//
//

বাংলা ছন্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান আলোচনা কর।

বাংলা ছন্দে রবীন্দ্রনাথের অবদান

চির নতুনের কবি রবীন্দ্রনাথ। জীবনে ও মননে, চিন্তনে ও কল্পনায়, গদ্যেও  বারবার নিজেকে তিনি নটরাজের মত ভেঙ্গেছেন গড়েছেন— নতুন সৃষ্টিতে আপনার আনন্দে আপনি বিভোর হয়েছেন। বাংলা ছন্দে পালা বদলের পালা রচনা করেছিলেন মধুসদন রবীন্দ্রনাথে এসে সেই ‘পালা’ মহাসঙ্গীত’ হয়ে উঠল প্রবল ও বিপুল সৃষ্টির উচ্ছ্বাসে।

রবীন্দ্র কবিচিত্তের রোমান্টিক ভাবোচ্ছ্বাসের ‘অধরা-মাধুরী’—এবার ধরা পড়ল নব ‘ছন্দ-বন্ধনে’। কাব্যের রীতি প্রকৃতির গতানুগতিক অনুসরণ নয়, তাঁর কবিতা হয়ে উঠল প্রকৃত ‘ধ্বনির শিল্প’। এই ধ্বনি যেমন একদিকে ছন্দ-স্পন্দন-ধ্বনি, অন্যদিকে ‘রসধ্বনি’। ভাবের প্রকাশরূপে রবীন্দ্র-ছন্দ নব ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করল। তাঁর ছন্দের বৈশিষ্ট্য তাঁরই ভাষায়—

মানবের জীর্ণ বাক্যে মোর ছন্দ দিবে নব সুর,

অর্থের বন্ধন হ’তে নিয়ে তারে যাবে কিছুদূর

ভাবের স্বাধীন লোকে।

রবীন্দ্রনাথ জানতেন ছন্দ কেবল রূপ-রীতি নয়, তা “রূপের পাত্রে অরূপ মধুপান”– এর মাধ্যমে। ছন্দের মায়া কাব্যবাণীর ব্যঞ্জনা ও মাধুর্যকে অনায়াসে রসিক চিত্তে সঞ্চারিত করে। রবীন্দ্রনাথ ছন্দের সেই মায়া শক্তিকে আয়ত্ত করেছিলেন স্বভাব-বৈশিষ্ট্যে। “ছন্দ রবীন্দ্রকাব্যের বাহনমাত্র নয়, কাব্যের আত্মার মূর্ত প্রকাশ, কবির উপলব্ধির প্রতীক” (অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়)। রবীন্দ্রনাথ কাব্যে ছন্দের অপরিহার্যতা ও তাৎপর্য বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন—“আমরা কথায় বলে থাকি, কথাকে ছন্দে বাঁধা। কিন্তু এ কেবল বাহিরে বন্ধন, অন্তরে মুক্তি। কথাকে তার জড়ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার জন্যই ছন্দ। সেতারের তার বাঁধা থাকে বটে, কিন্তু তার থেকে সুর পায় ছাড়া। ছন্দ হচ্ছে সেই তার বাঁধা সেতার। কথার অন্তরের সুরকে সে ছাড়া দিতে থাকে।”

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবি-দৃষ্টির অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা থেকে আধুনিক বাংলায় ছন্দ সম্পর্কে সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করেছেন। কবি দেখেছেন বাংলার প্রচলিত ছন্দ-রীতি নব যুগের ভাবের পূর্ণ বাহন হতে পারছে না। তাই নতুন ধ্বনিস্পন্দন ও রীতি সৃষ্টির মাধ্যমে ছন্দের পরিসরকে তিনি বিস্তৃত করলেন। বাংলা ছন্দ যে একধরনের ধ্বনি শিল্প’ একথা তিনিই প্রথম বললেন। শুধু তাই নয়, ভাব ও রূপ, কথা ও ধ্বনি, সুর ও ছন্দের মধ্যে যে পাবত। পরমেশ্বর সম্বন্ধ সে কথা প্রথম বলেছিলেন তিনি—

