সাহিত্যেও মানুষ বিচিত্রভাবে আপনার আনন্দরূপকেই ব্যক্ত করিতেছে।
- সাহিত্য দুই রকম করিয়া আমাদিগকে আনন্দ দেয়। এক, সে সত্যকে মনোহররূপে আমাদিকে দেখায়, আর সে সত্যকে আমাদের গোচর করিয়া দেয়।
- সাহিত্য তেমনি করিয়া একটা সামঞ্জস্যের সুষমার মধ্যে সমস্ত চিত্র দেখায় বলিয়া আমরা আনন্দ পাই। এই সুষমা সৌন্দর্য।
- সাহিত্যে তেমনি মানুষ কেবল যে আপনার ভাবের প্রাচুর্যকেই প্ৰকাশ করিয়া থাকে তাহা নহে, সে আপনার প্রকাশ শক্তির উৎসাহ মাত্রকেই ব্যক্ত করিয়া আনন্দ করিতে থাকে।
- সাহিত্যেও মানুষ কত বিচিত্রভাবে নিয়ত আপনার আনন্দরূপকেই ব্যক্ত করিতেছে তাহাই আমাদের দেখিবার বিষয়। ‘সৌন্দর্য ও সাহিত্য’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যগুলির যৌক্তিকতা বিচার কর।
‘সাহিত্য ও সৌন্দর্য’ প্রবন্ধে কবি বলেছেন—দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক সত্যকে উপলদ্ধি করার জন্য সাধনা করে থাকেন। কিন্তু দার্শনিক ও বিজ্ঞানী নিরাসক্ত মন নিয়ে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে, কার্যকারণ সূত্র আবিষ্কার করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়াস করেন। আবার জ্ঞানের আলোয় যে সত্যকে পাওয়া যায় তার সঙ্গে হৃদয়ের কোন সম্পর্ক থাকে না, কেননা সত্য সেখানে ব্যক্তি-নিরপেক্ষ, বস্তুধর্মী ও নিরাসক্ত। কিন্তু কবি বা সাহিত্যস্রষ্টা বোধির আলোকে সত্যকে উপলদ্ধি করেন। সত্যের মধ্যে যে অসীমতা আছে তা তাঁর মনে প্রতিভাত হয়। জ্ঞানরূপে সত্যকে লাভ করলে বুদ্ধিদীপ্ত মনের অধিকার বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়। এর ফলে শক্তিকে উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু হৃদয়ের আলোয় সত্যকে লাভ করার অর্থ হ’ল সত্যকে সৌন্দর্যবোধের মাধ্যমে গ্রহণ করা। এর ফলে সত্যের আনন্দরূপ উদঘাটিত হয়। জগতের সত্যকে যখন যুক্তি ও তর্কের মধ্যে দিয়ে পাবার চেষ্টা করা হয়, তখন তার আংশিক রূপকে আমরা দেখি। কিন্তু এই সত্যকে যখন নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করি তখন তার সমস্ত পরিচয় পরিস্ফুট হয়। জগতে যেখানে আমাদের মন আকৃষ্ট হয় সেখানেই পাই সত্যের সার্থক পরিচয়। জগতে অধিকাংশ মানুষ আমাদের কাছে অপরিচিত ও ছায়াচ্ছন্ন। কিন্তু মানুষকে যখন ব্যক্তিরূপে অন্তরে গ্রহণ করতে পারি, তখন সে সত্য হয়ে ওঠে। আমাদের প্রীতি ও অনুরাগের মধ্যে দেশ আর ভৌগোলিক পরিচয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে চিন্ময়ী সত্তায় পরিণত হয়। যে সত্য হৃদয়ের অনুভূতিতে সুস্পষ্টরূপে সত্য হয়ে প্রকাশিত হয় তাতেই আমাদের গভীর আনন্দ।
ইংরেজ কবি কীটস সৌন্দর্য ও সত্যকে একাত্মরূপে ব্যাখ্যা করেছেন। সত্যকে যখন আমরা হৃদয়মনীষামনসা উপলদ্ধিকরি তখন তা সুন্দর হয়। বাস্তব জীবনে দুঃখের অভিজ্ঞতা শোকাবহ। এ সত্য সন্দেহ নেই। কিন্তু এই দুঃখকেও নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতে পারলে তা আনন্দকর হয়ে ওঠে। দুঃখের উপলদ্ধিতে আমরা আমাদের চৈতন্যকে নিবিড়ভাবে জানতে পারি। এই জানার মধ্যে আবার আনন্দ আছে। মানব চৈতন্য যখন অসাড় হয়ে থাকে, তখন তা হয় দুঃখকর। আমার চৈতন্য-সত্তাকে যখন গভীরভাবে, একান্তরূপে উপলব্ধি করার সুযোগ পাই, তখনই আমাদের আনন্দ জন্মে। তাই কবির ধর্ম হল চৈতন্য-সত্তা থেকে জড়-যবনিকা অপসারিত করে দেওয়া। কবির ভাষায়—
