।” আপনি যে এদেশ?’
তুচ্ছার্থক সর্বনাম
যে ব্যক্তিবাচক সর্বনাম পদে কাউকে তুচ্ছভাবে বর্ণনা করা হয়, তাকে তুচ্ছার্থক সর্বনাম বলে। যেমন: তুই তোকে, তোর, তোদের। তুই মরিতে এত ভীত কেন?
২. নির্দেশক সর্বনাম পদ [Definite Pronoun]
যে সর্বনাম পদে কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে নির্দেশ করা হয়, তাকে নির্দেশক সর্বনাম বলে। যেমন: এ, এই, সে, ঐ ইত্যাদি। নির্দেশক সর্বনাম আবার দু’প্রকারের: নৈকট্যসূচক ও দূরত্বসূচক।
নৈকট্যসূচক সর্বনাম
যে নির্দেশক সর্বনামে নৈকট্য সূচিত হয়, তাকে নৈকট্যসূচক নির্দেশক সর্বনাম বলা হয়। যেমন: ইনি, এ, ইহা ইত্যাদি। আমাদের রিপোর্টের মধ্যে এই কথাটাই বিশেষ করে উল্লেখ করা আছে। যাকে খুঁজছেন সে যে ‘এ’ নয় তার আমি জামিন হতে পারি। ‘ইনি’ হচ্ছেন রাজবিদ্রোহী।
দূরত্বসূচক নির্দেশক সর্বনাম
যে নির্দেশক সর্বনাম পদ দূরত্ব সূচিত করে, তাকে দূরত্বসূচক নির্দেশক সর্বনাম বলা হয়। যেমন: উনি, ওই, উহা। তুমি যদি আমাকে বর্শা মারিতে পারিতে তাহা হইলে আমি ‘উহা’ বাম হস্তে ধরিতাম। ‘ওই’ কুটিরে তাহারা থাকে। ‘উনি’ কি এখন তপোবনে আছেন?
৩. সাপেক্ষমূলক সর্বনাম পদ [Correlative Pronoun]
যে সর্বনাম পদে পারস্পরিক আপেক্ষিকতা বোঝায়, তাকেই বলে সাপেক্ষমূলক সর্বনাম। অর্থাৎ, পারস্পরিক নির্ভরশীল সংযোগবাচক সর্বনামই সাপেক্ষমূলক সর্বনাম। যেমন: যে—সে, যাহারা—তাহারা, যাহা—তাহা, যা—তা, যিনি—তিনি। ‘যে’ যায় লঙ্কায় ‘সে’ হয় রাবণ। দেহ ‘যাহা’ পায় ‘তাহা’ রাখিবার জন্য নহে । ‘যাহারা’ ঘুমাইতেছিল ‘তাহারা’ কিছুই জানিতে পারিল না।
৪. সাকল্যবাচক সর্বনাম পদ [Inclusive Pronoun]
যে সর্বনাম পদ সমষ্টিগতভাবে সকল ব্যক্তি, বস্তু বা ভাবের পরিবর্তে প্রযুক্ত হয়, তাকে বলা হয় সাকল্যবাচক সর্বনাম। যেমন: সব, সকল, সর্ব, উভয়, সবাই ইত্যাদি। ‘সব’ কথার ঠিকঠিক উত্তর দেয় কিন্তু তার নিজের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, আমি তো পঁয়তাল্লিশ নম্বরের। তারা মোর মাঝে ‘সবাই’ বিরাজে। ‘সর্ব’ খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ। ‘উভয়ে’ তরবারি নিষ্কাশিত করিলেন।
৫. প্রশ্নবাচক সর্বনাম পদ [Interrogative Pronoun]
যে সর্বনাম পদ কোন কিছু সম্প প্রশ্ন করবার জন্যে প্রযুক্ত হয়, তাকে প্রশ্নবাচক সর্বনাম পদ বলা হয়। যেমন: কে, কি, কোনটা, কাহারা, কারা, কী, কে কে, কারা কারা, কোনগুলি, কোথায় ইত্যাদি। এই বালক ‘কী’ সংযোগে এখানে আসিল?’ ‘কে’ সেই ধর্মপত্নীপরিত্যাগী পাপাত্মার নাম কীর্তন করিবেক?’ ‘কী কী লইয়া গিয়াছে?’
৬. অনির্দেশক সর্বনাম পদ [Indefinite Pronoun]
যে সর্বনাম পদে কোন বস্তু, ব্যক্তি বা ভাবকে নির্দিষ্ট করে বোঝায় না, তাকে অনির্দেশক সর্বনাম বলে। যেমন: কেহ, কিছু, কোন, কেউ, যে-কেহ, যে-কেউ, কিছু কিছু, কেহ কেহ, কেউ কেউ, অমুক, কোন কিছু ইত্যাদি। ‘কেহ’ হাসে, ‘কেহ’ গান গায়। ‘যে—কেহ’ মোরে দিয়েছে দুখ, দিয়েছে তাঁরি পরিচয়, সবারে আমি নমি। ‘কেউ কেউ’ বলে, তিনি এখনও জীবিত। কিছু বলব বলে এসেছিলাম। রাজার বাড়ী ‘কোথায়’ আছে?
