//
//

রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে স্টার থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।

স্টার থিয়েটার (হাতিবাগান)

৫/৩ নম্বর কর্ণওয়ালিস স্ট্রিট (বিধান সরণি), কলকাতা

প্রতিষ্ঠাতা: গিরিশচন্দ্র (নেপথ্যে), অমৃতলাল বসু, দাসুচরণ নিয়োগী, অমৃতলাল মিত্র, হরিপ্রসাদ বসু

উদ্বোধন: ২৫ মে, ১৮৮৮ (শুক্রবার)

স্থায়িত্বকাল: ২৫ মে ১৮৮৮ – ১২ অক্টোবর ১৯৯১

নাটক: নসীরাম (‘সেবক’ ছদ্মনামে গিরিশচন্দ্র)

প্রথম পর্ব: (১৮৮৮-১৯০০)

৬৮ নং বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারের বাড়ি গোপাল শীলকে ত্রিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়ে গিরিশচন্দ্র এবং স্বত্বাধিকারী চারজন (অমৃতলাল বসু, দাসুচরণ নিয়োগী, অমৃতলাল মিত্র, হরিপ্রসাদ বসু) শুধুমাত্র ‘স্টার’ নামটির ‘গুডউইল’ সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন। তাঁরা কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে হাতিবাগানের কাছে রণেন্দ্রকৃষ্ণ দেবের ত্রিশ কাঠা জমি সাতাশ হাজার টাকায় কেনেন। গিরিশ গোপাল শীলের এমারেল্ড থিয়েটারে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যে কুড়ি হাজার টাকা বোনাস পেলেন, তার থেকে ষোল হাজার টাকা বিনা শর্তে নতুন স্টারের বাড়ি তৈরি করতে দিয়ে দিলেন। প্রথমে কুড়ি হাজার টাকাই গিরিশচন্দ্র দিয়েছিলেন। তবে তাঁর ভাই অতুলকৃষ্ণ এতে খুশি হননি। তিনি অনেক চেষ্টা করে তাদের কাছ থেকে শেষমেষ চার হাজার টাকা ফেরত নিয়েছিলেন। থিয়েটার বাড়ি তৈরি করতে দিয়ে স্টারের দল বাইরে অভিনয় করতে বেরিয়ে গেল অর্থোপার্জনের আশায়। মাত্র পাঁচ মাসের চেষ্টায় নতুন বাড়ি তৈরি হয়ে গেল। সাহায্য করলেন এঞ্জিনীয়ার যোগেন্দ্রনাথ মিত্র এবং মঞ্চ অভিজ্ঞ ধর্মদাস সুর। থিয়েটারের নক্সা নির্মাণ ও অলঙ্করণ এদের দায়িত্বেই সুষ্ঠু ও সুদৃশ্যভাবে সম্পন্ন হলো। গ্যাসবাতি দিয়ে উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা করলেন পি. সি. মিত্র এণ্ড কোম্পানী। দৃশ্য সজ্জাকর ছিলেন দাসুচরণ নিয়োগী, সঙ্গীত—রামতারণ সান্যাল এবং নৃত্য—কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়। ম্যানেজার অমৃতলাল বসু। দেড় হাজার দর্শকাসন বিশিষ্ট এই রঙ্গালয়ের প্রবেশমূল্য ছিল—

রয়েল বক্স (পাঁচ জন)—একশো টাকা। বক্স (চার জন)—চোদ্দ টাকা। বক্স (দুই জন)—আট টাকা। ড্রেস সার্কেল—চার টাকা। অর্কেস্ট্রা স্টল—তিন টাকা। স্টল—দুই টাকা। পিট সিট—এক টাকা। গ্যালারি—আট আনা। জেনানা বক্স (চার জন)—দশ টাকা। জেনানা সিট—দুই টাকা।

মহিলাদের একেবারে আলাদা আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। উদ্বোধনের দিনে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হয়েছিল, অভিনয় শেষে হাতিবাগান থেকে বউবাজার পর্যন্ত ছয় পয়সা ভাড়ায় দর্শকদের জন্য স্পেশাল ট্রামগাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে শুক্রবার ফুলদোলের দিন (১৩ জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৫) মহাসমাওহে হাতিবাগানের নবনির্মিত দ্বিতীয় স্টার থিয়েটার উদ্বোধন হলো। নাটক গিরিশের লেখা ‘নসীরাম’। এমারেল্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকাতে গিরিশ লুকিয়ে খালপাড়ে বসে এই নাটকটি লিখে দেন। গভীররাতে এমারেল্ড কর্তৃপক্ষের চোখ এড়িয়ে স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে গোপনে নাটকটি লিখতে হয়েছিল গিরিশকে। এবং নিজের নাম গোপন রেখে ‘সেবক প্রণীত’ বলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। নসীরাম নাটকে অভিনয় করলেন স্টারের খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রীবৃন্দ: নসীরাম—অমৃতলাল বসু, অনাথনাথ—অমৃতলাল মিত্র, শম্ভুনাথ—অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, কাপালিক—অঘোর পাঠক, বিরজা—কাদম্বিনী, সোনা—গঙ্গামণি। তারাসুন্দরী পাহাড়িয়া বালকের ভূমিকায় প্রথম মঞ্চাবতরণ করেন এবং একটি মাত্র সংলাপ—“ওরে হরি বল, নইলে কথা কি কইবে না।’’—দিয়ে নাট্যজীবন শুরু করেন।

উদ্বোধনকালে অমৃতলাল বসু গিরিশের লেখা কবিতা পাঠ করেন, তার একটি লাইন—‘‘হিন্দুপ্রাণ কোমলতায়/ধর্মপ্রাণ শ্রেষ্ঠ পরিচয়/ধর্ম রঙ্গালয়।’’ বোঝা যাচ্ছে জাতীয় রঙ্গালয়ের উন্মাদনা স্তিমিত হয়ে, হয়ে গেল ধর্ম রঙ্গালয়। হিন্দু ও জাতীয় প্রায় সমার্থক তখন অনেকেরই কাছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে উনিশ শতকের শেষ তের বছর স্টার খুব সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় চালিয়ে যায়। প্রথম বছর গিরিশ স্টারে ছিলেন না, তবুও তার পুরনো নাটকগুলিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এখানে অভিনীত হয়ে চলল। চৈতন্যলীলা, বিল্বমঙ্গল ঠাকুর, সীতার বনবাস, নলদময়ন্তী, রাবণবধ ভালই চলল। কিন্তু প্রচুর সাফল্য পেল সরলা’র অভিনয়। তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্বর্ণলতা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দেন অমৃতলাল বসু এবং ‘সরলা’ নামে অভিনয় হয় ২২ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৮। বাংলা থিয়েটারে ঠিক এই রকম ঘরোয়া পারিবারিক ও সামাজিক নাটক কখনো অভিনীত হয়নি। ‘Domestic Tragedy’ নামে খ্যাত সরলার অভিনয় জনমনে নতুন সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সে যুগে অভিনয় ও টিকিট বিক্রির রেকর্ড করেছিল সরলা। এই নাটকে অসামান্য অভিনয় করেন:বিধুভূষণ—অমৃতলাল মিত্র, গদাধর—অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, শশিভূষণ— নীলমাধব চক্রবর্তী, সরলা—কিরণবালা, গোপাল—তারাসুন্দরী, শ্যামা—গঙ্গামণি, প্রমদা—কাদম্বিনী।

গিরিশ স্টারে এলেন ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৯, কিন্তু ‘অফিসিয়াল’ যোগ দিলেন ২৭ এপ্রিল। হলেন ম্যানেজার। ‘সরলা’ নাটকের সাফল্য গিরিশকে এই ধরনের নাটক লিখতেই প্ররোচিত করল। এর আগে গিরিশ সামাজিক বিষয় নিয়ে নাটক লেখাকে ‘নর্দমা ঘাঁটা’ বলে মনে করতেন। কিন্তু এবারে উপায়ান্তর না দেখে লিখেই ফেললেন ‘প্রফুল্ল’। একান্নবর্তী পরিবারে ভাইয়ের বিরুদ্ধে চক্রান্ত, পারস্পরিক সম্পর্কের হানি, মদ্যপানের বিষময় ফল কীভাবে একটি মধ্যবিত্ত সংসারকে ভেঙে তছনছ করে দিল তারই কাহিনী। কলকাতার নীচুতলার সমাজ-জীবনের ছবিও এখানে বাস্তবসম্মত ভাবে আঁকা হলো। আর সবার উপরে রইলো বিশ্বাস ও আদর্শের জ্বলন্ত প্রতীকরূপে প্রফুল্ল নামের নারী চরিত্রটি। নাটকটি অভিনীত হলো ২৭ এপ্রিল। মুহূর্তে পূর্ববর্তী সরলার সব রেকর্ড ভেঙে দিল প্রফুল্ল। গিরিশ কোনো চরিত্রে অভিনয় করেননি। যারা অভিনয় করলেন: অমৃতলাল মিত্র—যোগেশ, অমৃতলাল বসু—রমেশ, কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়—সুরেশ, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়—ভজহরি, মহেন্দ্রনাথ চৌধুরী—পীতাম্বর, শ্যামাচরণ কুণ্ডু—কাঙালিচরণ, নীলমাধব চক্রবর্তী—মদন ঘোষ, ভূষণকুমারী—প্রফুল্ল, গঙ্গামণি—উমাসুন্দরী, কিরণবালা—জ্ঞানদা, টুম্পামণি—জগমণি। অমৃতলাল মিত্রের যোগেশ চরিত্রে অভিনয় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অমৃতলাল বসুর খল রমেশ চরিত্র এবং অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়ের দুষ্ট ভজহরির চরিত্র অভিনয়ে কৃতিত্বও সবাই স্বীকার করেছেন।

১৮৮৯-তে প্রফুল্ল ছাড়া আর অভিনীত হল গিরিশেরই সব পুরনো নাটক ধ্রুবচরিত্র, দক্ষযজ্ঞ এবং অমৃতলালের তাজ্জব ব্যাপার। গিরিশের নতুন নাটক ‘হারানিধি’ (৭/৯/৮৯) প্রফুল্পের মতই সামাজিক নাটক। কিন্তু সেরকম সাফল্য পেলো না।

১৮৯০-তে সবই গিরিশের পুরনো নাটক, যেমন রূপসনাতন, চণ্ড অভিনীত হলো। অমৃতলালের বাঞ্ছারাম, তরুবালা এবং গিরিশের মলিনাবিকাশ এবং মহাপূজা (জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন উপলক্ষে) মঞ্চস্থ হলে। গিরিশের পুত্র সুরেন্দ্রনাথ (দানী) চণ্ড নাটকের রঘুদেবজীর চরিত্রে প্রথম অভিনয় শুরু করেন। গিরিশের ‘মলিনাবিকাশ’ গীতিনাট্যে বাংলা মঞ্চে প্রথম দ্বৈত-নৃত্যগীতের প্রচলন হয়। বিকাশ—গোলাপ (সুকুমারী) এবং মলিনা—মানদাসুন্দরী। রামতারণ সান্যালের সুর এবং কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নৃত্যশিক্ষায় এবং অভিনেত্রী দুজনের নৃত্যগীত কুশলতায় মলিনাবিকাশ সাফল্যলাভ করে। এই ধরনের দ্বৈত-নৃত্যগীতের অভিনয় অন্য সব মঞ্চেও শুরু হয়ে গেল।

এই বছরেই স্টারের বিখ্যাত অভিনেতা অমৃতলাল মুখোপাধ্যায় (১১ মার্চ) এবং অভিনেত্রী কিরণবালার (এপ্রিল) মৃত্যু হয়। দুজনের আকস্মিক মৃত্যুর জন্য তিন মাস স্টারে অভিনয় বন্ধ থাকে। অমৃতলাল বসুর নতুন নাটক ‘তরুবালা’ মঞ্চ সাফল্য লাভ করে। ঠাকুরদা নীলমাধব চক্রবর্তী এবং ঠানদিদি—গঙ্গামণি অভিনয়ে মাতিয়ে দিয়েছিলেন। তরুবালার ভূমিকায় প্রমদাসুন্দরীও খ্যাতি অর্জন করেন। সামাজিক ব্যঙ্গ নাটকে অমৃতলালের কৃতিত্ব স্বীকৃত হয়।

এই ক’বছরে স্টারের অভিনয়ের ধারাবাহিক সাফল্য লক্ষ করা যায়। তাই ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকা (১৫ শ্রাবণ, ১২৯৭) লিখেছিল—‘‘আজকাল থিয়েটারের বাজারে স্টার থিয়েটারের বড়ই নামডাক। কাগজে-কলমে চারিদিকে সুখ্যাতির ছড়াছড়ি, আর সেজন্যই স্টার থিয়েটারের কোন কিছু অভিনয় হইবে শুনিলেই লোক আর ধরে না—তিনি উনি সকলেই অভিনয় দেখিতে ছুটেন।’’

১৮৯১-তে গিরিশ স্টারের ম্যানেজারের পদ থেকে বরখাস্ত হন (১৫ ফেব্রুয়ারি)। কিছু দিন ধরেই স্টারের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গিরিশের নানা কারণে মনোমানিল্য চলছিল। বরখাস্ত হয়ে গিরিশ চলে যাওয়ার সময়ে সঙ্গে নিয়ে যান নীলমাধব চক্রবর্তী, অঘোরনাথ পাঠক, প্রবোধচন্দ্র ঘোষ, দানীবাবু, শরৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানদাসুন্দরী প্রমুখকে। নীলমাধব চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সিটি থিয়েটার খোলা হয় এবং গিরিশ অন্তরাল থেকে এদের সাহায্য করতে থাকেন। এইভাবে স্টার ভেঙে যাওয়াতে নাট্যাভিনয়ের ধারা ব্যাহত হয়।

গিরিশের পরিবর্তে ম্যানেজার হলেন অমৃতলাল বসু এবং নাট্যকার হিসেবে যোগ দেন রাজকৃষ্ণ রায় (১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯১), মাসিক একশো টাকা বেতনে।

১৮৯১-তে তাই গিরিশের পরিবর্তে রাজকৃষ্ণ রায়ের নাটকগুলিই অভিনীত হতে থাকে। সম্মতি সঙ্কট, নরমেধ যজ্ঞ, লায়লা-মজনু প্রভৃতি রাজকৃষ্ণের নাটকগুলি মোটামুটি চললো। বিদ্যাসাগরের মৃত্যুতে (১৯ জুলাই, ১৮৯১) স্টারে অমৃতলাল বসু রচিত ‘বিলাপ’ বা বিদ্যাসাগরের স্বর্গে ‘আবাহন’ অভিনীত হলো (২২ আগস্ট)।

১৮৯২-তে সবই প্রায় রাজকৃষ্ণের নাটক অভিনীত হল। বনবীর, ঋষ্যশৃঙ্গ, রাজাবাহাদুর প্রভৃতি রাজকৃষ্ণের নাটক ছাড়া অমৃতলালের কালাপানি অভিনীত হলো। এখানে ‘কৃষ্ণবিলাস’ নামে একটি হিন্দি ভাষায় অপেরা অভিনীত হয় (৬ আগস্ট)। বাংলা মঞ্চে হিন্দি ভাষায় রচিত নাটকের এই প্রথম অভিনয় হলো। এর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে পরের বছর গিরিশের সীতার বনবাস নাটকের হিন্দীরূপ ‘রামাশ্বমেধ’ স্টার অভিনয় করে (২৭ মে, ১৮৯৩)। কৃষ্ণবিলাসে রাধিকা চরিত্রে তারাসুন্দরী সচ্ছন্দ ও প্রাণবন্ত অভিনয় করেন।

১৮৯৩-তে রাজকৃষ্ণের বেনুজীর বদরেমুনীর এবং অমৃতলালের বিমাতা বা বিজয়বসন্ত অভিনীত হলো। ’৯৪-তে বঙ্কিমের চন্দ্রশেখর (নাট্যরূপ: অমৃতলাল) এবং অমৃতলালের ‘বাবু’ অভিনীত হয়। চন্দ্রশেখর আর্থিক সাফল্যলাভ করে। অমৃত মিত্র (চন্দ্রশেখর), তারাসুন্দরী (শৈবলিনী), অক্ষয় কোঙার (প্রতাপ) এবং নরীসুন্দরী (দলনী) খুবই ভালো অভিনয় করেন।

রাজকৃষ্ণ রায়ের মৃত্যু হয় ১১ মার্চ, ১৮৯৪। বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু ৮ এপ্রিল, ১৮৯৪। তাদের মৃত্যুতে স্টারের অভিনয় বন্ধ থাকে ১৪ মার্চ ও ১৮ এপ্রিল। রাজকৃষ্ণের অভাবে স্টারে আর কোনো নির্দিষ্ট নাট্যকার রইলো না।

১৮৯৫-তে ১৩ জুলাই এখানে আবার গিরিশের প্রফুল্ল নামানো হয়। একই দিনে মিনার্ভায় ‘প্রফুল্ল’ অভিনীত হয়। গিরিশ তখন মিনার্ভায়, তিনি যোগেশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। স্টারে যোগেশ সাজেন আগের মতোই অমৃতলাল মিত্র। প্রতিযোগিতা জমে ওঠে। বাংলা নাট্যশালায় একই নাটক একই সময়ে একাধিক্রমে দুটো মঞ্চে এই প্রথম অভিনয়ের সূত্রপাত হলো। যোগেশের ভূমিকায় গুরু-শিষ্যের (গিরিশ—অমৃত মিত্র) অভিনয়ের তুলনায় দর্শকেরা মেতে উঠলেন।

