//
//

সামাজিক উপন্যাস কাকে বলে? একটি সামাজিক উপন্যাস ব্যাখ্যা কর।

সামাজিক উপন্যাস

সামাজিক উপন্যাসের স্বরূপ এক কথায় বোঝাতে গিয়ে অ্যাব্রাম্‌স্ তাঁর পূর্বোল্লিখিত গ্রন্থে লিখেছেন— ‘‘The sociological novel emphasizes the influence of social and economic conditions on characters and events.’’ অর্থাৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার স্বরূপ উদঘাটনই এই শ্রেণীর উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই সঙ্গে সমাজ সংস্কারের বাসনা ঔপন্যাসিকের থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে—বাসনা যদি বা থাকে তা অনেক ক্ষেত্রে অস্পষ্টই থেকে যায়, সমস্যাটির প্রতিফলনই এই ধরনের বেশির ভাগ উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য।

সামাজিক পটভূমি এবং অর্থনীতির প্রসঙ্গ থাকলেই যে সে উপন্যাসকে আমরা সামাজিক উপন্যাসের শ্রেণীতে বিন্যস্ত করতে পারবো না, এ কথা এই প্রসঙ্গে আমাদের বিশেষ ভাবে স্মরণ রাখা দরকার। প্রায় প্রত্যেক উপন্যাসেই বিশেষ এক সমাজের কথা থাকে, থাকবেই, কিন্তু উপন্যাসের শ্রেণীবিচারে তা কোনো তাৎপর্য বহন করে না। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রজনী’ উপন্যাসে উচ্চবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত দু ধরনের সমাজই দেখানো হয়েছে, নিম্নবিত্ত সমাজে বিবাহ যে এক প্রবল সমস্যা, এ কথা বলাও হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘রজনী’-কে আমরা ঠিক সামাজিক উপন্যাসের পর্যায়ে ফেলতে পারবো, না-এমন কী লবঙ্গলতা-অমরনাথের একটি তীব্র সামাজিক সমস্যা সত্ত্বেও। অর্থনীতির সঙ্গে যোগ থাকলেও, সেই কারণেই, কেবল এই সংযোগের কারণে তাকে সামাজিক উপন্যাস বলা যাবে না, উদাহরণ ‘ঘরে-বাইরে’। অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দিক ছিল স্বদেশি জিনিস বেশি ব্যবহার এবং বিদেশি জিনিস বর্জন। স্বদেশি জিনিস বেশি ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে নিখিলেশ বহু অর্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে, বিদেশি বর্জনের আবেগে মানুষ বিদেশি দ্রব্য নষ্ট করেছে। এর ফলে অর্থনীতিতে একটা পরিবর্তন আসতে পারে বলেই মনে হয়, কিন্তু তাই বলে ‘ঘরে-বাইরে’-কে সামাজিক উপন্যাস বলা যাবে না, অন্তত এই অর্থনৈতিক কারণে।

উপন্যাসকে সামাজিক উপন্যাস হতে গেলে, বা অন্য ভাবে বলা যায় তাকে এই শ্রেণীতে বিন্যস্ত করতে গেলে, তার সামাজিক পটভূমির চেয়েও বেশি বিচার্য, ঔপন্যাসিক সমস্যার বিচার—যে সমস্যা নিয়ে উপন্যাসটি রচিত তার প্রকৃতি সামাজিক কিনা। আমাদের সমাজে অনেক ধরনের সমস্যা আছে—জাতপাতের সমস্যা, অস্পৃশ্যতার সমস্যা, বেগার খাটার সমস্যা, বিধবাদের নিয়ে সমস্যা, অনেক কিছু। পরবর্তীকালে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার সমস্যা, সিংগল ইউনিট পরিবারের সমস্যা, সামাজিক মূল্যবোধ দ্রুত পালটে যাবার সমস্যা এবং ইত্যাকার আরো কিছু সমস্যা।

আসল কথা সামাজিক সমস্যাকে বিষয়বস্তু করে নেওয়াও নয়, তার প্রতিক্রিয়া, বিশ্লেষণ এবং তাৎপর্য পরিস্ফুট করা। সে সব করা হয়েছে বলেই উল্লিখিত উপন্যাসগুলি সার্থক হতে পেরেছে। এ রকম সার্থক সামাজিক উপন্যাস বিদেশি ও বাংলা সাহিত্যে আরো অনেক আছে। কিংসলের ‘ঈস্ট’, ডিকেন্সের ‘হার্ড টাইমস’, আপটন সিনক্লেয়ার ‘দি জাঙ্গল’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সহরতলি’ প্রভৃতি তার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।

