//
//

ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ ও ধ্বনি পরিবর্তনের ধারাগুলি আলোচনা কর।

ধ্বনিপরিবর্তন (Sound Change)

ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানের অন্যতম উপজীব্য হল কাল পরম্পরায় ভাষার পরিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণ। ভাষার এই পরিবর্তন হয় তার, দেহে এবং আত্মায়—তার বহিরঙ্গ গঠনে এবং তার অন্তরঙ্গ বক্তব্যে। ভাষার বহিরঙ্গ গঠনের মূল উপাদান হল ভাষার ধ্বনি এবং তার অন্তরঙ্গ বক্তব্য হল তার অর্থ। ভাষার পরিবর্তনের তাই দুটি প্রধান দিক হল— ধ্বনিপরিবর্তন (Sound change) এবং অর্থপরিবর্তন (Semantic change)।

ধ্বনিপরিবর্তনের কারণ

ভৌগোলিক পরিবেশ ও জলবায়ু

বিখ্যাত দার্শনিক বডিন প্রথম অনুমান করেন যে, একটি জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রকৃতি সেই জাতির ভৌগোলিক পরিবেশ ও তার জলবায়ুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই থেকে কোনো কোনো ভাষাতত্ত্ববিদ সিদ্ধান্ত করেন যেখানকার ভূপ্রকৃতি রুক্ষ্ম কঠোর সেখানকার ভাষায় কর্কশতা ও কঠোরতা বেশি এবং যেখানকার ভূপ্রকৃতি বর্ষাস্নিগ্ধ কোমল সেখানকার ভাষায় কোমলতা ও মাধুর্য বেশি। এই কারণে জার্মান ও ইংরেজি ভাষা অপেক্ষাকৃত কর্কশ, আর ফরাসি ও ইতালীয় ভাষা অপেক্ষাকৃত মধুর। কিন্তু প্রত্যেক ভাষার স্বরূপ-স্বাতন্ত্র যে পুরোপুরি ভৌগোলিক প্রকৃতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একথা সর্বক্ষেত্রে অব্যর্থভাবে লক্ষ করা যায় না। বর্ষাগ্নিগ্ধ সুজলা সুফলা বঙ্গ প্রকৃতির কোলে গড়ে-উঠা বাংলা ভাষা একটি মধুর ভাষা সন্দেহ নেই, কিন্তু দিল্লি-আলীগড়-লক্ষ্ণৌ অঞ্চলের শুষ্ক রুক্ষ প্রকৃতিতে বিকশিত উর্দুভাষার মাধুর্যও সর্বজনস্বীকৃত। প্রাচীন পশ্চিম ভারতের মধ্যদেশ (শূরসেন) অঞ্চলের জলবায়ুও শুষ্ক রুক্ষ কঠোর, অথচ সেখানেই বিকাশ লাভ করেছিল সুমধুর ক্লাসিক্যাল সংস্কৃত ভাষা। সুতরাং ভাষার ধ্বনিপ্রকৃতির গঠনে ও পরিবর্তনে ভৌগোলিক পরিবেশের আংশিক প্রভাব থাকলেও ভাষার ধ্বনিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের এইটিই একমাত্র শক্তি নয়।

ন্য জাতির ভাষার প্রভাব

একটি জাতি দীর্ঘকাল অন্য জাতির শাসনাধীনে থাকলে শাসক-জাতির ভাষার প্রভাব শাসিত-জাতির ভাষায় পড়তে থাকে। এর ফলে এক ভাষার শব্দ ও বাগধারাই শুধু অন্য ভাষায় গৃহীত হয় তা নয়, এক-ভাষার উচ্চারণরীতি এবং ধ্বনিও অন্য ভাষায় গৃহীত হয়, এবং এতে গ্রহণকারী ভাষার ধ্বনিপরিবর্তনও সংঘটিত হয়। পশ্চিম বাংলার আদর্শ চলিত বাংলায় তিনপ্রকার শিস ধ্বনির (শ, য স) মধ্যে স্বনিম বা মূল ধ্বনি হিসাবে তালব্য ‘শ’-ই স্বীকৃত। কিন্তু পূর্ব-বাংলায় (বাংলা দেশ) মধ্যযুগ থেকে মুসলমান শাসনের ব্যাপক প্রভাবের ফলে ফারসি ভাষার প্রভাবে দন্ত্য ‘স’-এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় এবং আধুনিক ভাষাতত্ত্ববিদেরা সেখানকার বাংলায় দন্ত্য ‘স’ কেও মূলধ্বনিরূপে স্বীকার করেন। বাংলায় পদান্তে যুক্ত ব্যঞ্জন স্বরধ্বনি ছাড়া উচ্চারিত হয় না। অন্য স্বরধ্বনি না থাকলে অন্তত ‘অ’ বা ‘ও’ উচ্চারিত হয়। যেমন—‘নন্দ’-এর খাঁটি বাংলা উচ্চারণ হল নিন্দো, তেমনি বন্ধ = বন্ধো। কিন্তু আধুনিক কালে হিন্দির প্রভাবে পদান্তিক যুক্ত ব্যঞ্জনও কোথাও কোথাও স্বরহীনভাবে অর্থাৎ হসন্ত ব্যঞ্জনের মতো উচ্চারিত হচ্ছে। যেমন—স্ট্রাইক বা ধর্মঘট অর্থে ‘বন্ধ’।

