বাংলা গদ্যের বিকাশে সাময়িক পত্রের অবদান আলোচনা কর।
সাময়িক পত্র
যে কোনো দেশের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি হল সাময়িক পত্র। আবার দেশ বিদেশের সভ্যতার অগ্রগতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তারের প্রচেষ্টাও প্রতিফলিত হয় সাময়িক পত্রে। এছাড়া সমকালীন ঘটনাচক্র, অতীত ও আগামী দিনের ইঙ্গিত প্রভৃতির দিক থেকেও সাময়িক পত্রের গুরুত্ব যথেষ্ট। যুগোপযোগী নবচেতনার উদ্বোধন, পরিপোষণ এবং প্রচারের জন্য সাময়িক পত্র এক বড় মাধ্যম। তাই আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভাবনার পূর্ণ পরিচয় লাভের ক্ষেত্রে সাময়িক পত্রের অবদান গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের দেশে সাহিত্যসৃষ্টির প্রধান কেন্দ্র ছিল তিনটি— (এক) রাজরাজড়া, অমাত্যদের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা; দুই) ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সহায়তা এবং (তিন) লৌকিক প্রেরণা। আধুনিককালে পুরাতন এই প্রেরণাস্থলগুলি শক্তিহীন হয়ে পড়ল। জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার পরিমাণ বেড়ে গেল। প্রচলন হল মুদ্রণযন্ত্রের। ফলে সাহিত্য সৃষ্টির পটভূমিও পরিবর্তিত হয়ে গেল। বিভিন্ন গ্রন্থ মুদ্রিত ও প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ এল ছাপাখানার উদ্ভবের ফলে ও শিক্ষার প্রসারে। সাধারণ ক্রেতারা হল এই সাহিত্য সৃষ্টির পৃষ্ঠপোষক।
সাময়িক পত্রের গুরুত্ব
ছাপাখানার দুটি দান সাহিত্যজগতে গুরুত্বপূর্ণ— (এক) গ্রন্থ প্রকাশ এবং (দুই) সাময়িক পত্র প্রকাশ। গ্রন্থ প্রকাশ একক চেষ্টা হলেও সাময়িক পত্র একটি প্রতিষ্ঠানের মতো হয়ে উঠল। কেননা তা একাধিক লেখকের নানা ধরনের রচনার সংকলন। এই সাময়িক পত্র জনসাধারণের মনের উপর শুধু প্রভাব বিস্তারই করল না, সেই সময়ের সামাজিক চিত্রকেও জনমানসে তুলে ধরতে সচেষ্ট হল।
বাংলা গদ্যভাষা সাহিত্যিক রূপ পেতে আরম্ভ করল ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জন্য অনেকগুলি গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। ‘স্কুল বুক সোসাইটি’র চেষ্টায় স্কুলপাঠ্য বাংলা গ্রন্থ গদ্যরীতিকে সুনির্দিষ্ট আকার দান করছিল। কিন্তু স্কুল-কলেজের সীমাবদ্ধতা থেকে সাময়িক পত্রই প্রথম বাংলা গদ্যরীতিকে বৃহত্তর জনসাধারণের কাছে পৌছে দিল। ‘সমাচার দর্পণ’ ও ‘সম্বাদ কৌমুদী’র মতো পত্রিকা প্রথম যুগের বাংলা গদ্যকে বৃহত্তর পটভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করল। সে কারণে ভাষার শক্তি ও সারল্য বৃদ্ধি পেল। ভাষাকে সংস্কৃত আনুগত্যের হাত থেকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করতে সাময়িক পত্রের অবদান ছিল সুদুরপ্রসারী। বাংলা গদ্যরীতির বিবর্তনের ইতিহাসে সাময়িক পত্রের যে বিশেষ অবদান রয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেমন—
- তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা— সংস্কৃতানুগ সাধু রীতির গদ্যভাষার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
- মাসিক পত্রিকা— সহজ সরল কথ্যরীতির অনুগামী ছিল।
- অন্যদিকে সাধু কথ্য রীতির মিশ্রণের চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল বঙ্গদর্শন পত্রিকা।
- ভারতী ও সাধনা পত্রিকা সাধু কাঠামোয় চলিত রীতির প্রাধান্যের সূচনা করে এবং
- সবুজপত্র চলিত রীতির গদ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।
সাহিত্যজগতে ভাবের, চিন্তার ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে সাময়িক পত্রগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। জনসাধারণের জন্য সাহিত্য রচনার প্রয়োজন নিয়ে যত আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ পত্রিকার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হয়েছিল। খ্রিস্ট্রধর্ম ও হিন্দুধর্মের বিরোধ, বিভিন্ন সমাজসংস্কার আন্দোলনকে নিয়ে বিরুদ্ধবাদীদের মতানৈক্য সাময়িক পত্রে সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছিল। সাহিত্যঘটিত নব্যভাবনা প্রকাশের ক্ষেত্রে সাময়িক পত্রের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। যেমন, ‘কল্লোল’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে জটিল জীবনবোধ ও মনস্তাত্ত্বিক ভাবনামূলক মহাযুদ্বোত্তর ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব গতিশীলতা লাভ করেছিল।
বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের সাহিত্য রচনার প্লাটফর্ম হিসেবে সাময়িক পত্রের অবদান ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া বহু সাধারণ লেখকও সাময়িক পত্রে রচনা প্রকাশের তাগিদে তারা তাদের রচনাকর্মে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখতে পেরেছিল ফলে বাংলা সাহিত্য ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ হতে পেরেছিল। যেসব বিশিষ্ট সাহিত্যিকরা বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে পেরেছিলেন তার একটি তালিকা দিলেই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যেমন, সম্বাদ কৌমুদী—রামমোহন রায়; সংবাদ প্রভাকর—ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত; তত্ত্ববোধিনী—অক্ষয়কুমার দত্ত; বিবিধার্থ সংগ্রহ—মধুসূদন দত্ত; বিদ্যোৎসাহিনী পত্রিকা—কালীপ্রসন্ন সিংহ; মাসিক পত্রিকা—প্যারীচাঁদ মিত্র; অবোধবন্ধু পত্রিকা—বিহারীলাল চক্রবর্তী; বঙ্গদর্শন—বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হিতবাদী, ভারতী, সাধনা, নবপর্যায় বঙ্গদর্শন, সবুজপত্র, প্রবাসী—রবীন্দ্রনাথ, সবুজপত্র—প্রমথ চৌধুরী। সুতরাং এইসব সাহিত্যিকদের সাহিত্য বিকাশে সাময়িক পত্রের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।
সমালোচনা সাহিত্যের বিকাশেও সাময়িক পত্রের অবদান অনস্বীকার্য। সোমপ্রকাশ, রহস্যসন্দর্ভ, বঙ্গদর্শন, এডুকেশন গেজেট প্রভৃতি পত্রিকা সমালোচনার ধারাটি প্রবহমান রেখেছিল।
