//
//

সাবিরিদ খানের বিদ্যাসুন্দর ও হানিফা-কয়রাপরী সম্পর্কে আলোচনা কর।

সাবিরিদ খান: বিদ্যাসুন্দর ও হানিফা-কয়রাপরী 

রোমান্টিক প্রণয়কাব্যের কবি হিসেবে সাবিরিদ খানের নাম উল্লেখযোগ্য। কেউ কেউ কবির নাম শাহ বারিদ খান মনে করেন। তবে কবির প্রায় সব ভণিতায় তার নামের বানান ‘সাবিরিদ’ পাওয়া যায়। তিনি কালিকামঙ্গল কাব্যধারার বিদ্যাসুন্দর কাহিনির অন্যতম কবি রূপে স্বীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। হানিফা ও কয়রাপরী নামে তার অপর একটি প্রণয়কাব্য রয়েছে। তিনি রসুলবিজয় কাব্যের রচয়িতা।

কবির কাব্যের যে সব পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে তা খণ্ডিত বলে তা থেকে কবির ব্যক্তিপরিচয় সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি। কবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে—কবির পিতা নানুরাজা মল্লিকের কৃতিত্বেই চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত ইছাপুর পরগনার নানুপুর গ্রাম স্থাপিত হয় এবং তার নামানুসারেই গ্রামের নামকরণ করা হয়। কবির অনুলিখিত পুথিগুলোও চট্টগ্রাম থেকে আবিস্কৃত হওয়ায় এখানেই কবির জীবন অতিবাহিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছে। ড. আহমদ শরীফের মতানুসারে সাবিরিদ খান ১৪৮০ থেকে ১৫৫০ সালের মধ্যে বর্তমান ছিলেন। ভাষার প্রাচীন বিচারে ড. মুহম্মদ এনামুল হক তার কাব্যকে ষোল শতকের গোড়ার দিককার রচনা মনে করেন। কবি আত্মপরিচয় দিয়েছেন এভাবে—

পিয়ার মল্লিক সুত         বিজ্ঞবর শাস্ত্ৰযুত

উজিয়াল মল্লিক প্রধান।

তান পুত্র জিঠাকুর        তিন সিক সরকার 

অনুজ মল্লিক মুসা খান॥

রসেত রসিক অতি        রূপে জিনি রতিপতি

দাতা অগ্রগণ্য অর্কসুত।

ধৈর্যবন্ত যেন মেরু        জ্ঞানেত বাসবগুরু

মানে কুরু ধর্মে ধর্মসুত॥

তান সুত গুণাধিক        নানুরাজ মহল্লিক

জগত প্রচার যশ খ্যাতি।

তান সুত অল্পজ্ঞান        হীন সাবিরিদ খান 

পদবন্ধে সুচিল ভারতী॥

বিদ্যাসুন্দর

এই কাব্য রচনায় কবি সাবিরিদ খান প্রচলিত কাহিনি অবলম্বন করেছেন। বিদ্যাসুন্দর কাব্যের কাহিনি কালিকামঙ্গলের অন্তর্গত এবং রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রসহ অনেক কবি একই কাহিনি ভিত্তিক কাব্যের রূপ দিয়েছেন। সাবিরিদ খানের কাব্যের কাহিনির সঙ্গে দেবী কালিকার বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই। কাব্যরস সৃষ্টি ব্যতীত এর অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না; মানবীয় রস এতে প্রাধান্য পেয়েছে। কবি রোমান্স হিসেবেই কাব্যটি রচনা করেছিলেন। কবি তার কাব্যকে নাটগীতি বলে উল্লেখ করেছেন।