সুর আপনারে ধরা দিতে চাহে ছন্দে,

ছন্দ ফিরিয়া ছুটে যেতে চায় সুরে।

ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ

রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া।

বাংলা ছন্দ বিষয়ে তাঁর অধিকার অসপত্ন ও অবিতর্কিত। ছন্দ বিষয়ে তাঁর কয়েক সিদ্ধান্তের পরিচয় নেওয়া যাক—

(ক) “ছন্দের তত্ত্ববিচারে ভাষার অন্তর্নিহিত ধ্বনিপ্রকৃতির বিচার-অত্যাবশ্যক।”

(খ) “বাংলা ছন্দের তিনটি শাখা। একটি আছে পুঁথিগত কৃত্রিম ভাষাকে অবলম্বন করে, সে ভাষায় বাংলার স্বাভাবিক ধ্বনিরূপকে স্বীকার করেনি। আর একটি সচল বাংলার ভাষাকে নিয়ে, এই ভাষা বাংলার হসন্ত শব্দের ধ্বনিকে আপন বলে গ্রহণ করেছে। আর একটি ছন্দের উদগম হয়েছে সংস্কৃত ছন্দকে বাংলায় ভেঙে নিয়ে।” (বাংলা ছন্দের প্রকৃতি ছন্দ) এই তিনজাতীয় ছন্দেই তিনি নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন।

(১) স্বরবৃত্ত/দলবৃত্ত লৌকিক ছড়ার ছন্দ বলেই পরিচিত। এই ছন্দটিকে তিনি গুরুগম্ভীর কবিতার ক্ষেত্রেও অনায়াসে ব্যবহার করেছেন। ‘মুক্তক’ ও ‘গদ্যকবিতা’র মধ্যেও স্বরবৃত্তের সার্থক ব্যবহার করেছেন তিনি—

(ক) কৃষ্ণকলি। আমি তারেই। বলি। ৪+৪+২

কালো তারে। বলে গাঁয়ের। লোক ৪+৪+২

(খ) এতদিনে। প্রথম যেন। বাজে ৪+৪+২

বিয়ের বাঁশি । বিশ্ব আকাশ। মাঝে। ৪+৪+২

তুচ্ছ বাইশ। বছর আমার । ৪+৪

ঘরের কোণের | ধূলায় পড়ে । থাক্। ৪+৪+১

(দলবৃত্ত রীতির মুক্তক)

(২) অক্ষরবৃত্তের আট-ছয় মাত্রার হেরফের ঘটিয়ে নতুন রীতির কাব্য রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। “অক্ষরের সংখ্যা গণনা করে ছন্দের ধ্বনি মাত্রা গণনা বাংলায় চলে না।” বাংলা কবিতার ছন্দের ক্ষেত্রে ধ্বনির গুরুত্ব তিনি জানতেন। তাই অক্ষরবৃত্তের আধারে পয়ার জাতীয় ছন্দের নানা রূপ-বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন তিনি। এর মধ্যে প্রবহমানতার বেগ সঞ্চার করে, যতি চিহ্নের স্বেচ্ছাধীন প্রয়োগ করে নানা রূপ সৃষ্টি করলেন, মিল ও অমিল পয়ার ও মহাপয়ার, প্রবহমান পয়ার ও প্রবহমান মহাপয়ার।

(৩) মধুসূদনের অমিত্রাক্ষরকে নতুন রূপ দিয়েছেন মিত্রাক্ষর ছন্দ নির্মাণের মাধ্যমে।

(৪) মধুসূদন সৃষ্টি করলেন বাংলা সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার ছন্দ। যার ভিত্তি ১৪ মাত্রা। রবীন্দ্রনাথ তাকে ১৬ বা ১৮ মাত্রার সনেটে পরিণত করলেন। স্বভাবতঃ অষ্টক-ষটকের বন্ধনও তিনি মানলেন না। ভাবের আকাশে সনেটের নবরূপ ঘটল। ‘কড়ি ও কোমল’, ‘মানসী’, ‘নৈবেদ্য’, ‘উৎসর্গ’, ‘স্মরণ’, ‘পরিশেষ’ প্রভৃতি কাব্যে তার রূপবন্ধ ছড়িয়ে আছে।

