ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা, ইহাই সাহিত্য, ইহাই ললিতকলা।
- ভাবকে নিজের করিয়া সকলের করা, ইহাই সাহিত্য, ইহাই ললিতকলা।
- সাহিত্যে যাহা সত্য তাহাকে গ্রহণ করা হয় রসরূপে। ‘সাহিত্যের সামগ্রী’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যদুটি বিচার কর।
সাহিত্য ভাবের বিষয়। ভাবকে সংবেদনশীল পাঠকের মনে সঞ্চারিত করে দেবার উদ্দেশ্যে সাহিত্য রচিত হয়ে থাকে। যা জ্ঞানের কথা তা প্রমাণসাপেক্ষ। যে জ্ঞানের বিষয় মানুষ একবার জেনেছে, দ্বিতীয়বার তা আর জানতে চায় না। কিন্তু যে সাহিত্যে হৃদয়ভাবের কথা ব্যক্ত হয় তা বার বার প্রকাশ করলেও পুরোনো হয় না। বরং হৃদয়ের অনুভূতি কাল পরম্পরায় যত পুরোনো হয় ততই তা গভীর। এর আবেদন কালপ্রবাহে লোকমনে আরও ব্যাপ্তি লাভ করে। নরনারীর বহু পুরোনো বিরহ-মিলন-গাথা প্রায় পৃথিবীর মতই প্রাচীন। কিন্তু এই গাথা কত কবির কাব্যে, যুগযুগান্তর হতে বর্ণিত হয়ে আছে। কত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর রূপকে উদ্ঘাটিত করা হচ্ছে। তথাপি এর আবেদন ক্ষুণ্ন না হয়ে বেড়ে চলেছে। সূর্যোদয়ের আনন্দ ও সৌন্দর্য প্রাণের রসভূমিতে মানুষের আবির্ভাব কাল থেকে আজ পর্যন্ত অম্লান আছে। কোন ভাব বা অনুভূতিকে চিরকালিন প্রতিষ্ঠা দান করতে হলে সাহিত্যকে অবলম্বন করতে হয়। ভাবের ধর্ম হল একমন থেকে আরেক মনে সঞ্চারিত হয়ে যাওয়া আর জ্ঞানের কথা প্রমাণসাপেক্ষ। ভাব যে রূপে যে বিগ্রহের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত লাভ করে তা থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কিন্তু জ্ঞানের কথাকে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় সহজে রূপান্তরিত করা যায়। এতে তার মাধুর্য বা বক্তব্যের গুরুত্ব হ্রাস পায় না। ভাবের একটি অখণ্ড মূর্তি আছে। এজন্য তা অনির্বচনীয় এবং অসীমের ব্যঞ্জনা প্রকাশ করে।
এই অসীমকে রূপের আধারে প্রকাশ করার জন্য শিল্পীর কত বিচিত্র সাধনা। রবীন্দ্রনাথের ‘বাজেকথা’ প্রবন্ধে দেখি বিশ্বকবি এই বাজে খরচের বিভাগে তাঁর থলি ঝুলি কেবলই উজাড় করে দিচ্ছেন, অথচ রসের ব্যাপারে আজও দেউলে হলো না। মানুষের অন্তরে যে ভাবের পিপাসা আছে তা কাব্যে, সঙ্গীতে, ললিতকলায় প্রকাশিত হয়। এই পিপাসা হল অন্তরবাসী পুরুষের। জ্ঞানের দুটি দিক আছে, একটি তথ্য অপরটি সত্য। পৃথিবীতে যা আছে তার পরিচয় যখন লাভ করি, তখন তাকে বলি তথ্য। কিন্তু এই তথ্য যখন পূর্ণতাকে আশ্রয় করে তখন নাম হয় সত্য। তথ্য খণ্ডিত, বিচ্ছিন্ন কিন্তু তা সত্যকে অবলম্বন করে সার্থকরূপে প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশই আসল কথা। কাব্য সাহিত্য ও ললিতকলার ধর্ম হচ্ছে প্রকাশ। তথ্যকে কেন্দ্র করে মনকে সত্যের স্বাদ দেওয়া হল সাহিত্য ও ললিতকলার উদ্দেশ্য। কিনু গোয়ালার অন্ধকার, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে সত্তদাগরি অফিসের কনিষ্ঠ কেরাণী হরিপদ দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত জীবন যাপন করে তা তথ্য মাত্র। কিন্তু বাঁশীর সুরে তার মানব সত্তার উজ্জীবনকে সত্য বলা যাবে। প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন—
জীবন মানে না জৈব নীতির দাস্য।
ভুলে জ্বলে-ওঠা দৈব দীপ্তি, ঊর্মিল উল্লাস,
ভাঙে ভাঙে বুঝি প্রাণ-শৃঙ্খলে অন্ধ অনু প্রাস।
চিত্রকর যখন ছবি আঁকেন তখন তথ্যকে ততটুকু গ্রহণ করেন, যাকে উল্লেখ করে তিনি সুষমাকে প্রকাশ করতে পারবেন। সাহিত্যে যা সত্য তাহাকে গ্রহণ করা হয় রস-রূপে।