এই বছরে প্রফুল্ল ছাড়া তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য নাটকের অভিনয় হয়নি। বাদবাকি সবই পুরনো নাটক—এগুলি আগেই স্টারে অভিনীত হয়েছে।

১৮৯৬-তে গিরিশ মিনার্ভা ছেড়ে স্টারে ফিরে এলেন (১৫ এপ্রিল, ১৮৯৬) এবং পুরোপুরি ড্রামাটিক ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দিলেন। বাংলা থিয়েটারে এই পদ প্রথম গিরিশের জন্যই তৈরি হলো।

রাজসিংহ (নাট্যরূপ: অমৃতলাল) ১১ জানুয়ারি অভিনীত হল। গিরিশ তাঁর নতুন নাটক ‘কালাপাহাড়’ লিখে খুব যত্ন সহকারে অভিনয় করালেন (২৬/৯/৯৬)। অভিনয় করলেন: গিরিশ—চিন্তামণি, অমৃত মিত্র—কালাপাহাড়, নগেন্দ্ৰবালা—ইমান, নরীসুন্দরী—দোলনা, প্রমদাসুন্দরী—চঞ্চলা।

অমৃতলালের ‘বৌমা’-ও এই বছর অভিনীত হয়। বিলিতি মঞ্চের অভিনেতা দেব কার্সন সাহেবের মৃত্যুতে (২৪ ফেব্রুয়ারি) স্টার অভিনয় বন্ধ রাখে এবং দুদিন পরে তার স্ত্রীর সাহায্যার্থে অভিনয় করে। বিদেশি হলেও, অভিনেতার প্রতি অভিনেতাদের এই সম্মান প্রদর্শন থিয়েটারের মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। আবার ৮ জুলাই ঔপন্যাসিক তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতির সম্মানে স্টার তাঁর পরিবারের সাহায্যে ‘সবলা’ নাটক অভিনয় করে।

১৮৯৭-তে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো নাটকের অভিনয় হয়নি। রানী ভিক্টোরিয়ার রাজ্যশাসনের অষ্টম বর্ষপূর্তি স্মরণে অভিনীত হয় হীরকজুবিলী (২১ জুন)। গিরিশের দুটি নতুন রচনা পারস্যপ্রসূন ও মায়াবসান সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে অভিনয় করা হয়। ‘মায়াবসান’ গিরিশের নতুন সামাজিক নাটক, এতে গিরিশ নিজে কালীকিঙ্করের ভূমিকায় অবিস্মরণীয় অভিনয় করেন। অন্যান্য ভূমিকায় দানীবাবু (হলধর), অক্ষয় কোঙার (গণপতি), তারাসুন্দরী (অন্নপূর্ণা), নরীসুন্দরী (রঙ্গিনী) ও নগেন্দ্ৰবালা (বিন্দু) অভিনয় করেন। হীরকজুবিলীতে নট চরিত্রে অমৃতলাল মিত্র এবং এক মাতালের ভূমিকায় দানীবাবু অসামান্য অভিনয় করেন।

’৯৮-তে শুধুমাত্র অমৃতলালের গ্রাম্য-বিভ্রাট এবং হরিশচন্দ্র নতুন নাটক হিসেবে অভিনীত হয়। অমৃত মিত্রের হরিশচন্দ্র এবং অক্ষয় কোঙারের বিদূষক খুবই প্রশংসা পেয়েছিল।

এই বছরেই আবার গিরিশের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের মনান্তর হয় এবং গিরিশ ১১ মে অভিনয়ের পর স্টার ছেড়ে দেন। তার এই স্টার ছেড়ে শেষবারের মতো যাওয়া, আর কখনো তিনি স্টার থিয়েটারে ফিরে এসে যোগ দেননি।

এই সময় অমনিতেই স্টারের অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। তার উপরে গিরিশ চলে গেলেন। নাটক নেই, ভালো অভিনেতা নেই। এই দুর্দিনে থিয়েটার বাঁচাতে স্টার এক অভিনব ব্যবস্থা নেয়। নাট্যাভিনয়ের পূর্বে বায়স্কোপ দেখাবার ব্যবস্থা করে। ২৯ অক্টোবর, ১৮৯৮ স্টারে বায়োস্কোপ দেখানো শুরু হয়। নেলসনের মৃত্যু, হীরকজুবিলীর শোভাযাত্রা, গ্ল্যাডস্টোনের শবানুগমন দেখানো হয়। পরে অমৃতলালের ‘বাবু’ অভিনীত হয়। এরপর থেকে প্রতিটি নাট্যানুষ্ঠানের সঙ্গে বায়স্কোপ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়।

১৮৯৮-তে কলকাতায় প্লেগ মহামারী রূপে দেখা দেয়। মার্চ মাস থেকেই আতঙ্কে লোকজন কলকাতা ছেড়ে পালাতে থাকে। ফলে ১৫ মে থেকে টানা চল্লিশ রাত স্টারে অভিনয় বন্ধ থাকে। আবার অভিনয় শুরু হয় ২৫ জুন থেকে। গিরিশের চৈতন্যলীলা নাটক দিয়ে।

১৮৯৯-তে পুরনো নাটকগুলির সঙ্গে নতুন নাটক অভিনীত হল মৃচ্ছকটিক, সাবাস আটাশ (অমৃতলাল), বিরহ (দ্বিজেন্দ্রলাল রায়)।

দেখা যাচ্ছে নাট্যকারের অভাবে অমৃতলাল পরপর নাটক লিখে চলেছেন। পুরনো নাট্যকার মনোমোহনের নাটক অভিনয় করতে হচ্ছে। নতুন নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাংলা মঞ্চে গৃহীত হচ্ছেন, যদিও তাঁর সার্থক নাটকগুলি এখনো রচিত হয়নি।

১৮৯৯-এর ২৮ এপ্রিল থেকে, ‘আদর্শবন্ধু’ অভিনয়ের সঙ্গে স্টারে প্রথম বিদ্যুৎ আলোর ব্যবস্থা করা হয়। কলকাতায় তখন সবে (১৮৯৯-এর ১৭ এপ্রিল থেকে) নবাবিষ্কৃত বিদ্যুৎ-আলোর ব্যবস্থা চালু হয়েছে এবং রঙ্গালয়ের মধ্যে প্রথমেই স্টার তার ব্যবহার শুরু করে। এই নতুন আলোর ব্যবহারের ফলে থিয়েটারে আলোক নিয়ন্ত্রণ অভিনব হয়ে উঠলো। গ্যাসের আলোর যুগ শেষ হলো।

১৯০০-তে আদর্শবন্ধু (অমৃতলাল), কৃপণের ধন (অমৃতলাল), প্রণয়পরীক্ষা (মনোমোহন বসু), লীলাবতী (দীনবন্ধু), হরিশ্চন্দ্র (মনোমোহন), ত্র্যহস্পর্শ (দ্বিজেন্দ্রলাল), যাদুকরী (অমৃতলাল) অভিনীত হয়। উনিশ শতক শেষ হয়ে বিংশ শতক শুরু হলো। ‘স্টার’ নানা সুখ দুঃখ, উত্থানপতন, বাধা-বিঘ্নের মধ্যে দিয়ে তার অভিনয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে।

এই পর্বে কলকাতায় একই সঙ্গে স্টার, মিনার্ভা ও ক্লাসিক থিয়েটার সমানে পারস্পরিক পাল্লা দিয়ে চলেছে। গিরিশ তখন বহুমুখী প্রতিভা নিয়ে খ্যাতির মধ্যগগনে। তিন থিয়েটারই গিরিশকে নিয়ে টানাটানি করছে এবং গিরিশ যখন যে মঞ্চে গেছেন, তারই সৌভাগ্য ফিরেছে। স্টার সবসময়ে গিরিশের আনুকূল্য পায়নি, একসময় থেকে একেবারেই আর পায়নি। তবুও শত অসুবিধে সত্ত্বেও স্টার তার অব্যাহত অভিনয় ধারা রক্ষা করেছে। তুলনায় ক্লাসিক কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে, মিনার্ভা থেকে থেকেই নির্জীব হয়ে পড়েছে।

দ্বিতীয় পর্ব: (১৯০১-১৯২০)

বিশ শতকের গোড়া থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল পর্যন্ত (১৯০১-১৯২০) স্টার চালিয়েছিলেন কখনো অমৃতলাল, অর্ধেন্দুশেখর কিংবা অমরেন্দ্রনাথ দত্ত। এই সময়কালের মধ্যেই অর্ধেন্দুশেখর (১৯০৮) ও অমরেন্দ্রনাথ (১৯১৬) মারা যান। দীর্ঘায়ু অমৃতলাল বসু তারপরেও বহুদিন সব সময়েই স্টারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। অভিনেতা অমৃতলাল মিত্রও (১৯০৮) চলে গেলেন।

১৯০১ খ্রিস্টাব্দে রাজকৃষ্ণ রায়ের ‘নরমেধ’ ও অমৃতলালের ‘যাদুকরী’ অভিনীত হয় (১ জানুয়ারি)। তাছাড়া গিরিশের ‘বুদ্ধদেবচরিত’ ও অমৃতলালের ‘তাজ্জব ব্যাপার’ (৫ জানুয়ারি), রাজকৃষ্ণ রায়ের ‘ঋষ্যশৃঙ্গ’ (৬ জানুয়ারি), দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ (১৩ জানুয়ারি), মনোমোহন বসুর ‘প্রণয় পরীক্ষা’ (১৯ জানুয়ারি), দীনবন্ধুর ‘লীলাবতী’ (১৬ ফেব্রুয়ারি), বঙ্কিমের ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ (অমৃতলাল বসু, ১৩ এপ্রিল), ‘সরলা’ প্রভৃতি নাটকের ঘুরে ফিরে অভিনয় হয়। ২৫ ডিসেম্বর অভিনীত হয় ‘অবতার’ (অমৃতলাল)।

১৯০২ খ্রিস্টাব্দে পুরনো নাটকগুলিরই অভিনয় চলতে থাকে। নতুনের মধ্যে অমৃতলাল বসুর ‘নবজীবন’ প্রথম অভিনীত হলো (১ জানুয়ারি), বঙ্কিমের চন্দ্রশেখর উপন্যাসের নাট্যরূপ (অমৃতলাল, ২ ফেব্রুয়ারি), অমৃতলালের ‘তরুবালা’ (৯ ফেব্রুয়ারি), এখানে প্রথম অভিনয় করা হলো। এছাড়া সপ্তম এডওয়ার্ডের মুকুটোৎসব হিসেবে বিশেষ অভিনয় করা হলো ‘সাতখুন মাপ’ নামে নাটক ২৫ জুন। এটি ‘Seven murders pardoned’ নাটকের বাংলা রূপান্তর। ক্ষীরোদ প্রসাদের ‘সাবিত্রী’ প্রথম অভিনীত হলো (৪ অক্টোবর), ‘বেদৌরা’ প্রথম অভিনীত হলো ২৫ ডিসেম্বর।

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ বাংলার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। এই বছরেই ব্রিটিশ বড়লাট লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব দেন। সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশ প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে। জনমনের এই দাবিতে রঙ্গালয়গুলিও পেছনে থাকতে পারেনি। অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের (১৮৭৬) ভয়ে বাংলা মঞ্চ থেকে জাতীয়তাবোধ ও স্বদেশপ্রেমের নাটক প্রায় অন্তর্হিত হয়েছিল। এই গণ-উন্মাদনার দিনে রঙ্গমঞ্চগুলি আবার সাহস ভরে জাতীয় ভাবাবেগের নাট্যাভিনয় শুরু করে দেয়। রঙ্গমঞ্চের উৎসাহে নাট্যকারেরাও আবার এই ধরনের নাট্যরচনায় মনোনিবেশ করেন। বাংলা থিয়েটারে আবার স্বদেশ ও জাতীয়তাবোধের বিষয় নিয়ে নাটক রচনার জোয়ার এলো।

গিরিশচন্দ্র মিনার্ভা থিয়েটারে তাঁর ‘সিরাজদ্দৌলা’, ‘মীরকাশিম’, ‘ছত্রপতি শিবাজী’ স্বদেশপ্রেমের নাটকগুলি অভিনয় করে বাঙালিকে মাতিয়ে দিলেন। স্টার থিয়েটারও এতদিন বাদে সাহসভরে পৌরাণিক নাটক ও গীতিনাট্য ছেড়ে স্বাদেশিক ভাবানুরাগের নাটক অভিনয় আরম্ভ করলো। ঠিক এই সময়ে (মে, ১৯০৩) অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি স্টারে যোগ দেন এবং তাঁরই উদ্যোগে এই জাতীয় অভিনয় হতে থাকলো। এবং স্টার থিয়েটারের ভাগ্য ফিরে গেল। ক্ষীরোদ প্রসাদের ‘প্রতাপাদিত্য’ (১৫.৮.০৪), ‘রঞ্জাবতী’ (৩.৯.০৪) প্রথম অভিনয় করলো স্টার। এই ধারা বেয়েই ক্রমে ক্ষীরোদ প্রসাদের ‘পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত’ (৪.৬.০৬), ‘নন্দকুমার’ (১৪.৮.০৭), ‘পদ্মিনী’ (২৩.১২.০৫); দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘রাণাপ্রতাপ’ (২২.৭.০৫), অমৃতলাল বসুর ‘সাবাস বাঙালি’ (২৫.১২.০৫); মনোমোহন গোস্বামীর ‘কর্মফল’ (৩.৭.০৯), অভিনীত হলো। অনেকদিন বাদে বাংলা রঙ্গালয় জাতীয় ভাবোদ্দীপনায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ফিরে এলো ‘নীলদর্পণ’, অভিনীত হতে থাকলো বঙ্কিমের ‘চন্দ্রশেখর’, রমেশচন্দ্র দত্তের ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ (অমরেন্দ্রনাথ দত্ত) ‘জীবনসন্ধ্যা’ নামে (২১.১১.০৮); অমরেন্দ্রনাথ দত্তের ‘রানী ভবানী’। অনেকদিন বাদে ঝিমিয়ে পড়া রঙ্গমঞ্চ প্রাণাবেগে চঞ্চল হয়ে উঠলো। স্টার থিয়েটারে অভিনেতা অমৃতলাল মিত্র প্রতাপাদিত্য, রাণাপ্রতাপ, মীরকাশিম প্রভৃতি ইতিহাসের জাতীয় বীরদের চরিত্রাভিনয়ে বাঙালি দর্শকদের আবেগাপ্লুত করে তুললেন।

এই জাতীয় অভিনয় শুরু হয়েছিল স্টারে ১৯০৩ থেকেই, সেই বঙ্কিমের ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ (অমৃতলাল বসু, ৪.৪.০৩) অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে। রাজসিংহের ভূমিকায় অমৃতলাল মিত্র এবং দরিয়ার চরিত্রে নরীসুন্দরী জনগণকে মাতিয়ে দিতে শুরু করলেন। ‘রাজসিংহ’ স্টারে আগেও অভিনীত হয়েছিল, কিন্তু বর্তমান যুগমানসের আকাঙ্ক্ষায় এবারকার ‘রাজসিংহ’ নতুন মাত্রা পেয়ে গেল।

ক্ষীরোদ প্রসাদের নতুন লেখা ‘প্রতাপাদিত্য’ সেই ধারাকে আরো প্রাণবন্ত করে তুললো। অভিনয়ে ছিলেন: বিক্রমাদিত্য ও রডা—অর্ধেন্দুশেখর, বসন্ত রায়—অক্ষয়কালী ঢোঙার, প্রতাপাদিত্য—অমৃতলাল মিত্র, গোবিন্দ দাস—কালীনাথ চট্টোপাধ্যায়, বিজয়া—নরীসুন্দরী, গয়লা বৌ—ক্ষেত্ৰমণি।

১৯০৩ থেকে ১৯০৫, এই উন্মাদনার মধ্যে দিয়ে বাঙালি যেমন চলেছিল, বাংলা রঙ্গমঞ্চগুলিও সেইভাবে এই জাতীয় নাটকগুলি অভিনয় করে চলেছিল। ১৯০৫-এর জুলাই মাসে বড়লাট লর্ড কার্জন ঘোষণা করেন, ১৬ অক্টোবর থেকে ‘বঙ্গভঙ্গ’ কার্যকর হবে। বাংলাকে ভেঙে দু টুকরো করে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গ যুক্ত হবে অসম প্রদেশের সঙ্গে এবং পশ্চিমবঙ্গ যুক্ত হবে বিহার-ওড়িশার সঙ্গে। এর প্রতিবাদে সারা বাংলা উত্তাল হয়ে ওঠে। আন্দোলন শুরু হয়। ‘স্বদেশী আন্দোলন’ নামে খ্যাত এই প্রতিবাদের প্রচণ্ডতায় সেদিন সারাদেশ স্বদেশ প্রেমের দীক্ষা নেয়। বাংলা রঙ্গমঞ্চগুলির সঙ্গে স্টার থিয়েটারও সেদিন নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে বাঙালির স্বদেশপ্রেমের আন্দোলনে শামিল হয়েছিল।

১৯০৫-এর ৬ সেপ্টেম্বর, যেদিন বঙ্গভঙ্গ করার কথা ঘোষণা করলেন লর্ড কার্জন, সেদিন সমগ্র বাঙালি জাতির সঙ্গে বাংলা রঙ্গালয়গুলিও অশৌচ পালন করেছিল। সেদিন স্টার থিয়েটারেও অভিনয় বন্ধ রাখা হয়েছিল বিজ্ঞপ্তি মারফৎ—

Mourning At the ‘STAR’!!!