(৫) মাত্রাবৃত্ত তাঁর কাছে ‘সংস্কৃত ভাঙা ছন্দ’। তিনি এই ছন্দে দীর্ঘস্বরকে একমাত্রা ও রুদ্ধদলকে দু-মাত্রার ধরে নতুন রূপ দিলেন। ফলে ধ্বনির স্পন্দনে ছন্দ সুষমিত হলো। মুক্তক ও গদ্য কবিতাতেও মাত্রাবৃত্তের সার্থক ব্যবহার করেছেন তিনি।

(৬) চর্যাপদ ও ব্রজবুলি রচিত অধিকাংশ পদ প্রত্ন-মাত্রাবৃত্তে রচিত। কিন্তু আধুনিক কবিতা ও গানেও রবীন্দ্রনাথ তার সার্থক প্রয়োগ দেখিয়েছেন। ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘জনগণমন অধিনায়ক’, ইত্যাদি কবিতা ও গান এই রীতিতে রচিত।

(৭) বাংলা কবিতায় মধুসূদনের পর রবীন্দ্রনাথই প্রকৃতপক্ষে ‘বেড়া ভাঙলেন’। মুক্তক ও গদ্যকবিতার ছন্দে ভাবের মুক্তি ঘটালেন তিনি। ভাবের বাহন কবিতা এবং কাজের বাহন গদ্যের মিলন ঘটিয়ে তিনি নবযুগের প্রাণময় কাব্য ধারাকে মহাসমুদ্রের সন্ধান দিলেন। মুক্তক ও গদ্যছন্দ বাংলা কবিতার মুক্তি ঘটালো। তাঁর ‘গদিকা’ সম্বন্ধে তাঁর ভাষ্য—“এমন মেয়ে দেখা যায় যার সহজ চলনের মধ্যেই বিনা ছন্দের ছন্দ আছে।…সে মেয়ের চলনটাই কাব্য, তাতে নাচের তাল নাই বা লাগল, তার সঙ্গে মৃদঙ্গের বােল দিতে গেলে বিপত্তি ঘটবে।…গদ্যকাব্যেরও সেই দশা। সে নাচে না। সে চলে। সে সহজে চলে বলেই তার গতি সর্বত্র। সেই গতি আবাঁধা।” তিনি আরো বললেন—“বৃহতের ভার অনায়াসে বহন করার শক্তি গদ্যছন্দের মধ্যে আছে।”

রবীন্দ্রনাথের ছন্দ ভাবনা সম্বন্ধে আচার্য প্রবোধচন্দ্র সেনের মূল্যায়ন স্মরণ করে এ প্রসঙ্গ সমাপ্ত করা যায়। তিনি রবীন্দ্র সিদ্ধান্তগুলিকে ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে লিখেছেন— তিনি (রবীন্দ্রনাথ) যে অভিমত প্রকাশ করে গেছেন তার ঐতিহাসিক মূল্য কম নয়। যেমন—

(১) বাংলা ছন্দের আলােচনায় ‘অক্ষর সংখ্যা গণনার অনাবশ্যকতা।

(২) সাধু রীতির ছন্দে শব্দাত্য রুদ্ধদলের দীর্ঘ অর্থাৎ দ্বিমাত্রিক উচ্চারণ।

(৩) সাবেক সাধু ছন্দের বিশ্লেষণে সিলে এর (মাত্রা’-র) ভূমিকা এবং এ জাতীয় ছন্দের মিশ্র প্রকৃতি স্বীকারের প্রয়োজনীয়তা।