আমারো আহ্বান ছিল যবনিকা সরাবার কাজে
সে আমার পরম বিস্ময়।
নিবিড় বোধের দ্বারা সত্যকে যেমন সমগ্রভাবে আমরা উপলদ্ধি করি, তেমনি তার মধ্যে সৌন্দর্যের পরিচয় পাই। একান্ত উপলব্ধির দ্বারা বস্তুর ভাবসত্য তা নিঃসংশয়ে গ্রহণ করা যায়।
সৌন্দর্যবোধ মানুষকে তার ব্যক্তিক সীমিত ক্ষেত্র থেকে নৈর্ব্যক্তিক প্রসারিত ক্ষেত্রে বহুর সান্নিধ্যে উপস্থিত করে। প্রত্যেকের বিকাশের মূলতত্ত্বই থেকে যায় সমগ্রের সঙ্গে যোগে। এই যোগ কবি বার বার বলেছেন প্রয়োজনের নয়, আনন্দের। জ্ঞানের দ্বারা আমাদের মনের, কর্মের দ্বারা আমাদের শক্তির এবং সৌন্দর্যের দ্বারা আমাদের আনন্দের ব্যাপ্তি ঘটে। সৌন্দর্যবোধ ক্রমে ক্রমে আমাদের বহির্জগতকে আনন্দের জগতে পরিণত করে সীমার বন্ধন থেকে বিকাশের মধ্যে আমাদের মুক্তি দেয়। সুন্দর বস্তুমাত্রই আনন্দদায়ক। সুন্দর অথচ আনন্দ দান করে না কবির মতে এ অত্যন্ত বিরুদ্ধ কথা। এই প্রসঙ্গে দার্শনিক জর্জ সান্তায়ানাও বলেছেন— ‘‘A object cannot be beautiful if it can give pleasure to nobody, a beauty to which all men are forever indifferent it is a contradiction in terms.’’ অবশ্য সুন্দরের সঙ্গে আনন্দের সম্পর্ক বিচারে সান্তায়ানা শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, সুন্দর হল মূর্তিমান আনন্দ— ‘‘Thus beauty is constituted by the objectification of pleasure. It is pleasure objectified.’’ সুন্দর যে আমাদের দান করে তার প্রধান কারণ বিভেদে সামঞ্জস্য। সাহিত্যে সুন্দরের ভূমিকা আলাদা প্রসঙ্গ, কিন্তু সুন্দর ও সাহিত্য কোনটিই যেমন অসমঞ্জস্য নয়, তেমনি আনন্দই তাদের মূল স্বভাব। সুন্দর ও সাহিত্যে আমরা নিজদের সত্যরূপের সন্ধান পাই বলে তারা আনন্দময়।
রবীন্দ্রনাথসহ অন্যান্য রোমান্টিকধর্মী সমালোচকরা সাহিত্যসৃষ্টিকে ব্যক্তিমনের প্রকাশরূপে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে এজরা পাউণ্ড এবং টি.এস.এলিয়ট কাব্য সৃষ্টি প্রসঙ্গে বলেছেন যে, কাব্য বা সাহিত্য স্রষ্টার ব্যক্তি মনের ঐশ্বর্য প্রকাশ করে না। এ হল মনের নিরাসক্ত সৃষ্টি।’ ‘‘Impression and experiences which are important for the man may take no place in the poetry, and those which become important in the poetry may play quite a negligible part in the man, the personality.’’ এলিয়টের বক্তব্য হল যে, কাব্যের অনুভূতি ও আবেগের সঙ্গে কবির জীবনের কোন সম্পর্ক নেই। কবি নিজস্ব দৃষ্টি নিয়ে জীবন ও সমাজকে প্রত্যক্ষ করতে পারেন। কিন্তু সৃষ্টির মধ্যে কবি মনের আবেগ ও অনুভূতি সঞ্চারিত হয়। স্বভাবতঃ বিজ্ঞানীর নিরাসক্ত দৃষ্টি ও কবির নিরাসক্ত দৃষ্টি এক পর্যায়ের নয়। এ প্রসঙ্গে এলিয়ট আরও বলেছেন— ‘‘when a poet’s mind is perfectly equipped for its work, it is constantly amalgamating disperate experience, the ordinary mans experience is chaotic, irregular, fragmentary.’’