Partition of Bengal

No Amusement work at the

Star Theatre

on

Wednesday, the 6th September

Amritlal Bose

Manager

(Amritabazar Patrika: 6.9.1905)

এই ধরনের নাটক ছাড়াও এই পর্বে সৎসঙ্গ (ভূপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়), খাসদখল (অমৃতলাল), পরপারে (দ্বিজেন্দ্রলাল), ধর্মবিপ্লব (মনোমোহন গোস্বামী), জয়পতাকা (রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়), অহল্যাবাঈ (মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়), অকলঙ্ক শশী (রবীন্দ্রনাথের ‘দিদি’ গল্পের নাট্যরূপ: রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়), সওদাগর (মার্চেন্ট অফ ভেনিসের রূপা: ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়), বিরাজ বৌ (শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ: ভূপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়), ওথেলো (অনুবাদ: দেবেন্দ্র বসু) প্রভৃতি অভিনয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে।

দ্বিজেন্দ্রলালের নাটক যেমন এই সময়ে স্টারে অভিনীত হতে থাকে, তেমনি নাট্যকার হিসেবে ক্ষীরোদপ্রসাদের প্রতিষ্ঠাও এখানে হতে থাকে। প্রতাপাদিত্য থেকেই তাঁর খ্যাতি বৃদ্ধি পায়। অমরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯১১-১৩ পর্যন্ত এই মঞ্চের স্বত্বাধিকারী হন, অবশ্য ১৯০৭ থেকেই তিনি কুসুমকুমারী সহঁ স্টারে অভিনয় করছিলেন। ১৯০৭-এর ৪ মে স্টার থিয়েটার-এ বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহার শুরু হয়। তখন ‘রক্ষ ও রমণী’ (ক্ষীরোদপ্রসাদ) এবং ‘একাকার’ (অমৃতলাল) অভিনয় হচ্ছিল।

১৯০৮ থেকে পুরনো নাটকগুলি অভিনীত হয়ে চললো মাঝে অভিনীত হলো অমরেন্দ্রনাথ দত্তের ‘যৎকিঞ্চিৎ’ (২৫ জুন), হারাণচন্দ্র রক্ষিতের উপন্যাস অবলম্বনে ‘কামিনীকাঞ্চন’ (নাট্যরূপ অমরেন্দ্রনাথ দত্ত), রমেশচন্দ্র দত্তের উপন্যাস ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা’ অবলম্বনে (নাট্যরূপ অমরেন্দ্রনাথ, ২১ নভেম্বর), অমরেন্দ্রনাথের ‘কেয়া মজাদার’ (২৫ ডিসেম্বর)।

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ চললো একইভাবে। নতুন নাটকের মধ্যে ‘ইন্দিরা’, মনোমোহন গোস্বামীর ‘কর্মফল’, নিত্যবোধ বিদ্যারত্নের ‘কুসুমে কীট’ (২০ জুলাই) অভিনীত হলো। স্টারেই ‘কর্মফল’ প্রথম অভিনীত হয়। ব্রিটিশ সরকার এই নাটকের অভিনয় ও প্রচার বন্ধ করে দেয়।

১৯১০-এ প্রথম অভিনীত হল দশচক্র, রবীন্দ্রনাথের মুক্তির উপায় গল্পের নাট্যরূপ (সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, ২৬ ফেব্রুয়ারি)। অমরেন্দ্রনাথের ‘রাণী ভবানী’ (৬ আগস্ট), গুরুঠাকুর (ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ১১ সেপ্টেম্বর), হরনাথ বসুর ‘বেহুলা’ (১০ ডিসেম্বর)। নতুন এই নাটকগুলির সঙ্গে পুরনো নাটকগুলি তো চলছিলই।

১৯১১-তে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘সুলতান’ এবং নাগেশ্বর’ (২৯ এপ্রিল) এখানে প্রথম অভিনীত হল। এছাড়া পুরনো সব নাটকের পুনরভিনয় চলছিল। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর এখানে অভিনয় বন্ধ ছিল। তারপর অভিনীত হলো ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সৎসঙ্গ’ (১১ নভেম্বর), দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মজার নাটক ‘হরিনাথের শ্বশুরবাড়ি যাত্রা’ (২৫ নভেম্বর), নরেন্দ্রনাথ সরকারের ‘জীবন সংগ্রাম’ (২৬ ডিসেম্বর)। হরিনাথের ‘শ্বশুরবাড়ি যাত্রা’ নাটকে দেখানো হয়েছিল, মঞ্চে একটা আস্ত ট্রেন। এই ট্রেন থেকে যাত্রীরা ওঠানামা করছে, তারপরে ট্রেন ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। মঞ্চের এই কৌশল সেদিন দর্শকদের আকর্ষণের ও আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল।

১৯১২ খ্রিস্টাব্দের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খবর হলো গিরিশচন্দ্রের মৃত্যু (৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯১২)। [৮ ফেব্রুয়ারি রাত্রি বারোটার পর ১টা ১০ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয়, সেজন্য ইংরেজি মতে ৯ ফেব্রুয়ারি হওয়াই বিধেয়]। গিরিশচন্দ্রের মৃত্যু বাংলা রঙ্গালয়ের পক্ষে বিরাট ক্ষতি। তার নাট্যজীবনের প্রায় ৪০ বছর তিনিই ছিলেন বাংলা মঞ্চের শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় অভিনেতা, শ্রেষ্ঠ নাট্য পরিচালক ও মঞ্চাধ্যক্ষ এবং অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ ও খ্যাতিমান নাট্যকার।

১৯১২ তে পুরনো নাটকেরই অভিনয় চলছে। তার মধ্যে অমৃতলাল বসুর নতুন নাটক ‘খাসদখল’ প্রথম অভিনীত হয় ৩০ মার্চ। অভিনয় করলেন: অমৃতলাল বসু—নিতাইচরণ, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত—মোহিতমোহন, কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়—মনোমোহন, কুঞ্জলাল চক্রবর্তী—ঠাকুর্দা মহাশয়, লক্ষ্মীনারায়ণ মিত্র—ডা. ডি. মিত্র, কার্তিকচন্দ্র দে—পাকড়াশি, বসন্তকুমারী—মোক্ষদা, মৃণালিনী—বিধু ঝি।

এই নাটকের অভিনয় সব দিক দিয়ে আলোড়ন তুলেছিল। অভিনয় সাজসজ্জা, দৃশ্যপট, হ্যান্ডবিল—সব বিষয়েই রঙ্গালয়ের ইতিহাসে অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছিল। নিতাইচরণের মুখে (অভিনেতা—অমৃতলাল) ‘is the’ বাংলা ভাষায় প্রবাদবাক্য হয়ে উঠেছিল। “নিতাই অমৃতলালের এক অভিনব ও অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। স্বল্পবুদ্ধি এই মানুষটি তাহার ‘‘ইজ দি’’র বাহুল্যে কৌতুকের প্রবাহ অনর্গল করিয়া দিয়া নাটকের শেষের দিকে একটি পুরা মানুষ হইয়া উঠিয়াছেন…মোহিত ও গিরিবালার পুনর্মিলনে আনন্দিত হইয়া বলিয়াছে—‘‘Beg your pardon is the, মোহিতের সঙ্গে ইজ দি নয়। You are is the গিরিবালা—মা’র বর, vour pardon’’—এখানে হাস্যরস ও করুণরস এক হইয়া গিয়াছে।” [অরুণকুমার মিত্র—অমৃতলাল বসুর জীবনী ও সাহিত্য]। গিরিবালার ভূমিকায় সুশীলাবালার কণ্ঠে গান—“ওগো কেউ বল না গো ভাতার কেমন মিষ্টি’’—সেকালে ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল।

এছাড়া, এই বছরে মনোমোহন বসুর ‘রূপকথা’ (১৫ জুন), দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘পরপারে’ (১৭ আগস্ট), মনোমোহন গোস্বামীর ‘ধর্মবিপ্লব’ (২৯ মার্চ), রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাল পরিণয়’ (২৫ ডিসেম্বর) এখানে প্রথম অভিনীত হয়।

এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ অবশ্যই প্রয়োজন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা কৌতুক গীতিনাট্য ‘আনন্দবিদায়’ স্টার থিয়েটারেই প্রথম অভিনীত হলো ১৬ নভেম্বর, ১৯১২। সঙ্গেই দ্বিজেন্দ্রলালেরই ‘পরপারে’ অভিনয়ের ব্যবস্থা ছিল। ‘আনন্দবিদায়’ গীতিনাট্যে রূপকের সাহায্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করাই ছিল নাট্যকারের উদ্দেশ্য। এই নিয়ে ‘আনন্দবিদায়’ অভিনয়ের প্রথম দিনেই গণ্ডগোল শুরু হয়। সেদিনকার মতো নাটকটির অভিনয় বন্ধ হয়ে গেলেও ৫ ডিসেম্বর, ১৯১২ নাটকটি পুনরভিনীত হয়। সঙ্গে অ্যানি অ্যাবটের প্রদর্শনী ও আবু হোসেন’-এর অভিনয় হয়েছিল। [এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্র. ড. দর্শন চৌধুরীর প্রবন্ধ—স্টার থিয়েটারের ইতিহাস নাট্যচিন্তা, মে-অক্টোবর, ২০০১]। নাটকটি অভিনয়ের সময়ে স্টার থিয়েটারের ম্যানেজার ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত ও পারিবারিক পরিচিত অমরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং অনারারি ‘ড্রামাটিক ডিরেক্টর’ ছিলেন অমৃতলাল বসু।

দ্বিতীয়বারের পর ‘আনন্দবিদায়’ স্টারে তো নয়ই, অন্য কোনো রঙ্গমঞ্চেও আর কখনো অভিনীত হয়নি।

১৯১৩-তে নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যু হয় (১৭ মে)। পুরনো নাটকগুলির সঙ্গে মঞ্চে ‘বায়োস্কোপ’ দেখানো চলছে। টাকার জন্য বাইরে গিয়ে আমন্ত্রিত অভিনয়ও চলছে। সে কারণে কলকাতায় অভিনয় বন্ধ থাকছে। তার মধ্যে মনোমোহন গোস্বামীর ‘ধর্মবিপ্লব’ ঐতিহাসিক পঞ্চাঙ্ক নাটক অভিনীত হলো (২৯ মার্চ)। অমরেন্দ্রনাথের কৌতুক গীতিনাট্য ‘কিসমিস’ (৩ মে), অনেকদিন বাদে রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রাণী’ (১৭ মে) অভিনীত হলো। অমরেন্দ্রনাথের কৌতুকনাট্য ‘রোকশোধ’ (১ নভেম্বর) প্রথম অভিনয়। কোনও কোনও দিন নাট্যাভিনয়ের সঙ্গে প্রফেসর চিত্তরঞ্জন গোস্বামীর হাস্যকৌতুক, ম্যাজিক, টেলিপ্যাথি, গোপালচন্দ্র সিংহরায়ের ক্যারিকেচার ও ভেন্ট্রিলোকুইজম; এম. এল. সেনের রয়্যাল বায়স্কোপ ইত্যাদি প্রোগ্রামে থাকতো।

১৯১৪-তে উল্লেখযোগ্য অভিনয় রবীন্দ্রনাথের ‘শাস্তি’ গল্পের নাট্যরূপ (রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় অমরেন্দ্রনাথ দত্ত) ‘অভিমানিনী’ (১৩ জুন)। অভিনয়ে মন্মথনাথ পাল—ছিদাম, ক্ষেত্রমোহন মিত্র—দুখীরাম, কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়—রামলোচন, বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়—সিভিল সার্জেন, কুসুমকুমারী—চন্দরনা, নরীসুন্দরী—ললিতা, মৃণালিনী—রাধা।

এই সময়ে অমরেন্দ্রনাথ উদ্যোগী হয়ে ‘থিয়েটার’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। প্রথম প্রকাশ ১০ জুলাই, ১৯১৪। আটমাস চলে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।

মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অহল্যাবাঈ’ প্রথম অভিনীত হলো (১৫ আগস্ট)। ৩১ অক্টোবর অভিনীত হলো ‘অকলঙ্ক শশী’—রবীন্দ্রনাথের ‘দিদি’ গল্পের নাট্যরূপ (রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়)। অভিনয় করেছিলেন: অমরেন্দ্রনাথ দত্ত—জয়গোপাল, কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়—দুর্লভ, কুঞ্জলাল চক্রবর্তী—কেদার নন্দী, হীরালাল দত্ত—মধু ডাক্তার, কুসুমকুমারী—শশী, বসন্তকুমারী—তারা, মৃণালিনী—সুভাষিণী।

এছাড়া ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ক্ষত্রবীর’ (৫ ডিসেম্বর) মহাভারতের যুদ্ধ নিয়ে লেখা হলেও ইউরোপের বর্তমান বিশ্বযুদ্ধকে তুলে ধরে। মনে রাখতে হবে, ১৯১৪-তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, চলেছিল ১৯১৮ পর্যন্ত। যদিও প্রথম এই মহাযুদ্ধের কোনও প্রত্যক্ষ প্রভাব এদেশে পড়েনি। তবুও পরোক্ষ প্রভাব ভারতবাসী হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। অমরেন্দ্রনাথ দত্তের অভিনেত্রীর ‘রূপ’ এখানে প্রথম অভিনীত হল (২৬ ডিসেম্বর)। তার একই নামের উপন্যাসের নাট্যরূপ তিনি নিজেই দিয়েছিলেন।

১৯১৫ খ্রিস্টাব্দেও স্টার চলেছে ভালোমন্দ মিশিয়ে। পুরনো সব নাটক অভিনয় করা হচ্ছে। বছরের গোড়াতেই (৩ জানুয়ারি) স্টারের প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুশীলাবালা মারা গেলেন। তাই সেদিন স্টারে অভিনয়ের আগে হরিসংকীর্তন হয়েছিল। এই বছরে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অভিনয় নেই। ভালো নাটকও তেমন রচিত হচ্ছে না। তার মধ্যেও অমরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রেমের ‘জেপলীন’ (৬ ফেব্রুয়ারি), রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বেলোয়ারী’ (৬ ফেব্রুয়ারি), স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘কনে বদল’ (৬ ফেব্রুয়ারি), মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মাধব রাও’ (২৭ এপ্রিল), জগৎচন্দ্র সেনের ‘রাজ চন্দ্ৰধ্বজ’ (২১ আগস্ট), মনোমোহন গোস্বামীর ‘ভীলেদের ভোমরা’ (২৫ ডিসেম্বর) প্রথম অভিনীত হলো। এর মধ্যে Wilson Barret-এর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘‘The Sign of the Cross’’ অবলম্বনে ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ওই নামেই বাংলায় নাট্যরূপ দেন এবং স্টারে অভিনীত হয় (২৭ ফেব্রুয়ারি)। অমৃতবাজার পত্রিকা (২৩ মার্চ, ১৯১৫) প্রশংসা করে লিখেছিল—‘‘The Sign of the Cross on the whole, as produced by this Company, marks a distant epoch, in dramatic production.’’

