সৌন্দর্য জাত মানিয়া চলে না, সে সকলের সঙ্গেই মিশিয়া আছে।
- জগতের মধ্যে সৌন্দর্যকে এইরূপ সমগ্রভাবে দেখিতে শেখাই সৌন্দর্যবোধের শেষ লক্ষ্য।
- সৌন্দর্য জাত মানিয়া চলে না, সে সকলের সঙ্গেই মিশিয়া আছে।
- আমাদের সৌন্দর্যবোধও ক্রমে ক্রমে সমস্ত জগৎকে আমাদের আনন্দের জগৎ করিয়া তুলিতেছে—সেই দিকেই তাহার গতি। ‘সৌন্দর্য ও সাহিত্য’ অবলম্বনে মন্তব্য তিনটি বিচার কর।
সাহিত্য ও সৌন্দর্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের পরিণত চিন্তার বাহন ‘সৌন্দর্য ও সাহিত্য’ প্রবন্ধটি। কোনও কিছুকে জানা তখনই সম্পূর্ণতা দান করে, যখন আমরা তাকে কার্যকারণ সূত্রের মধ্যে উপলদ্ধি করে থাকি। সাহিত্য ও সৌন্দর্য প্রবন্ধে কবি এ প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, জগৎ ব্যাপারের সঙ্গে মিলিয়ে না নিলে সে জানা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই জগৎকে যে পরিমাণে জ্ঞানের দ্বারা অধিগত করা যায় আসলে ততদূর সত্য তা নয়। এর মধ্যে আমরা আমাদের ব্যক্ত করি। এই কারণে মানব জীবনের সতত আকাঙ্ক্ষা হল হৃদয়ের অধিকারের সীমাকে বিস্তৃত করে দেওয়া। এইভাবে আমাদের সত্তা সত্যে ও শক্তিতে ব্যাপ্তি লাভ করে। সৌন্দর্যের ধর্ম এই নয় যে, তা নিছক আমাদের অধিগত সত্যকে উজ্জ্বল করে তোলে। এতে অনধিগত সত্য তিরস্কৃত হয়ে আমাদের বিকাশকে বাধা দেয়। সৌন্দর্যের লক্ষ্যই সত্যকে আমাদের অধিকারে আনা। সমস্তই সত্য, সুতরাং তাই আনন্দের বিষয়।
পৃথিবীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে একটি তত্ত্ব ফুটে ওঠে। এর কেন্দ্রাতিগ শক্তি বৈচিত্র্যকে প্রকাশ করছে, আবার কেন্দ্রানুগ শক্তি সমস্ত বৈচিত্র্যকে ঐক্যরূপে উদঘাটিত করছে। সেখানে জীবনের সুষমাযুক্ত সুবিহিত সামঞ্জস্য প্রকাশ পাচ্ছে। বৈচিত্র্যের অন্তরালে যে ঐক্য তা আনন্দের দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়ে থাকে। এরই পরিচয় প্রসংগে কবি ওয়ার্ডওয়ার্থ তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন—
While with an eye made quiet by the power
of harmony, and the deep power of joy,
we see into the life of things.
জগৎ সম্বন্ধে যখন বলা হয় যে, এর মধ্যে আনন্দধারা প্রবাহিত হচ্ছে তখন আমরা স্বীকার করে নিই যে, এর বেদনা ও ব্যর্থতা, আশা ও উদ্যম সমস্ত মিলে পরিপূর্ণ সংগীতের ঐকতান রচনা করছে। এ হলো—‘‘breathing human passion far above.’’ অর্থাৎ আনন্দই সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্যকে বিচ্ছিন্ন না করে জগতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখাই সার্থক দেখা। এই দেখার সাধনা যত গভীর হয় ততই সমগ্র বিশ্ব সৌন্দর্যের বিষয় হয়ে পড়ে। বিশ্বকে বাদ দিয়ে সৌন্দর্য পেতে চাইলে ‘পরশ পাথরের’ ক্ষ্যাপার মতই ব্যর্থ হতে হয়। একদা লর্ড ব্রাউনিং-এর কবিতার পারাসেলসাস পরিপূর্ণতা লাভের উদ্দেশ্যে বিশ্বকে বর্জন করেছিলেন কিন্তু নানা দুঃখের আঘাতে তার ভ্রান্ত ধারণার নিরসন হয়েছিল।
ইউরোপে একসময় একটা ধুয়ে উঠেছিল এই বলে যে, সৌন্দর্যের এক পৃথক সত্তা আছে। এবং একে অবলম্বন করেই অনুশীলনের মত্ততা প্রকাশ পেয়েছিল। সুতরাং যা সংসারে অত্যন্ত স্বচ্ছ সাধারণ, তার প্রতি অবজ্ঞা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু জীবনের সামান্যতাকে সযত্নে পরিহার করে, সৌন্দর্যের নির্বিশেষ সত্তাকে লাভ করার প্রয়াস নিছক ব্যর্থতা মাত্র। সৌন্দর্য যদি মানুষকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয় তবে তার মধ্যে কোন মঙ্গল থাকতে পারে না। বরং সৌন্দর্যকে জগতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে উপলদ্ধি করতে পারলে, সেখানে মঙ্গলকেও লাভ করা যাবে। সৌন্দর্য সমস্ত বস্তুর সঙ্গে মিশে আছে। সে ক্ষণিকের মধ্যে চিরন্তনকে, সামান্যের মধ্যে চিরবিষ্ময়কে প্রকাশ করে থাকে।
