গদ্যকবিতা কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্যগুলি উদাহরণসহ আলোচনা কর।
গদ্যকবিতা
গদ্যকবিতা জন্মগত ভাবেই মুক্ত কবিতা। গদ্যের বৈশিষ্ট্য হল সে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাবিহারী, বৈচিত্র্যময় ও সর্বত্রগামী; অন্যদিকে কবিতা ছন্দবন্ধনেও মুক্ত বিহঙ্গ। গদ্যকবিতা তার স্বেচ্ছাবিহারে ছন্দ-ঝংকারময়। গদ্য চলে খুশির মেজাজে, পদ্য নুপুর নিক্কনে দোলা জাগিয়ে। গদ্যকবিতায় এ দুয়ের হরগৌরী মিলন যেন গতির মেখলায় ছন্দের আলিম্পন।
রবীন্দ্রনাথ কবিগুরু। তাঁকে ছন্দ-গুরু বললেও অত্যুক্তি হয় না। গদ-ছন্দের তিনিই স্রষ্টা, শ্রেষ্ঠও তিনিই। তাঁর গদ্য-কবিতা যেন “রূপের পাত্রে অরূপ মধুপান।” গদ্যের পাত্রে পদ্যের সুর-সাধনা। তাঁর কথায়—
- “গদ্যকে কাব্যের প্রবর্তনায় শিল্পিত করা যায়। তখন সেই কাব্যের গতিতে এমন কিছু প্রকাশ পায়, যা গদ্যের প্রাত্যহিক ব্যবহারের অতীত। গদ্য বলেই এর ভিতর অতি মাধুর্য বা অতি-মাদকতা থাকতে পারে না। কোমলে-কঠিন মিলে একটা সংযত রীতির আপনা-আপনি উদ্ভব হয়।”
- অসংকুচিত গদ্যরীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব এই আমার বিশ্বাস।
- গদ্যরচনায় যেখানে রসের আবির্ভাব, সেখানে ছন্দ অতি নির্দিষ্ট রূপ নেয় না, কেবল তার মধ্যে থেকে যায় ছন্দের গতিলীলা।”
- “এর মধ্যে ছন্দ নেই বললে অত্যুক্তি হবে, ছন্দ আছে বললেও সেটাকে বলব স্পর্ধা।”
- “গদ্যকাব্যেরও সেই দশা। সে নাচে না, সে চলে। সে সহজে চলে বলে তার গতি সর্বত্র। সেই গতিভঙ্গি আবাঁধা।”
- “রূপ রসাত্মক পদ্য, অর্থ ভারবহ গদ্য নয়, তেজস গদ্য।”
- বৃহতের ভার অনায়াসে বহন করার শক্তি গদ্যছন্দের মধ্যে আছে। ও যেন বনস্পতির মত, তার পল্লব পুঞ্জের ছন্দোবিন্যাস কাটাছটা সাজানো নয়, অসম তার স্তবকগুলি তাতেই তার গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য।”
- “সাধারণ গদ্যের সঙ্গে তার প্রভেদ নেই, তবু ভাবের দিক থেকে কাব্য না বলে থাকবার জো নেই। …এই প্রচ্ছন্ন আবেগের ব্যঞ্জনা, এই তো কাব্য, এর মধ্যে ভাব বিন্যাসের শিল্প আছে, তাকেই বলব ভাবের ছন্দ।”
- “গদ্যে পদ্যের রঙ ধরানো”—ছন্দ হল গদ্যকবিতা।
গদ্যকবিতার বৈশিষ্ট্য
রবীন্দ্র ব্যাখ্যার অনুসরণে গদ্য কবিতার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করা যেতে পারে—
- গদ্যছন্দ ভাবছন্দ। সেজন্য ভাবানুযায়ী পর্ব-বিন্যাস হয়, ফলে বিশেষ কোন রীতির পর্ব বিন্যাস রীতি প্রযোজ্য নয়। কিন্তু ধ্বনিগত পরিমিতি থাকে। এই ছন্দে বিশেষ ছন্দ রীতির সন্ধান পাওয়া যায় না।
- সাধারণ ছন্দের মত প্রত্যাশিত মাত্রা সম্মিতি থাকে না, কিন্তু ছন্দ-স্পন্দন থাকে।
- কথ্যরীতির বা ভঙ্গিমাকে অনুসরণ করে গড়ে ওঠে। ফলে মৌখিক ও চলিত শব্দের স্বচ্ছন্দ অবস্থান লক্ষিত হয়।
- গদ্যের মত অর্থ-যতির ব্যবহার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
