//
//

‘সাহিত্যসৃষ্টি’ প্রবন্ধের মূল ভাববস্তু নিজের ভাষায় লেখ।

  • সাহিত্য কেবল লেখকের নহে, যাহাদের জন্য লিখিত তাহাদেরও পরিচয় বহন করে।
  • যে বস্তুটা টিকিয়া আছে সে যে কেবল নিজের পরিচয় দেয় তাহা নয়, সে তাহার চারিদিকের পরিচয় দেয়; কারণ, সে কেবল নিজের গুণে নহে, চারিদিকের গুণে টিকিয়া থাকে। ‘সাহিহ্যসৃষ্টি’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যদুটি বিচার কর।

পৃথিবীতে পরিব্যাপ্ত অণুসমূহ এক অজ্ঞাত আকর্ষণে জীবদেহে দানা বাঁধে। এর পরে এক অলৌকিক শক্তির ফলে প্রাণ দেহে সঞ্চারিত হয়। সেই প্রাণ শুধু টিকে থাকে না, নিজেকে প্রকাশ ও বিকীর্ণ করতে চায়। এটা প্রাণের স্বাভাবিক ধর্ম। মানুষের মনেও কত অব্যক্ত ভাব ও ভাবনা ভেসে বেড়ায়। তাদের আকাঙ্ক্ষা হল আকৃতি লাভ করা, অস্পষ্টতা থেকে পরিস্ফুট হওয়া এবং একটি বিশেষ তাৎপর্যের মধ্যে পরিণাম রচনা করা। সচেতন অবস্থায় এই ভাবনাগুলি মানুষের কর্মের মাধ্যমে নিজেদের প্রকাশ করে। কিন্তু যখন দেখা দেয় অবকাশ, লাভ লোকসানের খনি বন্ধ হয়, তখন সামান্য একট উপলক্ষকে কেন্দ্র করে মনের এই ভাবনাসমূহ নানান রূপ ধারণ করেন। হয়তো ফুলের গন্ধকে আশ্রয় করে কত দিনের স্মৃতি, কত হারানো দিনের ইতিহাস মনের সামনে ভীড় করে এসে দাঁড়ায়। এদের উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, শুধুই হয়ে ওঠা, রূপময় হবার প্রয়াস মাত্র। কিন্তু এই হয়ে ওঠা যথেষ্ঠ নয়, এর পরে আসে টিকে থাকার পালা। গাছে যে পরিমাণে মুকুল আসে তারমধ্যে অনেক ঝরে পড়ে। অবশিষ্ট যেগুলি ফলে পরিণত হল, তারা চায় কঠিন শাখার নিরাপদ আশ্রয়। তা না পেলে তাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষের মনেও নানান ভাবনা আসে। কিন্তু সকলের মনে সে সব আশ্রয় পায় না। একমাত্র ভাবুক চিত্তের রসে তারা সার্থকভাবে পরিপুষ্ট হয়।

পুনর্বার গাছে যে ফল এল, তাদের মধ্যে নিজ অধিকার বিস্তার করার, সীমা অতিক্রম করার এক দুর্নিবার বাসনা পরিলক্ষিত হয়। রসে, রঙে, ও গন্ধে পরিপূর্ণতা লাভ করার পরে সে বৃক্ষের বাঁধন ছিড়ে মাটিতে পড়তে চায়। মানুষের মনের ভাবনাও মনের আশ্রয় ছেড়ে বিশ্বমানবের মনে নবজন্ম লাভ করতে চায়। এই বিচিত্র অভিব্যক্তির মধ্যে ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাই ভাবনাগুলি মানুষকে স্থির থাকতে দেয় না। তারা চায় অসংখ্য মানুষের মনে সঞ্চারিত হয়ে সার্থকতা লাভ করতে। এইজন্য দেখা যায়, মন থেকে মনে মিলনের অভিসার চলেছে। একটি মন আর একটি স্পর্শে যেন সজীবতা লাভ করে থাকে। এইজন্য অপরাহ্নে জল ফেলে দিয়েও মেয়েরা ঘাটে যায়। বন্ধুকে পাবার জন্য বন্ধু পায় এবং চিঠিপত্রেরও আদান-প্রদান হয়। এখান সেখানে সভা সমিতিতে, তক-বিতর্ক, বাদানুবাদ ও মত বিনিময় ঘটে। তাই প্রেমিক প্রেমিকাকে আহ্বান করে বলে—