যাকে ভাব বলা হয়, তা সকল মানুষের হৃদয়ে আছে। এইভাব যদি একজন প্রকাশ না করেন, তবে অন্য একজন এসে করবে না; সুতরাং ভাব হল সর্বসাধারণের। ভাবকে প্রকাশ রীতি সম্পূর্ণ লেখকের। এই রীতির মধ্যে স্রষ্টার মৌলিকতা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। ভাবকে বিশেষ মূর্তির মধ্যে প্রকাশ করে সকলের আনন্দের সামগ্রী করে ভােলার কৃতিত্বের মধ্যে লেখকের কীর্তি নিহিত। যে ভাব সকলের মনে ছড়িয়ে আছে, কোথাও ব্যক্ত, কোথাও অব্যক্ত—লেখক তাকে নিজের করে নেন। প্রত্যক্ষগোচর জগৎ হল সাহিত্যসৃষ্টির উপাদান। এই জগৎ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করা হয়। সুতরাং যে ভাবটিকে লেখক স্বীকার করলেন, তাকে অনুভূতি ও কল্পনায় সমৃদ্ধ করে তিনি নতুন করে প্রকাশ করেন।
এই প্রকাশ সম্পর্কে একটি কথা আছে—সাধারণ মানুষের অন্তরে ভাব আছে কিন্তু তারা এই অনির্বচনীয় ব্যাকুলতাকে প্রকাশ করতে পারে না। তারা নিজেরা না বুঝে বোঝাতে পারে । লেখক বা কবির ধর্ম হল—
কিছু ঘুচাইব সেই ব্যাকুলতা,
কিছু মিটাইব প্রকাশের ব্যথা,
বিদায়ের আগে দুচারিটা কথা
রেখে যাব সুমধুর।
কবি নির্জনে বসে সাধনা করেন বটে, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি মানব-সমাজের জন–বিহঙ্গের গান হয়ত স্বতোৎসারিত, নিজের আনন্দ প্রকাশ ছাড়া তার অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু কবির রচনা সম্পর্কে কথা বলা যায় না। পাঠক সমাজই তাঁর লক্ষ্য। কবির অন্তরের ভাবনারাজি বিশেষ অবস্থায় ভাব সংঘাতে অথবা নতুন পরিচয়ে জেগে ওঠে, তখন সেই ভাবসমূহকে তিনি প্রকাশ করতে চান। এ প্রসঙ্গে ম্যাথু আর্নল্ড-এর বক্তটি এখানে প্রাসঙ্গিক বলেই তার উল্লেখ করা যেতে পারে— ‘‘for a literary master-piece, two powers must concur, the power of the man, and the power of the moment, and the man is not enough without the moment.’’ বর্ষাকালে জলস্ফীত ব্রহ্মপুত্র নদী যেমন তট-অরণ্য প্লাবিত করে প্রলয় নৃত্যপর মহাদেবের মত ডম্বরুধ্বনি করে প্রচণ্ড গর্জনে ছুটে চলে ও নতুন। করে কূল রচনা করতে চায়, মহাকবি বাল্মীকিও তেমনি হৃদয়াবেগকে বাণীবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কবি এমনভাবে তাঁর অন্তরের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন, তা তাঁর নিজস্ব হয়েও পরের হয়। কবি স্রষ্টা কিন্তু তাঁর কাব্যের ভোক্তা হল পাঠকসমাজ। এমনভাবে কবি তাঁর ভাব ব্যক্ত করেন যা অর্থবহ ইংগিত, দূরপ্রসারী ব্যঞ্জনা আভাসিত হয়। এই অর্থে একটি সষ্টি, তা কাব্য, চিত্র ও ভাস্কর্য হোক-লেখক ও পাঠক উভয়ে মিলে সৃষ্টি করেন। কবির ভাষায়—
একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুইজনে;
গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেকজন গাবে মনে।
যে কবিতার অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট ও সহজবোধ্য, সেখানে পাঠক কিছু প্রত্যাশা করেনা। অতি স্পষ্টতার জন্য সেখানে ব্যঞ্জনা নষ্ট হয়ে যায়। কাব্যসৃষ্টির সার্থকতা হল, যেখানে কবির বক্তব্য সহৃদয় হৃদয় সংবাদী পাঠকমনে সঞ্চারিত হয়ে যায়। পাঠক যেখানে সহজে কবির সৃষ্টির সঙ্গে একাত্মতা স্থাপন করেন, সেখানে বুঝতে হবে কবিতার ভাবটি সাধারণীকৃত হয়েছে। একটি বিশেষ ভাবকে সাধারণের উপভোগ্য করে তোলার ক্ষমতাকে সাধারণীকরণ বলা যায়। কবি ভাবসমূহকে নিজ মানসে প্রতিফলিত করে পাঠকসমাজকে দান করেন। সুতরাং দেখা যায়, কাব্যসৃষ্টিতে নৈর্ব্যক্তিক কিছু থাকে না। যেখানে কবির সৃষ্টি বস্তুধর্মী, সেখানেও তিনি ভাবসমূহকে আপন অনুভূতি ও. মনোভাবে রঞ্জিত করে প্রকাশ করেন। বিজ্ঞানে আমরা নির্লিপ্তভাব প্রত্যাশা করি। কারণ, বিজ্ঞানে ব্যক্তি-নিরপেক্ষ। কিন্তু সাহিত্যের বাণী স্বয়ংবরা। উপন্যাস ও নাটকে লেখক নির্লিপ্ত থাকেন বটে, কিন্তু বিজ্ঞানীর মত নিরাসক্ত থাকতে পারেন না। সেখানে তিনি নানারূপে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করে থাকেন। শেক্সপীয়রও নানা চরিত্রের মধ্যে নিজেকে ব্যক্ত করেছেন। অতএব সাহিত্য সম্পর্কে যে কথা সত্য, যে কোন ললিতকলা সম্বন্ধেও এই কথা বলা চলে।
Leave a Reply