সমগ্র জগতের যা মূল সুর অর্থাৎ ঐক্যের সুর তাই আমাদের মনের কাছে প্রকাশ করে দেয়। সৌন্দর্যে যা আমরা দেখি তাকে জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখি না। তার যোগেই সকলকে দেখে থাকি। আমাদের মনের সংস্কার হেতু আমরা সামান্যকে তুচ্ছ বলে অবজ্ঞা করে থাকি। কিন্তু কবি যখন সামান্যের উপরে তাঁর কল্পনাদৃষ্টি প্রসারিত করে, তাকে অসামান্যতা দান করেন তখন আমরা তার নতুন মূল্য উপলব্ধি করে বিস্মিত হই। এমনি করে যা সুপরিচিত ও অপরিচিত, তাদের রহস্য আমাদের কাছে উদঘাটিত হয়। ফুলের জগতে আকন্দকে এক নামহারা ফুলরূপে চিহ্নিত করা হয়। তাই কবিগান যেদিন বসন্তের জাগাও আহ্বান ছন্দের উৎসব সভাতলে’, সেদিন সুরের বরণমাল্যে সবারে বরিয়া নিল কবি। কিন্তু আকন্দ সংকোচের জন্য সভায় আসতে পারল না। কিন্তু কবি তার সৌন্দর্যকে পরবর্তীকালে বন্দনা জানিয়ে লিখলেন—
ভরিল আমার চিত্ত বিস্ময়ের গভীর আনন্দ,
চিনিলাম তোমারে আকন্দ।
সৌন্দর্যকে সাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলে তাকে জীবনের বিরোধী করে তোলা হয়। এতে তার স্বরূপ বিনষ্ট হয়ে পড়ে। কবি তাই প্রকৃতি সত্তার সঙ্গে আপন সত্তাকে একাত্ম করে নিয়ে সৌন্দর্যকে উপলদ্ধি করে থাকেন। ইংরেজ কবি কোলারিজ কবি সাদিকে এক পত্রে লিখেছিলেন— ‘‘A poet’s heart and intellect should be combined, intensely combined and unified with the great appearances of nature.’’
এই ধরনের যোগসাধনের মাধ্যমে সত্য ও সৌন্দর্যকে উপলদ্ধি করা যায়। জ্ঞান শত্তিজগতকে মনের জগৎ করে তুলছে। কর্মশক্তি তাকে আমাদের ব্যবহারের উপযোগী করে আপন করে নিচ্ছে। সৌন্দর্যবোধও জগৎকে আনন্দের বস্তু করে তুলছে। জ্ঞানের মাধ্যমে জগতে আমাদের মন প্রসারিত হয়, কর্মের দ্বারা শক্তি ব্যাপ্ত হয় এবং সৌন্দর্যবোধের দ্বারা আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং জ্ঞান, কর্ম ও সৌন্দর্য একাত্ম হয়ে মনুষ্যত্মকে বিকশিত করে। জগৎকে জ্ঞানরূপে, শক্তিরূপে ও আনন্দরূপে লাভ করার মধ্যে জীবনের সার্থকতা প্রকাশিত হয়। এই প্রাপ্তি দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে ঘটে থাকে বটে, কিন্তু তার অবসানও ঘটে। প্রাচীনকালে মানুষের কাছে চেতন ও অচেতনের মধ্যে কোন ভেদ ছিল না। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির বিকাশের জন্য পরে এই ভেদ আরো প্রকট হয়ে দেখা ছিল। সৌন্দর্যবোধের ক্ষেত্রেও সুন্দর-অসুন্দরের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। সৌন্দর্য চেতনার বিকাশের সঙ্গে আমরা উপলদ্ধি করি যে, আগে উল্লিখিত পার্থক্য অসঙ্গত। তখন সৌন্দর্যকে জগতের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য স্থাপন করেই তার রহস্য উপলব্ধি করি।
সৌন্দর্যকে খণ্ডতা থেকে, বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি না দিলে তাকে চেনা যায় না। বিজ্ঞান বর্তমানকে সত্য বলে মানতে চায় না, প্রতীতিকে সে যাচাই করে নেয়। তেমনি আমাদের অনুভূতি যদি বিশ্বের সংগে সামঞ্জস্য স্থাপন করতে না পারে, তাহলে তার উপলব্ধ সৌন্দর্যও গ্রহণযোগ্য নয়, তা অসার্থক। এর মধ্যে সত্যের পূর্ণতা নেই। এই সৌন্দর্য ও সত্যের সঙ্গে মঙ্গলের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। জ্ঞানসাধক কোন তপস্বী কিংবা বীর যখন আদর্শের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেন, তখন তাঁর দুঃখবরণ ও ত্যাগ স্বীকার আমাদের মনে আনন্দের পরিধি বিস্তৃত করে দেয়। এই আনন্দের মধ্যে সৌন্দর্য ও মঙ্গল নিহিত। এই বৃহত্তর দিকে, পূর্ণতার দিকে মানবজীবনকে সর্বদা আকর্ষণ করছে। এই জন্য জগৎ ও জীবনের সঙ্গে সৌন্দর্যের গভীর সম্পর্ক আছে। সৌন্দর্য আমাদের মনে জীবনবোধের গভীরতা বাড়িয়ে দেয়। সৌন্দর্যের আলোয় আমরা সত্যের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় উপলব্ধি করে থাকি, সৌন্দর্য ও সত্য একাত্ম হয়ে জীবনের স্বরূপকেই প্রকাশিত করে থাকে।
Leave a Reply