//
//

ধর্মমঙ্গল কাব্যধারায় রূপরাম চক্রবর্তীর কৃতিত্ব আলোচনা কর।

রূপরাম চক্রবর্তী

ধর্মমঙ্গল কাব্যের আদি কবি ময়ূরভট্ট হলেও প্রথম উল্লেখযোগ্য কবি হলেন রূপরাম চক্রবর্তী। তাঁর কাব্যের এক-তৃতীয়াংশ মাত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাতে লাউসেনের জন্ম থেকে আখড়ায় মল্লবিদ্যা শিক্ষা পর্যন্ত কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।

সুকুমার সেনের মতে রূপরাম ধর্মমঙ্গলের প্রথম কবি। তাঁর কাব্য রচনাকাল সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। ১৫৪৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়কে কাব্য রচনাকাল হিসাবে সমালোচকরা মনে করেন। তবে ষোড়শ শতকের শেষভাগে কিম্বা সপ্তদশ শতকের প্রথমে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়— বর্ধমানের রায়না থানার অন্তর্গত শ্রীরামপুরের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। কবি বাল্যকাল থেকে পড়াশোনায় অমনোযোগী ছিলেন, সেজন্য অভিভাবকের কাছে তিরস্কৃত হতেন। তারপর বাড়ি ছেড়ে এক টোলে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকে একদিন মনের দুঃখে ঘুরতে ঘুরতে ব্যাঘ্ররূপী ধর্মঠাকুরের সঙ্গে কবির দেখা হয় এবং ঠাকুর তাকে কাব্যরচনার নির্দেশ দিয়ে আশীর্বাদ করেন।

রূপরামের কাব্যের নাম ‘অনাদিমঙ্গল’ (অনাদ্যমঙ্গল)। তাঁর কাব্যের রচনাকাল সম্পর্কিত যে শ্লোকটি পাওয়া যায় তা হল—

তিন বাণ চারি যুগে বেদে যত রয়।

শাকে সনে জড় হৈলে কত শক হয়।

রসের উপরে রস তাহে রস দেহ।

এই শকে গীত হৈল লেখা কইরা লেহ।।

এই বিশুদ্ধ পাঠ আশুতোষ ভট্টাচার্যের। তাঁর মতে— রূপরামের কাব্য রচনাকাল ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দ। সুকুমার সেনের মতে এই সময় ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দ। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির মতে তা ১৬০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দ। বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ১৬৪১ শকাব্দ (১৬৪১+৭৮) অর্থাৎ ১৭১৯ এবং দীনেশচন্দ্র সেনের মতে রূপরাম পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দে আবির্ভূত হয়েছিলেন। রূপরামের আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়, কবিকঙ্কণের জন্মস্থানের সন্নিকটে বর্ধমান জেলার অন্তর্গত রায়না থানার কাইতি শ্রীরামপুর গ্রামে রূপরামের জন্ম হয়।

তাঁর পিতা শ্রীরাম চক্রবর্তী ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তি। কেননা শতাধিক ছাত্র তার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত। কবিরা তিন ভাই ও দুই বোন। রূপরাম কৈশোরে পড়াশোনায় অমনোযোগী ছিলেন বলে তাঁর মেজ ভাই তাঁকে কর্কশবাক্যে গঞ্জনা দিলে কবি উচ্চতর শিক্ষালাভের জন্য পাসণ্ডাগ্রামে রঘুরাম ভট্টাচার্যের কাছে গেলেন। সেখানেও গুরুর সঙ্গে তর্ক হলে তিনি ক্ষুব্ধ চিত্তে নবদ্বীপে বিদ্যা অর্জন করার জন্য রওনা হলেন। নবদ্বীপের অভিমুখে যাত্রা করে যাত্রাপথে বিপদে পড়েন— “দুটা বাঘ দুদিগে বসিয়া লেজ নাড়ে।” এই বিপদের সময় স্বয়ং ধর্ম ব্রাহ্মণের রূপ ধরে কিশোর কবির সামনে আবির্ভূত হলেন এবং পরিচয় দিয়ে বললেন—

