‘সাহিত্যের তাৎপর্য’ প্রবন্ধের স্বরূপ ব্যাখ্যা কর।
- সাহিত্যের বিষয় মানবহৃদয় এবং মানবচরিত্র।
- সাহিত্য ব্যক্তিবিশেষের নহে, তাহার রচয়িতার নহে, তাহা দৈববাণী। ‘সাহিত্যের তাৎপর্য’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যদুটি আলোচনা কর।
সাহিত্যের অবলম্বন মানবহৃদয়। আমাদের সামনে প্রসারিত যে বস্তুবিশ্ব তা অবিচ্ছিন্ন বস্তু। এখানে সকল কিছু বিপর্যস্ত ও অবিন্যস্ত হয়ে আছে। ভাল ও মন্দ, মুখ্য ও গৌণ প্রকৃতির অপক্ষপাত প্রাচুর্যহেতু পৃথিবীতে জড়াজড়ি করে আছে। মানবহৃদয়ের বিচিত্র ভাবরসে এই পৃথিবী রূপান্তরিত হয়। সাহিত্যের ধর্ম হল বাস্তব পৃথিবীকে মানসিক ও মানবিক করে তোলা। জঠরের জারকরস যেমন খাদ্যদ্রব্যকে পরিপাক করে শক্তি আহরণ করে, তেমনি হৃদয়বৃত্তির জারকরসে বাইরের জগৎ অন্তরের হয়ে যায়। চেতনার স্পর্শে যা নিতান্ত জড়বস্তু তা হয় সুন্দর—
সেই আমির গহনে আলো-আঁধারের ঘটল সংগম,
দেখা দিল রূপ, জেগে উঠল রস;
‘না’ কখন ফুটে উঠল হাঁ, মায়ার মন্ত্রে,
রেখায় রঙে, সুখে দুঃখে।
বাইরের জগতের সংগে মানবের জগতের পার্থক্য আছে। মানব জগৎ জানায় সুন্দর ও অসুন্দরের পার্থক্য, ভালো-মন্দের ব্যবধান। এ নিছক সংবাদ দেয় না, তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে না, রসের পাত্রে তত্ত্বকে পরিবেশন করে। জগৎ ও জীবনের প্রবাহ অত্যন্ত পুরাতন। কিন্তু কবি একে নব নব রূপে উপলব্ধি করেন বলে যা পুরনো তাই নিত্য নবীন রূপে প্রতিভাত হয়। কিন্তু এই জগৎকে হৃদয়ে গ্রহণ করে বাইরে প্রকাশ করতে না পারলে তা অসার্থক হয়ে যায়। মানবহৃদয় তাই চিরকাল নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছে। এই প্রকাশের নাম সাহিত্য। কবির হৃদয়বেদনা যত গভীর হয়, কল্পনা যত বিশ্বব্যাপী হয় ততই সাহিত্যের বিস্তৃতি ঘটে। মানববিশ্ব ও সাহিত্যের বিস্তৃতির মধ্যে আমাদের মন বিপুলম্ব লাভ করে। যে মানসজগৎ অন্তরের মধ্যে সৃষ্ট হয়ে ওঠে, তাকে এমনভাবে করতে হয় যাতে সে অপরের হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়ে সত্য হয়ে ওঠে। তাই হৃদয়ের ভাবকে যথাযথরূপে ধারণ করতে হলে ছলাকলা, আভাস-ইঙ্গিতের প্রয়োজন হয়।
কবি যে অরূপকে উপলব্দি করেন, তাকে রূপের মধ্যে প্রকাশিত করতে হলে ভাষার মধ্যে অনির্বচনীয়তাকে রক্ষা করতে হয়। নারীর যেমন শ্রী ও স্ত্রী, সাহিত্যের অনির্বচনীয়তাও সে রকম ছন্দ, অলংকার ও ভাষার অতীত নিগূঢ় ব্যঞ্জনায় আভাসিত হয়। এই যে ভাষাতীত ব্যঞ্জনা তার জন্য কাব্যে চিত্র ও সঙ্গীত—এই দুই উপকরণের প্রয়োজন হয়। চিত্রের মাধ্যমে মানবহৃদয়ের ব্যাকুলতা এবং সঙ্গীতের মাধ্যমে যে ভাব গভীর ও অন্তৰ্গূঢ় তাকে ব্যক্ত করা হয়।
কেবলমাত্র মানুষের হৃদয়কে যে সাহিত্যে ব্যক্ত করা হয় তাই নয়, মানবচরিত্রও আমাদের ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আয়ত্ত হয়। এই মানবচরিত্র সম্পর্কে আমাদের কৌতূহলের সীমা নেই, কিন্তু সে অন্তরময় বলে অন্তর মেশালে তার পরিচয় পাওয়া যায়। মানবচরিত্র স্থির নয়, সুসংগত ও নয়। তার মধ্যে নানা স্তর আছে, বিভাগ আছে। এ কোথাও প্রকাশিত, কোথাও বা অপ্রকাশের আবরণে ঢাকা। এ সদা চঞ্চল, পরিবর্তনশীল। এর অন্দরে বাইরে অবারিত গতিবিধি সহজসাধ্য নয়। এ ব্যতীত এর লীলা এত সূক্ষ্ম, অভাবনীয় ও আকস্মিক যে, তাকে সম্পূর্ণরূপে জানা ও আয়ত্ত করা কঠিন। মহৎ কবিগণের কাব্যে মানব-জীবনের সুসঙ্গত প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়।
বাইরের জগৎ ও মানবজীবন—এই উভয়ে মিলিয়ে অন্তরে যে মহা ঐকতান রচনা করে, তারই প্রকাশ সাহিত্য। এই প্রকাশ ভাষার সাহায্যে ঘটে থাকে, কখনও চিত্ররীতির মাধ্যমে, কখনও বা সংগীতের সুরে। এই চিত্র ও সঙ্গীত কোথাও থাকে বিযুক্ত কিন্তু প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে তারা পরস্পর সংলগ্ন হয়ে ভাব প্রকাশকে সার্থক করে তোলে। প্রকাশ যথাযথ হলে অনির্বচনীয়ের ব্যঞ্জনা বহুদূর প্রসারিত হয়। ‘সোনারতরী’র ‘পুরস্কার’ কবিতায় কবির তাই আকাঙ্ক্ষা হল—
অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দ শোক করি-বিরচন
গীতরসধারা করি সিঞ্চন
সংসার ধূলিজালে।
চিত্র ভাবকে আকার দেয়, সংগীত তাতে গতিরূপ সঞ্চারিত করে। চিত্র হল দেহ এবং সংগীত তার প্রাণ। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিত্র ও সংগীত একাত্ম হয়ে অনির্বচনীয় মাধুর্যকে প্রকাশ করে থাকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাগরিকা’ কবিতায় বালী কন্যার সঙ্গে ভারত পুরুষের মিলন বর্ণনা করে বলেছেন—
মধুর হোলো বিধুর হোলো মাধবী নিশীথিনি,
আমার তালে তোমার নাচে মিলিল রিণিঝিনি।
পূর্ণ-চাঁদ হাসে আকাশ-কোলে,
আলোক-ছায়া শিব-শিবানী সাগর জলে দোলে।
এইখানে চিত্র ও সংগীত মিলিত হয়ে এক অপূর্ব ভাব-ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে।
মানবহৃদয়ও সাহিত্যে আপন অন্তরের আনন্দ ও ঐশ্বর্যকে ব্যক্ত করার, সৃজন করার প্রয়াস করছে। মানবহৃদয়ের প্রকাশের এই যে প্রচেষ্টা, কবিগণ তার উপলক্ষ্য মাত্র। ভগবানের সৃষ্টি প্রকৃতির ও মানবজীবনের সৌন্দর্যকে নিয়ে উৎসারিত। কিন্তু সৌন্দর্যপ্রকাশ সাহিত্যের উপলক্ষ্য মাত্র, উদ্দেশ্য নয়। হ্যামলেট বা ওথেলোর চিত্র মানবহৃদয়ের প্রকাশ। সাহিত্যে আমরা সমগ্র মানুষের পরিচয় পাই। মহৎ কবিদের রচনায় মনুষ্যত্বের নিরাবরণ প্রকাশ আমরা দেখি। শেকসপীয়রের নাটকে মানুষের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা আমাদের মুগ্ধ করে। প্রকাশ যেখানে যথাযথ তার সংঘাতে আমাদের মনুষ্যত্বের উদ্বোধন ঘটে। জীবনের প্রকাশ যেখানে সামগ্রিক সেখানে সুবৃহৎ অনাবরণকে অশ্লীল বলা যাবে না। কিন্তু যেখানে মনুষ্যজীবনের আংশিক প্রকাশ ঘটে, সেখানে আংশিক অনাবরণ অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট। শেক্সপীয়র ও অন্যান্য মহৎ কবিরা সমস্ত মানুষকে দেখেছেন বলে তার প্রতিকৃতি সহজে ব্যক্ত করেছেন।
বিশ্বের নিঃশ্বাস আমাদের চিত্তে রাগিনী বাজাচ্ছে। সাহিত্য তাকেই স্পষ্ট করে প্রকাশের প্রয়াস করছে। এই যে সাহিত্য তা ব্যক্তিবিশেষের নহে, রচয়িতারও নহে, তাহা দৈববাণী। বাইরের জগৎ যেমন তার ভালো-মন্দ, অম্পূর্ণতা নিয়ে ব্যক্ত হবার প্রয়াস করে, মানুষের বাণীও সেইরকম হৃদয় থেকে সুসম্পূর্ণরূপে বের হবার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালাচ্ছে। কবি যা সৃষ্টি করেন তা দৈবী প্রেরণার বশে। যাকে ইংরেজিতে ইনসপিরেসন বলে সে একটা মুগ্ধ অবস্থা, তখন লেখক একটা অর্ধচেতন শক্তির প্রভাবে কৃত্রিম জগতের শাসন অনেকটা অতিক্রম করে এবং মনুষ্যরাজার যেখানে খাস দরবার সেই মর্মসিংহাসনের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয়। এই দৈবী প্রেরণা সম্পর্কে প্লেটো বলেছেন—“For all good poets, epic as well as lyric, compose their beautiful poems not by art, but because they are inspired and possessed. And as the corybantian revellers when they dance are not in their right mind, so the lyric poets are not in their mind when they are composing their beautiful strains.’’
মানবহৃদয়কে জানতে পারলে, তার অতলান্ত রহস্যের পরিচয় পেলে, মানবচরিত্রকে প্রকাশ করা সহজ হয়ে পড়ে। প্রাণের রঙ্গভূমিতে মানুষ আবির্ভূত হল অনেক পরে। সে তার চৈতন্যের। আলোয় জড় বিশ্বকে জয় করেছে। পৃথিবীজুড়ে চলেছে মানুষের চৈতন্য প্রকাশের পালা। কবির ধর্ম হল এই মানবচৈতন্যকে প্রকাশ করা, তার প্রকাশের বাধা অপসারিত করে দেওয়া—
পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে
অঙ্কে অঙ্কে চৈতন্যের ধীরে ধীরে প্রকাশের পাশা
আমি সে নাট্যের পাত্রদলে
পরিয়াছি সাজ।
আমার আহ্বান ছিল যবনিকা সরাবার কাজে,
এ আমার পরম বিস্ময়।
Leave a Reply