- গাম্ভীর্য সৃষ্টির জন্য সমাসবদ্ধ পদ, যুক্তবর্ণ সমৃদ্ধ দীর্ঘায়তন শব্দের ব্যবহার হয়।
- গদ্যকবিতা মিত্রাক্ষর বিহীন। চরণান্তিক মিল প্রত্যাশিত নয়।
- গদ্যকবিতায় প্রধান লক্ষণ এর বিষম পর্ব সন্নিবেশ। সাধারণ ছন্দে থাকে ‘পর্বসম্মিতি’, মুক্তকে থাকে— ‘পর্ব-সংগতি’, আর গদ্য কবিতায় থাকে ‘পর্ব-বৈচিত্র্য’। ফলে একই চরণে পর্বের মাত্রা যুগপৎ জোড়-বিজোড় উভয়ই হতে পারে।
- গদ্যকবিতার ভিত্তি অক্ষরবৃত্ত/মিশ্রবৃত্ত। প্রতিটি মুক্তদলে একমাত্রা, পদের আদিতে ও মধ্যে রুদ্ধদল একমাত্রা এবং পদান্তে রুদ্ধদল সর্বত্র দুমাত্রা ধরা হয়।
- গদ্য কবিতা ধীর লয় যুক্ত কবিতা।
- গঠন গদ্যধর্মী হলেও সজ্জিত হবে কবিতার চরণ রূপে।
- অর্থানুযায়ী পর্ব বিন্যাস করা হয়।
- একই শব্দ বা পর্ব বারবার ব্যবহার করে ছন্দের ধ্বনি-সৌন্দর্য রক্ষার চেষ্টা হয়।
রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’য় প্রথম গদ্য ছন্দের আভাস মিলেছিল। পরে ‘পুনশ্চ’-তে তার পরিপূর্ণ প্রকাশ। রবীন্দ্র প্রদত্ত নাম ‘গদ্যিকা’। লিপিকার রীতি সম্বন্ধে নিজেই বলেছেন— “ছাপবার সময় বাক্যগুলিকে পদ্যের মত খণ্ডিত করা হয়নি, বোধ করি ভীরুতাই তার কারণ।’’ কিন্তু পুনশ্চের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন— ‘‘অসংকুচিত গদ্য রীতিতে কাব্যের অধিকারকে অনেক দূর বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব এই আমার বিশ্বাস এবং সেই দিকে লক্ষ রেখে এই গ্রন্থে প্রকাশিত কবিতাগুলি লিখেছি। এর মধ্যে কয়েকটি কবিতা আছে, তাতে মিল নেই, পদ্য ছন্দ আছে, কিন্তু পদ্যের বিশেষ ভাষা রীতি ত্যাগ করবার চেষ্টা করেছি।” গদ্য কবিতার স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক—
(ক) আমারই চেতনার রঙে। পান্না হল সবুজ, ১০+৭
চুনি উঠল । রাঙা হয়ে। ৪+৪
আমি চোখ মেললুম। আকাশে ৭+৩
জ্বলে উঠল আলো ৬
পূবে-পশ্চিমে। ৫
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম। ‘সুন্দর’— ৬+৫+৩
সুন্দর হল সে। ৬
(আমি, রবীন্দ্রনাথ)
(খ) পড়তে ওর | মন লাগে না । কিছুতেই ৪+৫+৪
এমন নিরেট বুদ্ধি।
পাতাগুলো । দুষ্টুমি করে। কেটে রেখে দেয় ৪+৫+৬
বলে, । ইঁদুরে কেটেছে ২+৬
এতবড় বাঁদর। ৭
(ছেলেটা, রবীন্দ্রনাথ)
আধুনিক কবিদের কবিতা থেকে কিছু দৃষ্টান্ত
(ক) অনেকক্ষণ। বৃষ্টি থেমে গেছে
বৃষ্টি থেমে গেছে। অনেকক্ষণ
ফুটো চাল থেকে আর | জল গড়িয়ে পড়বে না
খোকাকে | শুইয়ে দাও।
(পরান মাঝি হাঁক দিয়েছে, রামবসু)
(খ) এই তো । জানু পেতে বসেছি, । পশ্চিম
আজ। বসন্তের শূন্য হাত
ধ্বংস করে দাও আমাকে | যদি চাও
আমার সন্ততি। স্বপ্নে থাক।
কোথায় গেল ওর। স্বচ্ছ যৌবন
কোথায় কুরে খায়। গোপন ক্ষয়।
চোখের কোণে এই। সমূহ পরাভব
বিষায় ফুসফুস | ধমনী শিরা!
(বাবরের প্রার্থনা, শংখ ঘোষ)
Leave a Reply