উচ্চারণের ত্রুটি, আরামপ্রিয়তা ও অনবধানতা

ভাষা ব্যবহারে ও ভাষাসঞ্চারে দুটি পক্ষের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বক্তা ও শ্রোতা। বক্তা ভাষা উচ্চারণ করে এবং শ্রোতা তা শ্রবণ করে। বক্তার উচ্চারণে বা শ্রোতার শ্রবণে ত্রুটি ঘটলে ধ্বনিবিকৃতি সাধিত হয় এবং সেই ধ্বনিবিকৃতিই প্রচলন লাভ করলে ভাষার ধ্বনির পরিবর্তন সাধিত হয়। বক্তার দিক থেকে যদি ধ্বনি উচ্চারণের কষ্ট লাঘব করার প্রবণতা থাকে অথবা জিহ্বার আড়ষ্টতা থাকে তা হলে বক্তা অনেক দুরুচ্চাৰ্য ধ্বনিসমাবেশকে সহজ করে ফেলে। যেমন—যুক্তব্যঞ্জনকে ভেঙে সে পৃথক্ করে দেয়, বা বিষম ব্যঞ্জন বা বিষম স্বরকে একই রকম করে উচ্চারণ করে। যেমন—‘লক্ষ্মী’ শব্দের যুক্তব্যঞ্জন ক্ + ষ্ + ম বাংলায় পরিবর্তিত হয়ে হয়েছে শুধু ক্ + খ আর ম লোপ পেয়েছে, উচ্চারণ হয়েছে লোক্‌খি। তেমনি ‘দেশী’ শব্দের দুটি পৃথক স্বর ‘এ’ আর ‘ই’ বাংলা উচ্চারণে হয়েছে শুধু ‘ই’ আর ‘ই’, শব্দটির উচ্চারণ হয়েছে দিশি। একই কারণে শব্দের গোড়ায় শ্বাসাঘাত থাকলে শব্দের অন্য ধ্বনিতে আর আমরা বেশি জোর দেবার কষ্ট স্বীকার করি না। তখন সেই শ্বাসাঘাতহীন ধ্বনিটা ক্ষীণ হয়ে যায় বা তার সঙ্গে যুক্ত স্বরটি লোপ পায়। যেমন—গামোছা > গামছা। বক্তার দিক থেকে আর এক রকমের ত্রুটি হতে পারে—অনবধানতা বা সাবধানতার অভাব। এর ফলে শব্দের অন্তর্গত একটি ধ্বনি উচ্চারণ করার পরে অন্য ধ্বনি উচ্চারণে যাবার পথে জিহ্বা মাঝখানে ভূঁইফোড় ধ্বনি উচ্চারণ করে ফেলে। যেমন—সংস্কৃত বানর থেকে প্রাচীন বাংলা বান্দর (আধুনিক বাংলা বাঁদর)—এখানে ‘ন’ ও ‘র’-এর মাঝখানে যে ‘দ’ ধ্বনিটি এসেছে সেটা অনবধানতার জন্যেই এসেছে। ইংরেজিতে যাকে Spoonerism বলে—যা অক্সফোর্ডের শুনার সাহেবের নামে পরিচিত—তাও এই অনবধানতার বশেই ঘটে। যেমন—এক কাপ চা আমরা তাড়াতাড়ি বলতে গিয়ে বলে বসি ‘এক চাপ কা’।

শ্রবণের ও বোধের ত্রুটি

বক্তার দিক থেকে উচ্চারণের ত্রুটির ফলে যেমন ধ্বনিবিকৃতি হতে পারে, শ্রোতার দিক থেকে শোনার ও বোঝার ত্রুটির ফলেও তেমনি ধ্বনিবিকৃত ঘটতে পারে। বিদেশি ভাষা থেকে গৃহীত শব্দের ধ্বনিবিকৃতি ও ধ্বনিপরিবর্তন এই কারণে হতে পারে। যেমন—ইংরেজি zeal শব্দের উচ্চারণ ইংরেজের কাছ থেকে শোনার সময় বাঙালি যদি মনে মনে এর উচ্চারণ ধরে নেয় ‘জীল্’ তা হলে এটা শ্রোতারই ত্রুটি। কারণ এটা আসলে ‘জীল্’ (ji : l) নয়, ‘জীল্’ (zi : l) ; কারণ ইংরেজি ‘z’-এর উচ্চারণ বাংলা ‘জ’-এর মতো নয়। তেমনি জার্মান ‘Zar’-এর উচ্চারণ যদি জার্মান বক্তার উচ্চারণ থেকে ঠিক-ঠিক বুঝে না নিতে পারে তা হলে বাঙালি ভাববে এটা ‘জার’, কিন্তু আসলে ‘Zar’-এর মূল জার্মান উচ্চারণ হল ‘ৎসার’।

সন্নিহিত ধ্বনির প্রভাব: ধ্বনিসৃষ্টি ও ধ্বনিলোপ

উপরিউক্ত এইসব কারণই বাহ্য কারণ। এছাড়া ভাষার আভ্যন্তরীণ কারণেও ধ্বনিপরিবর্তন হয়। যেমন একই ভাষার নিজস্ব একটি ধ্বনির প্রভাবে অন্য ধ্বনির পরিবর্তন হয়, একটি শব্দের সাদৃশ্যে অন্য শব্দের ধ্বনি পরিবর্তন হয়, ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তনে ভাষার ধ্বনিক্ষয় হয় ও ভাষায় নতুন ধ্বনির সৃষ্টি হয়। খাঁটি বাংলায় ‘পদ্ম’ শব্দ যখন ‘পেদ্দ’ উচ্চারিত হয় তখন বোঝা যায় ‘দ’-এর প্রভাবে ‘ম্’-এর উচ্চারণ হয়েছে। এখানে পৃথক পৃথক দুটি ধ্বনি উচ্চারণের কষ্ট লাঘব করার জন্যে এই পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই; কিন্তু ‘ম’ যে পরিবর্তিত হয়ে ‘দ’ই হয়েছে, অন্য ধ্বনি হয়নি, তার কারণ প্রথম ‘দ্’-এর প্রভাব। এসব ছাড়া ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তনে ভাষার ধ্বনিক্ষয় হতে পারে এবং ধ্বনি লোপ পেতে পারে, যেমন বৈদিক সংস্কৃতের ৯-কার ক্লাসিক্যাল সংস্কৃতে প্রায় লোপ পেয়েছিল, এবং বাংলা ভাষায় এর ব্যবহার একেবারেই নেই। তেমনি বাংলায় প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার মূর্ধন্য ‘ণ’ ও অন্তঃস্থ ‘ব্’ লোপ পেয়েছে। আবার ভাষায় নতুন ধ্বনির সৃষ্টিও হতে পারে, একই মূলধ্বনি বা স্বনিমের উপধ্বনিগুলি ক্রমে স্বতন্ত্র স্বনিম রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করার ফলে ভাষায় নতুন মূলধ্বনি বা স্বনিমের সৃষ্টি হতে পারে। যেমন বাংলার ‘অ্যা’ ধ্বনি (অ্যাখন, অ্যামন), বাংলার ‘ড়’ ‘ঢ়’ ধ্বনি (বড়, দৃঢ়) ইত্যাদি।