(৪) প্রাকৃত লৌকিক ছন্দের সিলেবল্ গোনা (মাত্রা গোনা) প্রকৃতি স্বীকার।

(৫) তিন রীতি ভেদে ত্রিবিধ পয়ারের পরোক্ষ স্বীকৃতি।

(৬) আধা যতি, পুরো যতি, পঙক্তি প্রভৃতি কোনো কোনো পারিভাষিক শব্দের নির্দিষ্টার্থক প্রয়োগ।”

বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথ কবি, তিনি ভাবের রূপ নির্মাণ করেছেন নিজের খেয়ালে। ছন্দ বন্ধন তাঁর কাছে সৌন্দর্য সৃষ্টির মাধ্যম মাত্র ছিল, তা অপরিহার্য কাঠামো বলে কখনোই মনে হয়নি। ছন্দ নিয়ে সংস্কার তাঁর ছিল না। তাই যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হলেই ছন্দের বেড়া ভাঙতে দ্বিধা করেননি। তার সেই কবিজনোচিত চেষ্টায় ছন্দের চলার গতি প্রাণবন্ত হয়েছে।

ছন্দ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ

(১) “কথা যখন খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তখন সে কেবলমাত্র আপন অর্থটুকু নিবেদন করে। যখন তাকে ছন্দের আঘাতে নাড়া দেওয়া যায় তখন তার কাছ থেকে অর্থের বেশি আরো কিছু বেরিয়ে পড়ে। সেটা জানার জিনিস নয়, বেদনার জিনিস। সেটাতে পদার্থের পরিচয় নয়, রসের সম্ভোগ।

আবেগকে প্রকাশ করতে গেলে কথার মধ্যে আবেগের ধর্ম সঞ্চার করতে হয়। আবেগের ধর্ম হচ্ছে বেগ; সে চলে, চালায়। কথা যখন সেই বেগ গ্রহণ করে তখন স্পন্দিত হৃদয়ভাবের সঙ্গে তার সাধ্য ঘটে।

চলতি ভাষায় আমরা বলি কথাকে ছন্দে বাঁধা। বাঁধা বটে, কিন্তু সে বাঁধন বাইরে, রূপের দিকে; ভাবের দিকে মুক্তি। যেমন সেতারে তার বাঁধা, তার থেকে সুর পায় ছাড়া। ছন্দ সেই সেতারের বাঁধা তার, সুরের বেগ কথাকে অন্তরে দেয় মুক্তি।

উপনিষদে আছে, আত্মার লক্ষ্য ব্রহ্ম, ওঙ্কারের ধ্বনিবেগ তাকে ধনুর মত লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দেয়। এতে বলা হচ্ছে, বাক্যের দ্বারা যুক্তির দ্বারা ব্রহ্মা জানবার বিষয় নন, তিনি আত্মার সঙ্গে একাত্ম হবার বিষয়। এই উপলব্ধিতে ধ্বনিই সহায়তা করে, শব্দার্থ করে না।

জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় উভয়ের মধ্যে মোকাবিলা হয় মাত্র; অর্থাৎ সান্নিধ্য হয়, সাযুজ্য হয় না। কিন্তু, এমন-সকল বিষয় আছে যাকে জানার দ্বারা পাওয়া যায় না, যাকে আত্মস্থ করতে হয়। আম বস্তুটাকে সামনে রেখে জানা চলে, কিন্তু তার রসটাকে আত্মগত করতে না পারলে বুদ্ধিমূলক কোনো প্রণালীতে তাকে জানবার উপায় নেই। রসসাহিত্য মুখ্যত জ্ঞানের জিনিস নয়, তা মর্মের বেগবান। তাই, সেখানে কেবল অর্থ যথেষ্ট নয়, সেখানে ধ্বনির প্রয়োজন; কেননা ধ্বনি বেগবান। ছন্দের বন্ধনে এই ধ্বনিবেগ পায় বিশিষ্টতা, পায় প্রবলতা। নিত্য ব্যবহারের ভাষাকে ব্যাকরণের নিয়মজাল দিয়ে বাঁধতে হয়। রস প্রকাশের ভাষাকে বাঁধতে হয় ধ্বনি সংগতের নিয়মে।