সেইকথা ভালো, তুমি চলে এসো একা,

বাতাসে তোমার আভাস যেন গো থাকে—

স্তব্ধ প্রহরে দুজনে বিজনে দেখা,

সন্ধ্যা তারাটি শিরীষ ডালের ফাঁকে।

মানুষ নিঃসঙ্গ থাকতে পারে না, তার অন্তরের ভাবগুলি তাকে নিঃসঙ্গ থাকতে দেয় না, তাদের চেষ্টাই হল নানা রূপে ও নানা আকারে ব্যক্ত হয়ে ওঠা।

একজন মানুষের মনের ভাবনা রূপলাভ করে অপরের মন অধিকার করতে চায়, তার ফলে ভাবনাগুলি স্বতন্ত্র কিংবা বিচ্ছিন্ন হয়ে বিশেষ একজনের থাকে না। তারা অলক্ষিতে অপর মানুষের মনের উপযোগী হয়ে ওঠে। বন্ধু যখন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে, তখন স্বতঃই সে নিজেকে অপরের মনের ছাঁদে গড়ে নেয়। একজন যখন অপর একজনকে পত্র লিখি তখন সে কল্পনায় তার স্থলাভিষিক্ত করে নেয়। তা ছাড়া তার পুত্র সমাদৃত হবে না। আমার মনের ভাব অন্য এক ব্যক্তির মানসিক স্বীকৃতির জন্য হেঁটে কেটে উপযোগী করে নিতে হয়। মানুষের কথা শ্রোতা ও বক্তা উভয়ের সহযোগে সৃষ্ট হয়ে থাকে। একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুইজনে—

টের বুকে লাগে জলের ঢেউ তবে সে কলতান উঠে,

বাতাসে বনলতা শিহরি কাঁপে তবে সে মর্মর ফুটে।

সাহিত্যে লেখকের যে রচনাটি প্রকাশ পায় তা অজ্ঞাতসারে পাঠক মনের উপযোগী হয়ে ওঠে। ভারতচন্দ্র বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচনা করেছিলেন। তাঁর মনশ্চক্ষুর সামনে ছিল, রাজসভার শ্ৰোতৃমণ্ডলী। দাশরথির পাঁচালীও একদা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এর কারণ, তাঁর কালের শ্রোতাদের অনুরাগ বিরাগের আদর্শেই তা রচিত হয়েছিল। কাজেই লেখক নিজে শুধু লেখেন, পাঠকও তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। সাহিত্যে যাঁরা কৃতিত্ব অর্জন করেছেন তাঁদের রচনাতেও বিশেষ সম্প্রদায়, সমাজ অথবা বিশ্বমানবের মন প্রভাব বিস্তার করেছে। শেক্সপীয়রের নাটকে তাঁর যুগের পৃথিবী সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা প্রকাশিত হয়েছিল। সমস্ত পৃথিবী ঐক্যসূত্রে গ্রথিত। এখানে নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে স্তর পর্যায় ও সুষমাও আছে। বিশ্বজীবন, সমাজ এবং মানব মন—একসূত্রে গ্রথিত। রাষ্ট্রে যেমন বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা, সমাজের সংহতিকে বিচলিত করে তোলে, তেমনি মানুষের মনেও অশান্তি দেখা দিলে তার মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বিনষ্ট হয়ে যায়। রাজা পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তিনি শান্তি ও শৃঙ্খলার নিয়ামক। সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শেক্সপীয়রের যুগে জনসাধারণের মন সমর্থন করতে পারেনি। শেক্সপীয়রও তাই রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সমর্থন করতে পারেননি।

পৃথিবীতে যে বস্তুটি টিকে থাকতে পারলে যে কেবল নিজের গুণে থাকে না, চারদিকের আনুকূল্য লাভ করে বলে থাকতে পারে। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাই। পাঠক সমাজের মানসিক আশ্রয় লাভ করতে পারলে মেঘ, কত বলাকাশ্রেণি, ধরিত্রীতে বারিবর্ষণের সুগন্ধ, নদী-নির্ঝরিণীর উপরে আষাঢ়ের স্নিগ্ধ মেঘের ছায়া, কত কবির মনে ভাব সঞ্চার করেছে। কত বেদনা ও সৌন্দর্যের পলক তার মনে জেগেছে। মহাকবি কালিদাস বহু যুগের সেই ভাবসমূহকে তার ‘মেঘদূত’ কাব্যে গেঁথে দিলেন। যজ্ঞের বিরহ-বাতার সুযোগ নিয়ে শতেক যুগের ভাবগীতিকা তাঁদের কাব্যে মন্দাক্রান্তা ছন্দে পুষ্পিত হয়ে উঠল।

