মহাভারতের কাহিনি ও চরিত্র বিষয়ে আলোচনা কর।
মহাভারত
ব্যাসশিষ্য বৈশম্পায়ন বলেছিলেন—
ধর্মে চার্থে কামে চ মোক্ষে চ ভরতর্ষভ।
যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন কুত্রচিৎ।।
(আদি পর্ব)
অর্থাৎ ভারতবর্ষের ধর্ম, অর্থ, কাম ও মুক্তির বিষয় এতে যা আছে, তা অন্যত্র থাকতে পারে; কিন্তু এতে যা নেই, তা কোথাও নেই। সত্যিই মহাভারত সুবিশাল গ্রন্থ—যেমন তার বৈচিত্র্য, তেমন তার গভীরতা। অষ্টাদশ পর্বে রচিত মহাভারতে মূল কাহিনী ছাড়াও অসংখ্য উপকাহিনী। রামায়ণে যেখানে পারিবারিক কাহিনী স্থান পেয়েছে, সেখানে মহাভারতে বৃহত্তর সমাজের সংঘাত চিত্রিত হয়েছে। মহাভারতের গৃহযুদ্ধে সমগ্র ভারত যুক্ত, সমগ্র ভারত আন্দোলিত। তাছাড়া, ভারতীয় জীবনের সমস্ত নীতি রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি, গৃহধর্ম, রাজধর্ম, আপদ্ধর্ম, ধর্মশাস্ত্র ও কামশাস্ত্র সমস্তই মহাভারতের বিপুল দেহেস্থান লাভ করেছে।
মহাভারতের বিষয় ও বিভাগ
পাণ্ডবরা তাদের ভাই কৌরবদের কাছে বসবাসের জন্য পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিল কিন্তু দুর্যোধনাদি কৌরবরা বিনাযুদ্ধে সূচের অগ্রভাগ সমান জমি পাণ্ডবদের দিতে না চাওয়ায় যে অবশ্যম্ভাবী। যুদ্ধ উপস্থিত হয়েছিল সেই যুদ্ধ ও যুদ্ধের পরিণাম মহাভারতের মূল ঘটনা। মহাভারতের আদি পর্বে বলা হয়েছে কুরুকুলে দুর্যোধন ছিলেন একটা মন্ময় মহাবৃক্ষ, কর্ণতার স্কন্ধ, শকুনি শাখা, দুঃশাসন পুষ্পও ফল এবং রাজা ধৃতরাষ্ট্র তার মূল। আর পাণ্ডবপক্ষে যুধিষ্ঠির ছিলেন ধর্মময় মহাম, তারস্কন্ধ অর্জুন, শাখাভীমসেন, মাদ্রীসুত নকুলও সহদেব পুষ্পফল এবং কৃষ্ণ ও ব্রাহ্মণ্যবর্গ তার মূল।
মহাভারত আঠারটি পর্বে বিভক্ত— আদি, সভা, বন, বিরাট, উদ্যোগ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য, সৌপ্তিক, স্ত্রী, শান্তি, অনুশাসন, অশ্বমেধ, আশ্রমবাসিক, মৌসল, মহাপ্রস্থানিক ও স্বর্গারোহণ পর্ব। আদি পর্বের ঘটনা—পরীক্ষিতের কাহিনী, আস্তিকোপাখ্যান, দুষ্যন্ত-শকুন্তলার কাহিনী, যযাতি উপাখ্যান, পরাশর-মৎস্যগন্ধ সংবাদ, ভীষ্ম কাহিনী, ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু-বিদুরের জন্ম, জতুগৃহদাহ প্রভৃতি। সভা পর্বে ময়দানব কর্তৃক সভানির্মাণ, জরাসন্ধ বধ, পাণ্ডবদের দিগ্বিজয়, যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ, শিশুপাল বধ, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা প্রভৃতি কাহিনী স্থান পেয়েছে। বন পর্বে দ্বৈতবনে যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর অনুযোগ, কিরাতাৰ্জুন সংবাদ, নল উপাখ্যান, ইন্দ্রদ্যুম্নের উপাখ্যান, রামায়ণ কথা, বকযুধিষ্ঠির সংবাদ ইত্যাদি বর্ণিত।
বিরাট পর্বে পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস মূল ঘটনা। উদ্যোগ পর্ব কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব। ভীষ্ম পর্বে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্র সংবাদ, শ্রীকৃষ্ণার্জুন সংবাদে শ্রীমদ্ভাগবদগীতা, ভীষ্মের পরাজয় ও শরশয্যা প্রভৃতি বর্ণিত। দ্রোণ পর্বে বর্ণিত হয়েছে অভিমন্যুবধ, জয়দ্রথ-ঘটোৎকচ-দ্রোণ বধ। কর্ণ পর্বের মূলঘটনা কর্ণবধ। শল্য পর্বে শল্য ও শকুনিবধ, দুর্যোধনের উরুভঙ্গ প্রভৃতি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সৌপ্তিক পর্বে অশ্বত্থামার সৈনাপত্য গ্রহণ, দুর্যোধনের