সামাজিক উপন্যাসের কথা বলতে গেলে এর আর-একটি উপবিভাগের কথাও বলতে হয়, একে বলা যায় সমাজ-বাস্তবতাবাদী উপন্যাস। ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন ম্যাকসিম গর্কি। এর মূল কথা হল সমাজে যা ঘটেছে তাই একমাত্র সত্য নয় এবং যথাযথ ভাবে তাকে সাহিত্যে তুলে ধরাটাই সাহিত্যিকের একমাত্র কাজ নয়, তার একটি দায়বদ্ধতা আছে সমাজের উন্নতিসাধন এবং বিপ্লবকে পরিপুষ্ট করার কাজে। এই কারণেই, সমাজতান্ত্রিক সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাকে এমন সামাজিক উপন্যাস রচনা করতে হবে যা সমাজ-পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারে, যদি সে জন্য বাস্তবের সামান্য বিকৃতি ঘটে বা সমাজ-পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত অনাগত বাস্তবকে কল্পনা করে নিতে হয়, তাও করতে হবে। ম্যাকসিম গর্কি তাঁর ‘মা’ উপন্যাসে তা করেছিলেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘হারাণের নাত জামাই’ গল্পে একই কারণে জিতিয়ে দিয়েছেন তেভাগা আন্দোলনের কৃষকদের।

একটি সার্থক সামাজিক উপন্যাস

সামাজিক উপন্যাসের প্রকৃতি স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য আমরা একটি বাংলা সামাজিক উপন্যাসের ব্যাখ্যা করতে পারি। সমাজসচেতন লেখক হিসাবে খ্যাত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসটি আমাদের আলোচনার জন্য গৃহীত হতে পারে।

নরনারীর ব্যক্তিগত সমস্যা, এবং অধিকাংশ সময়েই প্রেমঘটিত সমস্যা, শরৎচন্দ্রের প্রায় প্রত্যেক উপন্যাসেই থাকে। ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসেও একটি প্রেমঘটিত আখ্যান আছে, সেটি রমা ও রমেশের প্রেমাকর্ষণের ফল্গুধারা; কিন্তু সমাজেতিহাসের আলোড়িত ঘটনাধারায় তা প্রায়শই চাপা পড়ে যায়। গ্রাম থেকে বহুদিন নির্বাসিত এবং পশ্চিমের কোনো শহরে বড়ো হওয়া রমেশ গ্রামে ফিরতে বাধ্য হয় পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে। গ্রাম সম্বন্ধে রোম্যান্টিক অনেক ধারণা তার ছিল, তার ওপর আদর্শবাদী এই যুবকের মনেও গ্রামের উন্নতির অনেক পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু প্রধানত জ্ঞাতিশ বেণী ঘোষাল-সহ গ্রামের অন্যান্য মাতব্বর ও ব্রাহ্মণশ্রেণীর অপদার্থ গ্রাম্য চক্রান্তের শিকার হয়ে তাকে জেলে যেতে হয় এবং যখন গ্রাম থেকে ফিরে যাওয়াই সে মনস্থ করেছে তখন গ্রামের লোকেরা তাকে স্বীকৃতি জানায়, রমেশ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে বলে মনে হয়।

এই উপন্যাসকে আমরা সামাজিক শ্রেণীতে ফেলতে পারি এই জন্য যে, সমস্যাটি নিঃসন্দেহে পল্লীসমাজের। অর্থনৈতিক দিক থেকে হতশ্রী পল্লীর জীবনে যে গ্রাম্য দলাদলি এবং ঘণ্য স্বার্থপরতা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রকৃতি এবং তা নিরসনের উপায় এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে। গ্রামের লোকেরা এত শোষণের শিকার হয়েছে যে, কোনো মানুষের সৎ উদ্দেশ্যকে তারা বিশ্বাস করে না, বিবেক বর্জন দিয়ে নিজেদের সামান্যতম লাভও তারা উৎসাহের সঙ্গে সংগ্রহ করে নেয়, ভালো মানুষিকে তারা মানুষের দুর্বলতা মনে করে। গ্রাম সম্বন্ধে রোমান্টিক ধারণা যখন রমেশের ক-দিনেই চলে যায় এবং গ্রাম্যজীবনে সে হাঁফিয়ে ওঠে, তখন গ্রামেরই এক অসাধারণ মহিলা জ্যাঠাইমা তাকে বলেছিলেন সমস্যাটিকে আন্তরিকভাবে বিচার করতে হবে। বাইরে থেকে এবং অগভীরভাবে দেখলে গ্রামের মানুষের এই স্বার্থপরতা এবং নীচ দলাদলি অসহ্য বলেই মনে হবে, কিন্তু সমস্যাটিকে বিচার করতে চাইলে এদের একজন হিসাবেই সেটি তাকে দেখতে হবে। তখন বোঝা যাবে, এর জন্য দায়ী দুটি কারণ—এক৷ অর্থনৈতিক অবমূল্যায়ন, এবং দুই৷ শিক্ষার অভাব। অর্থনৈতিক দুরবস্থা চরমে পৌঁছানোর ফলেই মানুষের মনুষ্যত্ব লোপ পেয়েছে এবং সামান্যতম স্বার্থের সন্ধান পেলে মানুষ তা গ্রহণ করতে প্রলুব্ধ হচ্ছে। দীননাথের মতো বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ যে আচরণ করেন তা ঘৃণ্য সন্দেহ নেই কিন্তু তার এই আচরণের মূলে নিহিত আছে এই করুণ অর্থনৈতিক অবস্থাই। ব্যাপারটি প্রায় নৃশংসতার পর্যায়ে চলে গেলেও সুস্থ অনুভবী মন এই চরম সমস্যাটি উপলব্ধি করতে পারবে। কুঁয়াপুর গ্রামে প্রথম এসেই ধর্মদাস চাটুজ্যে এবং গোবিন্দ গাঙ্গুলির যে ঘৃণ্য কলহ রমেশ দেখেছে, তাতে পল্লীসমাজ সম্বন্ধে বীতস্পৃহ হওয়া তার পক্ষে মোটেই অস্বাভাবিক নয়। জ্যাঠাইমা তাকে বুঝিয়েছেন—“এরা যে কত দুঃখী, কত দুর্বলতা যদি জানিস রমেশ, এদের উপর রাগ করতে তোর আপনি লজ্জা হবে।”