কবি যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সাজিয়ে নিয়ে তাদের পারম্পর্য দান করেন তার নেপথ্যে আছে তাঁর কল্পনা, অনুভূতি ও মননশক্তি একযোগে কাজ করে। নিছক বুদ্ধি কাজ করলে বলা যেত যে, কবির সৃষ্টি ‘escape from personality’ কিন্তু তা নয়। কাজেই কাব্যসৃষ্টিতে কবির ব্যক্তিত্বকে উপেক্ষা বা বর্জন করা যায় না। যেহেতু কবি সরাসরি পাঠক মনে তাঁর ভাব সঞ্চারিত করতে পারেন না, সেইহেতু তাঁকে উপযুক্ত মাধ্যম নির্বাচন করতে হয়। এই মাধ্যম হল ‘a set of objects, a situation, a chain of events.’ কিন্তু গীতি কবিতার ক্ষেত্রে এই মন্তব্য সম্পূর্ণ মেনে নেওয়া যায় না। সাহিত্য অতি পরিচিতকে সৌন্দর্যকে আবেষ্টনের মধ্যে এনে নতুন মূর্তিতে যখন ফুটিয়ে তোলে তখন অতি পরিচিত ভাষা, ছন্দ, রচনা কৌশলে নতুন বলে প্রতীত হয়। সুতরাং সাহিত্যিক বিষয়বস্তু নির্বাচন ও প্রকাশ কৌশলে সাহিত্যকে বিশিষ্ট করে তোলেন। সৌন্দর্য সৃষ্টিই কবির লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য সুন্দরের দ্বারা আনন্দ দান। সাহিত্যের প্রধান লক্ষ্য হল আনন্দ দেওয়া। আলোচ্য প্রবন্ধে কবি আনন্দদানের দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন—এক. সে সত্যকে মনোহর রূপে দেখানোর জন্য ভাষা-ছন্দ-অলংকারের পারিপাট্য গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু রূপগত সৌন্দর্যমাত্রের দ্বারা সত্যকে ‘গোচর’ করানো যায় না। এই দুটি কাজের জন্য ভাষাই একমাত্র সহায়, যেহেতু সাহিত্য বাণীশিল্প। ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে মহাকবি কালিদাস হিমালয়ের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা বর্ণনার গুণে শুধু কালিদাসের কাছে নয়, চিরকালের মানুষের কাছে প্রত্যক্ষ ও পরিচিত হয়ে উঠেছে যেন। মানবরস তার মধ্যে সঞ্চারিত হলে মন তাকে অভ্যর্থনা জানায়। কবি কীট্স তাঁর ‘Ode to Autumn’ কবিতায় শরতের রূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে চারটি চিত্র এঁকেছেন। শরৎরাণী শস্যভাণ্ডারে বসে আছেন— “The sitting careless on a granary floor, by hair soft lifted by the winnowing wind.’’ শষ্য কাটতে কাটতে কৃষক শস্যের আঁটির সঙ্গে জড়িত একটি ফুলের প্রতি করুণাবশতঃ সাময়িকভাবে কাজ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে, শস্যের ভার নিয়ে সে সন্তর্পণে নদী পার হচ্ছে এবং অসীম ধৈর্যে শরৎরাণী আঙ্গুররস চোয়ানো দেখছেন। এই চিত্রসমূহের সঙ্গে মানবরস যুক্ত হওয়ায় চার পাঠকহৃদয়ের সহানুভূতি আকর্ষণ করেছে।
Leave a Reply