সৌন্দর্যমূর্তিই মঙ্গলের পূর্ণমূর্তি এবং মঙ্গলমূর্তিই সৌন্দর্যের পূর্ণ স্বরূপ।
- সৌন্দর্যের সঙ্গে মঙ্গলের সম্পর্ক।
- সৌন্দর্যমূর্তিই মঙ্গলের পূর্ণমূর্তি এবং মঙ্গলমূর্তিই সৌন্দর্যের পূর্ণ স্বরূপ।
- সত্যের সঙ্গে মঙ্গলের সেই পূর্ণ সামঞ্জস্য দেখিতে পাইলেই তাহার সৌন্দর্য আর আমাদের অগোচর থাকে না। ‘সৌন্দর্যবোধ’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যগুলির যৌক্তিকতা বিচার কর।
মঙ্গলের সঙ্গে আমাদের ব্যবহারিক জীবনের সম্পর্ক আছে। মঙ্গল আমাদের ভালো করে—এ সত্য। কিন্তু যথার্থ শুধু প্রয়োজন সাধনই করে না, প্রয়োজনের ঊর্ধে তার স্থান। অহৈতুকী বলে তা সুন্দর। মঙ্গল অনির্বচনীয় সৌন্দর্যমূর্তিতে ধরা দিয়ে থাকে। যা প্রয়োজন মেটায় তার সংগে সৌন্দর্যের কোন সম্পর্ক থাকে না। আহার্য কিংবা ভোগের সামগ্রী আমাদের জীবনযাত্রাকে সুসহ করে তোলে, কিন্তু তাদের সংগে আমাদের সম্পর্ক নিছক প্রয়োজনের। কিন্তু স্বেচ্ছায় জ্যেষ্ঠভ্রাতার সঙ্গে লক্ষ্মণের বনবাস গমনের সংবাদে আমাদের হৃদয় পুলকিত হয়ে ওঠে। একে সুন্দর বলা যাবে। এই সৌন্দর্যের মধ্যে মঙ্গল আছে। মঙ্গল মাত্রই জগতের সঙ্গে মানুষের মনের সঙ্গে গভীর সামঞ্জস্যসূত্রে আবদ্ধ। এই সামঞ্জস্যের উপলব্ধিতে আমরা গভীর আনন্দ লাভ করে থাকি।
সত্যের সঙ্গে মঙ্গলের সামঞ্জস্য দেখতে পেলে সৌন্দর্যকে আমরা অনুভব করতে পারি। জগতে করুণা, প্রেম, ক্ষমা সুন্দর। কারণ এদের সঙ্গে জগতের এক নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কের মধ্যে সুষমা আছে কিন্তু কোন বিরোধ নেই। পুরাণে আছে যে, সমুদ্রমন্থনকালে লক্ষ্মী আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি তো শুধু ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যের দেবী নন, তিনি মঙ্গলেরও পূর্ণস্বরূপ। সৌন্দর্য ও মঙ্গল তাই একাত্ম। সৌন্দর্যমূর্তিই মঙ্গলের পূর্ণমূর্তি ও মঙ্গলমূর্তি সৌন্দর্যের পূর্ণস্বরূপ।
সৌন্দর্য আমাদের সমস্ত প্রয়োজন, সাংসারিক সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে বিরাজমান। এই হেতু তার ঐশ্বর্য। মঙ্গলের মধ্যেও সেই ঐশ্বর্য আছে। যখন কোন বীরপুরুষ আদর্শের জন্য নিজ স্বার্থ বিসর্জন দেন, তখন তার সৌন্দর্য আমাদের অভিভূত করে। এই সৌন্দর্যের মধ্যে মঙ্গল বিরাজমান। সৌন্দর্যবোধ যেমন আমাদের স্বেচ্ছাকৃত ত্যাগে অনুপ্রাণিত করে, মঙ্গলও তেমনটি করে থাকে। সৌন্দর্যদৃষ্টি দিয়ে দেখলে ঈশ্বরসৃষ্ট জগতের ঐশ্বর্য আমাদের কাছে ধরা পড়ে, মঙ্গলদৃষ্টিতে মানবজীবনের মহিমা উদঘাটিত হয়। এই মঙ্গলদৃষ্টির মাধ্যমে সৌন্দর্যের স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি আপন স্বার্থে নিমজ্জিত, সে মঙ্গলসৌন্দর্যকে উপলদ্ধি করতে পারে না। ভোজসভায় বহু আড়ম্বর থাকলেও তা মনকে প্রসন্ন করে না। কিন্তু গৃহকর্তা যদি হৃদয়ের আন্তরিকতা প্রকাশ করেন তখন, তুচ্ছ কলার পাতাও সোনা থালার চেয়েও মূল্যবান হয়ে ওঠে। স্বার্থপর মানুষ নিজের সংকীর্ণ হৃদয়ের মধ্যে নিজে সংকুচিত থাকে। তার অসংযত প্রবৃত্তি, তার লোভ, উপস্থিতকে নিয়ে মত্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু উপস্থিতের ঊর্ধ্বে মাধুর্যকে গ্রহণ করার শিক্ষা তার হয়নি। শক্তিমানের ধর্ম হল ক্ষমা। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে উপলদ্ধি করার ক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। লজ্জা যে স্ত্রীলোকের অন্তরের দীপ্তি প্রকাশ করে, তা দেখতে হলে বিশেষ শিক্ষা ও অন্তরের গাম্ভীর্য ও শান্তি প্রয়োজন।
