//
//

আগমনী ও বিজয়ার গান: বাঙালির সমাজ-জীবনের চিত্র— ব্যাখ্যা কর।

আগমনী ও বিজয়ার গান: বাঙালির সমাজ জীবনের চিত্র

শাক্ত পদাবলি মূলত ধর্মসঙ্গীত। কিন্তু তা সত্ত্বেও আগমনী-বিজয়ার পদগুলি কাব্যগুণে অকিঞ্চিৎকর নয়। সব পদ হয়তো কাব্যোৎকর্ষে সমান না হলেও আগমনী ও বিজয়ার মূল সুরটি বাঙালির এতই প্রিয় ছিল যে তার বিষয়গত মাধুর্য আস্বাদনে অধিকারীভেদের ব্যাপারটি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রতিভাহীন অথবা কবিত্বশক্তি-সম্পন্ন পদকর্তা যিনিই মেনকার আক্ষেপকে সর্বসাধারণের বেদনায় পরিণত করতে পেরেছেন তিনিই আগমনী-বিজয়ার পদকর্তা হিসেবে লোকপ্রিয় হয়েছেন। “আগমনী বিজয়া বাঙলার সর্বপ্রথম ঋতুগীতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের গান। শরতের শেফালী বনের মর্মের কামনাখানিকে উজাড় করে দিয়ে, ম্লান বিষণ্নতার রৌদ্রাশঙ্কা থেকে শিশিরকে মুক্ত করে এনে কবিরা ছড়িয়ে দিয়েছেন আগমনী গানে। মাতৃন্সেহকাতর মমতাম্পর্শ-ব্যাকুল একটি গৃহপ্রাঙ্গণে প্রভাতের প্রথম আলোর কমলখানি ফুটিয়ে তোলা ও ঝরিয়ে দেওয়ার লীলাসূত্রে বাধা এই আগমনী ও বিজয়া পদগুলি।”

শাক্ত পদাবলির বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে আগমনী ও বিজয়া পর্যায়ের পদসমূহ কাব্য-গুণে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ, যদিও এই পর্যায়ে শাক্ত পদাবলির শ্রেষ্ঠ গীতিকারদ্বয়— রামপ্রসাদ ও কমলাকান্তের রচিত পদ সংখ্যায় অল্প। আগমনী-বিজয়ার পদসমূহে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপর্বের ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভের নাগরিক কবিদের প্রাধান্য। এই তথ্য প্রমাণ করে, আগমনী-বিজয়ার সঙ্গীত মাধুর্য প্রধানত কবিওয়ালাদের নিত্যগীতের অন্যতম হয়ে লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং বিভিন্ন কবিকে প্রেরণা জুগিয়েছিল। আর এই সব কবিরা কেউ-ই রামপ্রসাদের মতো সাধক-কবি ছিলেন না। সুতরাং এইসব কবিদের রচিত পদে শান্ত সাধনার অন্তর্নিহিত তত্ত্ব কিছু থেকে থাকলেও তা কখনই সাধক-জীবনের বিশ্বাস থেকে সংক্রামিত হয় না— প্রাক্তন কাব্যের সংস্কার হিসেবে উত্তরাধিকাররূপে তা এসেছে। এই কারণে আগমনী-বিজয়ার সঙ্গীতগুলির কাব্য হয়ে ওঠার পথে ধর্মীয় বাতাবরণ কোন সময় বাধা হয়ে ওঠেনি।