গ্রন্থ সমালোচনা যখন সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হতো, তার মাধ্যমে সাহিত্যিকরা রচনাকর্মে উৎসাহিত হতেন। মধুসূদনের কাব্যৃষ্টির প্রেক্ষাপট আলোচনা করলে দেখা যাবে, তাঁর প্রতিটি রচনাকে কেন্দ্র করে সমকালীন একাধিক পত্র পত্রিকা সমালোচনায় প্রবৃত্ত হত। সেই সমালোচনা কবির সৃষ্টিশীলতাকে উদ্দীপিত করেছিল।
সাময়িক পত্রকে কেন্দ্র করে ভাবাদর্শগত এক সাহিত্যিক গোষ্ঠীও তৈরি হয়েছিল, যা সাহিত্যজগতকে উন্মাদনায় চঞ্চল করে তুলেছিল। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে প্রথম সাহিত্যিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। এই পত্রিকাগোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। এইভাবে বঙ্গদর্শনগোষ্ঠী, ভারতী গোষ্ঠী, সবুজপত্র গোষ্ঠী, কল্লোলগোষ্ঠী, শনিবারের চিঠি গোষ্ঠী সাহিত্যসেবায় নিজেদের নিযুক্ত রেখেছিল।
দিগদর্শন
প্রকাশকাল: ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে।
পরিচিতি: এটি একটি মাসিক পত্রিকা। পত্রিকাটি শ্রীরামপুর মিশন থেকে প্রকাশিত হত। সম্পাদক ছিলেন জন ক্লার্ক এবং মার্শম্যান।
অবদান: পত্রিকাটির বিশেষ গুরুত্ব এই যে, এটি ‘যুবলোকের কারণ সংগৃহীত নানা উপদেশ’ ও তথ্যে সমৃদ্ধ হয়ে প্রচারিত হয়। যুবকদের মানসিক উৎকর্ষ সাধনে পত্রিকাটি যে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সে সময়ের কৌতূহলোদ্দীপক প্রসঙ্গগুলি পত্রিকাতে ভীড় করে থাকত।
সমাচার দর্পণ
প্রকাশকাল: ১৮১৮ সালের ২৩শে মে শনিবার। ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশ ও বিবর্তনের একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ১৭৯৯ সালের মে মাসে লর্ড ওয়েলেসলি সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন প্রকাশ করেন। ১৯ বছর পর ১৮১৮ সালে লর্ড হেস্টিংস এই আইনটি তুলে দেন। এই সময়ই ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশিত হয়। কেউ কেউ গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ‘বাঙ্গাল গেজেট’কে প্রথম সাময়িক পত্র রূপে অভিহিত করেছেন ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ সমালোচকের মতে ‘সমাচার দর্পণ’ই প্রথম সাময়িক পত্র।
পরিচিতি: গোপাল হালদার ‘সমাচার দর্পণ’কে ১৮১৮-১৮৪১ সালের মধ্যে প্রধান বাংলা সংবাদপত্র রূপে চিহ্নিত করেছেন। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মার্শম্যান। মিশনের কাজে তিনি এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, শেষের দিকে এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। তবে অনেকের মতে রামমোহনের সঙ্গে সমাচার দর্পণের অর্থাৎ মিশনারী সম্প্রদায়ের বিরোধ ক্রমেই তুঙ্গে ওঠায় এই পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি শ্রীরামপুর প্রেসে ছাপা হয়ে প্রকাশিত হয়।
অবদান: সমাচার দর্পণের দ্বারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং বাঙালি সমাজ বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। দেশীয় সমাজে কোথায় কী ঘটছে, কোথায় সমাজের উৎকর্ষ-অপকর্ষ দেখা দিচ্ছে, শিক্ষাসংস্কার, গ্রন্থপরিচয় প্রভৃতি সম্বন্ধে ‘সমাচার দর্পণ’ অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সাংবাদিকতার আদর্শ মেনে চলেছে। পরবর্তীকালে রামমোহন, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রভৃতি দক্ষ সম্পাদকেরা বাংলা সাময়িক পত্র ও সাংবাদিক বৃত্তিকে উচ্চ আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত করলেও সমাচার দর্পণের সাংবাদিক স্বরূপকে কখনও ছোট করা যায় না। সমকালীন বাংলাদেশের ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি জাতীয় জীবনের বহুমুখী বিকাশের দিকে সমাচার দর্পণের কৌতূহলী প্রকাশ ছিল উল্লেখযোগ্য। নারীশিক্ষা, সতীদাহ নিবারণ চেষ্টা প্রভৃতি নানারকমের সামাজিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরিচয় এই পত্রিকায় পাওয়া যায়।
সম্বাদ কৌমুদী
প্রকাশকাল: ‘সমাচার দর্পণে’ প্রায়ই হিন্দুধর্ম ও সমাজকে অকারণে গালিগালাজ করা হত। এর প্রতিবিধান করবার জন্য ১৮২১ সালের ৪ ডিসেম্বর রাজা রামমোহন ও ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’ শীর্ষক পত্রিকাটি প্রকাশ করে ‘সমাচার দর্পণে’ প্রকাশিত মিশনারীদের হিন্দু ধর্মের প্রতি আক্রমণের যথোপযুক্ত জবাব দেন।
পরিচিতি: ‘সম্বাদ কৌমুদী’র প্রথম সম্পাদক ছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাচাঁদ দত্ত। পত্রিকাটি ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকা।
অবদান: উনিশ শতকীয় রেনেশাঁসের প্রথম পুরোধা রামমোহন এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং যুক্তিনিষ্ঠ মনের দ্বারা একদিকে প্রাচীনপন্থ পণ্ডিতদের অন্ধ কুসংস্কারের তীব্র সমালোচনা করতে লাগলেন এবং অপরদিকে শাস্ত্র ব্যাখ্যার দ্বারা শ্রীরামপুরের পাদ্রীদের সঙ্গে বিতর্ক শুরু করলেন। এদিক থেকে সম্বাদ কৌমুদী পত্রিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে সমাচার দর্পণের হিন্দু-বিরোধী অপপ্রচার রোধ করার জন্য এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
ব্রাহ্মণ সেবধি
আবির্ভাব: ১৮২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়।
পরিচিতি: রামমোহন ‘সমাচার দর্পণে’ যেমন লিখতেন তেমনই ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ পত্রিকাতেও লিখেছিলেন। এই পত্রিকাটির সম্পাদনাও তিনি করেছিলেন।
অবদান: ব্রাহ্মণ সেবধি’র প্রথম তিনটি সংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, খ্রিস্টানদের ত্রিতত্ত্ববাদের সঙ্গে হিন্দুদের বহু দেববাদের আলোচনা সংযত ভাষায় করেছেন। এই পত্রিকায় রামমোহন একাধিক বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন।
সমাচার চন্দ্রিকা