ধ্বনিপরিবর্তনের ধারা ও সূত্র

ভাষার বহিরঙ্গগত কারণে ধ্বনি পরিবর্তন

বহিরঙ্গগত কারণে বিভিন্ন ভাষায় যেসব বহু বিচিত্র ধরনের ধ্বনিপরিবর্তন হয়েছে এবং হয়ে চলেছে ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞানীরা তা পর্যবেক্ষণ করে তা থেকে ধ্বনিপরিবর্তনের কয়েকটি সূত্র আবিষ্কার করেছেন। এবং এই সূত্রগুলিকে তারা প্রধানত চারটি ধারায় বিভক্ত করেছেন। যেমন— ১। ধ্বনির আগম ২। ধ্বনির লোপ ৩। ধ্বনির রূপান্তর ও ৪। ধ্বনির স্থানান্তর ও বিপর্যাস। সুতরাং প্রত্যেক ধারায় ধ্বনিপরিবর্তনের বিভিন্ন সূত্র লক্ষ করা যায়। প্রত্যেক ধারায় ধ্বনিপরিবর্তনের কয়েকটি প্রধান সূত্র নিম্নে ব্যাখ্যা করা হল।

ধ্বনির আগম

ধ্বনির আগম আবার দু’রকম হয়—স্বরধ্বনির আগম ও ব্যঞ্জনধ্বনির আগম। আগেই বলেছি শব্দের মধ্যে ধ্বনির স্থান, (position) তিন রকম— আদি (initial), মধ্য (medial) ও অন্ত্য (final)। শব্দের মধ্যে যে স্থানে স্বর ধ্বনিটি এসে যুক্ত হয় সেই স্থানভেদ অনুসারে স্বরধ্বনির আগমকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যেমন—আদিস্বরাগম (Vowel Prothesis), মধ্যস্বরাগম বা বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তি (Anaptyxis) ও অন্ত্যস্বরাগম (Catathesis)। এছাড়া কোনো কোনো অপিনিহিতিও (Epenthesis) স্বরাগমের মধ্যে পড়ে।

আদিস্বরাগম (Vowel Prothesis)

সাধারণত শব্দের আদিতে সংযুক্ত ব্যঞ্জন থাকলে সেই সংযুক্ত ব্যঞ্জনের উচ্চারণ-প্রস্তুতিরূপে বা উচ্চারণ-সৌকর্যের জন্যে তার আগে একটা স্বরধ্বনি এনে ফেলা হয়। শব্দের আদিতে স্বরধ্বনির এই আবির্ভাবকে বলে আদিস্বরাগম। যেমন— স্পৃহা > আস্পৃহা, স্কুল > ইস্কুল, স্টেবল (stable) > আস্তাবল, স্ত্রী > (পালি) ইত্থি।

মধ্যস্বরাগম / বিপ্রকর্ষ / স্বরভক্তি (Anaptyxis)

যুক্তব্যঞ্জনের অর্থ হল একাধিক ব্যঞ্জনের মাঝখানে কোনো স্বরধ্বনি না থাকা এবং ধ্বনিগুলির যুক্ত উচ্চারণ। এইরকমের যুক্তব্যঞ্জন উচ্চারণ করা অপেক্ষাকৃত কষ্টকর। যুক্তব্যঞ্জনের উচ্চারণ অপেক্ষাকৃত কর্কশও বটে। যুক্তব্যঞ্জনের উচ্চারণের কষ্ট লাঘব করার জন্যে বা তার উচ্চারণের কর্কশতা কমিয়ে, তাকে মধুর করার জন্যে আমরা যুক্তব্যঞ্জনের ধ্বনিগুলির মাঝখানে স্বরধ্বনি এনে যোগ করি। যুক্তব্যঞ্জনের ধ্বনিগুলির মাঝখানে এইভাবে স্বরধ্বনির আবির্ভাবকে মধ্যস্বরাগম বা বিপ্রকর্য বা স্বরভক্তি বলে (Anaptyxis)। প্রকর্য মানে প্রকৃষ্ট আকর্ষণ। আর বিপ্রকর্ষ মানে এই প্রকৃষ্ট আকর্ষণ যে প্রক্রিয়ায় বিগত হয়েছে সেই প্রক্রিয়া। যুক্তব্যঞ্জনের ধ্বনিগুলির মাঝখানে স্বরধ্বনি আসার ফলে ব্যঞ্জনগুলির মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ বিগত হয়ে যায়, ব্যঞ্জনগুলি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, এইজন্যে এই প্রক্রিয়াকে বিপ্রকর্ষ বলে। আর এই প্রক্রিয়ায় স্বরধ্বনির প্রতি অধিক ভক্তি বা অনুরাগ দেখান হয় বলে একে স্বরভক্তিও বলে। উদাহরণ— ভক্তি > ভকতি (ভ + অ + ক্ + ত‌ + ই > ভ্ + অ + ক + অ + ত্-ই)। তেমনি— মনোহর্থ > মনোরথ, গ্লাশ > গেলাশ, গার্ড > গারদ ইত্যাদি।