সতীনারীর ছবি আমাদের মনে জাগরূক আছে। গৃহস্থ ঘরে প্রাত্যহিক জীবন যাত্রায় সতী রমণীর কল্যাণী মূর্তিকে আমরা দেখেছি। কিন্তু সেই দেখা আবছায়ার মতো মনে ভেসে বেড়ায়। ‘কুমারসম্ভব’-এ আমাদের মনের ভাব মন্দাকিনীর ধারাধৌত দেবদারুর বনছায়ার হিমালয়ের শিলাতলে উমার তপস্যায় চিরকালীন মহিমা লাভ করেছে। পরিপূর্ণ বর্ষায় শূন্যতার বেদনা, প্রিয়মিলনের আকাঙ্ক্ষা কত নর-নারীর মনকে বেদনাবিধুর করেছে। বিদ্যাপতি এতে তাতে সঠিক সুরটি যেই লাগালেন, তখনই তা গীতিময় সুষমা লাভ করল—

এ ভরা বাদর মাহ ভাদর

শুন্য মন্দির মোর।

মানব মনের অব্যক্ত ভাবটি এক অপরূপ সুর ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে উঠল।

বাষ্প হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়, কিন্তু ফুলের পাপড়ির শীতল স্পর্শে তা শিশির কণায় পরিণত হয়। আকাশের বাপ পাহাড়ের শীতল স্পর্শে মেতে রূপান্তরিত হয়। তখন তার ধারাবর্ষণে নদ-নদী ভরে ওঠে৷ তেমনি মানবমনের অব্যক্ত ভাবসমূহ কবি কল্পনার স্পর্শে কাব্যে বাণীরূপ ধারণ করে গীতিকবিতায় একটি ভাবমুক্তোর মত শোভা পায় এবং মহাকাব্য ভাবের বিচিত্র প্রবাহ ঐক্য লাভ করে রস-পরিণাম রচনা করে। ফরাসি বিপ্লবের সময় নানা কবির মন ভাবসংঘাতে উদ্বেল হয়েছিল। তা যে কোথাও করুণায়, কোথাও জীবন মহিমার বন্দনায়, আবার কোথাও বা বিদ্রোহের সুরে প্রকাশিত হয়েছে। চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেমধর্ম এমনি করে আমাদের দেশে কবিদের মনে ভাববন্যা জাগিয়েছিল। কবির কল্পনা আকর্ষণ কেন্দ্রের মত মানুষের মনের অনুভূতি ও ভাবকে আকর্ষণ করে এনে কাব্যে সার্থক করে তোলে। আমরা যে ভাবকে প্রকাশ করতে পারি না, যা প্রকাশের জন্য ব্যাকুল হয়ে মনকে উদ্বেলিত করে তাঁর অগোচরে, এক বিশ্বব্যাপী গূঢ় প্রচেষ্টার প্রেরণায় তাকে প্রকাশ করেন। কবির এ কথা বলার তাৎপর্য এই যে আমাদের ভাবের সৃষ্টি একটা খামখেয়ালি ব্যাপার নহে, ইহা বস্তুসৃষ্টির মতোই একটা অমোঘ নিয়মের অধীন। প্রকাশের যে-একটা আবেগ আমরা বাহিরের জগতে সমস্ত অণু-পরমাণুর ভিতরেই দেখিতেছি, সেই একই আবেগ আমাদের মনোবৃত্তির মধ্যে প্রবলবেগে কাজ করিতেছে। অতএব যে চক্ষে আমরা পর্বত-কানন-নদনদী-মরুসমুদ্রকে দেখি, সাহিত্যকেও সেই চক্ষেই দেখিতে হইবে ইহাও আমার তোমার নহে, ইহা নিখিল সৃষ্টিরই একটা ভাগ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!