প্রকাশকাল: রামমোহনের হিন্দুধর্ম ও সমাজ সন্বন্ধে অতিশয় আধুনিক ও প্রগতিশীল মতের সঙ্গে কিছু রক্ষণশীল স্বভাব ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাল মিলিয়ে চলতে না পারার ফলে দুজনের মতভেদ হয়ে গেল। রামমোহনের সঙ্গ এবং ‘সম্বাদ কৌমুদী’র সংস্পর্শ ত্যাগ করে ভবানীচরণ ১৮২২ সালে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকা বার করেন।
পরিচিতি: ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পত্রিকাটি রক্ষণশীল সমাজে বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল। এদিক থেকে রামমোহন বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন ভবানীচরণ। তাঁর প্রতিভাও ছিল অনস্বীকার্য
অবদান: এটি ছিল সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই পত্রিকা ও পত্রিকার সম্পাদক রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দুদের মনোভাবের পোষকতা করতেন বলে এই পত্রিকা সে সময়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ভবানীচরণের গোঁড়ামি সমর্থনযোগ্য না হলেও তাঁর সাংবাদিক নিষ্ঠা এবং রসজ্ঞ জীবনদৃষ্টি ও মননশীলতা নবযুগ উন্মেষের সেই প্রথম লগ্নে এক বিস্ময়ের বস্তু ছিল।
সংবাদ প্রভাকর
প্রকাশকাল: সাপ্তাহিক ‘সংবাদ প্রভাকর’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনায় ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারী প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে মাসিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। শেষ পর্যন্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’ সাপ্তাহিক, মাসিক এবং দৈনিক প্রকাশিত হতে থাকে।
পরিচিতি: সংবাদ প্রভাকর সপ্তাহে তিনবার প্রকাশিত হত। এই পত্রিকা প্রথম বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। কলকাতার নবীন ও প্রবীণ উভয় দলই এই পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সহায়সম্বলহীন ও ইংরেজি শিক্ষাদীক্ষা বর্জিত ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন এই পত্রিকার সম্পাদক।
অবদান: এই পত্রিকা বাঙালিকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। কেননা সংবাদ প্রভাকর প্রাচীন ও নবীন উভয় সমাজের মধ্যে সংযোজকের কাজ করেছে। যেখানে সমাচার চন্দ্রিকা ও শেষের দিকে সম্বাদ কৌমুদী ছিল পুরাতনপন্থী সমাজের প্রতিভূ। এটি বাংলার প্রথম মাসিক পত্রিকা যাতে সাহিত্য রচনার বিশেষ প্রাধান্য ছিল। এতে ঈশ্বর গুপ্তের লেখকগোষ্ঠীর নবীন শিষ্যদের অনেকেই প্রবন্ধ ও কবিতা লিখতেন এবং ঈশ্বর গুপ্ত তাদের উৎসাহিত করতেন। ঈশ্বর গুপ্ত যুগের বাণীকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাঁর পত্রিকা হয়ে উঠেছিল যুগোচিত। সংবাদ, রাজনৈতিক মন্তব্য, ইংরেজ শাসনের সমালোচনায় ও আধুনিক শিক্ষাপ্রচারে ঈশ্বর গুপ্ত যথেষ্ট মনোবলের পরিচয় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ, সমাজ, ধর্ম, দীক্ষা, সাহিত্যসংক্রান্ত বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা তাঁর পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়। তাই তাঁকে বাংলা বার্তাজীবীদের গুরু বলা হয়।
জ্ঞানান্বেষণ
প্রকাশকাল: হিন্দু কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের ইংরেজি সাময়িক পত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিলেন ডিরোজিও। এরই ফলস্বরূপ ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকার আবির্ভাব। ১৮৩১ সালের ৩১ মে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকা (সাপ্তাহিক) প্রকাশ করেন।
পরিচিতি: প্রথম দিকে রসিক কৃষ্ণ মল্লিক ও মাধব চন্দ্র মল্লিক পত্রিকাটি পরিচালনা করতেন। দু’বৎসর চলবার পর ১৮৩৩ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ ভাগে পত্রিকাটি দ্বিভাষিক সাপ্তাহিকে পরিণত হয়। দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের পর রামগোপাল ঘোষ এই পত্রিকার সম্পাদক হন। হিন্দু কলেজের প্রাক্তন ছাত্ররাই বিভিন্ন সময়ে ‘জ্ঞানান্বেষণে’র বাংলা বিভাগ পরিচালনা করেছিলেন।
অবদান: বেদ অধ্যয়ন ও শ্রবণ শুদ্র ও স্ত্রীলোকদিগের পক্ষে নিষিদ্ধ—এই সামাজিক রীতির বিরুদ্ধে এই পত্রিকায় লেখা হয়। ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকায় তরুণ ছাত্রদের মানসিক উদারতা ও যুক্তির প্রতি একান্ত নির্ভরতার পরিচয় রয়েছে। তরুণ ছাত্রদল এই সাময়িক পত্রিকার সাহায্যে আধুনিক ভাবধারার প্রবল বন্যা সমাজে আনতে চেয়েছিলেন। এই সাপ্তাহিকে সর্বপ্রথম শুভপ্রদ মানসিক স্বাস্থ্যের লক্ষণ ফুটে উঠেছিল। ভাষা, ভঙ্গিমা, বক্তব্য ও বিষয় নির্বাচনে তরুণ মনের সজীবতা লক্ষ করা যায়। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজে এই পত্রিকাটি যেভাবে আলোড়ন তুলেছিল সেখানেই রয়েছে পত্রিকাটির বিশিষ্টতা।
তত্ত্ববোধিনী
প্রকাশকাল: ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
পরিচিতি: ১৮৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ সভার মুখপত্ররূপে দেবেন্দ্রনাথ ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। পরে দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার দত্তকে এই পত্রিকার সম্পাদনার ভার দেন (১৮৪৩-১৮৫৫)। ১২ বছর তিনি এই দায়িত্ব পালনও করেন।
অবদান: বিশুদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে রচিত হলেও এই পত্রিকা সাময়িক পত্রের গতানুগতিকতা ভঙ্গ করে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। অক্ষয়কুমার দত্ত, বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রাথ ঠাকুর প্রভৃতি চিন্তাশীল লেখকের রচনামণ্ডিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা বাংলা সাময়িক পত্রে যে আদর্শ স্থাপন করল, পরে তাই ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘ভারতী’তে অনুসৃত হয়েছে। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা বাংলা পদ্যকে একটি ভারবহনক্ষম স্বচ্ছন্দ গতিবেগ দান করেছিল। ধর্ম প্রচারের প্রয়োজনে রচিত হলেও ‘তত্ত্ববোধিনী’ তে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, জীবনী, পুরাতত্ত্ব, সমাজনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে লোকহিত জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ব্রাহ্ম ধর্মের ব্যাখ্যা ও বেদ-বেদান্ত অনুবাদের ভার নিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। আর জ্ঞান-বিজ্ঙান বিষয়ক তত্ত্বকথা প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাঙালির রুচি গঠনে এবং নব্য ইউরোগীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ভূগোল-ইতিহাস সম্বন্ধে কৌতুহল সৃষ্টিতে এই পত্রিকার ভূমিকা যথেষ্ট। উনিশ শতকের বাঙালির মানসমুক্তি ত্বরান্বিত করায় ‘তত্ত্ববোধিনী’ র বিশেষ ভূমিকা আছে। বাঙালির জ্ঞানবাদী মননধর্মী তত্ত্বজ্ঞ চিত্তের জাগরণে এই পত্রিকা আদর্শ রূপে বিবেচিত হয়েছে।
