//
//

মুক্তক কাকে বলে উদাহরণসহ আলোচনা কর।

মুক্তক

‘মুক্তক’ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় “বেড়া ভাঙা পয়ার”। আসলে মুক্তকে ছন্দের প্রকৃত মুক্তি ঘটেছে। বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথই এর স্রষ্টা এবং পোষক।

মুক্তক প্রকৃতপক্ষে অমিত্রাক্ষর তথা প্রবহমান পয়ারের বিবর্তিত রূপ। রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি—

(১) “চোদ্দো অক্ষরের গণ্ডী ভাঙ্গা পয়ার একদিন ‘মানসী’র এক কবিতায় লিখেছিলুম, তার নাম ‘নিষ্ফল প্রয়াস’ (রবীন্দ্রনাথ নিস্ফল কামনা লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন নিষ্ফল প্রয়াস)

ক্ষুধা মিটাবার খাদ্য নহে যে মানব,

কেহ নহে তোমার আমার।

অতি সযতনে

অতি সংগোপনে,

সুখে দুঃখে, নিশীথে দিবসে,

বিপদে সম্পদে,

জীবনে মরণে,

শত ঋতু আবর্তনে

শতদল উঠিতেছে ফুটি

সুতীক্ষ্ণ বাসনা ছুরি দিয়ে

তুমি তাহা চাও ছিঁড়ে নিতে?

(নিস্ফল কামনা)

প্রবহমানতা, অসম চরণ বিন্যাস, এবং মিলহীনতা এই কবিতাকে ছন্দের বেড়া ভাঙতে সাহায্য করেছে।

(২) “আরো অনেক বছর পরে বেড়া ভাঙা পয়ার দেখা দিতে লাগলো ‘বলাকা’-য়, ‘পলাতকা’য়।” (রবীন্দ্রনাথ)

প্রিয়া তারে রাখিল না, রাজ্য তারে ছেড়ে দিল পথ,

রুধিল না সমুদ্র পর্বত।

আজি তার রথ চলিয়াছে রাত্রির আহ্বানে

নক্ষত্রের গানে

প্রভাতের সিংহ দ্বার পানে

তাই

স্মৃতি ভারে আমি পড়ে আছি,

ভারমুক্ত সে এখানে নাই।

(শাজাহান, বলাকা)

বলাকার কবিতাটিতে মিল থাকলেও এর প্রবহমানতা, অসম চরণ-বিন্যাস লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এ সম্বন্ধে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাঁর মনে হয়েছিল–ছন্দের মুক্তির পথ প্রশস্ত হলেও পূর্ণমুক্তি ঘটেনি। এ সম্বন্ধে লিখেছেন—

(৩) “এতে করে কাব্যছন্দ গদ্যের কতকটা কাছে এল বটে তবু মেয়ে কম্পার্টমেন্ট রয়ে। গেল, পুরাতন ছন্দোরীতির বাঁধন খুললো না।”

আচার্য প্রবোধচন্দ্র সেন এইছন্দের নাম দিয়েছেন ‘মুক্তক’ ছন্দ। তিনি লিখছেন বলাকার ছন্দের মধ্যে—“কৃত্রিম বন্ধনের সম্পূর্ণ অবসান ঘটেছে। সুতরাং এই ছন্দের নাম দেওয়া যেতে পারে মুক্তক ছন্দ। যে ছন্দকে আমরা Verse libra বা Free Verse নামে জানি। তাকেই ‘মুক্তক’ নামে অভিহিত করলুম।” এই বক্তব্যের তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন অধ্যাপক অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় ও কবি বুদ্ধদেব বসু।

“ওদের ফ্রী-ভার্স প্রবোধচন্দ্রের মুক্তক নয়, গদ্য ছন্দও নয়; ওদের ফ্রী-ভার্স হোলো মিশ্র ছন্দ, যাতে একই কবিতায় একাধিক রকম ছন্দ স্থান পায় কিংবা গদ্য পদ্য মেশানো থাকে।” —বুদ্ধদেব বসু

অমূল্যধন বলেছেন— “রবীন্দ্রনাথের বেড়াভাঙ্গা পয়ার’ মানে সেই পয়ার, যে পয়ারে ছন্দোবন্ধের চিরস্বীকৃত রূপটা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকৃত…পয়ারের এই ছন্দোরূপকে বলা হয়েছে মুক্তবন্ধ’। ভাষান্তরে বলতে পারি “স্বৈরবন্ধ (Free form) ..‘মুক্তক’ নামটা মুক্তবন্ধেরই পারিভাষিক রূপ।”