অপিনিহিতি (Epenthesis)

শব্দমধ্যস্থ ‘ই’ বা ‘উ’-এর স্থানান্তরের ফলে যে একরকমের অপিনিহিতি হয় (যেমন— করিয়া > কইর‍্যা) তার কথা পরে আওচনা করা হবে। এছাড়া শব্দমধ্যে য-ফলা যুক্ত ব্যঞ্জন, ‘জ্ঞ’ বা ‘ক্ষ’ থাকলে তার আগে একটি ‘ই’-এর আগম হয়। এই প্রক্রিয়াকেও অপিনিহিতি বলা হয়। এটিও আসলে একধরনের মধ্যস্বরাগম। উদাহরণ-পূর্ববাংলার উচ্চারণে বাক্য > বাইক্ক, যজ্ঞ > যইগ্গ ইত্যাদি।

অন্ত্যস্বরাগম (Vowel Catathesis)

বাংলা ভাষায় শব্দের শেষে সাধারণত কোনো যুক্তব্যঞ্জন স্বর ছাড়া থাকে না, অর্থাৎ শব্দের শেষে যুক্তব্যঞ্জনের পরে কোনো-না-কোনো স্বর অবশ্য থাকে। যেখানে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় কোনো স্বর নেই সেখানেও শেষে ‘অ’ বা ‘ও’ উচ্চারিত হয়। কিন্তু ইংরেজি প্রভৃতি বিদেশি ভাষায় শব্দের শেষেও স্বরহীন যুক্তব্যঞ্জন উচ্চারিত হয়; যেমন— bench (বেঞ্চ)।এইরকমের শব্দ যখন আমরা বাংলা ভাষায় গ্রহণ করি তখন বাংলা রীতি অনুযায়ী সেগুলির শেষে সাধারণত একটি অতিরিক্ত স্বরধ্বনি যোগ করে উচ্চারণ করি। এই প্রক্রিয়াকে অন্ত্যস্বরাগম বলে। যেমন—বেঞ্চ (ব্ + এ + ন + চ্) > বেঞ্চি (ব্+ এ + ন‌ + চ্ + ই)। এইরকম গিল্ট (gilt) > গিল্টি, আরবি কিস্ত্ > কিস্তি। মধ্যভারতীয় ও নব্যভারতীয় আর্যভাষায় শব্দান্তিক একক ব্যঞ্জনের পরেও কখনো কখনো অন্ত্যস্বরাগম দেখা যায়। যেমন—সংস্কৃত পরিষদ্ > পালি পরিসদা। সং দিশ্ > বাংলা দিশা।

আদিব্যঞ্জনাগম (Consonant Prothesis)

শব্দের আদিতে ব্যঞ্জনধ্বনি যোগ হলে তাকে আদিব্যঞ্জনাগম (Consonant Prothesis) বলা যায়। তবে বাংলায় শব্দের আদিতে যে-কোনো ব্যঞ্জনের আগম হয় না, সাধারণত শুধু ‘র্’-এর আগম হয়ে থাকে; এবং এই ‘র্’-এরও আগম হয় শুধু সেই শব্দের গোড়ায় যে শব্দের আদিতে স্বরধ্বনি আছে। যেমন— ঋজু > উজু > রুজু (এখানে ‘উ’-এর আগে ‘র’-এর আগম হয়েছে); উপাধ্যায় > প্রাকৃত উবজঝাঅ > বাংলা ওঝা > রোজা (ও-এর আগে ‘র’-এর আগম)।

অন্ত্যব্যঞ্জনাগম (Consonant Catathesis)

ড. সুকুমার সেনের মতে অন্ত্যস্বরাগমের মতো অন্ত্যব্যঞ্জনাগমও হতে পারে অর্থাৎ শব্দের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনিরও আগম হতে পারে। যেমন— সংস্কৃত সর্ব + জি > সর্বজিৎ; ভূ + ভৃ > ভূভৃৎ; বাংলা খোকা > খোকন; বাবু > বাবুন।

মধ্যব্যঞ্জনাগম বা শ্ৰতিধ্বনি (Glide)

শব্দের ধ্বনিগুলি উচ্চারণ করার সময় আমাদের জিহ্বা অসাবধানতাবশত দুটি ধ্বনির মাঝখানে কোনো অতিরিক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণ করে ফেললে সেই প্রক্রিয়াকে মধ্যব্যঞ্জনাগম বলে। এইভাবে যে অতিরিক্ত ধ্বনিটি শব্দের মাঝখানে উচ্চারিত হয়ে যায় তাকে শ্রুতিধ্বনি (Glide) বলে। যেমন— চা + এর (ষষ্ঠী বিভক্তি) > চায়ের (এখানে ‘য়’-এর আগম হয়েছে); শৃগাল > সিআল (‘গ’-এর লোপ) > শিয়াল (এখানে ‘য়’-এর আগম হয়েছে)। এইভাবে শব্দমধ্যে যে ব্যঞ্জনের আগম হয় সেই ব্যঞ্জনের নাম অনুসারে শ্রুতির নামকরণ হয়ে থাকে। যেমন—

য়-শ্রুতি (y-glide)

মোদক > মোঅঅ (‘দ’ ও ‘ক্’-এর লোপ) > মোয়া: (‘য়’-এর আগম); লৌহ >* নোআ (‘ল’ স্থানে ‘ন’ উচ্চারণ এবং ‘হ’-এর লোপ) > নোয়া (‘য়’-এর আগম) ইত্যাদি।