বিবিধার্থ সংগ্রহ
প্রকাশকাল: ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে রাজেন্দ্রলাল মিত্র ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ নামক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। বিদেশি পেনি ম্যাগাজিনের আদর্শে পরিকল্পিত বাংলার প্রথম সচিত্র সাময়িক পত্র। পত্রিকাটির নিজস্ব ছাপাখানা ছিল না। পত্রিকাটি ছাপা হত ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেসে। মুদ্রাকর ছিলেন জে. টমাস।
পরিচিতি: ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। পত্রিকাটির উদ্যোক্তা ছিল বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ বা Vernacular Literature Society। বাংলা ভাষায় ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ ছিল প্রথম সচিত্র মাসিক পত্রিকা। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের পর কালীপ্রসন্ন সিংহ কিছুদিন পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ পত্রিকাটি মাত্র অনিয়মিত আটটি সংখ্যা প্রকাশের পর বন্ধ হয়ে যায়।
অবদান: গ্রন্থ সমালোচনার ক্ষেত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় রীতির সমালোচনা ছিল পত্রিকার বৈশিষ্ট্য। ধর্মীয় বা সামাজিক কোনো বিতর্ক এই পত্রিকায় আলোচিত হত না। পত্রিকাতে ঘোষণা থাকত পুরাবৃত্তেতিহাস-প্রাণীবিদ্যা-শিল্প ইত্যাদির কথা। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সাহিত্য ও সাহিত্যিক বিষয়ে আলোচনা প্রথম শুরু হয় ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’-এর পৃষ্ঠায়। পত্রিকাটি বিবিধ জ্ঞানপ্রচার ও শিল্পগত উৎকর্ষ সৃষ্টিতে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বক্তব্যের গাম্ভীর্যে ও বিষয়ের মর্যাদায় তত্তবোধিনী পত্রিকার উত্তরসাধক হলেও পত্রিকাতে ব্যবহৃত গদ্য ভাষাই পরবর্তীকালের শিক্ষিত সমাজের ভাষা ব্যবহারের পরিচয়কে নির্দিষ্ট করেছিল।
সোমপ্রকাশ
প্রকাশকাল: ১৮৫৮ খিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর এই পত্রিকা সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসাবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে।
পরিচিতি: দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের সম্পাদনায় ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। তারপর মোহনলাল বিদ্যাবাগীশের হাতে সম্পাদনার ভার দেন এবং শেষের দিকে তার পুত্র উপেন্দ্রকুমার নবপর্যায় সোমপ্রকাশ সম্পাদনা করতেন। মাঝে কাবুলে ব্রিটিশ নীতির বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য প্রায় এক বছর পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ ছিল।
অবদান: ‘সোমপ্রকাশ’ বাংলা সাহিত্য ও ভাষাকে গৌরবশ্রী দান করেছিল। দ্বারকানাথের সাংবাদিক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটেছে এই পত্রিকায়। তাঁর ব্যক্তিত্ব এই পত্রিকাকে স্বকীয়তার ঐতিহ্যে মণ্ডিত করেছিল। দর্শন, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি প্রভৃতি নানান বিষয় এই পত্রিকার পৃষ্ঠাকে উজ্জ্বল করেছিল। সোমপ্রকাশ পত্রিকার মাধ্যমে পাঠক জানতে পারল বাংলা ভাষায় সব রকমের ভাব প্রকাশ করা যায়।
বঙ্গদর্শন
প্রকাশকাল: ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে (১২৭৯ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ) বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়।
পরিচিতি: ১৮৭২ সালে বঙ্গদর্শনের পরিকল্পনাকালে বঙ্কিমচন্দ্র বহরমপুর ছিলেন এবং সেখানে সমকালীন সাহিত্যিক, মনীষী ও পণ্ডিতদের একটি সম্মেলন হয়। এই সম্মেলন থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হন। তাছাড়া তাঁর মধ্যে যে স্বাজাত্যপ্রীতি ও জাতীয়তাবোধ ছিল তাকে রূপ দেবার মাধ্যম হিসেবে তিনি ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাকে বেছে নিয়েছিলেন।
অবদান: (ক) এই পত্রিকার মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—চন্দ্রনাথ বসু, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রামদাস সেন, চন্দ্রশেখর প্রমুখ। (খ) বাংলাদেশের শিক্ষাচিন্তার ব্যাপারে ‘বঙ্গদর্শন’ একদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার চেয়েছেন অন্যদিকে শিক্ষাকে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রচার করে দেশবাসীর মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিতের সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। (গ) দেশের কৃষক সমাজের দুরবস্থা, প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে মনোভাব, পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন সংক্রান্ত আলোচনায় ‘বঙ্গদর্শন’ তত্ত্ববোধিনীর সার্থক উত্তরসূরি। (ঘ) জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, প্রাণীবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে সূক্ষ্ম অথচ সরল আলোচনা ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশিত হয়েছিল। পাশ্চাত্যরীতির ইম্প্রেসানধর্মী সাহিত্যসমালোচনার সূত্রপাত করলেন বঙ্কিম এই পত্রিকায়। (ঙ) বঙ্কিমচন্দ্র এই পত্রিকায় ইংরেজি Familiar Essay বা ব্যক্তিগত নিবন্ধের সূচনা করেন। (চ) সে যুগের