ভারতীয় জনজীবনে ও সাহিত্যে রামায়ণের প্রভাব আলোচনা কর।
ভারতীয় জনজীবনে ও সাহিত্যে রামায়ণের প্রভাব
রামায়ণ-মহাভারত ভারতীয় জীবনের জীবন্ত প্রেরণা। ভারতীয় জীবনে ও বাংলা সাহিত্যে এই দুটি গ্রন্থের প্রভাবও অপরিসীম। এ দুটি গ্রন্থ যেমন ভারতবর্ষের অন্তঃকরণের। ইতিহাস, তার ধর্মবোধ, কর্মনীতি ও চারিত্রিক আদর্শকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে তেমনি আবার এ দুটি গ্রন্থ এদেশের চরিত্রনীতি, কর্মাদর্শ ও ধর্মবোধকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। সেজন্য পাশ্চাত্য সমালোচক Winternitz যথার্থই বলেছেন— “It has been the property of the whole Indian people, and as scarcely any other poem in the entire Literature of the World, has influenced the thought and poetry of a great nation for centuries.’’
রামায়ণে উপস্থাপিত হয়েছে ভারতবর্ষের জীবনাদর্শ ও হৃদয়াবেগ, ভারতীয় জীবনে রামায়ণের জীবনাদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে। ধনীর প্রাসাদ থেকে দরিদ্রের পর্ণকুটীর পর্যন্ত এই কাব্য আজও পরম শ্রদ্ধায় সমাদৃত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতের আপামর জনসাধারণ তাতে চির অনুপ্রাণিত হয়ে এসেছে। ভারতীয় জীবনে রামায়ণ একাধারে ধর্মশাস্ত্র ও মহাকাব্য। হিন্দুদের চতুর্বর্গ ফলপ্রাপ্তির আধার এই রামায়ণ। তাই আদিকবি হলেন—
কামার্থগুণসংযুক্তং ধর্মার্থগুণবিস্তরম্।
সমুদ্রমিব রত্নাঢ্যং সর্বশ্রুতিমনোহরম্।।
ভারতীয় সমাজে রামচন্দ্র পিতৃভক্ত, ভ্রাতৃবৎসল, পত্মীপ্রেমিক, আশ্রিতপালক প্রজানুরঞ্জক। লক্ষ্মণ আদর্শ দেবর, আদর্শ ভ্রাতা; ‘ভরত ভ্ৰাতৃভক্তির পলান্ন’, ত্যাগের একাদর্শ। আর সীতা পাতিব্রত্যের পরাকাষ্ঠা, তার পবিত্রতা অগ্নিশুদ্ধা। এসব চরিত্রের প্রভাব আজও ভারতীয় জীবনে। রামায়ণে প্রতিফলিত পারিবারিক চিত্র সমাজকল্যাণে গৃহধর্মকে অখণ্ড সৌন্দর্যের তাৎপর্যে ও পবিত্রতায় মণ্ডিত করেছে।
ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক জীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে রামায়ণ। ভারতের বহুমানুষ প্রতিদিন রামসীতার নাম জপ করে। উত্তর ভারতে পারস্পরিক মিলন সম্ভাষণে ‘রামরাম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। বাংলায় বড় কিছু বোঝাতে ‘রাম’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। রামরাজ্য বলতে আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে বোঝায়। মৃত্যুকালে বালির উপদেশাবলী সুগভীর নীতিজ্ঞানের পরিচায়ক তা ভারতীয় জীবনে বিশেষ প্রভাববিস্তার করেছে। রাম-সুগ্রীবের মিতালি আমাদের ভারতীয় জীবনে বন্ধুত্বের আদর্শ হনুমানের দাস্য ও সেবা এখনো ভারতীয় জীবনে আদর্শস্থল। ভারতীয় জীবনে বিরোধের মধ্যে ভক্তি রামও রাবণের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেননা রাবণবধের জন্য রামচন্দ্রের অকালবোধনের পুরোহিত ছিলেন রাবণ। রাবণের বলদর্প, জিগীষা ও কামোন্মত্ততা ভারতীয় জীবনে দুর্লক্ষ নয়। রামায়ণের চরিত্রগুলি ভারতীয় জীবনে কালের বুকে যেন পাষাণরেখা। রামায়ণ রচনাকালে ব্রহ্মা বাল্মীকিকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন—
যাবৎ স্থাস্যন্তি গিরয়ঃ সরিতশ্চ মহীতলে।
তাবৎ রামায়ণী কথা লোকে প্রচরিষ্যতি।।
অর্থাৎ যতদিন পৃথিবীতে গিরি-নদী থাকবে, ততদিন পর্যন্ত রামায়ণের কাহিনী লোকসমাজে প্রচারিত হবে। এ থেকে বোঝা যায় ভারতীয় জনজীবনে বাল্মীকির কদর কতখানি।
শুধু ভারতীয় জীবনে নয়, ভারতীয় সাহিত্যে তথা বাংলা সাহিত্যে রামায়ণের প্রভাব অপরিসীম। কেননা ভারতীয় কবিগণ বেশিরভাগই বাল্মীকিকে আদিকবি রূপে সম্মান জানিয়েছেন। ভারতীয় কবিরা রামায়ণ থেকে অজস্র উপাদান আহরণ করে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাকে সজীব ও প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। সংস্কৃত সাহিত্যে কালিদাস, ভবভূতি থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ব্যক্তিত্ব বাল্মীকির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
সংস্কৃত সাহিত্যে রামায়ণের প্রভাব
ক। নাট্যকার ভাস— ‘প্রতিমা’, অভিষেক’ নাটক।
খ। কালিদাস— ‘রঘুবংশ’ কাব্য, ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ নাটক, ‘মেঘদূত’ কাব্য।
গ। ভবভূতি— ‘মহাবীরচরিত’, ‘উত্তররামচরিত’ নাটক।
ঘ। ভট্টি— ‘রাবণবধ’ বা ভট্টি কাব্য।
ঙ। কুমারদাস— ‘জানকিহরণ’ নাটক।
চ। মুরারি— ‘অনর্ঘরাঘব’ নাটক।
ছ। ক্ষেমেন্দ্র— ‘রামায়ণমঞ্জরী’।
জ। ভোজ— ‘চম্পু রামায়ণ’।
ঝ। অশ্বঘোষ— ‘বুদ্ধচরিত’।
Leave a Reply