(২) “ছন্দর সঙ্গে অছন্দর তফাৎ এই যে, কথা একটাতে চলে, আর-একটাতে শুধু বলে কিন্তু চলে না। যে চলে সে কখনো খেলে, কখনো নাচে, কখনো লড়াই করে, হাসে কালে; যে স্থির বসে থাকে সে আপিস চালায়, তর্ক করে, বিচার করে, হিসাব দেখে, দল পাকায়। ব্যবসায়ীর শুষ্ক প্রবীণতা ছন্দোহীন বাক্যে, অব্যবসায়ীর সরস চঞ্চল প্রাণের বেগ ছন্দোময় ছবিতে কাব্যে গানে।”

(৩) “গদ্যে প্রধানত অর্থবান শব্দকে বৃহবদ্ধ করে কাজে লাগাই, পদ্যে প্রধানত ধ্বনিমান শব্দকে বৃহবদ্ধ করে সাজিয়ে তোলা হয়।”

(৪) “ছন্দকে কেবল আমরা ভাষায় বা রেখায় স্বীকার করলে সব কথা বলা হয় না। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ছন্দ আছে ভাবের বিন্যাসে, সে কানে শোনবার নয়, মনে অনুভব করবার। ভাবকে এমন করে সাজানো যায় যাতে সে কেবলমাত্র অর্থবোধ ঘটায় না, প্রাণ পেয়ে ওঠে আমাদের অন্তরে। বাছাই করে সুবিন্যস্ত সুবিভক্ত করে ভাবের শিল্প রচনা করা যায়। বর্জন গ্রহণ সজ্জীকরণের বিশেষ প্রণালীতে ভাবের প্রকাশে সঞ্চারিত হয় চলৎশক্তি। যেহেতু সাহিত্যে ভাবের বাহন ভাষা, সেই কারণে সাহিত্যে যে ছন্দ আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ সে ছন্দ ভাষার সঙ্গে জড়িত। তাই, অনেক সময়ে এ কথাটা ভুলে যাই যে, ভাবের ছন্দই তাকে অতিক্রম করে আমাদের মনকে বিচলিত করে। সেই ছন্দ ভাবের সংযমে, তার বিন্যাস নৈপুণ্যে।”

(৫) “জ্ঞানের বিষয়কে প্রাঞ্জল ও যথার্থ করে ব্যক্ত করতে হলেও প্রকাশের উপাদানকে আঁট করে তাকে ঠিকমত শ্রেণিবদ্ধ করা চাই। সে তাকে প্রাণের বেগ দেবার জন্যে নয়, তাকে প্রকৃষ্ট অর্থ দেবার জন্যেই।

(৬) “গদ্যসাহিত্যের আরম্ভ থেকেই তার মধ্যে মধ্যে প্রবেশ করেছে ছন্দের অন্তঃশীলা ধারা। রস যেখানেই চঞ্চল হয়েছে, রস যেখানেই চেয়েছে রূপ নিতে, সেখানেই শব্দগুচ্ছ স্বতই সজ্জিত হয়ে উঠেছে। ভাবরসপ্রধান গদ্য-আবৃত্তির মধ্যে সুর লাগে অথচ তাকে রাগিণী বলা চলে না, তাতে তালমানসুরের আভাসমাত্র আছে। তেমনি গদ্যরচনায় যেখানে রসের আবির্ভাব সেখানে ছন্দ অতিনিৰ্দিষ্ট রূপ নেয় না, কেবল তার মধ্যে থেকে যায় ছন্দের গতিলীলা।”