বাঙালির আচার-আচরণ ও রীতি-নীতি, পোষাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতি অবলম্বন করে হাস্যরসাত্মক কৌতুক রচনার সূচনা করলেন বঙ্কিমচন্দ্র এই বঙ্গদর্শন পত্রিকায়। (ছ) বঙ্গদর্শন পত্রিকার নিয়মিত লেখক অক্ষয়চন্দ্র সরকার ১২৮০-১২৯২ বঙ্গাব্দের মধ্যে সম্পাদনা করেছিলেন সাপ্তাহিক ‘সাধারণী’ এবং ১২৮৪ বঙ্গাব্দে মাসিক ‘নবজীবন’ পত্রিকা। সম্পাদক নিজেই বলেছিলেন— “বন্ধিমবাবুর বঙ্গদর্শনের গুণে বাঙালী বাবু সখ্ করিয়া বাঙ্গালা পড়িতে শিক্ষা করেন।” (জ)‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যে অগ্রগতির সূচনা, তা পরবতী পর্বেও অব্যাহত ছিল। তাই প্রথম চার বছর বঙ্গদর্শন সম্পাদনার পর বন্ধিমচন্দ্র এর ভার দিলেন সঞ্জীবচন্দ্রের উপর এবং অনিয়মিতভাবে কিছুদিন প্রকাশিত হবার পর শ্রীশচন্দ্র এই পত্রিকার ভার গ্রহণ করলেন। এরপর পত্রিকাটি কিছুদিন বন্ধ থাকার পর রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় ‘নবপর্যায় বঙ্গদর্শন’ প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ১৩০৯-১৩১২ এই দীর্ঘ চার বৎসর ‘নবপর্ধায় বঙ্গদর্শন’ প্রকাশ করে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার ধারাকে অব্যাহত রেখেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের স্বাদেশিকতার ভাববন্যার যুগে রবীন্দ্রনাথ নবপর্যায় বঙ্গদর্শন সম্পাদনা করেছিলেন। ভারত আত্মার শাশ্বত মহিমা উপলব্ধিতে এবং পরম সংকটে দেশপ্রেমের উদ্বোধনে ‘নবপর্যায়ের বঙ্গদর্শন’ ১৮৭২-এর বঙ্কিম প্রবর্তিত ‘বঙ্গদর্শনে’র সার্থক ও যোগ্য উত্তরসূরিরূপেই আত্মপ্রকাশ করেছিল।
ভারতী
প্রকাশকাল: ১৮৭৭ সালের জুলাই মাসে (১২৮৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে) ‘ভারতী’ পত্রিকাটির প্রথম আবির্ভাব।
পরিচিতি: এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে এই ‘ভারতী’ পত্রিকা প্রকাশের পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই পত্রিকা মূলত ছিল ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা। প্রায় অর্ধশত বৎসর এই পত্রিকা চালু ছিল। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যা পর্যন্ত এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
অবদান: (ক) ‘ভারতী’ পত্রিকা মূলত ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হলেও সেকালের বহু বিশিষ্ট সাহিত্য ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। (খ) ‘ভারতী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী সাহিত্য প্রতিভার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। যেমন, তার অনেকগুলি ছোটগল্প, প্রবন্ধ, কবিতা। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র সমালোচনা এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ভানুসিংহ ঠাকুরের কবিতাও এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। (গ) এই পত্রিকার সব সংখ্যায় প্রবন্ধ, কবিতা, ছোটগল্প, রসরচনা, গ্রন্থ সমালোচনা, সংবাদ প্রভৃতি সব কিছুই প্রকাশিত হত। (ঘ) গদ্যরীতির বিবর্তনে এই পত্রিকার ভূমিকা ছিল যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক প্রবন্ধগুলি বেশিরভাগ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। (ঙ) গ্রন্থ সমালোচনার ক্ষেত্রে ‘ভারতী’ এক অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যের সমালোচনাও করেছিল এই পত্রিকা।
সাধনা
আবির্ভাব: ১২৯৮ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে ‘সাধনা’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ।
পরিচিতি: ১২৯৮ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক নিযুক্ত হন সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যদিও এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ সব্যসাচীর ভূমিকায় ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যেহেতু সে সময়ে শিলাইদহে থাকতেন, তাই সুধীন্দ্রনাথ-ই পত্রিকা প্রকাশ করতেন।
অবদান: (ক) রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই পত্রিকার সর্বেসর্বা। প্রতিপক্ষের সঙ্গে তর্কে রবীন্দ্রনাথ কখনও শাস্ত্রের আড়ালে আত্মরক্ষা করতে চেষ্টা করেননি। পত্রিকাকে শাস্ত্রালোচনার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে বুদ্ধি নির্ভরতার পথে পরিচালিত করে এই পত্রিকা। (খ) বঙ্কিমচন্দ্রের উত্তরকালে এই পত্রিকা সাময়িক পত্র জগতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই পত্রিকায় বেশ কিছু তরুণ লেখক রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে তাদের সাহিত্যচিন্তার প্রকাশে উপযুক্ত পটভূমিকা পেতে পারলেন। (গ) গানের স্বরলিপি থেকে সাংখ্যদর্শন পর্যন্ত, ব্রজবুলি থেকে পলিটিকস্ পর্যন্ত গদ্য-পদ্য রচনার সম্ভারে সাধনা পত্রিকা ছিল উজ্জ্বল। তাই রবীন্দ্রনাথের ‘সাধনা’ তাঁর নব ভাবনার উদ্যোগ পর্ব। (ঘ) ‘সাধনা’র সাধনা রবীন্দ্রনাথের ঘরের সাধনা, বাইরের সঙ্গে ঘরের সুগভীর যোগের সাধনা, বিংশ শতাব্দের সাহিত্যের বোধনকাণ্ড। বাংলার অন্তরের অন্তঃপুরে আত্মশক্তি সঞ্চয়ের যে আয়োজন চলছিল তাতে সমিধ যোগায় রবীন্দ্রনাথের সাধনা। (ঙ) সাধনার প্রথম সংখ্যা থেকেই ‘যুরোপযাত্রীর ডায়েরি’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। হিন্দু সমাজ ও ব্রাহ্ম সমাজের বহু কলহ ও বিতর্কের বিবরণ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এ সময় চন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিতর্কের সূত্রপাত হয়। সেই বিতর্কের প্রত্যুত্তর এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। () রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য অনেক গল্পের সঙ্গে ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘দালিয়া’ নামক বিখ্যাত ছোটগল্প দুটি এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
প্রবাসী