৭. আত্মবাচক সর্বনাম পদ [Reflexive Pronoun]
যে সর্বনাম পদে কারো সাহায্য গ্রহণ না করার বিষয় জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাকে আত্মবাচক সর্বনাম বলে। যেমন: স্বয়ং, নিজে, আপনি ইত্যাদি। দেশের লোককে শিশুকাল হইতে মানুষ করিবার সদুপায় যদি ‘নিজে’ উদ্ভাবন এবং তাহার উদ্যোগ যদি ‘নিজে’ না করি তবে আমরা সর্বপ্রকারে বিনাশপ্রাপ্ত হইব। তিনি ‘স্বয়ং’ আসিলেন। আপনাকে ‘আপনি’ দেখ যেও না মন কারো ঘরে।
৮. ব্যতিহারিক সর্বনাম পদ [Reciprocal Pronoun]
পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝাতে ব্যতিহারিক সর্বনাম পদ হয়। যেমন: আপনা আপনি, পরস্পর ইত্যাদি। বন চাঁড়ালের পাতা দুইটি ভিতরের শক্তি বলে ‘আপনা আপনি’ই নড়িতে থাকে। তারা ‘পরস্পর’ বিতর্কে জড়িয়ে পড়লো।
৯. সম্বন্ধবাচক বা সংযোগমূলক সর্বনাম [Relative Pronoun]
যে সর্বনাম পদে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে সম্বন্ধ বা সংযোগ বোঝায়, তাকে সম্বন্ধবাচক বা সংযোগমূলক সর্বনাম বলা হয়। যেমন: যে, যিনি, যাহা, যাহারা, যে যে, যা যা, যারা, যাকে, যাকে, যার, যার ইত্যাদি। ‘যে’ চাষী আলস্য ভরে বীজ না বপন করে, পক্ক শস্য পাবে সে কোথায়? সে যাহা পায়, তাহা খায়। ‘যে যে’ এসেছে, তাদের নাম লিখে রাখ। ‘যা যা’ বলেছি, সব সত্য। ‘যিনি’ তাজমহল দেখেছেন, তিনি মুগ্ধ হয়েছেন।
১০. সর্বনামের দ্বিত্ব
ব্যক্তি বা বস্তুর প্রত্যেককে পৃথক ভাবে বোঝানোর জন্যে অথবা বহু ব্যক্তি বা বস্তুকে বোঝাবার জন্যে সর্বনামের দ্বিত্ব হয়। যেমন: কে কে তোরা যাবি আয় [পৃথকভাবে]। ‘কেউ কেউ’ যাবে বলেছিল [বহুত্ব]।
১১. সর্বনাম-বিশেষণ
দেশ, কাল, প্রকৃতি ও পরিমাণ বোঝাতে প্রত্যয়যুক্ত হয়ে সর্বনাম থেকে ‘সর্বনাম-বিশেষণ’ গঠিত হয়। যেমন: ‘যে’ দেশ, ‘সে’ দেশ, ‘যে’ দিন, ‘সে’ দিন, ‘এ’ কথা, ‘সব’ কথা, ‘এইসব’ কথা, ‘এই’ আমি, ‘সেই’ তুমি। তখন কে বলে গো ‘সেই’ প্রভাতে নেই আমি, সকল খেলায় করবে খেলা ‘এই’ আমি।
১২. সর্বনাম-ক্রিয়াবিশেষণ
দেশ, কাল, প্রকৃতি ও পরিমাণ বোঝাতে কয়েকটি প্রত্যয় যোগ করে সর্বনাম থেকে সর্বনাম ক্রিয়া-বিশেষণ গঠিত হয়। যেমন: দেশ বোঝাতে—যেথা, সেথা, যেথায়, সেথায়, যেখানে, সেখানে, যথায়, তথায়। কাল বোঝাতে—যবে, তবে, কবে, এবে, যখন, তখন, কখন, এখন। প্রকৃতি বোঝাতে—যেমন, কেমন, তেমন, এমন, যেরূপ, সেরূপ, যেমত, সেমত, অমন। পরিমাণ বোঝাতে—যত, তত, এত, অত। যেথা যাই ‘সেথা’ গৌরবমাত্র সার। যত চাও তত লও, তরণী ’পরে। তুমি ‘কেমন’ করে গান কর, হে গুণী?
Leave a Reply