রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশ সম্পর্কে আলোচনা কর।
রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশ
রামায়ণ সাত কাণ্ডে রচিত— একথা প্রচারিত থাকলেও এর কাণ্ড সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। প্রথম কাণ্ড ও শেষ কাণ্ডের সঙ্গে অন্যান্য কাণ্ডের রচনাশৈলীর পার্থক সন্দেহকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পাশ্চাত্য সমালোচক Winternitz তাই বলেছেন— “There can be no doubt that the whole of Book VII of the Ramayana was added later to the work; but it has also long been recognised that the whole of Book I can not have belonged to the original work of Valmiki.”
যে সব কারণে রামায়ণের কিছু অংশকে প্রক্ষিপ্ত বলা হয় তার কারণ হল— প্রথম কাণ্ডের প্রথম চার সর্গ যদি বাল্মীকির রচনা হয়, তাহলে কবি নিজের কবিত্ব লাভের ইতিহাসটি উত্তমপুরুষে বর্ণনা না করে, প্রথম পুরুষের উক্তিতে বর্ণনা করলেন কেন?
- উত্তরকাণ্ডের ভাষা ও রচনারীতি অন্যান্য কাণ্ডের ভাষা ও রচনারীতি থেকে পৃথক। অযোধ্যা কাণ্ড থেকে যুদ্ধ কাণ্ড পর্যন্ত ঘটনার যে গতি, উত্তরকাণ্ডে তা বেশ মন্থর।
- বালকাণ্ডে রামায়ণ কাহিনীর দুটি অনুক্রমণিকা আছে—একটি নারদবর্ণিত, অপরটি বাল্মীকির নিজের। দুটি অনুক্রমণিকায় কিছু কিছু অমিল রয়েছে। সীতার পাতাল প্রবেশ উত্তরকাণ্ডের বিশেষ ঘটনা কিন্তু এই ঘটনার উল্লেখ কোন অনুক্রমণিকাতে নেই। সেজন্য উত্তরকাণ্ড যে বাল্মীকির রচনা নয়, এই ধারণা অনেকের। রাজশেখর বসুও বলেছেন তার (বাল্মীকির) মূলকাব্য মিলনান্ত, অযোধ্যায় ফিরে যাওয়ার পর রামসীতার আবার বিচ্ছেদ হয়েছিল, এমন কথা বাল্মীকি লেখেননি।
- কেউ কেউ মনে করেন, রামায়ণের যে সব অংশে ‘নরচন্দ্রমা’ রামে দেবত্ব, সে সব অংশও প্রক্ষিপ্ত।
- রামায়ণের বহু পুঁথির সাক্ষ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, ষষ্ঠ কাণ্ডের অন্তর্গত সীতার অগ্নিপরীক্ষার বৃত্তান্তও পরবর্তীকালের সংযোজন।
- বালকাণ্ডের একটি শ্লোকে রামায়ণকে চব্বিশ হাজার শ্লোকে রচিত সম্পূর্ণ মহাকাব্যরূপে উল্লেখ করা হলেও প্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্করণে শ্লোকসংখ্যা অনেক বেশি।
- বালিদ্বীপে প্রাপ্ত রামায়ণে সপ্তম কাণ্ড অনুপস্থিত।
- প্রক্ষিপ্ত অংশের বিভিন্ন স্থলে বাল্মীকিকে রামচন্দ্রের সমকালীন কবিরূপে জলে করা হয়েছে। কিন্তু মূল রামায়ণের বাল্মীকি এক পৌরাণিক ব্যক্তিত্ব।
ম্যাকডোনেলও রামায়ণের পাঁচটি কাণ্ডকেই এই মহাকাব্যের মূল অংশ বলে অভিমত প্রকাশ করে বলেছেন— ‘‘The Careful investigations of Prof. Jacobi have shown that the Ramayana originally consisted of five books only.”
একথা ঠিক যে, ভারতবর্ষ বহুকাল যাবৎ সাতকাণ্ড রামায়ণকেই স্বীকার করে আসছে। মূল রামায়ণ মিলনান্ত, এমন কথা কোথাও বলা হয়নি। নবম শতাব্দীর আলংকারিক আনন্দবর্ধনও রামায়ণকে করুণরসাত্মক কাব্য বলেছেন। কবি কালিদাসও রামায়ণের বিয়োগান্ত পরিণতিকেই অবলম্বন করেছেন। রামচন্দ্রের দেবত্বও বহুকাল থেকে প্রতিষ্ঠিত। ভগবান যখন নররূপে অবতীর্ণ হন, তখন তিনি দেবত্ব নয়, মানবত্বকেই প্রকাশ করে থাকেন। তার দ্বারা নরচন্দ্রমার দেবত্ব বাধিত হয় না, বরং দেবতার মাধুর্যই আভাসিত হয় এবং সেই গুণেই ধর্ম সাহিত্য কাব্য হয়ে ওঠে।
কাজেই রামায়ণের যে যে অংশে রামচন্দ্রের দেবত্ব দেখানো হয়েছে, তা প্রক্ষিপ্ত এই বিচার যথার্থ নয়। উত্তরকাণ্ড রামায়ণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উত্তরকাণ্ড না থাকলে রক্ষোবংশের আদি ইতিহাস ও বানরবংশের পূর্ববৃত্তান্ত অজ্ঞাত থেকে যেত। এমনকি উত্তরকাণ্ড না থাকলে রামায়ণকে আদি-মধ্য-অন্ত্য সমন্বিত মহাকাব্য বলা যেত না। উত্তরকাণ্ডের বিবরণের দ্বারাই রাবণ বিজয়ী রামচন্দ্রের গৌরব সুপ্রতিষ্ঠিত।
Leave a Reply