প্রকাশকাল: রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় বাংলার বাইরে যখন এলাহাবাদে আসেন তখন অন্যান্য প্রবাসীর মতোই এলাহাবাদেও কর্মসূত্রে অসংখ্য শিক্ষিত বাঙালি বসবাস করতেন। সে সময় বাঙালির মুখপত্র হিসাবে অধ্যাপক চট্টোপাধ্যায় ‘প্রবাসী’ নামক মাসিক পত্রিকাটি প্রকাশ করেন।
পরিচিতি: এলাহাবাদ প্রবাসী রামানন্দ চট্রোপধ্যায় ১৯০১ সালে প্রকাশ করেছিলেন উচ্চাঙ্গের সাহিত্যপত্রিকা ‘প্রবাসী’। বাংলার বাইরে থেকে প্রকাশিত হয়েছিল বলেই এর নাম ছিল প্রবাসী।
অবদান: মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রবাসী’ অল্পকালের মধ্যেই বাংলা সংবাদ ও সাময়িক পত্রের মধ্যে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। যথা—ক) সর্বভারতীয় আবেদন। খ) প্রবাসী বাঙালির কথা। গ) উচ্চমানের দেশী-বিদেশী চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের ছবিও ‘প্রাবসী’র পাতায় প্রকাশিত হয়। যেমন—রবি বর্মা, রাম বর্মা, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাবলী। ঘ) দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে, প্রথম শ্রেণির রচনাসম্ভারে সমৃদ্ধ করে নিয়মিত প্রকাশ। (ঙ) সমসাময়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও দেশব্যাপী প্রসারিত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে সাহসের সঙ্গে উপস্থিত করা। (চ) বিশ্বের সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনাকে ‘প্রবাসী’ প্রতিটি সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা। (ছ) তৎকালীন নতুন সাহিত্যিকদের প্রতিভাকে সযত্নে প্রতিষ্ঠা দেওয়া। (জ) বর্তমানকালের অনেক কবি-সাহিত্যিকের প্রথম গল্প উপন্যাস ‘প্রবাসী’র পাতাতেই আত্মপ্রকাশ করেছিল। শুধু সাহিত্য প্রকাশেই নয়, বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি যত্নসহকারে ছেপে ‘প্রবাসী’ বঙ্গ-সংস্কৃতির অপরিমেয় উন্নতি বিধান করেছিল। মুদ্রণ, প্রকাশনা, সাহিত্যের মান ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই রামানন্দের সুযোগ্য সম্পাদনায় ‘প্রবাসী’, প্রথম শ্রেণির সাময়িক পত্র হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল।
সবুজপত্র
প্রকাশকাল: ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপ ভ্রমণ শেষে রবীন্দ্রনাথের আশাবাদী কল্যাণবাদী মন যুদ্ধের মধ্যেই প্রত্যাশা করেছিল শুভ-প্রভাতের সম্ভাবনা। যুদ্ধ তাঁর কাছে জড়তা ও অশুভ অন্ধকার থেকে মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিল। রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণ পর্বে গীতাঞ্জলির বাণী ও ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছন। তাই রবীন্দ্রনাথ তার ‘সাধনা’ প্রকাশের মতোই প্রমথ চৌধুরীকে দিয়ে ‘সবুজপত্র’ প্রকাশ বা বাংলা সাহিত্যে সবুজের অভিযানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
পরিচিতি: বীরবল ছন্মনামে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ একখানি মাসিক পত্রিকা হিসাবে প্রকাশিত হয়। ২৫ বৈশাখ, ১৩২১ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে কলকাতায় ‘সবুজপত্র’র বিজ্ঞাপন, পাঁচ মিশালী সংবাদ আলোচনা বিবর্জিত সাহিত্যপত্রিকা।
অবদান: বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে ‘সবুজপত্র’ এক নতুন পর্বের দিকনির্দেশক। প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্রের সম্পাদক ও প্রতিষ্ঠাতা। ‘সবুজপত্রে’র লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এছাড়াও অতুলচন্দ্র গুপ্ত, কিরণশংকর রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি ব্যক্তিত্ব ‘সবুজপত্র’ গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত ‘সবুজের অভিযান’ কবিতা নিয়ে ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা উদ্বোধন করেন। রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা ও সমাজচিন্তা বিষয়ক কিছু প্রবন্ধ ‘কালান্তর’ গ্রন্থের ‘বাতায়নিকের পত্র’ নামক প্রবন্ধে প্রকাশিত হয়েছিল। এবং তা সবুজপত্রেও প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি ছোটগল্পও সবুজপত্রে প্রকাশিত হয়। গল্পগুলি হল ‘অপরিচিতা’, ‘হৈমন্তী’ প্রভৃতি।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধীয় প্রথম বাংলা প্রবন্ধটি সবুজপত্রে প্রকাশিত হয়। অতুলচন্দ্র গুপ্তের ‘কাব্যজিজ্ঞাসা’ নামক গ্রন্থের অলংকারশাস্ত্র সম্বন্ধীয় প্রবন্ধগুলি সবুজ পত্রে প্রকাশিত হয়। মননশীলতা, প্রকাশভঙ্গির বক্রতা, বৈদগ্ধ্য, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সবুজপত্র অনেকদিন ধরে বাঙালি রসগ্রাহীদের খোরাক জুগিয়েছিল। ফলে ‘সবুজপত্রে’র নবসাহিত্য বাঙালি বা ভারতীয় চরিত্রের সীমাবদ্ধতা ত্যাগ করে নির্মোহ বিশুদ্ধ চিন্তা অর্জন করতে পেরেছিল।
‘সবুজপত্র’ ভাষার ক্ষেত্রে যে নতুন আন্দোলন উপস্থিত করেছিল, তা হল চলিতভাষার একচ্ছত্র অধিকার। অমার্জিত কথ্যবুলিকে প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেননি। তাঁর চলিত ভাষা ছিল মার্জিত পরিশীলিত বিদগ্ধ মনের প্রতিফলন। প্রমথ চৌধুরী তথা ‘সবুজপত্রে’র চলিত ভাষারীতির আবাহনকে রবীন্দ্রনাথ অকুষ্ঠ সমর্থন ‘সবুজপত্রে’র পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের দুটি উপন্যাস ‘ঘরে-বাইরে’ ও ‘চার অধ্যায়’ প্রকাশিত হয়েছিল, তার ভাষাও ছিল চলিত রীতির অনুসারী। ‘সবুজপত্রে’র সর্বাপেক্ষা বড় কৃতিত্ব হল, চরিত্রধর্ম ও ভাষারীতির দিক থেকে পত্রিকাটি রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিল। সুতরাং ‘সবুজপত্রে’র নবসাহিত্য আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে ছিল যৌবনের শক্তি। প্রমথ চৌধুরী ‘প্রাণয়ে স্বাহা’ বলে সবুজপত্রের সূচনা করেছিলেন। পত্রিকার প্রথমসংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথের ‘সবুজের অভিযান’ কবিতায় যৌবনের জয়গান গেয়েছেন। এবং যৌবনের প্রাণধর্মই ছিল সবুজপত্রের চালিকাশক্তি। তাই সবদিক থেকে সাহিত্য রসিক সমাজে, সমাজের উচ্চতর চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ ও তৎকালীন আধুনিক বাঙালিদের কাছে প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ ছিল এক স্বতন্ত্র ধারার প্রবর্তক।