ইউরোপের কবিরা নারীর-যৌবন-বেদনা-রসে উচ্ছল চাঞ্চল্য কাব্যে লিপিবদ্ধ করেছেন। নারী জীবনের চরম সার্থকতা লাভ যখন আসন্ন হয়ে ওঠে তখন তার মধ্যে যে গৌরব দীপ্যমান হয়, তা বিশেষ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। মহাকবি কালিদাস তাঁর ‘মেঘদূতে’ মেঘকে যক্ষের বিরহী হৃদয়ের দৌত্যকার্যে নিযুক্ত করেছেন। কিন্তু মেঘকে তিনি নির্বাচন করেছেন তার কারণ, মেঘ বিরহী হৃদয়ের বাতাই শুধু বহন করবে না, নদীগিরিকাননের উপরে জলধারা বর্ষণ করে চলবে। বিরহীর হৃদয়ের আর্তিকে মঙ্গলের সঙ্গে গেঁথে কবি সৌন্দর্যরসপিপাসু চিত্তের তৃপ্তি সাধন করেছেন। মেঘের বর্ষণে কদম্ব ফুটে ওঠে, জম্বুকুঞ্জ ভরে যায়, ভরা নদী ছলছল করে ধাবিত হয় এবং ধরিত্রীও শস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এইভাবে সৌন্দর্য ও মঙ্গল এক হয়ে যায়। কুমারসম্ভবে কবি তপোবনে অকাল বসন্তের উৎসবে হর-পার্বতীর মিলন বর্ণনা করেননি। যেখানে প্রেম নিজের সমস্ত বাহুল্য পরিহারকরে শান্ত ও সংযত হয়েছে, সেখানে তিনি প্রেমকে মঙ্গলের মধ্যে স্থাপন করে তাকে সার্থকতা দান করেছেন। অভিজ্ঞানশকুন্তলম্-এও প্রেমময়ী নারী যেখানে জননী হয়েছেন প্রবৃত্তির বিক্ষোভ যেখানে বেদনার তপস্যায় অগ্নিশুদ্ধ হয়েছে, সেখানে। রাজদম্পতির মিলন সার্থক হয়েছে। এই দুই কাব্যে কবি মঙ্গলের মধ্যে সৌন্দর্যের পরিচয় ব্যক্ত করেছেন। সৌন্দর্য যেখানে পরিণতি লাভ করে সেখানে কোন প্রগলভতা থাকে না। ফুল আপন রূপ ও সৌরভের বাহুল্য পরিহার করে ফলে পরিণত হয়। এখানে সৌন্দর্যকে আমরা মঙ্গলের সংগে একাত্মরূপে দেখি।
ভোগবিলাসের সঙ্গে সৌন্দর্যের কোন সম্পর্ক থাকে না। সম্রাট অশোকের প্রমোদ-উদ্যানের কোন পরিচয় আজ আর নেই। কিন্তু তিনি যে স্তূপ ও স্তম্ভ নিবার্ণ করে গেছেন, পর্বতের গায়ে যে অনুশাসন উৎকীর্ণ করে গেছেন, তা পরমমঙ্গলের স্মরণচিহ্ন হিসেবে আজও বর্তমান। তিনি ভোগবিলাসকে হৃদয়ের অর্ঘ্য নিবেদন করেননি। এদেশে যেখানেই মানুষ সৌন্দর্যসৃষ্টির মাধ্যমে আপন হৃদয়ের ঐকান্তিক বিস্ময় প্রকাশ করেছে, সেখানে তা কালজয়ী হতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, অত্যন্ত দুর্গমস্থানে মানুষের অন্তরের ভক্তি ও আনন্দ আপন সৌন্দর্যরচনাকে যেখানে স্থাপন করতে পেরেছে, সেখানে আমরা সৌন্দর্যের মঙ্গলরূপের পরিচয় পাই। মঙ্গলের সংগে সৌন্দর্যের নিগূঢ় সম্পর্ক-যেমন বিষ্ণুর সঙ্গে লক্ষ্মীর। সৌন্দর্যকে ভোগস্পৃহার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে না পারলে তাকে উপলদ্ধি করা যায়। গ্রীক ভস্মাধারে উৎকীর্ণ চিত্রসমূহের সৌন্দর্য সংযত মন নিয়ে দেখেছিলেন বলেই কবি কীটস লিখেছিলেন—‘‘all breathing human passion far above.’’
সংযত মন ও দৃষ্টি নিয়ে দেখলে সৌন্দর্যের মধ্যে যে মঙ্গল নিহিত তা আমরা উপলব্ধি করি। স্থূল ও অসংযত দৃষ্টিতে সৌন্দর্যের বাত্ম্যরূপ আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহকে তৃপ্ত করে। কিন্তু শান্ত, সমাহিত দৃষ্টিতে দেখতে পারলে তার অন্তরের গভীর সামঞ্জস্য আমরা উপঞ্জি করতে পারি। এই কারণে তাপসী উমা ছদ্মবেশধারী ধূর্জটিকে বলেছেন যে, তাঁর মন ভাবরসে মহাদেবের সংগে সংযুক্ত। ভাবদৃষ্টিতে সুন্দর ধরা দেয়, ওই সুন্দরের মধ্যে মঙ্গল বিরাজমান।
Leave a Reply