সুবৰ্ণ পইতা গলে পতঙ্গ সুন্দর।

কলধৌত কাঞ্চন কুণ্ডল ঝলমল।

তরাসে কপিল তনু প্রাণ দুর দুর।

আপনি বলেন ধর্ম দয়ার ঠাকুর।।

আমি ধর্ম ঠাকুর বাঁকুড়া রায় নাম।

বারদিনের গীত গাও শুন রূপরাম।।

চামর মন্দিরা দিব অপূর্ব মাদুলি।

পথিমধ্যে এই অনুপম দৃশ্য দেখে কবির ‘তরাসে কপিল তনু চঞ্চল পরাণ।’ এই আত্মপরিচয় সম্বন্ধে সমালোচক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন— “এই আত্মপরিচয় টুকুতে বাল্য কৈশোরের সহজ স্বাভাবিক জীবন, লৌকিকতার প্রতি আকর্ষণ, গার্হস্থ্যজীবন ও সামাজিক পটভূমিকার যে জীবন্ত রেখাচিত্র অঙ্কিত হইয়াছে, তাহা মুকুন্দরামের সমকক্ষ। …ঘনরামের শিল্পরীতি বিচক্ষণ হইলেও চরিত্রসৃষ্টি স্বচ্ছন্দ বর্ণনা, পইজ অলঙ্কৃতি, শোক ও পরিহাস সৃষ্টিতে রূপরাম প্রায় মুকুন্দরামের কাছাকাছি গিয়া পড়িয়াছেন।”

সুকুমার সেন বলেছেন—রূপরামের রচনা বাহুল্য ও অলঙ্কারভার বর্জিত, সবল এবং পষ্ট। এইখানে তাঁহার সহিত পরবর্তী অধিকাংশ কবির প্রধান পার্থক্য। জীবনের সম্বন্ধে খানিকটা সচেতনতায় কল্পনার উদ্দামতা ও উচ্ছলতা সংযত হইয়াছে।” যেমন, দশ দিন কঠোর তপস্যাতেও ঠাকুরের দয়া না পেয়ে হতাশ হয়ে সামুলাকে রানি বলেছেন—

কোথা কোন দেবতা দুরন্ত হয়্যা আছে।

কত আর করুণা করিব তার কাছে।

তুমি বল্যাছিলে বনি চাপাই নদী যাবে।

অষ্টদিনে সেখানে ধর্মের দেখা পাবে।

রূপরামের চরিত্রচিত্রণ প্রশংসনীয়। তাঁর চরিত্রগুলির স্বরূপ যেমন ঘরোয়া তেমন বাস্তব। রঞ্জাবতীর মর্ত্য-জীবন পিপাসা ও পুত্রবতী হওয়ার মধ্যে শাশ্বত মাতৃত্বের স্বরূপ চিত্রিত হয়েছে—

পুত্রবর না পাই শালে গিয়া মরি।

মনে পুনর্বার জীব হেন সাধ করি।।

কি কহিব কাহারে এ বচন অগাধ।

এমন বয়সে মরি বিধাতার সাধ।।

শিশু লাউসেন থেকে শুরু করে তরুণ লাউসেন পর্যন্ত লাউসেনের দৃঢ়তা ও নৈতিকতা কবির লেখনীতে অনবদ্য রূপ লাভ করেছে। যেমন, আদর্শবাদী লাউসেন ভ্রষ্টা নারী নয়ানীর প্রলোভন সম্বন্ধে বলেছে—

পথ ছাড় পথিনী ছাড়িয়া দেহগণ।

কুলবতী কন্যা তুমি এ কাজ কেমন।।

বলিতে উচিত বাণী মনে কিবা দুঃখ।

জন্মাবধি নাহি দেখি অসতীর মুখ।।

রূপরামের কবিত্বশক্তি ছিল প্রশংসনীয়। গোপভূমের রাজা গণেশ তাঁর কবিকর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। অবশ্য ধর্মমঙ্গল রচনা ও ধর্মপূজা করার অপরাধে রূপরাম নিজের সমাজে পতিত হয়েছিলেন। সে যাই হোক, তার কাব্য সরল সাবলীল ভাষায় রচিত। আসলে কবি প্রচলিত ব্রতকথাকে তাঁর কাব্যে কাব্যরূপ দান করেছেন। ফলে সমকালীন লোকজীবনের পরিচয় তাঁর কাব্যে রূপ পেয়েছে। যেমন—