(৭) “পদ্যছন্দের প্রধান লক্ষণ পঙক্তিসীমানায় বিভক্ত তার কাঠামো। নির্দিষ্টসংখ্যক ধ্বনিগুচ্ছে এক-একটি পঙক্তি সম্পূর্ণ। সেই পঙক্তিশেষে একটি করে বড়ো যতি। বলা। বাহুল্য, গদ্যে এই নিয়মের শাসন নেই। গদ্যে বাক্য যেখানে আপন অর্থ সম্পূর্ণ করে। সেইখানেই তার দাঁড়াবার জায়গা। পদ্যছন্দ যেখানে আপন ধ্বনিসংগতকে অপেক্ষাকৃত বড়ো রকমের সমাপ্তি দেয়, অর্থনির্বিচারে সেইখানে পঙক্তি শেষ করে। গদ্য সব-প্রথমে এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে অমিত্রাক্ষর ছন্দে, পঙক্তির বাইরে পদচারণা শুরু করলে। আধুনিক পদ্যে এই স্বৈরাচার দেখা দিল পয়ারকে আশ্রয় করে।”

(৮) “একদিন পুরুষও অফিস যেত পালকিতে, মেয়েরাও সেই উপায়ে যেত শ্বশুরবাড়িতে। এখন রেলগাড়ির প্রভাবে উভয়েই একত্রে একই রথে জায়গা পায়। আজকাল গদ্যের অপরিহার্য প্রভাবের দিনে ক্ষণে ক্ষণে দেখা যাবে কাব্যও আপন গতিবিধিব জন্যে বাঁধাছন্দের ময়ুর পঙ্খীটাকে অত্যাবশ্যক বলে গণ্য করবে না। পূর্বেই বলেছি, অমিত্রাক্ষর ছন্দে সব-প্রথমে পালকির দরজা গেছে খুলে, তার ঘেরাটোপ হয়েছে বর্জিত। তবুও পর যখন পঙক্তির বেড়া ডিঙিয়ে চলতে শুরু করেছিল তখনো সাবেকি চালের পরিশেরূপে গণ্ডির চিহ্ন পূর্বনির্দিষ্ট স্থানে রয়ে গেছে। ঠিক যেন পুরানো বাড়ির অন্দরমহল; তার দেয়ালগুলো সরানো হয়নি, কিন্তু আধুনিককালের মেয়েরা তাকে অস্বীকার করে অনায়াসে সদরে যাতায়াত করছে। অবশেষে হাল-আমলের তৈরি ইমারতে সেই দেওয়ালগুলো ভাঙা শুরু হয়েছে। চোদ্দ অক্ষরের গণ্ডিভাঙা পয়ার একদিন ‘মানসী’র এক কবিতায় লিখেছিলেম, তার নাম ‘নিষ্ফল প্রয়াস’ (নিষ্ফল কামনা)। অবশেষে আরো অনেকবছর পরে বেড়াভাঙা পয়ার দেখা দিতে লাগল ‘বলাকা’য় ‘পলাতকা’য়। এতে করে কাব্যছন্দ গদ্যের কতকটা কাছে এল বটে, তবু মেয়ে কম্পার্টমেন্ট রয়ে গেল, পুরাতন ছন্দোরীতির বাঁধন খুলল না।”

(৯) ‘পুনশ্চ’র কবিতাগুলোকে কোন সংজ্ঞা দেবে। পদ্য নয়, কারণ পদ নেই। গদ্য বললে, অতিব্যাপ্তি দোষ ঘটে। পক্ষিরাজ ঘোড়াকে পাখি বলবে না ঘোড়া বলবে? গদ্যের পাখা উঠেছে একথা যদি বলি, তবে শত্রুপক্ষ বলে বসবে, পিপিড়ার পাখা ওঠে মরিবার তরে। জলে স্থলে যে সাহিত্য বিভক্ত, সেই সাহিত্যে এ জিনিষটা জল নয়, তাই বলে মাটিও নয়। তা হলে খনিজ বলতে দোষ আছে কি। সোনা বলতে পারি এমন অহংকার যদি বা মনে থাকে মুখে বলবার সাহস নেই। না হয় তাবাই হল। অর্থাৎ এমন কোনো ধাতু যাতে মূর্তি গড়ার কাজ চলে। গদাধরের মূর্তিও হতে পারে, তিলোত্তমারও হয়। অর্থাৎ, রূপরসাত্মক গদ্য, অর্থভারবহ গদ্য নয়। তৈজস গদ্য।