এই বছরেই একবার স্টারে বহুখ্যাত মার্কিনী নাট্যশিল্পী Denever Bill তার Al Star Co. নিয়ে কলকাতায় এসে স্টারে ‘Red Indian War Drama’ অভিনয় করে যান (২৪ মার্চ)। তারা বারকয়েক অভিনয় করেছিলেন। স্টার একদিন (১২ অক্টোবর) ইংরেজিতে ‘দ্য সাইন অফ দ্য ক্রস’ নাটকটির নির্বাচিত দৃশ্যের অভিনয় করে। বাংলায় এই নাটকেরই একই দৃশ্যের অভিনয় করে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।

৪ ডিসেম্বর মহাসমারোহে অভিনীত হলো শেক্সপীয়রের Merchant of Venice নাটকের বাংলা রূপান্তর (ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়) ‘সওদাগর’ নামে। অভিনয় করেছিলেন: অমরেন্দ্রনাথ দত্ত—কুলীরক (Shylock), বীরেন্দ্রনাথ মুখখাপাধ্যায়—অনিলকুমার (Antonio), কুঞ্জলাল চক্রবর্তী—বসন্তকুমার (Bassamio), লক্ষ্মীকান্ত মুখোপাধ্যায়—রাজা বিক্রম সিংহ (Duke of Venice), কুসুমকুমারী—প্রতিভা (Portia), নারায়ণী—নিরজা (Narissa), আশ্চর্যময়ী—যুথিকা (Jessika), কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়—নটবর (Iancelot gobbo)।

১৯১৫-এর ১২ ডিসেম্বর ‘সাজাহান’ নাটকে ঔরংজেবের ভূমিকায় অভিনয় করে যেতে যেতে অমরেন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তৃতীয় অঙ্ক শেষ হওয়ার আগেই তার মুখ দিয়ে রক্ত উঠতে থাকে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। মঞ্চে এই তার শেষ অভিনয়। এর মাস খানেকের মধ্যে, ৬ জানুয়ারি ১৯১৬, অমরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়।

অমরেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর স্টার কর্তৃপক্ষ কোনওরকমে কিছুদিন থিয়েটার চালান এবং পুরনো নাটকগুলিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অভিনয় করতে থাকেন। তখন ম্যানেজার হয়েছেন অমৃতলাল বসু। নতুন অভিনয়ের মধ্যে ভূপেন্দ্রনাথের ‘গুরুদক্ষিণা’ (১১ মার্চ), হেমেন্দ্রলালের একটি উপন্যাসের নাট্যরূপ (ভূপেন্দ্রনাথ, ৮ এপ্রিল), যোগেন্দ্রনাথ দাসের ‘বল্লাস সেন’ (১৩ মে), হারাণচন্দ্র রক্ষিতের ‘জড়ভরত’ (২৪ জুন)। মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের পঞ্চশর’ এবং মনোমোহন গোস্বামীর ‘সাধনা’ (২৫ ডিসেম্বর) প্রভৃতি।

১৯১৭-তে পুরনো নাটক সব অভিনীত হচ্ছে। নতুন নাটক অভিনীত হলো, ১৪ এপ্রিল, মাইকেলের জীবনীকার যোগীন্দ্রনাথ বসুর পঞ্চাঙ্ক নাটক ‘দেববালা’। চন্দ্রশেখর নাট্যরূপের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে স্টারে তা অভিনীত হলো ১৪ জুলাই। এই দিনে মিনার্ভা ও মনোমোহন থিয়েটারেও চন্দ্রশেখর অভিনীত হলো।

১৯১৭-এর ৮ আগস্ট ‘চন্দ্রশেখর’ ও ‘খাসদখল’ নাটকে প্রথম মঞ্চাবতরণ করলেন অমৃতলাল বসুর কনিষ্ঠপুত্র অসিভূষণ বসু। তিনি ‘চন্দ্রশেখর’-এ প্রতাপ এবং ‘খাসদখল’-এ মোহিত চরিত্রে অভিনয় করেন।

স্টার থিয়েটারের অবস্থা তখন খুবই সঙ্গীন। ভালো নাটক নেই, ভালো অভিনেতা নেই। দর্শকও কমে আসছে দিনকে দিন। এই অবস্থায় ১১ আগস্ট, ১৯১৭ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভিনয় বন্ধ থাকে। কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব ছেড়ে ‘লেসী’ করলেন অনঙ্গমোহন হালদারকে। ম্যানেজার নরেন্দ্রনাথ সরকার। ২২ সেপ্টেম্বর ডা. নারায়ণ বসুর লেখা মহাভারতের ‘কুরুক্ষেত্র’ নাটক দিয়ে নতুন করে স্টার থিয়েটার চালু হলো। এবং পরপর পুরনো নাটকের মাঝে কুরুক্ষেত্র সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করে চললো। অভিনয়ে: নৃপেন্দ্রচন্দ্র বসু—শ্রীকৃষ্ণ, লক্ষ্মীকান্ত মুখোপাধ্যায়—ভীষ্ম, পুষ্পকুমারী—উত্তরা, কুঞ্জলাল চক্রবর্তী—ভীম, হরিসুন্দরী (ব্লাকী)—দ্রৌপদী।

আবার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে থিয়েটারের। তাই ৩১ অক্টোবর অভিনয়ের পর ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত আবার স্টার বন্ধ থাকে। ২৯ ডিসেম্বর থেকে পুরনো নাটকগুলির অভিনয় শুরু হয়।

১৯১৮-তেও স্টার থিয়েটার কোনওরকমে চলছিল। ‘রণভেরী’ নাটক দিয়ে ১ জানুয়ারি শুরু হলো। নাট্যকার দাশরথি মুখাোপাধ্যায়। এই নাটকটি দেখতে সেদিন বালগঙ্গাধর তিলক এসেছিলেন। ১৩ জানুয়ারি ‘Sole Lesee’ হলেন অনঙ্গমোহন, ম্যানেজার—এম. এল. মুখার্জী। অভিনীত হল বঙ্কিমের ‘মুচিরাম’-এর নাট্যরূপ (১৯ জানুয়ারি)। মুচিরামের ভূমিকায় কুসুমকুমারীর অনবদ্য অভিনয় সেদিনের পত্রপত্রিকায় উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে আবার স্টার বন্ধ হয়ে যায়। তবে মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত অভিনয় চলেছে। গওহরজানের গান, ম্যাজিক, বায়োস্কোপ ইত্যাদি দিয়ে দর্শক আকর্ষণের চেষ্টা চলেছে। তবে ২৮ এপ্রিলের অনুষ্ঠানের পর একেবারে ২৮ জুন পর্যন্ত স্টার একটানা বন্ধ থাকে। ২৯ জুন থেকে পুরনো নাটক এবং সঙ্গীত, নৃত্য, বায়োস্কোপ ইত্যাদির অনুষ্ঠান চলতে থাকে।

এরপর ৩ আগস্ট থেকে গিরিমোহন মল্লিকের কর্তৃত্বাধীন স্টার থিয়েটারের ভাগ্য ফেরানোর জন্য নামানো হয় শরৎচন্দ্রের ‘বিরাজ বৌ’-এর নাট্যরূপ (ভূপেন্দ্রনাথ)। সাধারণ রঙ্গালয়ে শরৎচন্দ্রের এই কাহিনীর প্রথম নাট্যরূপ অভিনীত হলো। অভিনয় করেছিলেন: অমৃতলাল বসু—যদু, মি. পালিত—নীলাম্বর, ক্ষেত্রমোহন মিত্র—পীতাম্বর, কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়—নিতাই, হীরালাল দত্ত—ভুলু, মনোমোহন গোস্বামী—নরহরি, কুসুমকুমারী—বিরাজ বৌ, বসন্তকুমারী—সুন্দরী, নরীসুন্দরী—মোহিনী।

এক সময়ে বঙ্কিমের উপন্যাসের নাট্যরূপ বাংলা থিয়েটারে প্রবলভাবে অভিনীত হয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। শরৎচন্দ্রের আত্মপ্রকাশের কয়েক বছরের মধ্যেই তার উপন্যাসের নাট্যরূপ অভিনয় শুরু করেছিল স্টার। তারপরে বিভিন্ন থিয়েটারে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপের অভিনয়ও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

‘বিরাজ বৌ’ স্টার থিয়েটারের ভাগ্য ফিরিয়ে দিল। আর্থিক সাফল্যে উৎসাহী গিরিমোহন নতুন উদ্যমে থিয়েটার চালাতে লাগলেন। পুরনো নাটকের ফাঁকে ভূপেন্দ্রনাথের প্রহসন ‘বিদ্যাধরী’ (২১ সেপ্টেম্বর), যতীন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায়ের পঞ্চাঙ্ক ঐতিহাসিক নাটক ‘আরব অভিযান’ (২ নভেম্বর) অভিনয় করা হলো।

ব্রিটেনের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ উপলক্ষে স্টার বিশেষ অভিনয় (victory celebration performance) করেছিল ২৯ নভেম্বর, ১৯১৮। ‘খাসদখল’ ও ‘জয়দেব’। উল্লেখ্য, এই দিন দরিদ্রদের জন্য প্রবেশমূল্য ছিল না।

গিরিমোহন মল্লিক স্টার থিয়েটারকে আরও ভালোভাবে চালানোর জন্য অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে থিয়েটারের ম্যানেজার নিযুক্ত করেন (৪ ডিসেম্বর)। অপরেশচন্দ্রের সঙ্গে মিনার্ভা থিয়েটার থেকে চলে এলেন তারাসুন্দরী ও নীরদাসুন্দরী। Sole Proprieton হলেন গিরিমোহন। নতুন নাটক প্রস্তুতির জন্য থিয়েটার বন্ধ রইলো। তারপরে ১৪ ডিসেম্বর অভিনয় করলেন ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘কিন্নরী’। এটি আগেই অপরেশচন্দ্র মিনার্ভায় অভিনয় করেছিলেন। (১৭.৮.১৮)। স্টারে অভিনেতা-অভিনেত্রী হলেন: তারকনাথ পালিত—সুধন, তারাসুন্দরী—উৎপল, বসন্তকুমারী—মুকরী, নীরদাসুন্দরী—চকুরিশ। স্টারের পাশাপাশি মিনার্ভাও ‘কিন্নরী’ অভিনয় করে চললো। একসঙ্গে দুই থিয়েটারে ‘কিন্নরী’ হাউসফুল হতে থাকলো। মিনার্ভার মালিক উপেন্দ্রনাথ মিত্র স্টারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা ঠুকে দিলেন। কিন্তু স্টারেও ‘কিন্নরী’র অভিনয় চলতে লাগলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মিটে গেছে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ শুরু হলো সেই ‘কিন্নরী’ দিয়ে। চললো আরো সব পুরনো নাটক। ১৯১৯-এর ২ মার্চ আদালতের আপত্তিতে স্টার ‘কিন্নরী’র অভিনয় বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়।

উনিশ শতকের শেষের দিকে গিরিশচন্দ্রকে নিয়ে এইরকম এক মামলা হয়। গিরিশ তখন (১৮৯১) স্টার ছেড়ে নীলমাধব চক্রবর্তীকে নিয়ে সিটি থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে গিরিশের নাটকগুলির অভিনয় শুরু হয়। সেই নাটকগুলি স্টারেও চলছিল। স্টার কর্তৃপক্ষ এই নিয়ে মামলা করেন। স্টার হেরে যায়। বিচারপতি উইলসন তার রায়ে বলেন, কোনও মুদ্রিত নাটক দোকানে বিক্রি হতে শুরু করলেই সে নাটক সকল থিয়েটারই বিনা বাধায় অভিনয় করতে পারবে।

এই রায় মেনেই এতোদিন সব থিয়েটারে অভিনয় চলতো। কিন্তু ‘কিন্নরী’ নাটক খুব সাফল্যলাভ করায়, মিনার্ভা ও স্টারে একইসঙ্গে অভিনয় চলতে থাকায়, মিনার্ভার উপেন্দ্রনাথ মিত্র হাইকোর্টে মামলা করে জেতেন এবং স্টারে ‘কিন্নরী’ বন্ধ হয়ে যায়। ২৬ বছর ধরে প্রচলিত ও অনুসৃত আইন পালটে যায় এবং এক থিয়েটারে অভিনীত নাটক বিনা অনুমতিতে অন্য থিয়েটারে অভিনয় করা যাবে না—এই আইন চালু হয় (5A of Britisli Copyright Act of 1912)। এখন অবধি বাংলা থিয়েটারে এই আইন চালু আছে।

১৯১৯-পুরনো নাটকের মধ্যেই নতুন নাটক প্রথম অভিনীত হলো ‘ওথেলো’ (৮ মার্চ) এবং মুখের মতো (নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায়, ৮ মার্চ)। শেক্সপীয়রের ‘ওথেলো’ নাটকের বঙ্গীয় রূপান্তর করেন দেবেন্দ্রনাথ বসু। অভিনয়ে: তারকনাথ পালিত—ওথেলো, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়—ইয়াগো, লক্ষ্মীকান্ত মুখোপাধ্যায়—ব্ৰাচাব্রসিও, প্রবোধচন্দ্র বসু—কেসিও, তারাসুন্দরী—ডেসডিমোনা, নীরদাসুন্দরী—এমিলিয়া, মণিমালা—বিয়াঙ্কা, অতীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য—ডিউক।

প্রবোধচন্দ্র বসুর নির্দেশে পরেশচন্দ্র বসু (পটলবাবু) দৃশ্য পরিকল্পনা করেছিলেন। ওথেলোর অভিনয় দর্শকদের সমাদর লাভ করে। এবং বেশ কিছু রাত্রি ‘ওথেলো’র অভিনয় চলেছিল। তারাসুন্দরীর ডেসডিমোনা প্রশংসা লাভ করেছিল। তবুও প্রচুর পরিশ্রম, মহার্ঘ সাজসজ্জা, দৃশ্যসজ্জা ইত্যাদিতে খরচ ও মেহনত হয়েছিল, তা উশুল হয়নি।

এবারে অপরেশচন্দ্র নিজের লেখা গীতিনাট্য ‘উর্বশী’ নামালেন। কালিদাসের সংস্কৃত ‘বিক্রমোর্বশীয়ম’ অবলম্বনে এটি লেখা। নাচগানে ভরা এই নাটক নামিয়ে অপরেশচন্দ্র আর্থিক ক্ষতিপূরণ করলেন। তারপরে অপরেশচন্দ্র নিজের লেখা ‘দুমুখো সাপ’ নাটক অভিনয় করলেন। এটি William Congreve-এর ‘The Double Dealer অবলম্বনে লেখা। এই নাটকও ভালোই চললো।

১ নভেম্বর অভিনীত হল দীনবন্ধুর ‘সধবার একাদশী’। তাতে উল্লেখযোগ্য খবর হলো নিমচাঁদের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী নীরদাসুন্দরী। এই অভূতপূর্ব প্রয়াসের কথা কর্তৃপক্ষ সগর্বে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে জানিয়েও দিয়েছিলেন। এবং একরাত্রি নয়, বেশ কয়েক রাত্রি নীরদাসুন্দরী নিমচাঁদের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। যদিও বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, এই ‘‘Lady artist quite unacquainted with the English Alphabet” এবং এই অভিনেত্রী যে তা সত্ত্বেও ‘নিমাচাঁদ’-এর অভিনয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাও বিজ্ঞাপনে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এরপরে অভিনীত হলো রমেশচন্দ্র দত্তের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত’ অবলম্বনে ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাট্যরূপ ‘জীবনপ্রভাত’ (২৯ নভেম্বর)। তারপরে ভূপেন্দ্রনাথের মিলনাত্মক নাটক ‘বৈবাহিক’ (২৫ ডিসেম্বর)।

১৯২০-তে গিরিমোহন মল্লিক স্টার থিয়েটারের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন। এবারে অপরেশচন্দ্র ‘লেসী’ হলেন এপ্রিল মাস থেকে। পুরনো নাটকের মাঝে নতুন নাটক মঞ্চস্থ হলো ‘রাখীবন্ধন’ (২২ জুন), দেবেন্দ্রনাথ বসুর ‘কুইকী’ (১৯ জুন) এবং অপরেশচন্দ্রের নিজের নাটক ‘ছিন্নহার’ (২১ আগস্ট)। ‘ছিন্নহার’ সে সময়ে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দেও চললো কোনওরকমে। অপরেশচন্দ্রের ‘বাসবদত্তা’ (১৫ জানুয়ারি), ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘মন্দাকিনী’ (২ এপ্রিল) এবং অপরেশচন্দ্রের ঐতিহাসিক নাটক ‘অযোধ্যার বেগম’ (২ ডিসেম্বর) মঞ্চস্থ হলো।

১৯২২-তেও একই অবস্থা। নতুন নাটকের মধ্যে নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নবাবী আমল’ (১ জুলাই), অপরেশচন্দ্রের দুটি নাটক ‘অপ্সরা’ (১৯ আগস্ট) এবং ‘সুদামা’ (২৩ সেপ্টেম্বর)।

এই সময় কালে দেখা যাচ্ছে, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় অভিনেতা ও ম্যানেজার হয়ে স্টার থিয়েটারে যোগ দিয়ে ধীরে ধীরে নাট্যকার হয়ে উঠলেন। ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অনুবাদ করছেন, নাট্যরূপ দিচ্ছেন এবং মৌলিক নাটক লিখে চলেছেন। এই মন্দা অবস্থায় অভিনেতা অপরেশচন্দ্ৰ ক্ৰমে মঞ্চের তাগিদে নাট্যকার হয়ে উঠলেন। তখনকার প্রচলিত নাটকের ধরন এবং বিষয়বস্তু নিয়েই তার নাটকগুলি তৈরি হয়েছিল। সমসাময়িক চাহিদা মিটিয়েই সেগুলির মূল্য শেষ হয়ে গেছে।

তৃতীয় পর্ব (১৯২৩-৩৩)

এবারে গিরিমোহন স্টার ছেড়ে দিলে অপরেশচন্দ্র, প্রবোধচন্দ্র গুহ ও তারাসুন্দরী মিলে থিয়েটারের লীজ নেন এবং পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন অপরেশচন্দ্র স্বয়ং। একা কিছুদিন থিয়েটার চালাবার পর সবাই মিলে একটি যৌথ প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ‘আর্ট থিয়েটার লিমিটেড’ নাম দিয়ে স্টার থিয়েটারের বাড়িতে নতুন নাট্যদল তৈরি করে নাট্যাভিনয় করতে থাকে। ১৯২৩-এর ৩০ জুন অপরেশচন্দ্র রচিত, পরিচালিত ও অভিনীত কর্ণার্জুন নাটক দিয়ে আর্ট থিয়েটারের অভিনয় শুরু হয়। ২৬০ রাত্রি একাদিক্রমে অভিনয়ের রেকর্ড সৃষ্টি করল ‘কর্ণার্জুন’। আর্ট থিয়েটার পূর্ণবেগে তাদের থিয়েটার চালাতে লাগলো স্টার থিয়েটারের বাড়িতে। একটানা দশ বৎসর অভিনয় চালিয়ে আর্ট থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায় ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে। কিছুটা দেনার দায় ও মূলত ‘প্রধান উদ্যমী’ অপরেশচন্দ্রের মৃত্যু আর্ট থিয়েটারের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটায়।

চতুর্থ পর্ব (১৯৩৪-৩৭)

১৯৩৪ থেকে এখানে শিশির ভাদুড়ি ভাড়া নিয়ে তাঁর ‘নবনাট্য মন্দির’ খোলন এবং একটানা ১৯৩৭ পর্যন্ত তাঁর দলের অভিনয় এখানে চালান।

আর্ট থিয়েটার-এর অভিনয়ের রমরমা স্টার থিয়েটারের গৌরব বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপরে শিশিরকুমার ভাদুড়ির নবনাট্য মন্দির ও তার বিভিন্নমুখী অভিনয়ের কৃতিত্ব ও সৌকর্যে স্টার থিয়েটার বাড়ির মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

পঞ্চম পর্ব (১৯৩৮-১৯৫৩)