ওয়-শ্রুতি (w-glide)

যা (= to go, ধাতু) + আ (প্রত্যয়) > যাওয়া (‘ওয়’-এর আগম); ইত্যাদি।

হ-শ্রুতি (h-glide)

সংস্কৃত বিপুলা > প্রাকৃত বিউলা (‘প’-এর লোপ) বিহুলা (‘হ’-এর আগম) > বেহুলা; পর্তুগীজ viola (violin) > বেআলা > বেহালা (‘হ’-এর আগম) ইত্যাদি।

দ-শ্রুতি (d-glide)

বৈদিক সূনর > ক্লাসিক্যাল সংস্কৃত সুন্দর (‘দ’-এর আগম); সংস্কৃত বানর > প্রাচীন বাংলা ‘বান্দর’ (‘দ’-এর আগম) > আধুনিক বাংলা ‘বাঁদর’; ইংরেজি General (জেনারেল) > জান্দরেল (’-এর আগম) > জাঁদরেল।

ব-শ্রুতি (b-glide)

সংস্কৃত তাম্র > তম্‌ব্‌র (‘ব’-এর আগম) > প্রাকৃত তম্ব > বাংলা তাঁবা ইত্যাদি।

ধ্বনির লোপ 

আদিস্বরলোপ (Aphesis / Aphaeresis)

সাধারণত শব্দের আদি অক্ষরে শ্বাসাঘাত না থেকে যদি শব্দের মধ্যবর্তী কোনো অক্ষরে শ্বাসাঘাত থাকে তবে আদি স্বরধ্বনিটি গৌণ হয়ে ক্রমশ ক্ষীণ উচ্চারিত হয় এবং শেষে লোপ পায়। একেই আদিস্বরলোপ (Aphesis/ Aphaeresis) বলে। যেমন— উদ্ধার > উধার > ধার (‘উ’ লোপ), অলাবু > লাউ (‘অ’ লোপ)।

মধ্যস্বরলোপ (Syncope)

সাধারণত শব্দের আদি অক্ষরে শ্বাসাঘাত থাকলে শব্দের মধ্যবর্তী কোনো স্বরধ্বনি ক্ষীণ হয়ে ক্রমশ লোপ পেয়ে যায়। একে মধ্যস্বরলোপ (Syncope) বলে। যেমন— গামোছা > গামছা (‘ও’কার লোপ); সুবর্ণ (স‌ + উ + ব্ + অ + র্ + ণ‌ + অ) > স্বর্ণ (স্ + ব্ + অ + র‌ + ণ্ + অ) ‘উ’কার লোপ; সংস্কৃত সঙ্কটিকা > প্রাকৃত সঙ্কডী > সকডী (স্ + অ + ক্ + অ + ড্ + ঈ) > সড়কী (স্ + অ + ক‌ + ড়্ + ঈ) (‘অ’ কার লোপ)।

অন্ত্যস্বরলোপ (Apocope)

স্বাভাবিক উচ্চারণে প্রায়ই শব্দের শেষের দিকে শ্বাসের জোর কমে আসে এবং শব্দের শেষে অবস্থিত স্বর ক্ষীণ উচ্চারিত হতে-হতে শেষে লোপ পায়। যেমন— রাশি (র্ + আ + শ‌ + ই) > রাশ (ই কার লোপ); সংস্কৃত সন্ধ্যা > প্রাকৃত সঞঝা > বাংলা সাঁঝ (স্ + আঁ + ঝ্) ‘আ’-কার লোপ)।

দ্বিমাত্রিকতা/দ্ব্যক্ষরতা

শ্বাসবায়ুর এক ধাক্কায় যতটুকু ধ্বনিগুচ্ছকে একসঙ্গে উচ্চারণ করা যায় তাকে অক্ষর (Syllable) বলে। প্রত্যেক অক্ষরে একটি স্বরধ্বনি থাকবেই এবং কোনো অক্ষরে একের বেশি স্বরধ্বনি থাকবে না। অক্ষর (syllable) উচ্চারণে যে সময় লাগে সেই সময় পরিমাপের একককে মাত্রা (Mora) বলে। অক্ষর হ্রস্ব উচ্চারিত হলে এক মাত্রা, দীর্ঘ উচ্চারিত হলে ‘দু’ মাত্রা ও অতি দীর্ঘ (দ্রুত) উচ্চারিত হলে আরো অধিক মাত্রা ধরা হয়। সাধারণত সংস্কৃতে হ্রস্ব স্বরান্ত অক্ষর একমাত্রা হয়। যেমন— নি (ন্ + ই) = একমাত্রা। দীর্ঘরান্ত ও ব্যঞ্জনান্ত অক্ষর দু’মাত্রা। যেমন— সৎ, ধী প্রত্যেকটি = দু’মাত্রা; অবশ্য বাংলায় সর্বক্ষেত্রে এমন হয় না। আর বাংলায় উচ্চারণের একটি প্রবণতা হল বড় শব্দকে এমন টুকরো টুকরো অংশে ভাগ করে উচ্চারণ করা যাতে প্রত্যেক টুকরোতে দুটি দুটি করে অক্ষর (syllable) থাকে বা দু’য়ের গুণিতক অক্ষর থাকে। শব্দের আদি অক্ষরে শাসাঘাতের ফলে মধ্যবর্তী কোনো স্বর লোপ পেয়ে যায় আবার কখনো কখনো মধ্য অক্ষরে শ্বাসাঘাতের ফলে শব্দের শেষের কোনো স্বর লোপ পেয়ে যায়, এরই ফলে বড় শব্দ দুই বা দু’য়ের গুণিতক সংখ্যক অক্ষরের এক একটা টুকরোতে বিভক্ত হয়ে উচ্চারিত হয় অথবা শব্দটি যদি বে-জোড় সংখ্যার অক্ষরের (যেমন—তিন অক্ষরের) শব্দ হয় তবে সেটি জোড় সংখ্যার অক্ষরের শব্দে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াকে দ্বিমাত্রিকতা বা দ্ব্যক্ষরতা (Bimorism /Bisyllabism) বলে। বাংলায় বিভাজনটা ঠিক জোড়মাত্রা অনুসারে হয় না, জোড় অক্ষরের শব্দে হয়। তাই একে ঠিক দ্বিমাত্রিকতা না বলে দ্ব্যক্ষরতা বলাই ভাল। যেমন— গামোছা (গা + মো + ছা) (তিন অক্ষরের শব্দ) > গামছা (গাম্ + ছা) (দু’-অক্ষরের শব্দ); অপরাজিতা (অ + প + রা + জি + তা) (পাঁচ অক্ষরের শব্দ) > অপ্‌রাজিতা (অপ + রা + জি + তা) (চার অক্ষরের শব্দ)।

ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ

স্বরধ্বনি যেমন শব্দের আদি, মধ্য ও অন্ত্য যে-কোনো স্থান থেকেই লোপ পেতে পারে, ব্যঞ্জনধ্বনি তেমন লোপ পায় না। আদি ও অন্ত্য অবস্থান থেকে ব্যঞ্জন লোপের নিদর্শন নেই বললেই চলে। শব্দের আদিতে শুধু ‘র’ ধ্বনি লোপের নিদর্শন পাওয়া যায়। উত্তরবঙ্গের উপভাষায় আদি ‘র’-এর লোপ ও আদি ‘র’ আগম দুই দেখা যায়। যেমন— ‘আমের রস’ > সেখানকার উচ্চারণে ‘রামের অস’।

সমাক্ষর লোপ

পাশাপাশি অবস্থিত দু’টি সমধ্বনির মধ্যে একটি যখন লোপ পায় বা দুটি সমধ্বনিযুক্ত অক্ষরের (syllable) মধ্যে একটি যখন লোপ পায় তখন তাকে সমাক্ষর লোপ বলে। যেমন— বড় দাদা > বড়দা (একটি অক্ষর ‘দা’ লোপ পেয়েছে); পাদোদক > পাদোক (একটি ধ্বনি ‘দ’ লোপ পেয়েছে)।

সমবর্ণ লোপ

অনেক সময় শব্দের মধ্যে পাশাপাশি অবস্থিত দুটি সমবর্ণ বা সমাক্ষরের মধ্যে একটি শুধু লেখার বানানে লোপ পায়, কিন্তু লোকের মুখে উচ্চারণ ঠিকই থাকে। একে সমবর্ণ লোপ (Haplography) বলে। যেমন— ইংরেজিতে আগে ‘কৃষ্ণনগর’ (Krishnanagar) লেখা হত Krishnagar, একটি ‘na’ বাদ দিয়ে লেখা হত, কিন্তু লোকের মুখে দুটি ‘ন’ ঠিকই উচ্চারিত হয়— ক্রিশ্নোনগোর [Krisnonagor]।

ধ্বনির রূপান্তর

ধ্বনি যখন লোপ পায় না বা নতুন কোনো ধ্বনির যখন আগম হয় না, যখন একটি ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে অন্য ধ্বনির রূপ লাভ করে তখন তাকে ধ্বনির রূপান্তর বলা যায়। স্বর ও ব্যঞ্জন উভয়বিধ ধ্বনিরই রূপান্তর হয়। স্বরধ্বনির রূপান্তরের প্রধান প্রক্রিয়া হল অভিশ্রুতি, স্বরসঙ্গতি ইত্যাদি। ব্যঞ্জনধ্বনির রূপান্তরের বহু বিচিত্র প্রক্রিয়া; তাদের মধ্যে প্রধান হল সমীভবন, বিষমীভবন ইত্যাদি।

অভিশ্রুতি (Umlaut)

অপিনিহিতির প্রক্রিয়ায় শব্দের অন্তর্গত যে ‘ই’ বা ‘উ’ তার পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনের আগে সরে আসে সেই ‘ই’ বা ‘উ’ যখন পাশাপাশি স্বরধ্বনিকে প্রভাবিত করে এবং নিজেও তার সঙ্গে মিশে পরিবর্তিত হয়ে যায় তখন তাকে অভিশ্রুতি (Umlaut) বলে। অভিশ্রুতি হল অপিনিহিতির পরবর্তী ধাপ। যেমন করিয়া (ক্ + অ + র‌ + ই + য়‌ + আ) > কইর‍্যা (ক্ + অ + ই + র‌ + য়্ + আ)-যে ‘ই’ ছিল ‘র’-এর পরে তা এখানে ‘র’-এর আগে সরে এসেছে এইটা অপিনিহিতি; কইর‍্যা (অপিনিহিতি) > করে (অভিশ্রুতি) অপিনিহিতির ফলে যে ‘ই’, ‘র’-এর আগে সরে এসেছিল সেই ‘ই’-এর প্রভাবে য-ফলার পরবর্তী স্বরধ্বনি আকার পরিবর্তিত হয়ে ‘এ’-কার হয়ে গেছে এবং ‘ই’-কারটিও নিজে তার সঙ্গে মিশে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেসব শব্দ মূলত দু’ অক্ষরের (Bisyllybic) সেগুলির ক্ষেত্রে অভিশ্রুতির এই প্রক্রিয়াটি কার্যকর হয়; যেমন—বাক্য, যজ্ঞ, আজি প্রভৃতি দু’ অক্ষরের শব্দের রূপান্তর অপিনিহিতি পর্যন্ত ঠিকই হবে, বাইক্ক, যইজ্ঞ, আইজ; কিন্তু এর পরে অভিশ্রুতি হবে না; অপিনিহিতির ফলে যে ‘ই’ এসেছে, পশ্চিমবঙ্গের ভাষায় সেটা শুধু লোপ পাবে। যেমন-[বাক্কো, যগ্গো, আজ]।