সংজ্ঞা পরে হবে, আপাতত প্রশ্ন এই-ওতে চেহারা গড়ে উঠেছে কিনা। যদি উঠে থাকে তাহলেই হল।”

(১০) “কাব্যকে বেড়াভাঙা গদ্যের ক্ষেত্রে স্ত্রীস্বাধীনতা দেওয়া যায় যদি, তাহলে সাহিত্য সংসারের আলংকারিক অংশটা হালকা হয়ে তার বৈচিত্র্যের দিক তার চরিত্রের দিক অনেকটা খোলা জায়গা পায়। কাব্য জোরে পা ফেলে চলতে পারে। সেটা সযত্নে নেচে চলার চেয়ে সব সময়ে যে নিন্দনীয় তা নয়। নাচের আসরের বাইরে আছে এই উচুনিচু বিচিত্র বৃহৎ জগৎ, রূঢ় অথচ মনোহর, সেখানে জোরে চলাটাই মানায় ভালো, কখনো ঘাসের উপর, কখনো কাঁকরের উপর দিয়ে।”

(১১) “গদ্যের চালটা পথের চলার চাল, পদ্যের চাল নাচের। এই নাচের গতির প্রত্যেক অংশের মধ্যে সুসংগতি থাকা চাই। যদি কোনো গতির মধ্যে নাচের ধরনটা থাকে অথচ সুসংগতি না থাকে তবে সেটা চলাও হবে না, হবে খোড়ার চাল আর লম্ফঝম্ফ। কোনো ছন্দে বাঁধন বেশি, কোনো ছন্দে বাঁধন কম; তবু ছন্দমাত্রের অন্তরে একটা ওজন আছে। সেটার অভাব ঘটলে যে টলমলে ব্যাপার দাঁড়ায় তাকে বলা যেতে পারে মাতালের চাল, তাতে সুবিধাও নেই, সৌন্দর্য নেই।”

(১২) “গদ্যকে গদ্য বলে স্বীকার করেও তাকে কাব্যের পংক্তিতে বসিয়ে দিলে আচারবিরুদ্ধ হলেও সুবিচারবিরুদ্ধ না হতেও পারে, যদি তাতে কবিত্ব থাকে। ইদানীং দেখছি, গদ্য আর রাশ মানছে না, অনেক সময় দেখি তার পিঠের উপর সেই সওয়ারটিই নেই যার জন্যে তার খাতির। ছন্দের বাঁধা সীমা যেখানে লুপ্ত সেখানে সংযত সীমা যে কোথায় সে তো আইনের দোহাই দিয়ে বোঝবার জো নেই। মনে মনে ঠিক করে রেখেছি, স্বাধীনতার ভিতর দিয়েই বাঁধন ছাড়ার বিধান আপনি গড়েই উঠবে-এর মধ্যে আমার অভিরুচিকে আমি প্রাধান্য দিতে চাইনে। নানারকম পরীক্ষার ভিতর দিয়ে অভিজ্ঞতা গড়ে উঠেছে। সমস্ত বৈচিত্র্যের মধ্যে একটা আদর্শ ক্রমে দাঁড়িয়ে যাবে। আধুনিক ইংরাজি কাব্যসাহিত্যে এই পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে।”