বিদ্যাসুন্দরের কাহিনি সুপ্রাচীন। এই প্রণয়কাহিনির প্রথম রূপ দেন সংস্কৃত কবি বিলহন চৌরপঞ্চাশিকা কাব্যে। তার কাহিনিটি এ রকম—গুর্জর দেশে মহিলাপত্তন নামক এক নগরীতে বীরসিংহ নামে এক নৃপতি রাজত্ব করতেন। তিনি অবন্তী নৃপতির কন্যা সুতারাকে বিয়ে করে পাটরানী করেছিলেন। তার গর্ভে শশিকলা নামের এক পরম সুন্দরী কন্যা জন্মায়। রাজা তাকে সুশিক্ষিত করার জন্য কাশ্মীরের কবি বিলহনকে নিযুক্ত করেন। সুপুরুষ বিলহনের নিত্য সাহচর্যে রাজকুমারী তার অনুরক্ত হন এবং গান্ধর্ব মতে বিয়ে করেন। অন্তঃপুরের ক্ষীরা রাজকন্যার এই গোপন প্রেমের কথা জানতে পেরে রাজাকে জানায়। কিন্তু রাজা প্রথমে তা বিশ্বাস করেননি। পরে কবি নিজে রাজ পুরোহিতের কাছে সেকথা প্রকাশ করে রাজার সমীপে রাজকন্যার বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। ক্রুদ্ধ নৃপতি চৌর কবিকে শূলে চড়িয়ে হত্যার আদেশ দিলেন। বধ্যভূমিতে নীত হয়ে কবি রাজকন্যার সঙ্গে অতিবাহিত মুহূর্তগুলোর কল্পনা করে পঞ্চাশটি শ্লোক রচনা করেন। শ্লোক শুনে রাজা খুশি হন এবং তাদের বিয়ে দেন। এই সব শ্লোক নিয়েই চৌরপঞ্চশিকা কাব্য রচিত।

এই শ্লোকগুলোতে নারীর গোপন অবৈধ প্রেম-সম্ভোগের বিবরণ স্থান পেয়েছে। এগুলো আদিরসের খণ্ড কবিতা। সাবিরিদ খান রোমান্টিক কাব্যের আখ্যানবস্তু হিসেবে একে গ্রহণ করতে গিয়ে সংস্কৃত ভাষার কোন কাব্যের অনুসরণ করেছেন। বিদ্যাসুন্দরের অন্যান্য কবি কালিকামঙ্গলের বৈশিষ্ট্য অতিক্রম করেননি। তাই রোমান্টিক কাব্যের ধারায় কেবল সাবিরিদ খানকেই গ্রহণ করা চলে। ড. আহমদ শরীফ সাবিরিদ খানের প্রতিভার পরিচয় দিতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন—‘‘ভাষা ও উপমা-অলঙ্কারের সংযত ব্যবহারে আর পদলালিত্যে ও ছন্দসৌন্দর্যে গোটা মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে সাবিরিদ খানের বিদ্যাসুন্দরের দ্বিতীয় জুড়ি নেই বললে অত্যুক্তি হয় না। স্বয়ং ভারতচন্দ্রের কাব্য পদলালিত্য এবং ছন্দগৌরব সত্ত্বেও অনেক সময় অতিকথনের দোষে আমাদের কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। কিন্তু সাবিরিদ খানের অনন্যসাধারণ ললিত-মধুর রচনা পাঠক মাত্রকেই চমৎকৃত ও বিস্ময়াভিভূত করবে।’’