স্টার থিয়েটার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মামলায় হেরে শিশিরকুমার স্টার ছেড়ে দিলেন (জুন, ১৯৩৭)। তারপর মামলা-মোকদ্দমার নানা ঝামেলায় স্টার প্রায় বন্ধই থাকে। ১৯৩৭-এর ৪ অক্টোবর, যোগেশ চৌধুরী স্টার থিয়েটার ভাড়া নিলেন। তাঁর নাট্যদলের নাম ‘নাটমহল’। এই সম্প্রদায়ের হয়ে যোগেশ চৌধুরী তাঁর নিজের লেখা নাটক ‘গৌরাঙ্গসুন্দর’ (৪ অক্টোবর) অভিনয় করালেন। তারপর বিমল পাল নামে একজন কিছুদিনের জন্য স্টার থিয়েটারের ‘লেসী’ হন। তিনি তৈরি করলেন স্টেজ অ্যান্ড স্ক্রিন সিন্ডিকেট। স্টার মঞ্চে এই সম্প্রদায় অভিনয় করেছিল রমেশ গোস্বামীর ‘বিদ্যাপতি’ (১৭ নভেম্বর), অয়স্কান্ত বক্সীর ‘অভিসারিকা’ (২৫ ডিসেম্বর), ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘অপরাজিতা’ (৩০ ডিসেম্বর)। ১৯৩৭ এইভাবে শেষ হলো।

১৯৩৮-এর মার্চ পর্যন্ত ‘স্টেজ অ্যান্ড স্ক্রিন সিন্ডিকেট’ বিমল পালের কর্তৃত্বে স্টার থিয়েটারে অভিনয় চালিয়ে যায়। এই বছরে নতুন নাটকের মধ্যে শচীন সেনগুপ্তের ‘কালের দাবি’ (১২ মার্চ) উল্লেখযোগ্য।

বিমল পাল স্টার ছেড়ে দিলেন। মিনার্ভা থিয়েটারের স্বত্বাধিকারী উপেন্দ্রকুমার মিত্রের পুত্র সলিলকুমার মিত্র স্টারের নতুন ‘লেসী’ হলেন। নাট্যকার পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে যোগ দিলেন মহেন্দ্র গুপ্ত। ১৯৩৮-এর ২৯ মার্চ শুরু হলো স্টারের নতুন পর্ব।

এই সময় থেকে স্টার থিয়েটারে শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন অভিনয়ের ব্যবস্থা হয়। মহেন্দ্র গুপ্তের নিয়ন্ত্রনাধীনে খুবই সুষ্ঠুভাবে এই নতুন অভিনয় সূচি পালিত হতে থাকে। তখন স্টারে অভিনয় করতেন মহেন্দ্র গুপ্ত স্বয়ং, বিপিন গুপ্ত, ভূপেন চক্রবর্তী, শেফালিকা, পূর্ণিমা প্রমুখ।

মিনার্ভা থিয়েটার থেকে সলিলকুমার মিত্র স্টারে এসে প্রথমে মিনার্ভায় অভিনীত নাটকগুলিই চালাবার চেষ্টা করেন। তাঁর সম্পর্কিত ভ্রাতা কালীপ্রসাদ ঘোষ প্রথম দিকে দায়িত্ব নিয়ে মিনার্ভার চলতি নাটক, যেমন ‘ধর্মদ্বন্দ্ব’ ‘গয়াতীর্থ’, ‘শিবাৰ্জুন’ স্টারে অভিনয় করান। তার পরিচালনায় এবার এখানে অভিনীত হল নতুন নাটক ‘চক্রধারী’ (৩ জুন, ১৯৩৮)। নাট্যকার মহেন্দ্র গুপ্ত। পরেই সুধীন্দ্রনাথ রাহার ‘বাংলার বোমা’ (৩০ সেপ্টেম্বর), মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাসুদেব’।

১৯৩৮-এর ২০ আগস্ট স্টার থিয়েটারের জমি কিনে নেন অমিয়কুমার দে এক লক্ষ একাত্তর হাজার টাকায়। জমির মালিক নতুন হলেও স্টার থিয়েটার পরিচালনার পুরো দায়িত্বে রইলেন সলিলকুমার মিত্র। তাঁরই সুষ্ঠু ও নিপুণ কর্তৃত্বাধীনে স্টার থিয়েটার ১৯৩৮-এর ২৯ মার্চ থেকে ১৯৭১-এর ৩০ মার্চ পর্যন্ত দীর্ঘ তেত্রিশ বৎসর একটানা নাট্যাভিনয় চালিয়ে গেছে।

এবারে নাট্য পরিচালনার দায়িত্বে এলেন মহেন্দ্র গুপ্ত। অক্টোবর, ১৯৪০। তারপর থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত মহেন্দ্র গুপ্ত একটানা স্টারের নাট্য পরিচালনা করেছেন, প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন এবং প্রয়োজনে অনেক নাটক রচনা করেছেন। তাই নাট্যাভিনয়ের দিক থেকে এই পর্বকে (১৯৩৮-৫৩) স্টার থিয়েটারে মহেন্দ্র গুপ্তের পর্ব বলা যেতে পারে।

মহেন্দ্র গুপ্তের জাতীয় ভাবাত্মক নাটকগুলি এখানে জন সমাদর লাভ করে। ‘নন্দকুমার’, ‘টিপু সুলতান’, ‘রণজিৎ সিংহ’, ‘শতবর্ষ আগে’ প্রভৃতি নাটক খুবই খ্যাতিলাভ করে। ‘নন্দকুমার’ তো একটানা দু’শো রজনী অভিনয় হয়েছিল। এখান থেকেই মহেন্দ্র গুপ্ত নাট্যকার, পরিচালক ও অভিনেতা হিসাবে বঙ্গরঙ্গমঞ্চে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

মনে রাখতে হবে, এই পর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫) শুরু হয়। যুদ্ধের ভয় ও জাপানি বোমার আতঙ্কে তখন কলকাতাবাসী আতঙ্কিত। শহর কলকাতায় ব্ল্যাক-আউট। সারাদেশে খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ, মহামারী। পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। তার সঙ্গে চোরাচালানি, কালোবাজারি, মজুতদারি। দেশজুড়ে ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম। সে এক বিপর্যয়কর অবস্থা। বিশ্বযুদ্ধ মিটলেই ১৯৪৬-এর ভ্রাতৃঘাতী নিষ্ঠুর দাঙ্গা, ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা এবং বঙ্গবিভাগের ক্ষত ও জ্বালা। কাতারে কাতারে উদ্বাস্তুর আগমন। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। এই ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাপূর্ণ সময়ে কলকাতার বুকে রঙ্গালয়গুলিও মহাসমারোহে নাট্যাভিনয় চালাতে পারেনি। অন্য থিয়েটারগুলির মতো স্টারও মাঝে মাঝে নির্জীব হয়ে পড়ছিল। তার মধ্যেও মহেন্দ্র গুপ্তের জাতীয় ভাবাত্মক নাটক রচনা ও অভিনয় এবং সাফল্যলাভ অবশ্যই উল্লেখের দাবি রাখে। ঐতিহাসিক নাটকের উপস্থাপনা ও তার অভিনয়ের কৃতিত্বে তিনি এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন।

১৯৩৯-এ অভিনীত হল ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুর্গাশ্রীহরি’ (১৮ মার্চ), মহেন্দ্র গুপ্তের ‘সোনার বাংলা’ (২৭ মে), ভোলানাথ কাব্যশাস্ত্রীর ‘জাহ্নবী’ (২ সেপ্টেম্বর), সুধীন্দ্রনাথ রাহার ‘জননী জন্মভূমি’ (২৪ নভেম্বর)।

১৯৪০-এ মহেন্দ্র গুপ্তের তিনটি নাটক—‘সতী তুলসী’ (১৬ মার্চ)। ‘উত্তরা’ (১৮ মে), ‘পাঞ্জাব কেশরী রণজিৎ সিংহ’ অভিনীত হল। পরে সুধীন্দ্রনাথ রাহার ‘রণদাপ্রসাদ’ (২৮ সেপ্টেম্বর)। এই পর্যন্ত কালীপ্রসাদ ঘোষ স্টারের নাটকগুলি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। যদিও মহেন্দ্র গুপ্তই মূল দায়িত্ব পালন করতেন। অক্টোবর ১৯৪০ থেকে মহেন্দ্র গুপ্ত পুরোপুরি নাট্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। নামালেন ‘গঙ্গাবতরণ’ (২৬ অক্টোবর) এবং ‘ঊষাহরণ’—দুটিই তার লিখিত ও পরিচালিত।

১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে মহেন্দ্র গুপ্তের ‘কমলেকামিনী’ (৪ এপ্রিল) ভোলানাথ কাব্যশাস্ত্রীর ‘বৃত্রসংহার’ (১০ জুলাই), অমল চট্টোপাধ্যায়ের ‘মদনমোহন’ (১৮ সেপ্টেম্বর) প্রভৃতি অকিঞ্চিৎকর সব নাটক মঞ্চস্থ হলো।

১৯৪২-এ অভিনীত হল মহেন্দ্র গুপ্তের ‘রাণী ভবানী’ (২৪ জানুয়ারি) ও ‘অলকানন্দা’ (১৮ এপ্রিল)। অশ্বিনীকুমার ঘোষের ‘পুরীর মন্দির’ (১৮ জুলাই) এবং মহেন্দ্র গুপ্তের ‘মহালক্ষ্মী’ (৯ অক্টোবর)।

১৯৪৩-এ মহেন্দ্র গুপ্তের ‘রাণী দুর্গাবতী’ (৯ জানুয়ারি), ‘মহারাজা নন্দকুমার’ (৪ জুন) সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হলো। এগুলি ছাড়া বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্তের ‘কৃষ্ণার্জুন’ (১১ ফেব্রুয়ারি), রবিপাত্রের ‘সুকন্যা’ (২২ এপ্রিল), বঙ্কিমের দেবীচৌধুরাণীর নাট্যরূপ (মহেন্দ্র গুপ্ত, ২৯ সেপ্টেম্বর), দুর্গেশনন্দিনীর নাট্যরূপ (মন্দ্রে গুপ্ত, ২২ ডিসেম্বর) অভিনীত হলো।

নাট্যরূপ নাট্যনিকেতনে (১২ জুলাই, ১৯৪১) অভিনীত হয়েছিল। কিন্তু সে নাটক বেশিদিন চলেনি। মহেন্দ্র গুপ্তের নাট্যরূপটি স্টার থিয়েটারে বহুরাত্রি অভিনীত হয়ে খ্যাতিলাভ করেছিল। এছাড়া অন্য অভিনয়ের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ রাহার ‘গোলকোণ্ডা’ (২৩ ডিসেম্বর) পুরনাে নাটক হিসেবে অভিনীত হয়েছিল। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে সুধীন্দ্রনাথ রাহার ‘দিল্লী চলো’ (২৪ ফেব্রুয়ারি) মহেন্দ্র গুপ্তের ‘বিজয়নগর’ (২৩ জুলাই) ও ‘সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত’ (২৩ ডিসেম্বর) অভিনীত হয়েছিল। এই বছরে রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসের নাট্যরূপ (মহেন্দ্র গুপ্ত) ৭ মে মঞ্চস্থ হয়। রবীন্দ্রনাথের এই একটি নাটক বা নাট্যরূপ এই পর্বে স্টারে অভিনীত হয়েছিল।

১৯৫০-এ মহেন্দ্র গুপ্তেরই দুটি নাটক ‘ঊর্বশী’ (৯ ফেব্রুয়ারি) এবং ‘পৃথ্বীরাজ’ (২০ ডিসেম্বর) অভিনীত হয়।

১৯৫১-তে ‘মেঘমালা’ (সুরেশচন্দ্র চৌধুরী, ২ মে), ‘শকুন্তলা’ (মহেন্দ্র গুপ্ত, ১২ জুলাই) অভিনীত হওয়ার পর তারাশঙ্করের নাটক ‘বালাজীরাও’ (৬ অক্টোবর) মহেন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনা ও পরিচালনায় অভিনীত হলো।

১৯৫২ খিষ্টাব্দের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা হলো রমেশচন্দ্র দত্তের ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা’ অবলম্বনে মহেন্দ্র গুপ্তের নাট্যরূপ ‘সূর্যমহল’, ১৯ মে অভিনীত হলো।

১৯৫৩-এর অভিনয়ের তালিকায় রয়েছে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘কলঙ্কবতী’ (৬ মার্চ), মহেন্দ্র গুপ্তের ‘রাজনৰ্তকী’ (২৩ মে)। নীহাররঞ্জন গুপ্তের কাহিনী অবলম্বনে ‘পদ্মিনী’ (নাট্যরূপ—মহেন্দ্র গুপ্ত) ২ এপ্রিল অভিনয় করা হলো।

১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দেই মহেন্দ্র গুপ্তের যুগ শেষ হল। এই বছরের শেষের দিকে দেখা গেল, স্টারের পরপর বেশ কয়েকটি নাটকে তেমন দর্শক হচ্ছে না, কর্তৃপক্ষের লোকসান হচ্ছে। মনে করা হলো, মহেন্দ্র গুপ্ত আর আগের মতো মনঃসংযোগ বা নিষ্ঠা সহকারে থিয়েটারের কার্যাবলী পালন করতে পারছেন না। তাই থিয়েটারের মালিক সলিলকুমার মিত্র মহেন্দ্র গুপ্তকে ছেড়ে দিয়ে নিজের হাতেই সব দায়িত্ব তুলে নিলেন। মহেন্দ্র গুপ্ত বিদায় নিলেন।

এই পর্বে রবীন্দ্রনাথ ও তারাশঙ্করের উপন্যাসের নাট্যরূপ বা নাটক কিংবা বঙ্কিমের একাধিক উপন্যাসের নাট্যরূপ ছাড়া বাদবাকি প্রায় সব নাটকই মহেন্দ্র গুপ্তের। বাকি কিছু অন্য নাট্যকারের। এই পর্বের বড়ো ঘটনা ভারতের স্বাধীনতা লাভ। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা দ্বি-খণ্ডিত হওয়ার অভিশাপ পশ্চিমবঙ্গকে ভোগ করতে হয়েছে। পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩), দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫), সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (১৯৪৬), এবং এর পরেই দেশভাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা—পশ্চিমবঙ্গের বিপর্যয়কে বাড়িয়ে তুলেছে। দলে দলে উদ্বাস্তুর ভিড়ে কলকাতা জনাকীর্ণ—পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি বিপর্যস্ত।

এইসব প্রাণান্তকর দেশীয় পরিস্থিতিতে আমোদ-প্রমোদের রঙ্গালয়গুলি হয়ে পড়ল প্রাণহীন। সাধারণ রঙ্গালয়গুলি কোনওরকমে অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে, মালিকেরাও দর্শকাভাবে দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। তবুও রঙ্গালয়গুলি অভিনয়ধারা চালিয়ে যাচ্ছিল। নাট্যকার পরিচালক দেবনারায়ণ গুপ্তের মন্তব্য—‘‘স্বাধীনতা লাভের পর যে দুর্যোগের ঝড় সাধারণ রঙ্গালয়গুলির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে—আমি তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। সন্ধ্যায় প্রতিটি রঙ্গালয়ে আলাে জ্বলত বটে, কিন্তু দর্শক সংখ্যা ছিল অত্যন্ত সীমিত এবং রঙ্গালয়গুলির অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও দৃশ্যপটগুলির ছিল জরাজীর্ণ অবস্থা। সুলিখিত নাটক মঞ্চস্থ করেও এইসময়ে দর্শকদের মন জয় করা যায়নি।’’

এই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করছেন বুদ্ধদেব বসু—‘‘যত চেষ্টাই করা যাক থিয়েটারকে আর বাঁচানো যাবে না, সে মরতে বসেছে। কোনও থিয়েটারের মধ্যে ঢুকলে তার ধূলিমলিন জীর্ণ আসবাব, পানের পিকমাখা মেঝে ও দেওয়াল, রঙ্গমঞ্চে লক্ষপতির ড্রইংরুমে দুখানা ভাঙা চেয়ারপ্রতিটি ছোট ছোট জিনিস হা হা করে বলে—নেই, নেই, কিছু আর নেই। রঙ্গালয়ের এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল, আমাদের থিয়েটারের প্রাণবন্ত কিছু আর নেই, যারা থিয়েটার চালান তারা নিজেরাই নিরুৎসাহ।’’

তাছাড়া এই সময়ে (১৯৩১ থেকে) নবনির্মিত চলচ্চিত্রে কথা বলা শুরু হয়েছে। এতদিন থিয়েটারে ‘বায়োস্কোপ’ দেখানো হতো। তাতে থাকত শুধু চলমান চিত্র, কথা ছিল না। এই নতুন কথাবলা চলচ্চিত্র এদেশেও তৈরি হয়ে সিনেমা হলে দেখানো শুরু হয়েছে। এই চলচ্চিত্র থিয়েটারকে ক্রমশই কোণঠাসা করে দিয়েছিল, প্রথমদিকে।

অন্যদিকে নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী প্রায়শই আসছিল ফিল্ম থেকে, থিয়েটার থেকে চলে যাচ্ছিল ফিল্মে। কেউ দু চারদিন স্টেজে দেখা দিয়েই তারকা হওয়ার মতলবে চলচ্চিত্র জগতে ছুটেছেন। বুদ্ধদেব বসু এদের ‘তারকা’ না বলে ‘তাড়কা’ বলেছেন। কারণ, ‘ফিল্ম আজ রাক্ষসীর মতো সমস্ত বাংলাদেশকে গিলে খাচ্ছে।