স্বরসঙ্গতি (vowel Harmony)

শব্দের মধ্যে পাশাপাশি অথবা প্রায় কাছাকাছি অবস্থিত দুটি পৃথক্ স্বরধ্বনির মধ্যে যদি একটি অন্যটির প্রভাবে বা দুটিই পরস্পরের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে একই রকম স্বরধ্বনিতে বা প্রায় একই রকম স্বরধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়ে যায় তবে সেই প্রক্রিয়াকে স্বরসঙ্গতি (Vowel Harmony) বলে। স্বরসঙ্গতিকে ধ্বনিপরিবর্তনের গতিমুখ অনুসারে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়—(ক) প্রগত (Progressive), (খ) পরাগত (Regressive), (গ) পারস্পরিক বা অন্যোন্য (Mutual)।

প্রগত স্বরসঙ্গতি

পূর্ববর্তী ধ্বনির প্রভাবে পরবর্তী ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে একই রকম বা কাছাকাছি ধ্বনিতে রূপান্তরিত হলে তাকে বলে প্রগত (Progressive) স্বরসঙ্গতি। যেমন—পূজা > পূজো, দিশাহারা > দিশেহারা।

পরাগত স্বরসঙ্গতি

পরবর্তী স্বরধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে একই রকম বা কাছাকাছি স্বরধ্বনিতে রূপান্তরিত হলে তাকে বলে পরাগত (Regressive) স্বরসঙ্গতি। যেমন—দেশী > দিশি; ভুল + আ = ভুলা > ভোলা (to forget)।

পারস্পরিক বা অন্যোন্য স্বরসঙ্গতি

যদি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী দু’টি স্বরধ্বনিই পরস্পরের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে একই রকম বা কাছাকাছি স্বরধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়ে যায় তবে তাকে পারস্পরিক বা অন্যোন্য (Mutual/ Reciprocal) স্বরসঙ্গতি বলে। যেমন— যদু > যোদো।

এগুলি ছাড়া স্বরধ্বনির আরো একটি শ্রেণীর কথা কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন— মধ্যগত; দু’পাশের দুটি স্বরধ্বনির প্রভাবে তাদের মধ্যবর্তী অন্য কোনো ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে তাদের মতো একই বা কাছাকাছি ধ্বনি হয়ে গেলে তাকে বলেছেন মধ্যগত স্বরসঙ্গতি। যেমন— বিলাতি > বিলিতি। কিন্তু এটা স্বরসঙ্গতির কোনো স্বতন্ত্র শ্রেণি নয়, এটা একই সঙ্গে প্রগত ও পরাগত স্বরসঙ্গতির মিশ্র প্রক্রিয়া। স্বরসঙ্গতির বিপরীত প্রক্রিয়া হল স্বরের অসঙ্গতি (Vowel Disharmony)। এই প্রক্রিয়ায় কাছাকাছি অবস্থিত দুটি একই রকম স্বরধ্বনির মধ্যে একটি পৃথক হয়ে যায়। যেমন— মামা > মামু, কাকা > কাকু।

ক্ষতিপূরণ দীর্ঘীভবন বা পরিপূরক দীর্ঘীভবন

শব্দের কোনো ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ পেলে অনেক সময় সেই লোপের ক্ষতিপূরণ দেবার জন্যে তার পূর্ববর্তী হ্রস্বস্বর দীর্ঘস্বরে রূপান্তরিত হয়। একেই বলে ক্ষতিপূরণ বা পরিপূরক দীর্ঘীভবন (Compensatory Lengthening)। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার বিষম ব্যঞ্জনের মিলনে গঠিত সংযুক্ত ব্যঞ্জন মধ্যভারতীয় আর্য ভাষায় সমব্যঞ্জনের মিলনে গঠিত সংযুক্ত ব্যঞ্জনে পরিণত হয়েছিল। যেমন— সপ্ত > সত্ত। এই সমব্যঞ্জনের মিলনে গঠিত সংযুক্ত ব্যঞ্জনের মধ্যে একটি ব্যঞ্জন নব্য ভারতীয় আর্য ভাষায় লোপ পেল এবং তার পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি দীর্ঘ হল। যেমন— সত্ত (স্ + অ + ত্ + ত্‌ + অ) >. সাত (স্ + আ + ত্)। এখানে দুটি ‘ত’-এর মধ্যে একটি লোপ পেয়েছে এবং তার ফলে ‘অ’-এর দীর্ঘীভবন হওয়ায় এটি ‘আ’ হয়ে গেছে। তেমনি ধর্ম > ধৰ্ম্ম > ধাম, কর্ম > কম্ম > কাম।

সমীভবন (Assimilation)

শব্দের মধ্যে পাশাপাশি অবস্থিত বা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত দুটি বিষম ব্যঞ্জনধ্বনি অর্থাৎ পৃথক ধরনের ব্যঞ্জনধ্বনি যখন একে অপরের প্রভাবে বা দু’টিই পরস্পরের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে একই রকম ধ্বনিতে বা প্রায় অনুরূপ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়ে যায় তখন সেই প্রক্রিয়াকে বলে সমীভবন (Assimilation)। যেমন— উৎ + লাস > উল্লাস (এখানে ‘ল’-এর প্রভাবে ‘ৎ’ পরিবর্তিত হয়ে ‘ল’-এর সঙ্গে একই রকম ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সমীভবনে ধ্বনিপরিবর্তনের গতিমুখ অনুসারে সমীভবনকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়—প্রগত, পরাগত এবং অন্যোন্য বা পারস্পরিক।