হানিফা-কয়রাপরী

সাবিরিদ খানের অন্যতম রচনা ‘হানিফা-কয়রাপরী’ জঙ্গনামাজাতীয় যুদ্ধকাব্য হলেও প্রেমকাহিনির জন্য তা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের পর্যায়ভুক্ত। কবির কাব্যটি খণ্ডিত আকারে পাওয়া গেছে বলে কাব্যের নাম নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ড. আহমদ শরীফ কাব্যের নামকরণ করেছেন ‘হানিফার দিগ্বিজয়’, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ‘মোহাম্মদ হানিফা ও কয়রাপরী’ এবং ড. মুহম্মদ এনামুল হক ‘হানিফা ও কয়রাপরী’ নাম ব্যবহার করেছেন। কবির খণ্ডিত কাব্য থেকে কাহিনির উৎস সম্পর্কেও কিছু জানা যায়নি। হযরত আলীর পুত্র মুহম্মদ হানিফা কাহিনির নায়ক। জয়গুনের সঙ্গে হানিফার পরিণয় হয় এবং দিগ্বিজয়ী হিসেবে উভয়েই বহু রাজাকে পরাজিত করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন। তাদের এই বীরত্ব কাহিনি ছাড়াও হানিফার সঙ্গে কয়রাপরীর প্রণয়কাহিনি এ কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। কাব্যটি প্রেমকাহিনিভিত্তিক হলেও তা যুদ্ধসর্বস্ব। হানিফা-জয়গুন-কয়রাপরীর প্রণয়কাহিনি বিসর্পিল গতিতে অগ্রসর হয়ে রোমান্সের পর্যায়ে উঠেছে। কবির অন্য কাব্য বিদ্যাসুন্দরের ভাষায় যে গাম্ভীর্য ছিল আলোচ্য কাব্যে তা নেই। এখানে প্রাঞ্জল ভাষারীতির প্রয়োগ করা হয়েছে। ড. ওয়াকিল আহমদ এ কাব্য সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, কবির বর্ণনাভঙ্গি বিবৃতিসর্বস্ব। বিদ্যাসুন্দরে গীতিধর্মিতা ও নাটকীয়তার যেরূপ অপূর্ব সমন্বয় দেখা গেছে হানিফা-কয়রাপরীতে তার কণামাত্র রক্ষিত হয়নি। কবি এখানে কথকের ভূমিকা নিয়েছেন, সূত্রধরের ভূমিকা নয়। জীবননাট্য সূত্রে তিনি চরিত্রগুলোকে নাচাতে পারেননি ফলে হানিফা-কয়রাপরীতে আর্টের স্বাদ পাওয়া যায় না। কাব্যের ঘটনার ক্রমবিবর্তন আছে সত্য, তবে কবি সকল ঘটনাকে অনিবার্য সম্পর্কে বাঁধতে পারেননি। কবির ভাষাও খুব দুর্বল, স্থানে স্থানে তা স্থূল ও আড়ষ্ট পরিচর্যাহীন। তবে কবির সুমার্জিত ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায় জয়গুনের বারমাসীতে—

মধুমাসে মধুরিত মাধুরী মধুর।

মাধবী মালতী মল্লি বিকাশে প্রচুর॥

মলয়া পবন পরিমল বহে মন্দ

মধুকরে ঝঙ্কারে পিবএ মকরন্দ॥

মর্মক্ষত মদনে প্রাণেশ দূরদেশ।

মরিমু গরল ভক্ষি অল্প অবশেষ॥

মাধবী মাসেত মদমত্ত মহীরাজ।

বীজোৎপল দন্তরুচি মধুসেনা সাজ॥

মধুব্রত কূলে মধুমন্ত ভ্রমে নাদ।

মধুর ফুটএ পরভৃত কুহু নাদ॥

মনোরম ধনস্পতি প্রফুল্ল মুকুল। 

মানিনী বিভঙ্গ মন বিরহে আকুল।

এ ধরনের উজ্জ্বল পংক্তিমালা খুব বেশি নেই। সেজন্য ধারণা করা হয়, কবির প্রতিভা ও শক্তি ছিল, কেবল সাধনা ও পরিচর্যার অভাবে উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে নষ্ট করা হয়েছে।

সাবিরিদ খানের রসুলবিজয় কাব্য খণ্ডিত আকারে পাওয়া গেছে বলে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব নয়। কাব্যে হযরত মুহম্মদের (স) রাজ্যজয় প্রসঙ্গে মাহাত্ম্য ঘোষণা করা হয়েছে। কবি এ কাব্যে স্বীয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!