টাকাওয়ালারা থিয়েটারে টাকা না ঢেলে নতুন এই প্রমোদ মাধ্যম চলচ্চিত্রে অর্থ লগ্নী করতে লেগেছে। সব দিক দিয়েই তখন বাংলা থিয়েটারের নাভিশ্বাস। মহেন্দ্র গুপ্ত সাধারণ রঙ্গালয়ের এই অভিশপ্ত বিপর্যস্ত অবস্থানেই স্টার থিয়েটারে নিয়মিত নাটক রচনা, নাট্য পরিচালনা এবং নিজে অভিনয়ে অংশ গ্রহণ করে থিয়েটারকে প্রাণবন্ত করে রেখেছিলেন।

এই পরিস্থিতি স্মরণে রাখলে, এই সময়কার স্টার থিয়েটারের এবং মহেন্দ্র গুপ্তের কৃতিত্বকে কোনো অংশেই খাটো করে দেখা যায় না। তবে একথা ঠিক যে, মন্বন্তর ও যুদ্ধের পটভূমিকায় বাঙালির জনমানসের কোনও প্রতিক্রিয়ার নাট্যরূপ মহেন্দ্র গুপ্ত দেখাতে পারেননি। কিংবা স্বাধীনতা এবং দেশভাগের প্রতিক্রিয়ার কোনও ছবি তিনি আঁকতে পারেননি। তাছাড়া শিশিরকুমার ভাদুড়ি তার আগেই বাংলা রঙ্গালয়ে যে নতুন নাট্যাভিনয়ের পরীক্ষানিরীক্ষা করে চলেছিলেন, মহেন্দ্র গুপ্ত তার যথাযোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠতে পারেননি। নাট্যভাকায় ও মঞ্চায়নে তিনি শিশির পূর্ববর্তী ধারারই অনুবর্তন করে গেছেন।

আর একটি কথা। ১৯৪৩ থেকে মহামন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে এ দেশে গণনাট্য সঙঘ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তাদের নাট্য আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা নাটকের বিষয়বস্তু, উপস্থাপনা এবং গণমানসে উদ্দীপনা সৃষ্টির যে নবতম প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল তার কোনও প্রভাবই স্টার থিয়েটারে সমকালে পড়েনি। মন্বন্তরের বুকে বসে যখন গণনাট্য সঙঘ বিজন ভট্টাচার্যের ‘জবানবন্দী’, ‘নবান্ন’ অভিনয় করে বাংলা নাটক ও তার প্রয়োগ দিয়ে সকালের সমাজদ্বন্দ্বের প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে চলেছে, স্টার থিয়েটার তখনো সেই ঐতিহাসিক রোমান্সের উদ্দীপনায় দেশপ্রেমের ভাবাবেগের তারল্য উদ্‌গীরণ করে চলেছে। মহেন্দ্র গুপ্তের ও তাঁর সময়কার স্টার থিয়েটারের এই সঙ্কীর্ণ সীমাবদ্ধতাও অবশ্যস্বীকার্য। একথা ঠিক, সেই সময়কার কোনও সাধারণ রঙ্গালয়ই সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেনি।

ষষ্ঠ পর্ব (১৯৫৩-১৯৭১)

১৯৫৩-তে মহেন্দ্র গুপ্ত স্টার ছেড়ে দিলেন। অক্টোবর মাসে পরিচালক ও নাট্যকার হিসেবে যোগ দিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। এবারে সব দায়িত্ব নিলেন সলিলকুমার মিত্র। নতুন মালিকানায় নতুন করে রঙ্গালয় সাজানো হল। মঞ্চেরও আমূল সংস্কার করা হলো। সাজসজ্জা অলঙ্করণ নতুনভাবে করা হলো। সামনের মন্দিরের চূড়ার মতো অংশটি অক্ষুণ্ন রেখে নাট্যশালার বাকি অংশ পুনর্নির্মাণ করা হল। ১৯৫৬-তে ‘পরিণীতা’ অভিনয়ের সময়ে সমগ্র রঙ্গালয় হল শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। সেই প্রথম কলকাতার কোনো পেশাদার রঙ্গালয় ‘এয়ারকন্ডিশনড’ করা হয়। তখন থেকে স্টার বাংলার শ্রেষ্ঠ নাট্যশালারূপে পরিগণিত হলো।

১৯৫৩-এর ১৫ অক্টোবর প্রযোজিত হল ‘শ্যামলী’। নিরুপমা দেবীর ঐ নামের উপন্যাসের নাট্যরূপ দিলেন দেবনারায়ণ। নির্দেশনায় রইলেন শিশির মল্লিক ও যামিনী মিত্র। সহকারী পরিচালনায় রইলেন দেবনারায়ণ। নাট্যকারও তিনি। শিল্প নির্দেশক ও আলোক-সম্পাতে সতু সেন।

‘শ্যামলী’ নাটকের অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলা পেশাদারি রঙ্গালয়ে যুগান্তর ঘটে গেল। একাধিক্রমে ২৬ মাস ধরে ৪৮৪ রাত্রি অভিনীত হয়ে সর্বকালীন অভিনয়ের এবং জনপ্রিয়তার রেকর্ড সৃষ্টি করল। প্রথম পর্যায়ে শেষ-অভিনয় ১৩ নভেম্বর, ১৯৫৫। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বাংলা ব্যবসায়িক ও পেশাদার মঞ্চে যে একঘেয়েমি এবং রক্তাল্পতা দেখা দিয়েছিল, ‘শ্যামলী’ সেখানে নতুন প্রাণাবেগ এনেছিল। পেশাদার থিয়েটার নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে উঠলো। তদানীন্তন বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তম সুদর্শন অভিনেতা উত্তমকুমার এবং খ্যাতিময়ী অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে মূল ভূমিকায় অভিনয় করানো হলো। উত্তমকুমারের জন-আকর্ষণের ক্ষমতা এবং শ্যামলী চরিত্রে সাবিত্রীর অভিনয়কুশলতা বাংলা পেশাদার মঞ্চে নতুন প্রাণ সঞ্চার করলো। একটি বোবা মেয়ের আশা আকাঙ্ক্ষা কামনার মধ্যে দিয়ে ‘সেন্টিমেন্ট’-এর উত্তঙ্গ স্তরে নাট্যবিষয় ও ভাবনাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ভাবাবেগ আপ্লুত দর্শক ‘শ্যামলী’কে সাদরে গ্রহণ করেছিল সেদিন। উত্তম-সাবিত্রীর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন সরযূবালা দেবী, জহর গাঙ্গুলি, অনুপকুমার প্রভৃতি সেকালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা অভিনেত্রীরা। তাছাড়া ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি রায়, শ্যাম লাহা, সন্তোষ সিংহ, মিহির ভট্টাচার্য, অপর্ণা দেবী, শেফালী দত্ত প্রমুখ শিল্পীরা তো ছিলেনই।

‘শ্যামলী’র জনপ্রিয়তায় উৎসাহিত স্টার থিয়েটার তাদের সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন নাটক অভিনয়ের প্রথা তুলে দিলেন। এর আগে সাধারণ রঙ্গালয়ে সপ্তাহে বুধ ও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এবং শনি ও রবিবারে ম্যাটিনী ও সন্ধ্যায় অভিনীত হতো। শনি ও রবিবারে মূল নাটক অভিনয় করা হতো এবং মধ্য-সাপ্তাহিকে অন্য নাটক অভিনয়ের প্রথা চলে আসছিল। ‘শ্যামলী’ নাটকের জনপ্রিয়তা দেখে এই নিয়ম পালটে স্টার থিয়েটারে বৃহস্পতি, শনি ও রবিবারে একই নাটকের অভিনয় চলতে থাকে। পরবর্তীকালে সব সাধারণ রঙ্গালয়ই এই প্রথা মেনে তাদের অভিনয় চালিয়ে যেতে থাকে।

স্টারের তখন মূল নাট্যকার দেবনারায়ণ গুপ্ত। তিনি শ্যামলীর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে পরপর জনপ্রিয় উপন্যাসগুলির নাট্যরূপ দিলেন এবং সেগুলির অভিনয়ে স্টার থিয়েটার দিনে দিনে খ্যাতির শিখরে উঠে গেল।

অভিনীত হলো ‘পরিণীতা’ (১৫.১২.৫৫)। শরৎচন্দ্রের ওই নামের উপন্যাসের নাট্যরূপ (দেবনারায়ণ গুপ্ত)। ‘পরিণীতা’র পরিচালনায় রইলেন শিশির মল্লিক। এই নাটকের অভিনয়ে আর উত্তমকুমার ছিল না, তিনি ‘শ্যামলী’ অভিনয় চলাকালীনই স্টার ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেখানে এলেন চলচ্চিত্রের আর এক খ্যাতিমান অভিনেতা অসিতবরণ। সঙ্গে গায়ক তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

‘পরিণীতা’ টানা ১৩৫ রাত্রি চলাব পর (১৫.৭.৫৬) প্রায় সাড়ে ছয়মাস থিয়েটার বন্ধ রেখে সলিলকুমার মিত্র থিয়েটার বাড়ির সংস্কারে হাত দিলেন। ভাস্কর সুধাংশু চৌধুরীর পরিকল্পনায় ভেতরের সব সাজানো হলো। এবারে চালু করা হলো শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। স্টার থিয়েটার বাঙালির গৌরবের বস্তুতে পরিণত হলো।

১৯৫৭-এর ৭ জানুয়ারি আবার স্টার চালু হলো নব সাজে সেজে। নামানো হলো ‘শ্রীকান্ত’। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব অবলম্বনে নাট্যরূপ দিলেন দেবনারায়ণ এবং পরিচালনায় শিশির মল্লিক। নাটকের জন্য গান লিখলেন শৈলেন রায় তাতে সুর দিলেন দুর্গা সেন। মঞ্চ পরিকল্পনায় মণীন্দ্র দাস।

নিয়মিত শিল্পী ছাড়াও নতুন আনা হয়েছে সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক নির্মলকুমারকে, সঙ্গে শিপ্রা মিত্র এবং সুখেন দাস। একটানা তিনশ’ রাতের বেশি চলে বন্ধ হলো ২ মে, ১৯৫৮। অভিনয়ে ছিলেন: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়—অভয়া, জহর গঙ্গোপাধ্যায়—অভয়ার স্বামী, নির্মলকুমার—শ্রীকান্ত, শিপ্রা মিত্র—রাজলক্ষ্মী, সুখেন দাস—ইন্দ্রনাথ। অনুপকুমার—নতুনদা। খ্যাতিমান শিল্পীদের অভিনয়ের গুণে, শরশ্চন্দ্রের কাহিনীর আকর্ষণে, দেবনারায়ণের নাট্যরূপের কৃতিত্ব এবং দৃশ্যসজ্জা, দৃশ্য-পরিবর্তন ও আলোক সম্পাতের নৈপুণ্যে ‘শ্রীকান্ত’ জনপ্রিয় হয়ে গেল।

‘শ্রীকান্তে’র সাফল্যে নামানো হলো ঐ শ্রীকান্ত উপন্যাস থেকেই ‘রাজলক্ষ্মী’ (২.৬.৫৮)। শ্রীকান্ত উপন্যাসের ৩ ও ৪ পর্ব অবলম্বনে এই অংশেরও নাট্যরূপ দিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। পরিচালনা—শিশির মল্লিক, মঞ্চ ও আলো—মণীন্দ্র দাস, গীতরচনা—শৈলেন রায়, সুরকার হিসেবে যোগ দিলেন জনপ্রিয় গায়ক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। স্টারের নিয়মিত শিল্পীরাই অভিনয় করলেন। চললো টানা ১৩৪ রাত্রি, ২১ ডিসেম্বর, ১৯৫৮ পর্যন্ত।

এবারে নতুন নাটকের প্রস্তুতির জন্য দেরি না করে আগের ‘শ্যামলী’ দ্বিতীয় পর্যায়ে নামানো হলো (২৫.১২.৫৮) এবং ৩৮ রাত্রি অভিনয়ের শেষে (১৫.২.৫৯) বন্ধ করে দিয়ে নতুন নাটক অভিনয় শুরু হলো।

মনোজ বসুর ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’ উপন্যাসের নাট্যরূপ (দেবনারায়ণ) ‘ডাকবাংলো’ নাটক। অভিনীত হলো ১২ মার্চ, ১৯৫৯। নাট্যকারের দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে দেবনারায়ণ স্টারের নাট্য পরিচালকও হলেন। ডাকবাংলো দিয়ে শুরু। মঞ্চসজ্জা ও আলো—অনিল বসু। নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে যোগ দিলেন মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে প্রখ্যাত বর্ষীয়ান নাট ছবি বিশ্বাস এবং খ্যাতিমান নায়িকা সন্ধ্যা রায়। আগের শিল্পীরাও বইলেন। অনেকদিন বাদে আবার পেশাদারি মঞ্চে এসে ছবি বিশ্বাস বীরেশ্বর’-এর ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করলেন। দুশো রাতের বেশি চললো ‘ডাকবাংলো’।

১৯৬০-এর মার্চ নতুন নাটক ‘পরমারাধ্য শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ’ দেবনারায়ণের মৌলিক রচনা। বাংলা মঞ্চে শ্রীরামকৃষ্ণ বরাবরই আদৃত হন। তাঁর জীবনী নাটক কিন্তু বেশিদিন চললো না। দেবনারায়ণের কুশলী পরিচালনায় এবং শিল্পীদের অভিনয়ের গুণেও (গিরিশ চরিত্রে ছবি বিশ্বাস) মোটে ৭৬ রাত্রি অভিনীত হয়ে বন্ধ হলো। নতুন নাটক তখনো তৈরি হয়নি বলে আবার ডাকবাংলো নামিয়ে দেওয়া হলো (২১.৭.৬০)। ১১ রাত্রি চলার পর নতুন নাটক ‘শ্রেয়সী’র অভিনয় শুরু হলো।

১৯৬০-এর ১১ আগস্ট ‘শ্রেয়সী’র প্রথম অভিনয়। সুবোধ ঘোষের ওই নামে উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে পরিচালনা করলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। নায়ক হলেন চলচ্চিত্রের অভিনেতা বসন্ত চৌধুরী। লিলি চক্রবর্তীও এই প্রথম পেশাদার মঞ্চে অভিনয় করতে এলেন। সঙ্গে রইলেন কমল মিত্র, ছবি বিশ্বাস প্রমুখ দিকপাল অভিনেতৃবৃন্দ। শ্রেয়সী জন সমাদর লাভ করলো। চললো টানা ১৯৬২-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, ৩৭৩ রাত্রি।

এরপরেই মঞ্চস্থ হলো ‘শেষাগ্নি’ (৮ মার্চ, ১৯৬২)। উপন্যাস শক্তিপদ রাজগুরুর। নাট্যরূপ ও পরিচালনা দেবনারায়ণ গুপ্ত। এই নাটকটি চলেছিল ২২০ রাত্রি, দু’দফায়। শেষ অভিনয় হয় ১৯৬৩-এর ৩ ফেব্রুয়ারি।

মাঝে চীন-ভারত সংঘর্ষ শুরু হলে মন্মথ রায়ের এই উপলক্ষে লেখা দেশাত্মবোধেক নাটক ‘স্বর্ণকীট’, সঙ্গে তারই লেখা ‘কারাগার’ স্টার থিয়েটার কয়েক রাত্রি অভিনয় করেছিল।

‘তাপসী’ নাটকের প্রথম অভিনয় হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৩। নীহাররঞ্জন গুপ্তের ওই নামের উপন্যাস থেকে নাট্যরূপ দিলেন দেবনারায়ণ। তারই পরিচালনা। সঙ্গীত পরিচালনা—অনাদি দস্তিদার। চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এই প্রথম পেশাদার মঞ্চে এলেন; অভিনয় করলেন নায়ক দীপকের চরিত্রে। মঞ্চে তাঁর নতুনমাত্রার অভিনয় দর্শক ও সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করলো। এর আগে তিনি শিশির কুমারের দলে নাট্যাভিনয়ের শিক্ষা নিয়েছিলেন। এই নাটকে তিনখানি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার হয় এবং আবহে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর ব্যবহৃত হয়। ‘তাপসী’ একটানা ১৯৬৫-এর ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৬৭ রাত্রি চলেছিল। সৌমিত্র ছাড়া এই নাটকে প্রথম অভিনয় করলেন চিত্রজগতের অভিনেত্রী মঞ্জু দে। অন্যেরা হলেন—বাসবী নন্দী, অপর্ণা দেবী, গীতা দে, জ্যোৎস্না বিশ্বাস, নবকুমার, সুখেন দাস, প্রেমাংশু বসু প্রমুখ।

বিমল মিত্রের ‘একক দশক শতক’ উপন্যাস সেই সময় বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। স্টার এবার এই উপন্যাসটির নাট্যরূপ (দেবনারায়ণ) ওই একই নামে অভিনয় করলো। প্রথম অভিনয় ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫। পরিচালনা—দেবনারায়ণ। সঙ্গীত—অনাদি দস্তিদার। মঞ্চ ও আলো—অনিল বসু। গীতরচনা—পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। নৃত্য—নীলিমা দাস। নাটকটি চলেছিল ২৬৪ রাত্রি। শেষ অভিনয় ১৭ এপ্রিল, ১৯৬৬।