কলোল
আবির্ভাব: ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ এই পত্রিকার প্রথম প্রকাশ।
পরিচিতি: ১৯২৩-২৪ সালে কলকাতা ও ঢাকার শিক্ষিত তরুণ যুবকদের দুঃসাহসী সহযোগিতায় ‘কল্লোল’ মাসিক পত্রিকার প্রকাশ। গোকুলচন্দ্র নাগ ও দীনেশরঞ্জন দাস যুগ্মভাবে প্রথমে এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। কল্লোল পত্রিকাকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়।
অবদান: ‘কল্লোল’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে অসংখ্য কবি-ঔপন্যাসিক আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকা প্রায় সাত বছর আধুনিক সাহিত্যের প্রকাশে ব্যাপৃত ছিল। এই পত্রিকার প্রথম লেখক কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র। ‘কল্লোল’ পত্রিকার মাহাত্ম্যে সঙ্গে ডি. এম. লাইব্রেরীর অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত গোপাল দাস মজুমদার বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। নরেশ সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, নজরুল ইসলাম, দীনেশ রঞ্জন দাস প্রভৃতি ছিলেন পত্রিকার প্রথম বছরের শ্রেষ্ঠ লেখক। দ্বিতীয় বছরের মুখ্য লেখক ছিলেন অনিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। এছাড়া পরবর্তীকালে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, জগদীশচন্দ্র গুপ্ত, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ শ্রেষ্ঠ নবীন লেখকবৃন্দ ‘কল্লোল’ পত্রিকার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। নরেন্দ্র দেবের ‘যাদুঘর’ (১৯৩০) উপন্যাসটি প্রথমে ‘কল্লোল’ পত্রিকাতেই প্রকাশ হয়েছিল। কল্লোলের গল্প-লেখকদের মধ্যে শ্রীযুক্ত মনীশ ঘটক ‘যুবনাশ্ব’ ছদ্মনামে গল্প লিখতেন। কল্লোলের প্রাচীন ও নবীন লেখকদের মধ্যে শ্রীযুক্ত পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ও নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় অনুবাদে দক্ষতা দেখিয়েছেন। ‘কল্লোল’ পত্রিকার লেখকদের বৈশিষ্ট্য ছিল তারা বাস্তববাদী; মার্কসীয় অর্থে বাস্তববাদী নয়, তা শারীরিক ও জৈবিক বাস্তবতা। বাস্তববাদী ছাড়াও রোমান্টিকতা লেখকদের অন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। তাই কল্লোলের কালে বাংলা সাহিত্যের পালাবদলের মহড়া চলেছিল।
শনিবারের চিঠি
প্রকাশকাল: ২৭ জুলাই ১৯২৪ বা ১০ শ্রাবণ ১৩৩১-এ সাপ্তাহিক সাহিত্য পত্রিকারূপে আত্মপ্রকাশ করে ‘শনিবারের চিঠি’। পরে ১৩৩৪ সালের ৯ ভাদ্র নবপর্যায়ে মাসিক পত্রিকারূপে প্রকাশিত হয়।
পরিচিতি: ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক হলেন নীরদ চন্দ্র চৌধুরী। পত্রিকার প্রকৃত পরিচালক সজনীকান্ত এবং মোহিতলাল মজুমদার হলেন তাত্ত্বিক নেতা ও গুরু।
অবদান: ‘শনিবারের চিঠি’র মূল শক্তি বিরুদ্ধতা। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, চিত্তরঞ্জন দাশ এবং তরুণ সহিত্যিকদের কোন কোন সংখ্যায় তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। আবেগ প্রবণতা-হুজুগপ্রিয়তা ইত্যাদি অভ্যাসগুলিকে ছাপিয়ে বাঙালি কুৎসা প্রবণতার দিকে নজর দেন। তাই কুৎসা প্রবণতার পণ্যকে পুঁজি করে ‘শনিবারের চিঠি’ কালের সমুদ্রে পাড়ি দিতে চেষ্টা করে এবং অনেকখানি সফলও হয়। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে পত্রিকার প্রবন্ধিক অশোক চট্টোপাধ্যায় লেখেন—“উপায়ের ক্ষেত্রে আমরা মুগরকে হাতছড়ির উপরে জায়গা দেব, চাবুককে চাপড়ের চেয়ে বড় বলেই ধরব।” ‘শনিবারের চিঠি’ তার সমগ্র জীবনে চাপড় ও চাবুককেই প্রাধান্য দিয়েছিল এবং পরবর্তীক্ষেত্রে “কেবল চাপড় নয়, কাতুকুতু বা সুড়সুড়ি দেওয়ার প্রবণতাকেই প্রাধান্য দিয়েছিল।” সুতরাং নানা প্রতিকূল ও অনুকূল অবস্থা এবং সংগ্রামকে অতিক্রম করে সজনীকান্তের যোগ্য সম্পাদনায় ‘শনিবারের চিঠি’ বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িক পত্রের জগতে নিজস্ব আসন পাকা করে।
কালিকলম
প্রকাশকাল: এই পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে (১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে)।
পরিচিতি: ‘কলোলে’র ঘাটে বসেই ‘কালিকলমে’র প্রকাশনায় উদ্যোগী হয়েছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়—মুরলীধর বসু এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের সঙ্গে।
অবদান: ‘কালিকলম’ পত্রিকা আসলে কল্লোলবৃত্তের বহির্ভূত ছিল না। শৈলজানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্র এঁরা ছিলেন এই পত্রিকার কর্ণধার। অন্নদাশংকর রায়ও কালিকলম পত্রিকায় লিখেছেন ও এই পত্রিকাকে ভালোবাসতেন। কালিকলমের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত দরদ ও কৃতজ্ঞতার ঋণ তিনি স্বীকার করেছেন ১৯২৯ সালে মুরলীধর বসুকে চিঠি লিখে। পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় শৈলজানন্দ ‘মহাযুদ্ধের ইতিহাস’ নামক উপন্যাস লেখেন। এই সংখ্যায় ‘জোহানের বিহা’ নামক গল্পও লিখেছিলেন। তৃতীয় সংখ্যা (১৩৩৩, আষাড়)-য় তিনি লিখেছিলেন ‘সেয়ানে-সেয়ানে’ গল্প। প্রথম সংখ্যা থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র উপন্যাস, গল্প ও কবিতা লেখেন। ‘পাঁক’ উপন্যাস, ‘মানুষের মানে চাই’ কবিতা প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া মোহিতলাল মজুমদার, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন, যতীন্রনাথ সেনগুপ্ত, প্রমথনাথ বিশী, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরবল, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি লেখক এই পত্রিকায় তাদের লেখা প্রকাশ করেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘কৃত্তিবাস ভদ্র’ ছদ্মনামে এই পত্রিকায় লিখতেন।
প্রগতি