মুক্তকের বৈশিষ্ট্য

  • প্রমহমনতা।
  • চরণ বিন্যাসে স্বাধীনতা, চরণ দৈর্ঘ্যে অসমতা
  • ভাবানুযায়ী চরণের সন্নিবেশ
  • সাধারণত অক্ষরবৃত্তের ভিত্তিতে মাত্রা গণনা হয়, প্রতিটি পর্ব যুগ্মমাত্রা, পূর্ণ পর্বে দুই বা ততোধিক পর্ব থাকতে পারে। খণ্ড পর্বেও চরণ হতে পারে।
  • পর্ব-সমতা না থাকলেও পর্ব-সঙ্গতি থাকে। (অর্থাৎ মূল পর্বের সমতা অনেক | ক্ষেত্রেই থাকে)।
  • সাধারণত চরণান্তিক মিল থাকে।
  • স্বরবৃত্তে ও মাত্রাবৃত্তেও মুক্তক হতে পারে।
  • স্তবক নির্মাণে স্বাধীনতা।

মুক্তক-কে অনেকে ‘বলাকার ছন্দ’ ও বলেছেন। তবে রবীন্দ্রনাথের ‘বেড়া ভাঙ্গা পয়ার’ সর্বত্র ‘পয়ার’ নয়। কেননা সর্বত্র ৮+৬ মাত্রা থাকে না, স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের রীতি অনুযায়ী পর্ব গঠনও হয়ে থাকে। আবার চরণান্তিক মিলও থাকে না।

অনেকে গৈরিশ ছন্দের সঙ্গে মুক্তকের সাদৃশ্য দেখিয়েছেন বটে, কিন্তু গৈরিশ ছন্দ ও মুক্তক এক নয়। গৈরিশ ছন্দ অমিত্রাক্ষর, অর্থাৎ মিলহীন, মুক্তকে মিল থাকতেও পারে। গৈরিশ ছন্দে অক্ষরবৃত্তের রীতি কিন্তু মুক্তকে অন্য ছন্দরীতিরও প্রয়োগ হতে পারে।

গদ্যছন্দ ও মুক্তক এক নয়। গদ্য কবিতায় মুক্তকের মত পর্ব সঙ্গতি থাকে না, পরিবর্তে পর্ব বৈচিত্র্য থাকে। অন্ত্যমিল থাকে না। মুক্তক হল গদ্যমুখী পদ্য। আর গদ্যকবিতা হল পদ্যমুখী গদ্য। গদ্যকবিতায় পর্ব হয় অসমমাত্ৰক, মুক্তকে তা হয় না।

মুক্তবন্ধ/মুক্তক যে গতানুগতিক ছন্দবন্ধের মুক্তি তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সম্পূর্ণ মুক্তি কি না তাতে সংশয় আছে। আসলে কবিতার প্রাণ ও প্রধান উপাদান হল ছন্দ। যতিমাত্রার বন্ধনকে অস্বীকার করার উপায় কোথায়? বাহ্যিক কিছু গৌণ-বন্ধনের শিথিলতা আসলেও, মুক্তকে কিন্তু যতি মাত্রা ও ভাবের বন্ধনকে অস্বীকার করা হয়নি। চরণ গঠন, স্তবক নির্মাণ, পর্ব-বিন্যাস, অন্ত্য-মিল প্রভৃতি ক্ষেত্রে কবিরা যথেষ্ট স্বাধীনতা দেখিয়েছেন। তাই মুক্তক বা বলাকার ছন্দকে অনেকে বাংলা কবিতার মুক্তির সোপান বলে অভিহিত করেছেন।

মুক্তকের কিছু দৃষ্টান্ত

১) দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া

কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া

অবনী বাড়ি আছো?

বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস

এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে

পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস

দুয়ার চেপে ধরে

অবনী বাড়ি আছো?

(শক্তি চট্টোপাধ্যায়)

২) হে মধু বংশীর গলি,

তোমাকেই আমি বলি

রৌদ্রস্নাত খাটুনির পর সমস্ত দিন

মেরুদণ্ডহীন মানুষগুলিকে সম্মান করে,

ঘৃণা করে আর হিংসা করে,

নগ্ন নগণ্য সন্ধ্যাকে পাই।

তোড়া বাঁধা শ্মশানে পাঠাবার ফুল—

একটা অন্যায় শৌখিনতায় মন হারায় কুল,

ঘ্রাণ নিই প্রাণ ভরে।

হলদে আকাশ থেকে কার আশীর্বাদ যেন ঝরে পড়ে।

(জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র)

৩) মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর

পোড়া বাড়িটার

ঐ ভাঙা দরজাটা

মেলাবেন।

পাগল ঝাপটে দেবে না গায়েতে কাঁটা।

আকালে আগুনে তৃষ্ণায় মাঠ ফাটা।

মারী কুকুরের জিভ দিয়ে খেত চাটা,—

বন্যার জল, তবু ঝরে জল,

প্রলয় কাঁদনে ভাসে ধরাতল—

মেলাবেন

(অমিয় চক্রবর্তী)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!