প্রকৃতপক্ষে আগমনী-বিজয়ার সঙ্গীতগুলি বাঙালি সমাজের ছবি। বাঙালি কবি তাঁর নিজস্ব ভাবনায় উমা, মেনকা, গিরিরাজ, ভোলানাথের চরিত্র এঁকেছেন। চরিত্রগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পৌরাণিক সত্তা হারিয়ে বাঙালির একান্ত পরিচিত চরিত্ররূপে আমাদের আনন্দ-বেদনার অংশীদার হয়ে গিয়েছে। কন্যাবৎসলা মেনকা, স্বভাব-অচল অথচ স্নেহব্যাকুল গিরিরাজ। স্নেহাভিমানী উমা একান্তভাবেই বাঙাল কবির সৃষ্টি। বাঙালি মায়ের সম্ভান বাৎসল্য মেনকার মধ্যে চূড়াত্ত গভীরতা ও নিবিড়তা লাভ করেছে। সন্তান বাৎসল্যের আনন্দ ও বেদনার অপরূপ আলেখ্যর বাস্তব চিত্রটি রবীন্দ্রনাথের লেখায় অনবদ্যভাবে প্রকাশিত— “…হরগৌরীর কথায় আমাদের বাংলা দেশের একটা বড় মর্মের কথা আছে। কন্যা আমাদের গৃহের এক মস্ত ভার। একান্ন পরিবারের আমরা দূর ও নিকট, এমনকি নামমাত্র আত্মীয়কেও বাঁধিয়া রাখিতে চাই—কেবল কন্যাকেই ফেলিয়া দিতে হয়। …আমাদের মিলনধর্মী পরিবারে এই একমাত্র বিচ্ছেদ। …শরৎ সপ্তমীর দিনে সমস্ত বঙ্গভূমির ভিখারি-বধূ কন্যা মাতৃগৃহে আগমন করে এবং বিজয়ার দিনে সেই ভিখারি ঘরের অন্নপূর্ণা যখন স্বামীগৃহে ফিরিয়া যায় তখন সমস্ত বাঙালা দেশের চোখে জল ভরিয়া আসে।” বস্তুত আগমনী-বিজয়ার গানে মেনকা আর উমার মধ্যে বাঙালি আবিষ্কার করেছে বাঙালি ঘরের মাতা আর কন্যাকে। অবশ্য কোন কোন কবি পিতৃগৃহে আগতা উমার মধ্যে সুবর্ণমণ্ডিতা দশপ্রহরণধারিণী ভুবনভোলানো রূপও প্রত্যক্ষ করেছেন—

১. এমনরূপ দেখি নাই কারো মনের অন্ধকার

হরো মা, তোর হর-মনোমোহিনী

২. মায়ের রূপের ছটা সৌদামিনী

দিন যামিনী সমান করেছে।

উপরিউক্ত পঙক্তিগুলিতে উমার ভুবনভোলানো রূপ, মুগ্ধ কবির দৃষ্টিতে বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা দেশ নানাভাবে পর্যদুস্ত। দুর্ভিক্ষে-দারিদ্যে সর্বাভরণ-ভূষিতা মাতার অঙ্গে লেগেছে মালিন্যের ঝাপ, রিক্ততার ছাপ। সেই ভূষণহীনা রিক্তশোভা জননীর (কন্যারূপে) সন্তানগৃহে ক্ষণিক আগমনকে কেন্দ্র করে বাঙালি কবিরা শারদোৎসবে তার সমস্ত দুঃখ-যন্ত্রণা ভুলে ক্ষণিকের জন্যে হলেও আনন্দসাগরে ডুব দেয়। যে সম্পদ অচিরস্থায়ী তাকে ধরে রাখার আকুল কামনায় বাঙালি কবিরা যে আগমনী গান গেয়েছেন বিষয়বস্তুর মর্যাদায় তা অপূর্ব। আবার অচিরস্থায়ী সম্পদের অনিবার্য তিরোধানই বিজয়া সঙ্গীতের মূল সুর। বহু কবির কাব্যে বিজয়ার রাগিণী করুণ মুছনায় বেজে উঠেছে—

১. যেওনা রজনী আজি লয়ে তারাদলে।

২. ওরে নবমী নিশি না হইও রে অবসান।

আগমনী-বিজয়া পর্যায়ের কাব্যগত উৎকর্ষের মূল কারণ এই গানগুলি বাঙালি জীবনের উৎসব সঙ্গীত হয়ে উঠতে পেরেছে। যে উৎসবে বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে সানাই-এর সুর বেজে ওঠে, যে-উৎসবে প্রবাসী ঘরে ফিরে আসে, যে উৎসবে কন্যার পিতৃগৃহে আগমনে পিতৃগৃহ আনন্দমুখর হয়ে ওঠে—আগমনী গান সেই উৎবেরই বোধনসঙ্গীত আর বিজয়া সেই অকালসমাপ্তি উৎসবের ‘নশ্বরতার বিলাপ’, স্বপ্নচ্যুত জীবনের করুণ রাগিণী।

এই পর্যায়ের পদের বাণীরূপ বিচার করার আগে একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, পাঠ্য কবিতা হিসেবে নয়, সঙ্গীতের আঙ্গিকেই এ পদগুলি লেখা হয়েছিল। পাঠ্য কবিতার বন্ধন সেগুলির মধ্যে দেখা যায় না- সুরপ্রবাহকে কথার বীধ দিয়ে আটকে রাখা যায় না। আগমনী ও বিজয়া পর্বের পদসমূহ সম্বন্ধেও এ কথা প্রযোজ্য। ভাষার দিক থেকে আগমনী ও বিজয়ার পদগুলি যথেষ্ট এন্ব্যমন্তিত না হলেও বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িত এই পদগুলির ভাষা বেশ সরল এবং আন্তরিকতাপূর্ণ—

