//
//

রসবাদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা কর।

রসবাদ

সংস্কৃতে ‘রস’ ধাতুর অর্থ হ’ল আস্বাদন। এই ‘রস’ ধাতু থেকেই ‘রস’ শব্দটির উৎপত্তি। যাকে আস্বাদন করা যায় তাকে ‘রস’ বলে। মধুর, কটু, অম্ল, তিক্ত, কষায়, লবণ— এ সবগুলিই হল রস, কেননা এর সবগুলিই আমরা জিভ দিয়ে আস্বাদন করে থাকি। জিভ আস্বাদনের মাধ্যম বলে জিভের আর এক নাম রসনা। ইংরেজিতে বলা যেতে পারে ‘Taste Organ’, সাহিত্যক্ষেত্রেও ‘রস’ শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ একই। এখানেও ‘আস্বাদন’ অর্থে আমরা ‘রস’কে গ্রহণ করে থাকি।

তবে সাহিত্যে যে রস আস্বাদ্য, তা আমাদের বাহ্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সম্ভব হয় না। কারণ সাহিত্যে বস্তুর নির্যাস পরিবেশিত হয় না, সাহিত্যিক নির্যাস পরিবেশিত হয়। তাই সাহিত্যের রসাস্বাদনের ক্ষেত্রে বাইরের ইন্দ্রিয়গুলি গুরুত্ব হারিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রসনেন্দ্রিয় বা সহৃদয় পাঠকের অন্তরেন্দ্রিয়। একমাত্র সহৃদয় সামাজিকের অনুভূতিপ্রবণ মনই কাব্যরস আস্বাদনের অধিকারী। আচার্য বিশ্বনাথ বলেছেন যে ‘রসের আস্বাদ’ কথাটির দ্বারা রস ও স্বাদের মধ্যে একটি ভেদরেখা টানা হয় কিন্তু এ ভেদ নিতান্তই কাল্পনিক। কারণ  যা আস্বাদ্য তাই হল রস।

আমরা যেমন কথায় বলি ভাত পাক হচ্ছে’ অথচ পাকের যা ফল তাই হ’ল ভাত। তেমনি যদিও আমরা বলি রসের প্রতীতি বা অনুভূতি, কিন্তু এই প্রতীতি বা অনুভূতিই হচ্ছে রস। বহুকাব্য অধ্যবসায়ের ফলে যাঁদের মনোমুকুর স্বচ্ছ হয়েছে, সেই স্বচ্ছ মনোমুকুরে কাব্যের বর্ণনীয় বস্তুর যে তন্ময়তা প্রাপ্ত হয়, তেমন দরদী লোকের সুকাব্যজনিত চিত্তের অনুভূতি বিশেষের নামই হ’ল ‘রস’।

ভাব ও রস

রসের আলোচনায় অগ্রসর হয়ে আমরা দেখব কতকগুলি ভাব রসসৃষ্টিতে সহায়তা করে। কিন্তু এই ভাব ও রস এক জিনিস নয়। ভাব জিনিসটা লৌকিক, আর রস জিনিসটা অলৌকিক। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কিছু কিছু ভাব থাকে এবং অনেক সময় সেই ভাবের প্রকাশও দেখা যায়। যেমন প্রিয়জনের মৃত্যুতে অন্তরে শোকভাব জাগ্রত হলে আমরা কঁদি, অর্থাৎ প্রিয়জনের মৃত্যুই হল শোকভাবের কারণ।

কিন্তু লৌকিক জগতের এই ‘শোক’ রস নয়। কবি যখন তাঁর প্রতিভার মায়াবলে এই লৌকিক শোক ও তার কারণের এক অলৌকিক চিত্র কাব্যে ফুটিয়ে তোলেন তখনই পাঠকের মনে অলৌকিক করুণরসের জাগরণ ঘটে। লৌকিক ভাবগুলি বিভিন্ন রকম হলেও অর্থাৎ শোকভাব, হাভাব কিংবা রতিভাবের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এগুলি থেকে জাত করুণরস, হাস্যরস ও শৃঙ্গাররসের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, এই রসের সবগুলিই আনন্দের কারণ।

আচার্য অভিনবগুপ্ত তাই বলেছেন যে, রস হল একটি মানসিক অবস্থা এবং তা নিজের আনন্দময় সম্বিত বা চেতনার আস্বাদরূপ একটি ব্যাপার। ভাব ও রসের মধ্যে এই পার্থক্যটুকু মনে না রাখলে কাব্যরসাস্বাদনে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।

তথ্যসূত্র:

১. কাব্যজিজ্ঞাসা: অতুলচন্দ্র গুপ্ত

২. কাব্যালোক: সুধীরকুমার দাশগুপ্ত

৩. ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব: অবন্তীকুমার সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!