দ্বিতীয় কারণ যে শিক্ষার অভাব, সে কথাও জ্যাঠাইমা রমেশকে বলেছিলেন। রমেশের সমস্ত অভিযোগ প্রায় নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছিলেন এই ঘৃণ্য দলাদলি এবং জঘন্য স্বার্থপরতা কেবল যথার্থ জ্ঞানের অভাবের জন্যই। সেই জন্যই তার অনুরোধ—“আলো জ্বেলে দেরে শুধু আলো জ্বেলে দে! গ্রামে গ্রামে লোক অন্ধকারে কানা হয়ে গেল; একবার কেবল তাদের চোখ মেলে দেখবার উপায়টা করে দে বাবা! তখন আপনি দেখতে পাবে তারা কোনটা কালো, কোনটা ধলো”

‘পল্লীসমাজ’কে সামাজিক উপন্যাস বলে অভ্রান্ত স্বীকৃতি দেবার দ্বিতীয় কারণ, পল্লীসমাজের অন্তর্লীন সমস্যাই গভীরভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করেছে উপন্যাসের প্রশন ঘটনাধারা ও চরিত্রের আচরণকে। বেণী ঘোষালের আচরণ অবশ্য এক তরফা, তার কারণ অনুমান করতে বিশেষ সাহিত্যবুদ্ধির প্রয়োজন হয় না, কিন্তু রমেশের সমস্ত শুভ উদ্যোগ এবং মানবিকতা পল্লীসমাজের জটিলতা কীভাবে বিনষ্ট করতে উদ্যত হয়েছে তা আমরা আমাদের সহিত্যবুদ্ধি দিয়েই বুঝি। এর চেয়েও একটি গুরুত্বপূর্ণ, কোমল এবং আকর্ষণীয় দিক এই উপন্যাসে আছে, সেটি হল রমা ও রমেশের আপাত বোঝাপড়ার অভাব সত্ত্বেও এক গভীর ও আন্তরিক প্রেম। এই প্রেম যে কখনোই প্রকাশ পায়নি তার একটা কারণ নিশ্চয়ই হিন্দু নারী হিসাবে রমার আজন্ম সংস্কারের বাধা—সে যে বিধবা, এই সত্য যে নিজেকে কখনোই ভোলাতে পারে না। কিন্তু এর চেয়েও অনেক বড়ো কারণ হল এই যে, সে ভুলতে পারে না আর গ্রাম্যসমাজকে, যাকে সে আজন্ম চেনে—যেখানেই সে এত বড় হয়েছে। রমার কোনরকম দুর্বলতা যদি প্রকাশ পায় রমেশের প্রতি, তাহলে রমার বাড়ির যে-কোনও সামাজিক অনুষ্ঠান সমাজপতিরা বয়কট করবেন, ভাই যতীনের ভবিষ্যৎ জীবন বিষময় হয়ে উঠবে, এ কথা রমা ভালো করেই জানে। এ ছাড়াও তার মনে আশঙ্কা, এ জন্য রমেশকে কথা শুনতে হতে পারে এবং সেরকমটা ঘটলে এক-একটি সামান্য আঘাতও তার মনে অসামান্য হয়ে বাজবে। সুতরাং তার সমস্ত আচার ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করেছে সমাজ। এই কারণেই এই উপন্যাসকে আমাদের সামাজিক উপন্যাস আখ্যা দিতে সম্ভবত কোনও দ্বিধা থাকে না।

তথ্যসূত্র:

কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্তDownload
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাসDownload
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরীDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাসDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যালDownload
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাসDownload
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদারDownload
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তDownload
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দীDownload
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যালDownload
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেনDownload
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!