(১৩) “পয়ার ছন্দের বিশেষ গুণ এই যে, তার বুননানি ঠাসবুনোনি নয়, তাকে বাড়ানো কমানো যায়। সুর করে টেনে টেনে পড়বার সময় কেউ যদি যতির যোগে পয়ারের প্রথম ভাগে দশ ও শেষ ভাগে আট মাত্রা পড়ে তবু পয়ারের প্রকৃতি বজায় থাকে। যেমন—

মহাভারতের কথা ০ ০ | অমৃতসমান ০ ০।

কাশীরাম দাস ভনে ০ ০ | শুনে পুণ্যবান ০ ০।

অথবা

মহা ০ ০ ভারতের কথা ০ ০ | অমৃত ০ ০ সমা ০ ০ ন।

কাশীরা ০ ০ মদাস ভনে ০ ০ | শুনে ০ ০ পুণ্যবা ০ ০ ন।

পয়ার ছন্দ স্থিতিস্থাপক বলেই এটা সম্ভব, আর সেই গুণেই বাংলা কাব্যসাহিত্যকে সে এমন করে অধিকার করেছে।”

(১৪) গদ্য বলতে বুঝি যে ভাষা আলাপ করবার ভাষা; ছন্দোবদ্ধ পদে বিভক্ত যে ভাষা তাই পদ্য। আর, রসাত্মক বাক্যকেই আলংকারিক পণ্ডিত কাব্য সংজ্ঞা দিয়েছেন। এই রসাত্মক বাক্য পদ্যে বললে সেটা হবে পদ্যকাব্য আর গদ্যে বললে হবে গদ্যকাব্য। গদ্যেও অকাব্য ও কুকাব্য হতে পারে, পদ্যেও তথৈবচ। গদ্যে তার সম্ভাবনা বেশি, কেননা ছন্দেরই একটা স্বকীয় রস আছে—সেই ছন্দকে ত্যাগ করে যে কাব্য, সুন্দরী বিধবার মতো তার অলংকার তার আপন বাণী দেহেই, বাইরে নয়। একথা বলা বাহুল্য যে, গদ্যকাব্যেও একটা আবাঁধা ছন্দ আছে। আন্তরিক প্রবর্তনা থেকে কাব্য সেই ছন্দ চলতে চলতে আপনি উদ্ভাবিত করে, তার ভাগগুলি অসম হয় কিন্তু সবসুদ্ধ জড়িয়ে ভারসামঞ্জস্য থেকে সে ঋলিত হয়। বড়ো ওজনের সংস্কৃত ছন্দে এই আপাত প্রতীয়মান মুক্তগতি দেখতে পাওয়া যায়।

যেমন

মেঘৈর মেদুর। মম্বরং বনভুবঃ । শ্যামাস্তমা লদ্রুমৈঃ।  

এই ছন্দ সমান ভাগ মানে না, কিন্তু সমগ্রের ওজন মেনে চলে। মুখের কথায় আমরা যখন খবর দিই তখন সেটাতে নিশ্বাসের বেগে ঢেউ খেলায় না। যেমন—

তার চেহারাটা মন্দ নয়।

কিন্তু ভাবের আবেগ লাগবা মাত্র আপনি ঝোক এসে পড়ে। যেমন—

কী সুন্দর তার চেহারাটি।

একে ভাগ করলে এই দাঁড়ায়; কী সুন্। দর তার। চেহারাটি।

মরে যাই তোমার বালাই নিয়ে।

এত গুমর সইবে না গো, সইবে না—এই বলে দিলুম।

কথা কয় নি তো কয় নি,

চলে গেছে সামনে দিয়ে,

বুক ফেটে মরব না তাই বলে।

এই সমস্ত প্রতিদিনের চলতি কথার সহজ ছন্দ, গদ্য, কাব্যের গতিবেগে আত্মরচিত মনকে খবর দেবার সময় এ দরকার হয় না, ধাক্কা দেবার সময় আপনি দেখা দেয়, ছান্দসিকের দাগ-কাটা মাপকাঠির অপেক্ষা রাখে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!