‘দাবী’ অভিনীত হলো ২৮ এপ্রিল, ১৯৬৬। এটি দেবনারায়ণ গুপ্তের মৌলিক নাটক। পরিচালনাও তাঁরই। স্বল্পবিত্ত বাঙালি ঘরের স্বাভাবিক চিত্র তিনি এই নাটকে পরিচ্ছন্ন ও পরিমিতি দিয়ে রচনা করেছেন। একেবারে চেনা বাঙালি ঘরের এই নাটক দর্শকেরা সাদরে গ্রহণ করলো। সঙ্গীতে কালীপদ সেন, গীত রচনায় পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্চ ও আলো অনিল বসু। চলচ্চিত্রের অভিনেতা সতীন্দ্র ভট্টাচার্য প্রথম পেশাদার মঞ্চে অভিনয়ে এলেন। সঙ্গে অভিনেত্রী সুব্রতা সেন (পরে চট্টোপাধ্যায়)। স্টারের অন্যান্য শিল্পী ও কলাকুশলীরা তো রইলেনই। দাবী জনপ্রিয়তায় এতো দিনকার সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে একটানা ৫৮০ রাত্রি চললো। শেষ হলো ১৩ অক্টোবর, ১৯৬৮। এরপরে ‘শর্মিলা’। দেবনারায়ণের রচনা। পরিচালনাও তাঁরই। অভিনীত হলো ১৯৬৮-এর ২৪ অক্টোবর। অভিনেতা হিসেবে এলেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। চলল ৫৫১ রাত্রি। শেষ অভিনয় ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১।

দেবনারায়ণ গুপ্তের রচনা ও পরিচালনায় এবার মঞ্চস্থ হলে ‘সীমা’। নাটকটি চলেছিল ২০৩ রাত্রি। অভিনয়ে ছিলেন স্টারের নিয়মিত শিল্পীবৃন্দ। বন্ধ হয় ২ জানুয়ারি, ১৯৭২। ‘সীমা’ নাটকটি চলার সময়েই স্টার থিয়েটারের স্বত্ব বদল হয়ে গেল। সলিলকুমার মিত্র ১৯৩৮ থেকে একনাগাড়ে দক্ষতার সঙ্গে স্টার থিয়েটারের স্বত্বাধিকারী হিসেবে থিয়েটারটি চালিয়ে আসছিলেন। ১৯৭১-এর ৩১ মার্চ তিনি রয়্যালটির সঙ্গে তার দীর্ঘকালের সম্পর্ক ছেড়ে দিলেন। ১৯৩৮-এর ২৯ মার্চ থেকে ১৯৭১-এর ৩০ মার্চ পর্যন্ত সলিলকুমার স্টার থিয়েটারে ছিলেন।

স্টার থিয়েটারের জমির মালিক কলকাতার প্রাক্তন মেয়র গোবিন্দচন্দ্র দের বৌদি রেণুবালা দে (অমিয়কুমার দে’র স্ত্রী)। তার কাছ থেকে রঞ্জিত পিকচার্সের মালিক রঞ্জিতমল কাষ্কারিয়া স্টার থিয়েটারের সম্পত্তি ও নামটুকু কিনে নিলেন ৩১ মার্চ, ১৯৭১। সলিলকুমার মিত্রের বিদায়ের পর স্টারের স্বত্বাধিকারী হলেন রঞ্জিতমল (১ এপ্রিল, ১৯৭১)। রঞ্জিত পিকচার্সের তরফে রঞ্জিতমল স্টারের পূর্ণ দেখাশোনার দায়িত্ব নিলেন। দেবনারায়ণ গুপ্ত নাট্যকার ও পরিচালক হিসেবে রইলেন। চালু নাটক ‘সীমা’ যেমন চলছিল তেমনই চলতে লাগলো। ১৯৭২-এর ২ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘সীমা’ নাটকটি চলার পরে (২০৩ রাত্রি) বন্ধ হয়ে যায়।

‘সীমা’ নাটক চলার মাঝেই ঘটে যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এই নিয়ে সারাদেশ উত্তাল। এই বিষয় নিয়ে দেবনারায়ণ গুপ্ত লিখলেন ‘জয় বাংলা’। প্রথম অভিনীত হলো ৮ মে, ১৯৭১। সীমার অভিনয় বন্ধ রেখে। ‘জয় বাংলা’ বেশ কয়েকরাত্রি অভিনয়ের পর আবার ‘সীমা’ চালু হয়।

রঞ্জিতমলের পুরোপুরি মালিকানায় এবার মঞ্চস্থ হলো ‘মঞ্চরী’। আশাপূর্ণা দেবীর ওই নামের উপন্যাসের নাট্যরূপ দিলেন দেবনারায়ণ। তাঁরই পরিচালনা। নিয়মিত শিল্পীরা ছিলেন। নতুন এলেন সবিতাব্রত দত্ত। চলল ২৬৭ রাত্রি। (১৮.২.৭৩ পর্যন্ত)।

১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর কলকাতায় ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাধারণ রঙ্গালয়ের শুভ সূচনা হয়েছিল। তারই শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে স্টার থিয়েটার মঞ্চস্থ করল ‘বিদ্রোহী নায়ক’ (১৮.৩.১৯৭৩)। একশো বছর আগেকার গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের নাট্যকার ও পরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাসের জীবনী নিয়ে এই নাটক লিখলেন দেবনারায়ণ। সেই উপেন্দ্রনাথ, যার সুরেন্দ্র-বিনোদিনী, শরৎ-সরোজিনী, গজদানন্দ ও যুবরাজ এক সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী নাটক বলে হৈচৈ ফেলে দেয় এবং ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৬-এর কুখ্যাত অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন জারি করে। তার জেল হয়, পরে ছাড়া পান। স্টারে বিদ্রোহী নায়ক চলেছিল ১০৪ রাত্রি, বন্ধ হয় ১৯৭৩-এর ৩০ আগস্ট।

তারপরেই শচীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জনপদবধ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ ওই একই নামে অভিনীত হলো, ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩। পরিচালনা—দেবনারায়ণ। সঙ্গীত—তিমিরবরণ। নাটকটি ১৭৭ রাতের বেশি চলেনি। শেষ অভিনয়: ২৮ এপ্রিল, ১৯৭৪।

১৯৭৩-এর ২৫ ডিসেম্বর মন্মথ রায়ের একাঙ্কিকা বলে প্রচারিত ‘মুক্তির ডাক’ অভিনীত হলো, নাটকটির পঞ্চাশ বৎসর পূর্তি উপলক্ষে। এইখানে এসেই স্টার থিয়েটারের একটি গৌরবময় পর্বের সমাপ্তি ঘটলো। ১৯৭৪-এর প্রথম দিকেই দেবনারায়ণ গুপ্তের সঙ্গে স্টার থিয়েটারের সম্পর্ক শেষ হলো। পুরাতন শিল্পী ও কলাকুশলী গোষ্ঠীকেও বিদায় দেওয়া হলো।

দেবনারায়ণ গুপ্ত স্টারে থাকাকালীন ছোটবড় মিলিয়ে নাট্যরূপ এবং মৌলিক মোট কুড়িটা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। তার সবগুলিই জনসমাদর লাভ করেছিল। নাট্য সমালোচকদেরও প্রশংসা কুড়িয়ে ছিল। ঝকমকে রঙ্গমঞ্চ, সুদৃশ্য ঘূর্ণায়মান মঞ্চ, আলোর বাহার, নামকরা সব শিল্পী, আবেগ সর্বস্ব পারিবারিক কাহিনী, প্রেম-ভালোবাসার মধুর ও বিরহের অনুভব এবং পরিচালনার নিষ্ঠা—স্টার থিয়েটারের এই পর্বের নাট্যগুলিকে জনসমাদরে ভরিয়ে দিল। প্রতিটি নাটকই বহুরাত্রি অভিনীত হয়েছিল। প্রচলিত জনপ্রিয় উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে দেবনারায়ণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। পরে মৌলিক কয়েকটি নাটকও লেখেন। সাদামাটা পারিবারিক কাহিনী বাঙালি জীবনের আবেগ-অনুভূতির ওপর নির্ভর করে এইসব নাটক সেদিন দর্শক আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিল।

এদিকে স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের মধ্যে যে টালমাটাল অবস্থা, তার কোনও প্রভাব কিন্তু এইসব নাটকে ছিল না। চীন-ভারত যুদ্ধ, খাদ্য আন্দোলন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ, কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়ে যাওয়া, নকশাল আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পশ্চিম বাংলায় সন্ত্রাস এবং সত্তরের আগে পরে রাজনৈতিক বিভীষিকার অন্ধকারময় দিনরাত্রি—এগুলির, এই যুগসঙ্কটের কোনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রতিচ্ছবি এই সময়কার নাটকে দেখা যায় না। ‘জয়বাংলা’ বা ‘স্বর্ণকীট’ নামিয়ে তারা দায় সেরেছিল, যুগভাবনার দ্বন্দ্বময় উপস্থাপনা থেকে বহু দুরে স্টারের নাট্যাভিনয়গুলি অবস্থান করছিল।

তবে পরিচ্ছন্ন, সুন্দর ও সুস্থ সংস্কৃতির নাট্যাভিনয় করে স্টার বাঙালি দর্শকের সাধুবাদ কুড়িয়েছিল। সেই সময়ে পাশাপাশি অনেক পেশাদার থিয়েটার নগ্ন নাচ-গান এবং ক্যাবারে নৃত্য ইত্যাদি আমদানি করে বাংলা মঞ্চকে কলুষিত করেছিল। স্টার থিয়েটার কখনোই সে প্রলোভনের হাতছানিতে ভোলেনি। থিয়েটারের ইতিহাসে এটাও উল্লেখযোগ্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী মরা রঙ্গালয়ে প্রাণের বান ডাকিয়েছিল স্টার। এবং তাতেই উজ্জীবিত হয়ে আবার অন্য সাধারণ রঙ্গালয়গুলিও নতুন করে ফিরে দাঁড়িয়ে নাট্যাভিনয়ের ধারাবাহিক ইতিহাস তৈরি করেছিল।

সপ্তম পর্ব (১৯৭১-১৯৯১)

১৯৭১-এর ১ এপ্রিল থেকে রঞ্জিতমল কঙ্কারিয়া স্টার থিয়েটারের স্বত্বাধিকারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন পর্ব শুরু হয়েছে বলে ধরা যায়। তবে রঞ্জিতমল দায়িত্ব নিয়ে আগের ধারার কোনওরকম পরিবর্তন প্রথমেই করেননি। পুরনো নিয়মেই সব চলেছে। নাট্যকার-পরিচালক দেবনারায়ণ গুপ্ত, কলাকুশলী শিল্পী সব আগের। এবং আগের মতোই দেবনারায়ণ নাটক ও নাট্যরূপের অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

১৯৭৪-এ স্টারের সঙ্গে দেবনারায়ণের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। তখন থেকেই পুরোপুরিভাবে স্টারের আর এক পর্ব শুরু হলো। রঞ্জিতমল নিজেই সব দায়িত্ব নিয়ে ভাড়া করা লোকজন দিয়ে থিয়েটারের কাজ চালাতে লাগলেন। এক একজন নাট্যকার, আবার নতুন পরিচালক, শিল্পীদলের পরিবর্তন—এইভাবে বেশ কয়েকটি নাটক রঞ্জিতমলের কর্তৃত্বাধীনে স্টার থিয়েটারে অভিনীত হলো। বলা যায়, তখন থেকেই স্টারের গৌরবময় অধ্যায়ের অবসান হলো।

সত্তরের দশকের রাজনৈতিক ডামাডোল, পটপরিবর্তন এবং আতঙ্ক ও সন্ত্রাস জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। সব রঙ্গালয়ের অভিনয়ই তখন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। স্টার থিয়েটারও তা থেকে রেহাই পায়নি। তবে জীবন সমস্যার কোনো গভীর ব্যাপক নাট্যরূপায়ণ স্টার করতে পারেনি। বরং দেবনারায়ণের সাদামাটা সামাজিক ও পারিবারিক কাহিনীর নাটকই স্টারে অভিনীত হতে থাকলো।

১৯৭৪এর ৩১ মে অভিনীত হলো ‘পরিচয়’। কুণাল মুখোপাধ্যায়ের নাটক। পরিচালনায় বঙ্কিম ঘোষ। নায়িকা হলেন চলচ্চিত্রের শমিতা বিশ্বাস। এই নাটকই চলল ৩০৭ রাত্রি, বন্ধ হয়ে গেল ২২ জুন, ১৯৭৫।

২৮ জুন নামানো হলো নতুন নাটক বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’র নাট্যরূপ (কুণাল মুখোপাধ্যায়)। এই উপন্যাসের নাট্যরূপ আগে স্টার সমেত অন্যান্য রঙ্গালয়েও বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে। এবারে মহেন্দ্র গুপ্ত প্রধান উপদেষ্টা হয়ে এলেন। কৃষ্ণকান্তের ভূমিকায় অভিনয় করলেন। পরিচালক হিসেবে নাম বিজ্ঞাপিত হলো রঞ্জিতমলের। বোঝাই যায়, টাকা দিয়ে অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন, নাম রাখছেন নিজের। ৫৪৫ রাত্রি হলো অভিনয়।

১৯৭৬-এর ১৮ সেপ্টেম্বর, শরৎচন্দ্রের জন্মশতবর্ষের বছরে অভিনয় করা হলো ‘চন্দ্রনাথ’। ওই নামের উপন্যাসের নাট্যরূপ দিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। কিছুদিন ‘চন্দ্রনাথ’ চলার পর নতুন নাটক অভিনীত হলো ‘সম্রাট’। নাট্যকার অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। নান্দীকার গ্রুপ থিয়েটারের একনিষ্ঠ অভিনেতা ও কর্মী অসিত পেশাদারি থিয়েটারের জন্য নাটক লিখে দিলেন। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে রইলেন মহেন্দ্র গুপ্ত। অভিনয়ও করলেন প্রধান ভূমিকায়। কিন্তু পরিচালক হিসেবে নাম রইলো রঞ্জিতমলের। এই নাটক চলেছিল অনেকদিন, ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭৮-এ, বন্ধ হওয়ার সময় পর্যন্ত ৪৩৭ রাত্রি।

এবারে নতুন নাটক ‘সংগ্রাম’ (১৪ ডিসেম্বর ১৯৭৮)। নাট্যকার তপেন্দু গাঙ্গুলি। অপ্রস্তুত এই নাটক বেশিদিন চললো না। ২৮ রাত্রি। তাই উপায়ান্তর না দেখে রঞ্জিতমল পুরনো নাটক ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ আবার নামালেন। স্টারের মুখরক্ষা করে তা চললো ৭৭ রাত।

এবারে, ১৯৭৮-এর ৩০ এপ্রিল থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত স্টার থিয়েটার বন্ধ রাখা হয়। তারপরে অভিনীত হলো ‘সমাধান’ (৫ জুলাই, ১৯৭৯)। সমাধান নাটক বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের সর্বকালের অভিনয়ের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে চললো টানা এক হাজার চব্বিশ রাত্রি। ১৯৭৯-এর ৫ জুলাই থেকে শুরু করে ১৯৮৬-এর ১৩ মার্চ পর্যন্ত, সাত বছর ধরে নাটকটি একাদিক্রমে দর্শক পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে অভিনীত হয়ে গেছে। ‘সমাধান’ নাটকটি চলচ্চিত্রকার অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দাদু’র মঞ্চরূপ (সন্তোষ সিংহ)। সন্তোষ সিংহের পরিচালনায় এবং মহেন্দ্র গুপ্তের উপদেশনায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। পারিবারিক আবেগধর্মী এই নাটক সেদিন বাঙালি দর্শককে খুশি করেছিল। মহেন্দ্র গুপ্তের দাদুর ভূমিকায় অসামান্য অভিনয় উল্লেখযোগ্য। নাটকটি চলার মাঝপথেই ১১ নভেম্বর ১৯৮৪, মহেন্দ্র গুপ্ত মারা যান। ‘সমাধান’ নাটকেই তার শেষ অভিনয়।

‘সমাধান’ নাটক যথন রমরম করে স্টারে চলছে বৃহস্পতি, শনি ও রবি (ম্যাটিনী ও সন্ধ্যা), তখন আবার পূর্বের নিয়মে মধ্য-সাপ্তাহিক অভিনয় শুরু করে স্টার থিয়েটার। মধ্য-সাপ্তাহিক হিসাবে নামানো হলো ‘পাশের বাড়ি’। জনপ্রিয় চলচ্চিত্র হিসাবে এর আগেই ‘পাশের বাড়ি’ সিনেমাহলগুলিতে খুবই চলেছিল। অরুণ চৌধুরীর এই চলচ্চিত্র কাহিনীর নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় করা হলো স্টারে (১৪.৪.১৯৮৪)। ‘সমাধান’ নাটকের ফাকে ফাকে মধ্য-সাপ্তাহিক নাটক হিসেবে ‘পাশের বাড়ি’ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। চললো টানা ৭০৫ রাত।

এবারে শুরু হলো অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শাপমোচন’। প্রথম অভিনয় হলো ১৯৮৫-এর ২৭ জানুয়ারি। ভালো চললো না। মাত্র ২৬১ রাত।

আবার একটি চলচ্চিত্রের কাহিনী নিয়ে স্টার থিয়েটার নাটক তৈরি করলো। আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাস ‘বালুচরী’ অবলম্বনে আগেই চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল। তারই মঞ্চরূপ দিলেন অজিত গঙ্গোপাধ্যায়। নায়িকা এলেন খ্যাতিময়ী অভিনেত্রী সুপ্রিয়া চৌধুরী। ৩৮৮ রাত চলার পর ‘বালুচরী’র অভিনয় বন্ধ হয়ে গেল (২২.১১.১৯৮৭)। ‘বালুচরী’র সঙ্গে আবার একটি মধ্য-সাপ্তাহিক নাটক নামানো হলো ‘খেলনা’ (৩১.১২.১৯৮৬)। চলেছিল ৭২ রাত্রি, ‘বালুচরী’র ফাঁকে ফাঁকে। তারপরে ‘ঘরে ঘরে’। প্রথম অভিনয়: ১৫ এপ্রিল, ১৯৮৭। ভালো চলেনি। মোটে ১০৭ রজনী।

