//
//

কলহান্তরিতা কাকে বলে? এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবির কৃতিত্ব আলোচনা কর।

মান ও কলহান্তরিতা

সংজ্ঞা

বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গারের চারটি বিভাগের মধ্যে দ্বিতীয় ভাগ হল মান। এই মানের সংজ্ঞা দিতে দিয়ে উজ্জ্বলনীলমণি-কার শ্রীরূপ গোস্বামী বলেছেন—স্নেহস্তুৎকৃষ্টতাব্যাপ্ত্যা মাধুর্যং মানয়ন্ নবম্।

যো ধারয়তাদাক্ষিণ্যং স মান ইতি কীর্ত্যতে।।

অর্থাৎ স্নেহের অবস্থা যদি গাঢ়তা পায়, তাহলে তাতে আরো নতুন বৈচিত্র্য যুক্ত হতে পারে। সেই অবস্থাতে নায়ক-নায়িকা প্রতিকূলতা বা বক্রতা পোষণ করে পরবর্তী মিলনকে আরো আকর্ষক করে তোলেন। এই অবস্থাকেই বলা হয় মান। এই মানের সঞ্চারী ভাব হল—নির্বেদ, শঙ্কা, অমর্ষ (অসহন), চাপল, গর্ব, অসূয়া, অবহিত্থা (মনে ভাব গোপন), গ্লানি এবং চিন্তা। মান দুই প্রকার—সহেতু মান এবং নির্হেতু মান।

সহেতু মানের তিনটি কারণ— শ্রুত, অনুমিত এবং দৃষ্ট। নির্হেতু মানে নায়ক ও নায়িকার মধ্যে কারণ ছাড়াই অভিমান হয়। মানাবস্থায় নায়িকাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়-খণ্ডিতা এবং কলহান্তরিতা। প্রিয়ের আগমনের আশা করে সুসজ্জিতা যে নায়িকা প্রতীক্ষা করেন, তাকে বলা হয় বাসকসজ্জিকা। সংকেত-নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত না হয়ে যে নায়িকার প্রেমিক অন্য নায়িকার সঙ্গে বিলাস করার চিহ্ন অঙ্গে ধারণ করে প্রাতঃকালে আসেন, তাঁকে খণ্ডিতা বলে। খণ্ডতার পর কলহান্তরিতা। খণ্ডিত অবস্থায় প্রিয়তমকে উপেক্ষা করে অনুতাপ করেন যে নায়িকা তাকে কলহান্তরিতা বলে।

কলহান্তরিতা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি গোবিন্দদাস

বৈষ্ণব পদাবলীতে কলহান্তরিতা নায়িকার বর্ণনায় সবচেয়ে বেশি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন কবি গোবিন্দদাস। তাঁর রাধা চণ্ডীদাসের রাধার মতো ভেঙে পড়েন না। তাই অবশেষে যখন পরাজয় স্বীকার করেন তখন আমরা তার বেদনার তীব্রতা, তার অন্তর-সংঘাতে বিধ্বস্ত আত্মগ্লানিকে অনুভব করতে পারি।

গোবিন্দদাসের ‘আন্ধল প্রেম পহিল নাহি জানলুঁ’ শীর্ষক পদটি রাধার প্রেমগভীরতা এবং অন্তর্দাহের প্রকাশে অসাধারণ। এটি শ্রীরাধার উক্তি। রাধা সখীর কাছে দুঃখ করে বলছেন, কৃষ্ণের প্রেমলাভ করেছেন এই গৌরবে অন্ধ হয়ে তিনি প্রথমে দেখতে পাননি যে কৃষ্ণ বহুবল্লভ। তাই আরও আদর পাওয়ার আশায় তার সঙ্গে কলহ করেছেন। কিন্তু এখন রাধার প্রাণ দিনরাত্রি জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে। তিনি সখীর কাছে অন্তরের জ্বালা প্রকাশ করেছেন। কৃষ্ণের দোষ দেখে যদি কোনও নারী ক্রুদ্ধ হয় তাহলে এই পৃথিবীতে তাকে খুব কষ্ট পেতে হবে। কৃষ্ণের মিনতি উপেক্ষা করে রাধা মানকে বড় করেছেন। এখন তার প্রতিফল পাচ্ছেন। এখন রাধা মন্মথশরে জর্জর।

কিন্তু তিনি কৃষ্ণের দর্শন পাচ্ছেন না। মানের সঙ্গে সঙ্গে রাধার ধৈর্য এবং লজ্জাও যেন পলায়ন করেছে। উজ্জ্বলনীলমণির সংজ্ঞাকেই অনুসরণ করে পদটি লিখিত। রাধার আচরণে প্রলাপ, সন্তাপ, গ্লানি ও দীর্ঘ নিঃশ্বাস প্রভৃতি লক্ষণ এখানে দেখা যাচ্ছে। নিজের জীবন থাকবে কিনা তা নিয়েও রাধা সংশয় প্রকাশ করেছেন। কৃষ্ণবিরহে রাধার এই ব্যাকুলতা কলহান্তরিতার বাঁধা-ধরা ছকের মধ্যেও যেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব রসতত্ত্বেরও বাইরে এক মানবীয় প্রেমকে অসাধারণত্বে উন্নীত করেছে। সেই সঙ্গে রাধাপ্রেমের গৌরবও এখানে প্রকাশিত। রাধা নিজের মানের জন্য যে অনুতাপবাণী উচ্চারণ করেছেন তার অর্থ এই নয় যে, কৃষ্ণের বিরুদ্ধে তার অভিযোগগুলি মিথ্যা। কিন্তু কৃষ্ণকে অপরাধী জেনেও রাধা তার সান্নিধ্যলাভের জন্য ব্যাকুল। ভালবাসার এই নিরুপায় যন্ত্রণাই রাধার অনুতাপের কারণ।

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্করণে পদটির প্রথমাংশের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, রাধা নিজের ‘স্বার্থপূর্ণ সংকীর্ণ’ প্রেমে অন্ধ হয়ে আগে কৃষ্ণের বহুবল্লভত্ব সম্পর্কে সচেতন হননি। শ্রীকৃষ্ণ যে শুধু তার নন, ‘বিশ্ববাসী সকলেরই যে তিনি হৃদয়বল্লভ’, আগে সে কথা বুঝতে না পেরে আদর পাওয়ার জন্য তাঁর সঙ্গে বিবাদ করে দিনরাত প্রাণের জ্বালায় জ্বলে মরছেন। কিন্তু অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর মতে— “নিজের সংকীর্ণ স্বার্থপূর্ণ প্রেম’ সম্বন্ধে রাধা যদি সচেতন হইতেন, তাহা হইলে কখনই আবার কৃষ্ণের দোষের উল্লেখ করিতে পারিতেন না।” অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু আরও বলেন— “রাধিকা যদি আজ নিজ মানের জন্য অনুতাপ করেন, সে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে নিজ অভিযোগকে অসঙ্গত বলিয়া বিবেচনা করার জন্য নয়, ভালবাসার এমনই যন্ত্রণা, সব বিসর্জন দিয়া অন্যায়কারীর আলিঙ্গনের জন্য প্রাণ আর্তনাদ করে। বর্তমান পদে তাহাই ঘটিয়াছে।” 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!