প্রকাশকাল: ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে ঢাকায় পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৩৩৭ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকা চালু ছিল।
পরিচিতি: বুদ্ধদেব বসু ও অজিতকুমার দত্ত সম্পাদিত এটি মাসিক পত্রিকা।
অবদান: এই পত্রিকা প্রতি সংখ্যায় একটি করে ছবি ছাপত। যেমন, প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় ছিল কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছবি। এই ছবি ছাপার সূত্রপাত করেছিল কল্লোল পত্রিকা। এই পত্রিকা কী সম্পাদনা, কী লেখা, কী বক্তব্য—সব দিক দিয়েই কল্লোলের পথ অনুসরণ করেছিল। এই পত্রিকার লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, অজিতকুমার দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, মোহিতলাল মজুমদার, মনীশ ঘটক, অমলেন্দু বসু, জগদীশ গুপ্ত, নজরুল ইসলাম, বিষ্ণু দে, পরিমল রায়, প্রিয়ম্বদা দেবী, সুশীলকুমার দে প্রমুখ। অতি-আধুনিক সাহিত্যের মুখপত্ররূপে ‘প্রগতি’ স্বীকৃতি পেতে চেয়েছিল। তরুণ লেখকরা ছদ্মনামেও লিখতেন এই পত্রিকায়। যেমন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত—অভিনব গুপ্ত, অজিত দত্ত—দেবদত্ত, মনীশ ঘটক—যুবনাশ্ব ছদ্মনামে লিখতেন। প্রগতি যে কল্লোলের দোসর ও বাংলা সাহিত্যের পালাবদলের পক্ষে ছিল, তার প্রমাণ মেলে প্রকাশিত গল্প, কবিতা ও উপন্যাসের মধ্যে। অতি-আধুনিক সাহিত্য নিয়ে যে সমকালীন সময়ে বাদানুবাদ সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রকাশ রয়েছে এই পত্রিকায়। এই পত্রিকা ছিল মূলত আধুনিকতার অগ্রদূত।
পরিচয়
প্রকাশকাল: ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের (১৯৩১ খিঃ) শ্রাবণ মাসে ‘পরিচয়’ পত্রিকার প্রথম প্রকাশ।
পরিচিতি: বিশিষ্ট রবীন্দ্রোত্তর কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। এটি একটি মাসিক পত্র। সুধীন্দ্রনাথ মোট বারো বছর এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৩৫১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে এই পত্রিকার সঙ্গে তিনি সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এরপর নীরেন্দ্রনাথ রায়, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক হন। এখনো পরিচয় পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে।
অবদান: (ক) সাময়িক পত্রের ইতিহাসে এই পত্রিকার আদর্শগত বিশিষ্টতা ছিল লক্ষ্যণীয়। কেননা সবুজপত্র চেয়েছিল চিন্তাশক্তি জাগাতে, বাক্শক্তিকে পরিমিত-ও কার্যকরী করতে অর্থাৎ দেশীয় সাহিত্য ও শিল্পকে যুগোপযোগী ও সমুন্নত করতে। কিন্ত ‘পরিচয়’ পত্রিকা চাইল বিদেশী চশমা লাগিয়ে আমাদের ক্ষীণ সাহিত্যিক দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে। (খ) এই পত্রিকার অন্যতম দিক হল প্রচারধর্মিতা এবং তা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থেকে ছিল মুক্ত। রবীন্দ্রনাথ থেকে কনিষ্ঠতম লেখক পর্যন্ত সকলেরই জন্য পরিচয়ের আসন পাতা থাকত। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের আনুকুল্যেই পরিচয়ের পরিসর বিস্তৃতি লাভ করেছিল। (গ) পরিচয়ের প্রথমের দিকে প্রধান লেখকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন চারুচন্দ্র দত্ত। তাঁর স্মৃতিকথা তখন অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। (ঘ) প্রথম সংখ্যার লেখকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন—হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রমথ চৌধুরী, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রনাথ রায়, অন্নদাশংকর রায়, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ। পত্রিকার পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৪৫। দাম ছিল ১ টাকা। (ঙ) পরিচয় পত্রিকার অন্যতম আকর্ষণ ছিল পুস্তক পরিচয়। সমসাময়িক অন্যান্য বিশিষ্ট পত্রিকা যেমন সবুজ পত্র, প্রবাসী, বিচিত্র প্রভৃতি পত্রিকার কাছে সুধীন্দ্রনাথের একক কৃতিত্বে ‘পরিচয়’ নিজস্ব স্থান করে নিয়েছিল। বিশেষ করে এই পত্রিকার প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রশংসনীয়।
কবিতা
প্রকাশকাল: ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম প্রকাশকাল ১৩৪২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাস (১৯৩৫ সালের অক্টোবর)। বুদ্ধদেব বসু ছিলেন এই পত্রিকার প্রাণপুরুষ।
পরিচিতি: কবি বুদ্ধদেব বসু এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন। অবশ্য প্রারম্ভিক সংখ্যা থেকে সম্পাদক হিসাবে বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের নাম ছাপা হয় এবং সহকারী সম্পাদক ছিলেন কবি সমর সেন। পত্রিকাটি প্রকাশরীতিতে ছিল ত্রৈমাসিক।
অবদান: এই পত্রিকার লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, সমর সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। ‘কবিতা’ পত্রিকাকে অবলম্বন করে নানান ধরনের যে আধুনিক কবিতা রচিত হয়েছিল তাতে আধুনিক কবিতার একটা আদর্শ গড়ে উঠেছিল। নবীন প্রতিভাবান লেখকরা এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নবসৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠেছিলেন। কারণ তখনকার পত্রিকাগুলিতে যেমন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পাঁচ-ছয়টি করে কবিতা স্থান পেলেও নবীন লেখকদের লেখা ফাঁক পূরণের জন্য ব্যবহার করা হত। তাই নতুন লেখকদের প্রতিভার বিকাশে এই পত্রিকার গুরুত্ব যথেষ্ট ছিল।
পূর্বাশা
প্রকাশকাল: ১৯৩২-এ কুমিল্লা থেকে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশ।
পরিচিতি: সাহিত্য সমালোচনা, চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের ছবি প্রকাশ, হিটলার-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতির জন্য এই পত্রিকা বিখ্যাত।
অবদান: মানিক বন্দোপাধ্যায়, অমিয়ভূষণ মজুমদার, মন্মথ রায়, সঞ্জয় ভট্টাচার্য নিয়মিত এই পত্রিকায় লিখতেন।
Leave a Reply