মৃত্যু প্রধান ঘটনা। স্ত্রী পর্বে গান্ধারীর বিলাপ ও কৃষ্ণের প্রতি অভিশাপ, কুন্তী কর্তৃক যুধিষ্ঠিরের কাছে কর্ণের পরিচয় দান। শান্তি পর্বে শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের যুধিষ্ঠিরের কাছে রাজধর্ম ও মোক্ষধর্মের উপদেশ প্রদান। অনুশাসন পর্বে ধর্ম, অর্থ, দান, সত্যের ব্যবহার ও স্বরূপ কথন ও ভীষ্মের স্বর্গারোহণ; অশ্বমেধ পর্বে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন। আশ্রমবাসিক পর্বে ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী কুন্তীর বাণপ্রস্থ অবলম্বন ও মৃত্যু; মৌসল পর্বে যদুবংশ ধ্বংস কীর্তন; মহাপ্রস্থানিক পর্বে যুধিষ্ঠিরাদির মহাপ্রস্থান; স্বর্গারোহণ পর্বে যুধিষ্ঠিরের স্বর্গারোহণ বৃত্তান্তসহ মহাভারত পাঠের ফলশ্রুতি বর্ণিত হয়েছে।
মহাভারতের চরিত্র
মহাভারতের চরিত্রগুলি মহাসমুদ্রের মতো বিশাল ও মহৎ। সব চরিত্রের পুরোভাগে আছেন পুরুষোত্তম কৃষ্ণ, তিনিই পরমপুরুষ। মহাভারতে তার ভগবত্তা সুপ্রতিষ্ঠিত। এই কাব্যে কৃষ্ণের ভূমিকা নীতিকুশলী মানবের ভূমিকা। ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠায় তিনিই অগ্রণী, ধর্মযুদ্ধে তিনিই প্রধান সহায়। কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য নির্ঘোষ ধর্মযুদ্ধের আহ্বান, কৃষ্ণের উপদেশ বিপদে বল, অবসাদে প্রেরণা।
ভীষ্মও মহাভারতের গৌরবময় চরিত্র। তিনি শাপভ্রষ্ট দ্যু নামক বসু; শান্তনুর ঔরসে গঙ্গাগর্ভে মর্তে জন্মগ্রহণ করেন; তাই তার নাম দেবব্রত ও গাঙ্গেয়। পিতার জন্য তিনি কঠিন সত্য করেছিলেন—বিমাতা সত্যবতীর যে সন্তান হবে, সে হবে আমাদের রাজা। এছাড়া তিনি সারাজীবন ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করেছিলেন। এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার জন্য তার নাম হয় ভীষ্ম। ভীষ্ম কর্তৃক অম্বার নারীত্বের অপমান ভীষ্মবধের কারণ। ভীষ্মের কয়েকটি কাজ অত্যন্ত দুর্বোধ্য। যেমন, কৌরবসভায় দ্রৌপদীর চরম লাঞ্ছনার সময় ভীষ্মের নিষ্ক্রিয়তা কিম্বা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবপক্ষে অংশগ্রহণ।
ভীষ্মের পতনও ভাগ্যের পরিহাস। শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন তার উপর তীক্ষ্ণ শরনিক্ষেপ করেছিলেন। সে সময় আকাশ থেকেও দৈববাণী হয়—হে ধনুর্ধর, যুদ্ধে নিবৃত্ত হও ভীষ্ম অস্ত্রত্যাগ করলে অর্জুনের বিষম বাণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে রথ থেকে ভূতলে পতিত হন। তিনি ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন। শান্তি পর্বে ভীষ্ম অর্জুনকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তা আজ প্রত্যেক হিন্দুর শোকে সান্ত্বনা, দুঃখে শক্তি, জীবনে মহতী প্রেরণা।
ধৃতরাষ্ট্র মহাভারতের উল্লেখযোগ্য চরিত্র। মাতার দোষে ও ঋষির পাপে ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ। জন্মান্ধ হলেও ধৃতরাষ্ট্রের দেহে ছিল দশহাজার হাতির বল। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রস্নেহান্ধ ছিলেন বলেই তার যা কিছুঅপকর্ম পুত্রস্নেহবশত। তিনি প্রতিটি কাজে ছিলেন দোলাচলচিত্ত। তাঁর অন্তরে অসূয়া, বাইরে ধর্মভাব। ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুরের সঙ্গে তিনি পরামর্শ করতেন কিন্তু তাদের বিশ্বাস করতেন না। তিনি গান্ধারীকেও ছলনা করেছেন। গান্ধারীর আবেদনের ফল দ্বিতীয় দূতক্রীড়া। আবার পুত্র দুর্যোধনের প্রতি তাঁর স্নেহ সর্বাধিক। সেজন্য তার সমস্ত দুষ্কর্ম তিনি সমর্থন করেছেন।