স্টার থিয়েটার ‘লক আউট’ ঘোষণা করা হলো। আগে থেকেই স্টার থিয়েটার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কর্মী ও কলাকুশলীদের নানা ব্যাপারে মতাম্ভর চলছিল। কর্মী বিক্ষোভও চলছিল মাঝে মাঝে। রঞ্জিতমল স্টার থিয়েটারে ‘লক আউট’ ঘোষণা করলেন ১৯৮৭-এর ১ ডিসেম্বর। একবছর বন্ধ থাকার পর ৩০ নভেম্বর, ১৯৮৮, স্টার থিয়েটার আবার খোলে। বাংলা পেশাদার মঞ্চের ইতিহাসে এর আগে কখনও এইভাবে কোনও থিয়েটারে ‘লক আউট’ ঘোষণা করা হয়নি। গৃহ সংস্কার, মালিকানার হাতবদল অথবা মামলা-মোকদ্দমা, কিংবা আদালতের রায়ে কখনও কখনও কোনও রঙ্গালয় কিছুদিন বন্ধ থেকেছিল কিংবা একেবারে উঠে গিয়েছিল। কিন্তু স্টার থিয়েটারের মতো এইভাবে কারখানা সদৃশ ‘লক আউট’, বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

অনেক টালবাহানার পর কর্মীদের সঙ্গে সমঝোতায় এসে রঞ্জিতমল স্টারের দরজা খুললেন। গড়িমসি করে নাটকও প্রযোজনা করলেন। অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টগরী’ (২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯)। এ নাটক হতাশ করল সবদিক দিয়ে। টেনেটুনে ৪৩ রাত্রি চালানোর পর লোকসান দিয়ে, নাটক বন্ধ করে দিলেন। আগে থেকেই এর লোকসান চলছিল। লকআউট ঘোষণা তারই ইঙ্গিত। সবশেষে রঞ্জিতমল স্টারের কর্তৃত্ব ছেড়ে দিলেন। ১৯৮৯-র ৩০ এপ্রিল। এরপর রঞ্জিতমল স্টার থিয়েটার ভাড়া দিয়ে দিলেন অনুপ গুপ্ত ও স্বপন সেনগুপ্তকে।

এদের অন্য পেশা ছিল। থিয়েটারের ব্যবসায় এসে এরা উঠে পড়ে লাগলেন। একে তাকে জোগাড় করে প্রযোজনা করলেন ‘ঘরজামাই’ নামে এক মজার নাটক। একশো রাত্রি টানা চলল। স্টার যেন জেগে উঠল। কিন্তু ১৯৭ রজনী অভিনয়ের পর (১০ মার্চ, ১৯৯০) তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন, ‘ঘরজামাই’ বন্ধ হয়ে গেল।

রঞ্জিতমল তার স্টার থিয়েটার ভাড়া দিয়েছিলেন। সেখানে অনুপ গুপ্ত ও স্বপন সেনগুপ্ত নতুন করে নাটক করতে না পেরে স্টার থিয়েটার ভাড়া দিলেন প্রখ্যাত নট ও চলচ্চিত্রখ্যাত সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

তিনি তাঁর নিজস্ব থিয়েটার দল নিয়ে স্টারে এসে অভিনয় করলেন তাঁর ‘নহবত’ নাটক, ১৮ মার্চ ১৯৯০। রচনা ও পরিচালনা তাঁরই। প্রধান ভূমিকাতেও অভিনয় করলেন। সিরিও-কমিক এই নাটক একশো রজনী অতিক্রম করলো। রঞ্জিতমল তখন আবার উৎসাহিত হয়ে নিজেই উদ্যোগী হয়ে প্রযোজনা করলেন, ‘স্বামীরা আসামী’। প্রথম অভিনয় হলো ২৭ এপ্রিল, ১৯৯০। ব্যর্থ হলো। ৪৩ রাত্রি মোটে অভিনয় হয়েছিল।

আবার অনুপ গুপ্ত এবং স্বপন সেনগুপ্ত উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে এলেন। তাঁরা মঞ্চ ও চলচ্চিত্র জগতের খ্যাতকীর্তি ও জনপ্রিয় সুদর্শন অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এলেন। অভিনীত হলো ‘ঘটক বিদায়’। নাটক রচনা, পরিচালনা ও সঙ্গীতে: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মঞ্চ ও চলচ্চিত্র জগতের নামকরা সব অভিনেতা অভিনেত্রী এই নাটকে যোগ দিলেন। সৌমিত্র তো ছিলেনই, অন্যরা হলেন মাধবী মুখখাপাধ্যায় (চক্রবর্তী), রবি ঘোষ, শ্রীলা মজুমদার, তরুণকুমার প্রমুখ।

মজাদার এই নাটক জমে গেল রাতারাতি। সৌমিত্র, রবি ও তরুণকুমার প্রমুখের অসামান্য অভিনয় এই নাটকের সাফল্যের বড় কারণ। সৌমিত্রের নাট্য পরিচালনার কৃতিত্বও উল্লেখযোগ্য। সব মিলিয়ে ‘ঘটক বিদায়’ নাটক স্টার থিয়েটারে আবার প্রাণ ফিরিয়ে আনলো। চলেছিল টানা ৩১৬ রাত্রি। কিন্তু ৩১৭তম অভিনয়ের আগেই, ১৯৯১এর ১২ অক্টোবর রাত ১-১০ মিনিটে আগুন লেগে স্টার থিয়েটার পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। (ইংরেজি মতে, 18th October at 1-10 a.m.]। একশো বছরের ঐতিহ্যশালী স্টার থিয়েটার শেষ হয়ে গেল।

রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে স্টার থিয়েটারের অবদান

১০০ বছরের অধিককাল ধরে একটি রঙ্গালয়ের নানা উত্থান-পতন, ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে দিয়ে একাদিক্রমে অভিনয় চালিয়ে যাওয়া, পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসেই খুব কম দেখা যায়। এদেশে স্টারই একমাত্র মঞ্চ যা শতাধিক বৎসরের ঐতিহ্য নিয়ে অভিনয় চালিয়ে গেছে।

  • ১০০ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে কোনো থিয়েটারের অভিনয় চালিয়ে যাওয়াই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
  • নানা উত্থান-পতন সত্ত্বেও স্টার থিয়েটারে কখনো অভিনয় বন্ধ হয়নি। সাময়িকভাবে হলেও তা কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
  • একই সঙ্গে তিন চারটি রঙ্গমঞ্চ পাশাপাশি চললে এবং সেগুলি সবই ব্যবসায়িক থিয়েটার হলে, স্বাভাবিকভাবেই বিষম প্রতিযোগিতায় সুস্থতা থাকে না, অনেক সময়েই রুচি বিকৃতি দেখা যায়। প্রতিযোগিতার ভালো দিকের বাইরে এ এক অসুস্থ সম্ভাবনা। স্টার কিন্তু সবসময়েই কাহিনী নির্বাচনে এবং উপস্থাপনে সুস্থ রুচি বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। কুৎসিত, নিম্নরুচি কিংবা হাল্কা ভাঁড়ামো দিয়ে দর্শক আকর্ষণের চেষ্টা স্টার থিয়েটার কখনো করেনি। যতই মালিক বদল হউক, কোনো মালিকই কখনো এই পরিচ্ছন্ন শিল্প সংস্কৃতির ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হননি। এমন কি ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিক থেকে সত্তর-আশির দশকে অন্য মঞ্চগুলি যখন ক্যাবারে গার্লদের দিয়ে কুৎসিত নৃত্য, কিংবা নায়িকার বস্ত্রবিপ্লব ঘটিয়ে দর্শক আকর্ষণ করতে চেয়েছে, তখনো স্টার নির্মল ও সুস্থ মানসিকতার প্রসঙ্গ থেকে সরে যায়নি।
  • এই রঙ্গমঞ্চে বাংলার শ্রেষ্ঠ নাট্যকারবৃন্দ (গিরিশ, অমৃতলাল, রাজকৃষ্ণ, ক্ষীরোদপ্রসাদ, অতুল মিত্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, দেবনারায়ণ, মহেন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ) যুক্ত ছিলেন এবং তাদের শ্রেষ্ঠ নাটকগুলি এই স্টারের জন্যই লেখা। এখানে তার অনেকগুলি অভিনীত হয়ে যেমন দর্শকমণ্ডলীকে পরিতৃপ্ত করেছে, তেমনি বাংলা নাটকের ইতিহাসকেও সমৃদ্ধ করেছে। তাছাড়া এখানে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নিরুপমা দেবী, তারাশঙ্কর, বিমল মিত্র, মনোজ বসু আশাপূর্ণা দেবী প্রমুখের উপন্যাসের নাট্যরূপগুলিও প্রায়শই অভিনীত হয়েছে।
  • সে যুগ এবং এ যুগের সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রীবৃন্দ এখানে যুক্ত থেকে তাদের অভিনয়ের পারদর্শিতা দেখিয়ে বাংলা মঞ্চাভিনয়ের মান উন্নতও করেছেন। গিরিশ, অমৃতলাল মিত্র, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, অমৃতলাল বসু, অর্ধেন্দুশেখর, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, দানীবাবু, অপরেশচন্দ্র, অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, তিনকড়ি চক্রবর্তী, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, উত্তমকুমার, নির্মলকুমার, অনুপকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, কমল মিত্র, ছবি বিশ্বাস প্রভৃতি দিকপাল অভিনেতা এবং তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, তিনকড়ি, প্রমদাবালা, নিভাননী, প্রভা দেবী, সরযূ দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অভিনেত্রীবৃন্দ এখানে নানা সময়ে যুক্ত থেকে অভিনয় করে গেছেন। এছাড়াও দীর্ঘ একশো বছরে আরো কত দীপ্ত নট-নটী ছিলেন, তার তালিকা শেষ করা যাবে না।
  • এই রঙ্গমঞ্চ যেমন সুদৃশ্যভাবে তৈরি হয়েছিল, তেমনি দর্শকদের সুবিধের কথাও সমসময়ে ভাবা হয়েছিল। মহিলা দর্শকদের জন্যও আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফলে এখানকার পরিবেশ কখনো কলুষিত হয়নি।
  • বাংলা মঞ্চের মধ্যে এখানেই প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা এবং বিদ্যুত আলোকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ডায়নামো বসিয়ে সাময়িকভাবে চমক দেবার জন্য নয়। একেবারে পাকাপাকি ব্যবস্থা।
  • বিশ শতকের গোড়ার দিকে অনেক রঙ্গমঞ্চই দুরবস্থা কাটিয়ে উঠবার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতার সঙ্গে সঙ্গে দর্শক আকর্ষণের সব সস্তা ও নাট্যবহির্ভূত কৌশল অবলম্বন করতো। স্টার সবসময়েই রুচি মাফিক কাজ করার চেষ্টা করেছে। ফলে অন্য রঙ্গমঞ্চে দর্শকের মধ্যে উচ্ছঙ্খলতা প্রায়শই দেখা যেত। কিন্তু স্টার দর্শকদের কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে বেঁধে রাখতো। দর্শকেরা বেহিসেবী হওয়ার সুযোগ পেত না।
  • দীর্ঘ একশো বছর ধরে নানা ভাব ও নানা বিষয়ের এবং তাৎপর্যময় ঘটনার নাটক এখানে অভিনীত হয়েছে। নাটকের শ্লীল-অশ্লীল প্রসঙ্গে সুস্থ মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে।
  • তবে একথাও ঠিক, বিশ শতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে বাংলা নাটকের ধারায়, তার অভিনয়ে এবং বিষয়বস্তুতে আমূল পরিবর্তন এনেছিল গণনাট্যধারা। সেই ধারাকে নানামুখীন উৎকর্ষে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল গ্রুপ থিয়েটারগুলির অভিনয় প্রচেষ্টা। বিষয়ের এই নতুনত্ব এবং প্রযোজনা ও উপস্থাপনার এই পরিবর্তনের ধারাকে স্টার থিয়েটার গ্রহণ করতে পারেনি। যদিও গণনাট্য ও গ্রুপ থিয়েটারের অনেক খ্যাতিমান অভিনেতা অভিনেত্রীকে প্রয়োজনে স্টার থিয়েটারে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু বাণিজ্যিক থিয়েটারের প্রচলিত ও প্রথাসিদ্ধ থিয়েটারি ঘেরাটোপ থেকে স্টার থিয়েটার নিজেকে উন্মুক্ত করতে পারেনি। বাংলা নাটকের বিষয় ও উপস্থাপনা যখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে, আন্তর্জাতিক হয়ে উঠছে, স্টার তখনো ত্রিশ-চল্লিশের দশকের ঐতিহ্যের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে।
  • স্বাধীনতার পর নানা বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যখন নতুন করে দেশ গড়ে তোলার ভাবনা শুরু হয়েছে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ভাবনার প্রসার মানুষের মনে বিস্তারিত হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে স্টার প্রযোজনা করল ‘শ্যামলী’ (১৯৫৩)। শ্যামলীর অসামান্য সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে অন্য মঞ্চগুলিও অভিনয় করল ‘এরাও মানুষ’, ‘উল্কা’, ‘সেতু’। লক্ষ করতে হবে, এইসব নাটকের বিষয় কিন্তু অসম্পূর্ণাঙ্গ মানুষের কথা। ‘সেতু’তে বন্ধ্যা নারীর বেদনা, ‘উল্কা’তে বীভৎসদর্শন পুরুষের স্নেহাকাঙ্ক্ষা ও আত্মজ্বালা, ‘এরাও মানুষ’-এ বিকৃত শরীরের ভিখিরিদের বেদনা। ‘শ্যামলী’তে ছিল বোবা-কালা মেয়ের মনোবদনা। কিন্তু এইসব অসম্পূর্ণাঙ্গ মানুষও সমাজের একজন, তারা তাদের সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, সে সংগ্রামের কথা নাটকগুলিতে নেই। বরং তাদের প্রতিবন্ধকতাকে অবলম্বন করে দর্শকের ‘সেন্টিমেন্ট’ তৈরি করে কারুণ্যের বেদনা প্রকাশ করেছে। নাটকগুলির এইখানেই সীমাবদ্ধতা।

ঠিক একই সময়ে পেশাদারি থিয়েটার ‘মিনার্ভা’ ভাড়া করে উৎপল দত্ত তাঁর ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ নিয়ে (১৯৫৯-৬৯) ‘অঙ্গার’, ‘কল্লোল’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ প্রভৃতি নাটকের প্লাবন বইয়ে দিলেন। গোটা সম্পূর্ণাঙ্গ মানুষের সন্ধান চলেছে সেখানে, যে মানুষেরা সমবেত প্রয়াসে সমাজবদলের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে দর্শকের মনে। বাংলা নাটকের ও প্রযোজনার যে ধারাবদল হয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী ‘মিনার্ভা’তে, স্টার থিয়েটার তা ভ্রূক্ষেপ করেনি। তারা তাদের ব্যবসায়িক পেশাদারি থিয়েটারের গতানুগতিক ভাবধারায় ও উপস্থাপনায় মশগুল থেকেছে।

স্টার থিয়েটার ভস্মীভূত হওয়ার সময়ে (১৯৯১) বাংলা অন্য সাধারণ রঙ্গালয়গুলিও আর চলছিল না। রঙমহল, বিশ্বরূপা বন্ধ হয়ে পড়েছিল। মিনার্ভার অবস্থাও তাই। প্রতাপ মেমোরিয়াল বন্ধ, সুজাতা সদন দ্বাররুদ্ধ। কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ তালাবন্ধ। অন্য ছোটখাটগুলিও বন্ধ বলা যায়। অর্থাৎ একবিংশ শতকের প্রারম্ভকালে পেশাদারি সাধারণ রঙ্গালয়ের অভিনয়ের ধারা বন্ধই হয়ে যাচ্ছে বলা যায়। এখানে সেখানে দু একটি বিক্ষিপ্ত এবং ক্ষণিক প্রয়াস দিয়ে ইতিহাসের ধারা অব্যাহত রাখা যায় না।

দেবনারায়ণ গুপ্ত স্টার থিয়েটার তথা বাণিজ্যিক পেশাদারি থিয়েটারের সঙ্গে কাটিয়েছেন দীর্ঘ ত্রিশ বছরেরও বেশি। ৮২ বছর বয়সী দেবনারায়ণ গুপ্ত চোখের সামনে স্টার থিয়েটার পুড়ে গেলে আর্তনাদ করে বলেছিলেন—‘‘ওপারে যাবার বেলায় দেখে যাচ্ছি এপারে আমার কারখানা পুড়ে ছাই হল।…রঙ্গালয়টি আবার গড়ে উঠবে কি না জানি না। যদিও বা গড়ে ওঠে, আমার জীবদ্দশায় আমি তা দেখতে পাব না।’’

শেষে বহুরূপী’ নাট্যদলের নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা বর্ষীয়ান শ্রদ্ধেয় কুমার রায়ের মন্তব্য স্মরণযোগ্য— ‘‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর সাধারণ রঙ্গালয়ের কাজ নিঃশেষ প্রায়। স্টার পুড়ে যাওয়াটা যেন তারই প্রতীক।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!