গিরি এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না।

বলে বলবে লোকে মন্দ কারো কথা শুনব না।।

যদি এসে মৃত্যুপ্রয়, উমা নেবার কথা কয়।

এবারে মায়ে-ঝিয়ে করবো ঝগড়া, জামাই বলে মানব না।।

পদটি সহজ ভাষায় রচিত। স্বভাবতই সাধারণ মানুষের হৃদয় স্পর্শ করার ব্যাপারে এ জাতীয় ভাষার বিশেষ ভূমিকা আছে। পরিশীলিত চিত্ত না হলেও কবিতার মূল রস অনাম্বাদিত থাকে না। যেমন—

গিরি গৌরী আমার এল কৈ?

এ যে সবাই এসে দাঁড়িয়েছে হেসে,

(শুধু) সুধামুখী আমার প্রাণের উমা নেই।

উপরিউক্ত পংক্তিগুলি কবিতায় মৌখিক ভাষা প্রয়োগের দৃষ্টান্ত। কিন্তু মৌখিক ভাষার প্রয়োগে কবিরা সর্বক্ষেত্রে সার্থক নন। বস্তুত তৎসম শব্দ, মৌখিক শব্দ ইত্যাদির যথেচ্ছ ব্যবহারে পদগুলি অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সৌন্দর্য হারিয়েছে। কারণ বেশিরভাগ কবির রুচি ও শিক্ষা এমন কিছু উন্নতমানের ছিল না যাতে ভাষার সমৃদ্ধিসাধন সম্ভব হয়। কিন্তু কিছু কিছু পদের সরল অভিব্যঞ্জনার উৎকর্ষকে স্বীকার করতেই হয়।

শাক্ত পদাবলি মূলত সঙ্গীত রূপেই গ্রহণীয়। পাঠযোগ্য কবিতা না লিখে পদকর্তারা গান রচনা করেছেন বলে প্রচলিত ছন্দের কাঠামো আগমনী-বিজয়ার পদগুলিতে নেই। অপেক্ষাকৃত আধুনিক কবিদের পদ বিনা সুরে রচিত হলেও পরবর্তীকালে সুব আরোপিত হয়েছে। মধুসূদনের “যেও না রজনী আজি লয়ে তারাদলে’’— এই সনেটটিতে তানপ্রধান পয়ার-এর রূপটি অক্ষুণ্ন আছে। কিন্তু এটি যথার্থ অর্থে শাক্তসঙ্গীত নয়। শাক্ত পদাবলি সুরপ্রধান হওয়ায় নবীনচন্দ্র সেন যিনি স্বভাবে গায়ক বা সুরকার নন তিনিও “যেওনা নবমী রজনী” পদটি গানের ছন্দে রচনা করেছেন। কবিতার ছন্দের দিক থেকে শ্বাসাঘাতপ্রধান, শ্বাসাঘাত প্রধান মিশ্রিত তানপ্রধান এবং অস্পষ্টভাবে ধ্বনিপ্রধান ছন্দের পদও দেখা যায়—

এবার আমার উমা এলে আর উমা পাঠাব না।

বলে বলবে লোকে মন্দ কারো কথা শুনব না।

আগমনী ও বিজয়ার গীতগুলিতে অলঙ্কার ব্যবহারের অপ্রতুলতা লক্ষ করা যায়। অবশ্য সবরকম অলঙ্কারের কিছু কিছু ব্যবহার আগমনী-বিজয়ার পদগুলিকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছে। যেমন—

গিরি গৌরী আমার এল কৈ (অনুপ্রাস)

সোনার পুতলি দিলে পাথরে ভাসায়ে (অতিশয়োক্তি)

ওরে নবমী নিশি না হইও রে অবসান (সমাসোক্তি)

চিত্রকল্প সৃষ্টিতেও পদকর্তারা বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন—

সুনীল আকাশে এ শশি দেখি

কৈ গিরি আমার কৈ শশিমুখী?

শেফালিকা এল উমার বর্ণ মাথি,

বল বল আমার কোথা বর্ণময়ী?

চিত্রকল্পটিতে বিশ্বশক্তির মূলীভূত শক্তি উমার স্নিগ্ধরূপ বর্ণিত।

শাক্ত পদাবলির উমাসঙ্গীতের ধারায় কবিরা বাংসল্য রসের যে চিত্র এঁকেছেন তা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। কন্যাকে ঘিরে মাতৃহৃদয়ের আনন্দ-বেদনা আগমনী বিজয়ার গানগুলিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বাঙালি জীবনের এমন অন্তরঙ্গ পরিচয় সমগ্র বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!