(ক) সমকালীন ডোমসমাজের বীরত্বের স্বরূপ।

(খ) সাধারণ মানুষের নৈতিকতা ও ত্যাগ।

(গ) শিক্ষাসংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল নবদ্বীপ, শান্তিপুর।

(ঘ) বাংলাদেশের বিভিন্ন টোলগুলি ছিল ব্যাকরণ, অভিধান, ন্যায় ও কাব্যপাঠের পীঠস্থান।

(ঙ) ইতিহাস, পুরাণ, কিংবদন্তী, উপকথা লোকসমাজে বহুল প্রচলিত ছিল।

(চ) “ষেটের ব্রত’, ‘একুশা’ প্রভৃতি অনুষ্ঠান। জাঁকজমক করে অনুষ্ঠিত হত।

(ছ) বিভিন্ন লোকসংস্কার ও বিশ্বাস (শালেভর, মন্ত্রপূত কাজ)ও প্রচলিত ছিল।

(জ) লোকজীবনে অলৌকিকতায় বিশ্বাস ছিল। যেমন— পশ্চিম সূর্যোদয় ঘটে, স্বর্গলাভের আশায় পিতা পুত্রকে শুলে দিতে সংকোচ করে না ইত্যাদি।

কবির সমাজবোধ ছিল প্রখর। যে জীবনবোধ থাকলে সমাজের মূল সুরকে ফুটিয়ে তোলা যায় তা রূপরামের ছিল। যেমন, গৌড় থেকে ফেরার পথে লাউসেন কালুকে ময়নায় বসতি স্থাপনের প্রস্তাব দিলে কালুর পত্নী লখ্যা বলেছে—

রাজনিন্দা করি কেন যাব পলাইয়া।

সংহতি আপনি লহ রাজাকে বলিয়া।

রাজাকে বলিলে পরিণাম ভাল হয়।

লবণে জিনিলে তবে ঘরে অন্ন রয়।।

(কাঙুর যাত্রা পালা)

‘লখ্যা’র এই কৃতজ্ঞতাবোধ তাকে জীবন্ত ও উজ্জ্বল করে তুলেছে।

কবির বাস্তবতাবোধও ছিল যথেষ্ট। তাই পুত্রস্নেহে অন্ধ রঞ্জাবতী মল্ল গুরুকে বলেছেন—

রঞ্জাবতী বলে ভাই শুন মন দিয়া।

বলিব বিশেষ কথা বিরলে বসিয়া।।

বেটার কারণে আমি শালে দিনু ভর।

দিনে দশবার যাতে চায় দেশান্তর।।

কল্পনা করিয়া তারে শিখাবে সরণ।

ভাঙ্গিবে দক্ষিণ হাত দক্ষিণ চরণ।।

খোঁড়া করি লাউসেনে রাখিব নিকেতনে।

পুত্রমুখ সদা দেখি এই সাধ মনে।

(মল্লবধ পালা)

রূপরামের রচনা সহজ, স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল। পাণ্ডিত্যের জৌলুস তাঁর রচনাকে আড়ষ্ট করেনি। যেমন শিশু লাউসেনের বর্ণনা—

নিৰ্ম্মল সুধীর যেন শিরিষের ফুল।

পঙ্কজ সদৃশ দৃষ্টি চরণ রাতুল।।

তিলফুল উন্নত নাসিকা অনুপাম।

তনুরুচি শোভে যেন দুর্বাদল শ্যাম।।

কবি তাঁর কাব্যে বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের (অষ্টাদশ সর্গ) প্রসঙ্গ ও আখড়া পালায় সন্নিবেশিত করেছেন। যেমন—

কাকরূপে যমরাজা গেল দিগন্তর।

করে দান দিল মাসী অপূর্ব আতর।।

শঙ্কর বলেন গৌরী তুমি থাক ঘরে।

তরাসে চঞ্চল প্রাণ অসুরের ডরে।।

সুতরাং সহজ সাবলীল বর্ণনায়, নিপুণ চরিত্র সৃষ্টিতে, স্বচ্ছ সমাজবোধে রূপরাম ধর্মমঙ্গল কাব্যধারার একজন প্রতিভাবান কবি।

তথ্যসূত্র:

১. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস: আশুতোষ ভট্টাচার্য

২. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

৩. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!