পঞ্চপাণ্ডবের চরিত্রও বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল। যুধিষ্ঠির শান্তরসের, ভীম রৌদ্ররসের এবং অর্জুন বীররসের প্রতীক চরিত্র। মহাভারতের অতি ভয়ঙ্কর আবর্তে যুধিষ্ঠির চিরস্থির ও শান্ত। তিনি সত্যনিষ্ঠ ও ধর্মপথের পথিক। সেজন্য তিনি সশরীরে স্বর্গে গমন করেছিলেন।
ভীমের রৌদ্র মূর্তি বেশ ভয়ঙ্কর। অগ্রজকে তিনি অমান্য করেননি কিন্তু প্রতিমুহূর্তে তিনি ক্রোধে গর্জন করে উঠেছেন। দুঃশাসনের বক্ষেরক্তে দ্রৌপদীর বেণীসংহার ভীমের মহাভয়ঙ্কর রৌদ্রকর্ম।
অর্জুন কৃষ্ণের সখা, তৃতীয় পাণ্ডব। অর্জুনের দেহবল ও মনোবল বিশ্ববিশ্রুত। তিনি বীর, প্রেমিক, জিতকাম, যোগ ও ভোগের একাদর্শ। অর্জুনের প্রেমিক মূর্তিও মহাভারতে চিত্রিত। তিনি দ্রৌপদী প্রিয়। আবার সুভদ্রা, উলুপী, চিত্রাঙ্গদারও ধ্যেয়। আবার বীরত্বের অহমিকা তার পতনের কারণ।
দুর্যোধন অতিস্পর্ধী, অসহিষ্ণু। পাণ্ডবদের প্রতি তার জাতক্রোধ। ছলে, বলে, কৌশলে পাণ্ডবদের হেয় করা তার জীবনের লক্ষ্য। কর্ণের বীরত্ব দেখে দুর্যোধন তাঁকে অর্জুনের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে তিনি কর্ণকে অঙ্গ রাজ্যে অভিষিক্ত করেন। জতুগৃহদাহ, রাজসভায় কৃষ্ণার অপমান, মানী ব্যক্তির প্রতি দুঃসহ স্পর্ধিত দুর্বাক্য দুর্যোধনের অপকর্মের পরিচায়ক। দুর্যোধনের দম্ভ রাজসিক, পরশ্রীকাতরতা তুলনাহীন, তেমনি তার পতনও ভয়াবহ।
মহাভারতে দীপ্ত পুরুষকারের মূর্তিমান বিগ্রহকর্ণ। কুন্তীপুত্র হয়েও তিনি সুতপুত্র নামে পরিচিত। আজন্ম মাতৃপরিত্যক্ত ও মাতৃস্নেহবঞ্চিত। কর্ণ ছিলেন দাতা ও রথিশ্রেষ্ঠ, সিংহের মতো তিনি পরাক্রমশালী। কর্ণের সমগ্র জীবনই দৈবাহত। কোনো লোভ তার ছিল না বলেই তিনি মাতা কুন্তীর প্রলোভন ত্যাগ করতে পেরেছিলেন।
স্ত্রীচরিত্রগুলিও মহাভারতে উল্লেখযোগ্য। গান্ধারীশতপুত্রের জননী হয়েও অসুখী। গান্ধারী ধর্ম-দর্শিনী। অথচ যে পক্ষের তিনি মহিষী ও মাতা, সে পক্ষ অধর্মাচারী। স্বামী, পুত্র, ভ্রাতা— সকলেই অধর্মের পোষক। গান্ধারী দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের নিন্দা করেছেন। স্ত্রী পর্বে শোকাকুলা গান্ধারীরমূর্তি অতি করুণ—গান্ধারীশত পুত্রশোকে কৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়েও কুন্তীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন—‘অবশ্যম্ভাবী সম্প্রাপ্ত’— যা হবার তা হয়েছে।
অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত নারীচরিত্র হল কুন্তী। পঞ্চপাণ্ডবের মা হয়েও তিনি দুঃখী। কুন্তী তেজস্বী নারী। সেজন্য যুদ্ধ প্রস্তাবে যুধিষ্ঠিরের নিষ্ক্রিয়তা দেখে জ্বলে উঠেছেন। কর্ণের জন্ম তার জীবনে এক রহস্যময় অধ্যায়। এজন্য তিনি জীবন-দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন।
মহাভারতের আর একটি বিস্ময়কর স্ত্রী চরিত্র যজ্ঞ সমুত্থিতা দ্রুপদনন্দিনী দ্রৌপদী। দ্রৌপদী শ্যামা স্ত্রী, অপূর্ব সুন্দরী। যজ্ঞবেদী থেকে উত্থিতা বলে তার নাম যাজ্ঞসেনী। দ্রৌপদীই ভারত সমরের অরণি। রাজকন্যা ও রাজবধু হয়েও তিনি দুঃখিতা। স্বয়ম্বর সভায় এক বীরের কণ্ঠে তিনি বরমাল্য অর্পণ করলেন কিন্তু ভাগ্যের লিখনে তিনি হলেন পঞ্চস্বামীর পত্নী। কিন্তু দ্রৌপদী তেজস্বিনী নারী।
Leave a Reply