প্রগত সমীভবন

পূর্ববর্তী ধ্বনির প্রভাবে যদি কখনো পরবর্তী ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে একই রকম বা কাছাকাছি ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়ে যায় তবে সেই প্রক্রিয়াকে প্রগত সমীভবন (Progressive Assimilation) বলে। যেমন— পদ্ম > পদ্দ (এখানে পূর্ববর্তী ধ্বনি ‘দ্’-এর প্রভাবে পরবর্তী ধ্বনি ‘ম’ পরিবর্তিত হয়ে ‘দ’ হয়ে গেছে। তেমনি— সূত্র (স্ + ঊ + ত‌ + র্ + অ > সূত্ত (স্ + ঊ + ত‌ + ত্ + অ)।

পরাগত সমীভবন

পরবর্তী ধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী ধ্বনি যদি কখনো পরিবর্তিত হয়ে একই রকম ধ্বনি বা কাছাকাছি ধ্বনি হয়ে যায় তবে সেই প্রক্রিয়াকে পরাগত সমীভবন (Regressive Assimilation) বলে। যেমন— সৎ + মান > সম্মান (এখানে দেখা যাচ্ছে, পরবর্তী ধ্বনি ‘ম’-এর প্রভাবে পূর্ববর্তী ধ্বনি ‘এ’ পরিবর্তিত হয়ে একই রকম ধ্বনি ‘ম’-তে পরিণত হয়েছে। তেমনি— ধর্ম (ধ্ + অ + র‌ + ম্ + অ > ধম্ম (ধ্ + অ + ম্ + ম্ + অ); ভক্ত ( ভ্ + অ + ক‌্‌ + ত্ + অ) > ভত্ত (ভ্ + অ + ত‌্ + ত‌্ + অ); বড় ঠাকুর > বট্‌ঠাকুর।

পারম্পরিক বা অন্যান্য সমীভবন

পরস্পরের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যদি, পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী দুটি ধ্বনিই পরিবর্তিত হয়ে একই রকম ধ্বনি বা কাছাকাছি ধ্বনিতে পরিণত হয় তবে সেই প্রক্রিয়াকে বলে পারম্পরিক বা অন্যান্য সমীভবন (Mutual / Reciprocal Assimilation)। যেমন— উৎ + শ্বাস > উচ্ছ্বাস—এখানে পূর্ববর্তী ধ্বনি ‘ৎ’ ও পরবর্তী ধ্বনি ‘শ’ দু’টিই পরস্পরের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে কাছাকাছি বা প্রায় একই রকম ধ্বনি ‘চ’ ও ‘ছ’-তে পরিণত হয়েছে। তেমনি সত্য > সচ্চ > হিন্দি সচ্চা > বাংলা সাচ্চা; কুৎসা > কেচ্ছা; মহোৎসব > মোচ্ছব ইত্যাদি।

বিষমীভবন (Dissimilation)

সমীভবনের বিপরীত প্রক্রিয়া হল বিষমীভবন। এই প্রক্রিয়ায় দুটি সংযুক্ত বা কাছাকাছি অবস্থিত সমধ্বনির মধ্যে একটি পরিবর্তিত হয়ে বিষম অর্থাৎ পৃথক ধ্বনিতে পরিণত হয়ে যায়। যেমন— পর্তুগিজ আর্মারিও (আ + র্ + ম‌ + আ + র্ + ই + ও) > বাংলা আলমারি (আ + ল্ + ম‌ + আ + র্ + ই) (দুটি ‘র’-এর মধ্যে একটি পরিবর্তিত হয়ে ‘ল’ হয়ে গেছে)।

ঘোষীভবন (Voicing)

সাধারণত বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ধ্বনি, য্, র‌, ল্, হ‌, ড়্, ঢ়‌্ এবং সমস্ত স্বরধ্বনি হল সঘোষ ধ্বনি; আর অন্য ধ্বনিগুলি অঘোষ ধ্বনি। কোনো সঘোষ ধ্বনির প্রভাবে অঘোষ ধ্বনি যদি সঘোষ ধ্বনিতে পরিণত হয় তবে তাকে ঘোষীভবন (Voicing) বলে। যেমন— চাকদহ > চাগ্‌দা, এখানে ঘোষধ্বনি ‘দ’-এর প্রভাবে অঘোষ ধ্বনি ‘ক’ পরিবর্তিত হয়ে ঘোষধ্বনি ‘গ’-এ পরিণত হয়েছে।

স্বতোঘোষীভবন

ঘোষধ্বনির প্রভাব ছাড়াও আপনা থেকেই কোনো কোনো সময় পশ্চিমবাংলার উচ্চারণে শব্দের শেষে অবস্থিত একক অঘোষধ্বনি সঘোষ উচ্চারিত হয়। একে স্বতোঘোষীভবন (Spontaneous Voicing) বলা হয়। যেমন— কাক > কাগ, লোক > লোগ, ছত্র > ছাত > ছাদ।

অঘোষীভবন

ঘোষীভবনের বিপরীত প্রক্রিয়া অঘোষীভবন (Devoicing/ Devocalization)। ঘোষধ্বনি অঘোষ উচ্চারিত হলে সেই প্রক্রিয়াকে অঘোষীভবন বলে। যেমন—অবসর > কথ্য বাংলায় অপসর, ভোঁদা কাকা > দ্রুত উচ্চারণে ‘ভোৎকা’ ; ফারসি খরাব > বাংলা খারাপ, ফারসি গূলাব > বাংলা গোলাপ, বড় ঠাকুর > বট্‌ঠাকুর, পোর্তুগিজ cowve > বাংলা কোপি, জার্মান leben > lieb [lip]।

মহাপ্রাণীভবন (Aspiration)

বাংলায় সাধারণত বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ ধ্বনি এবং ‘হ’ হল মহাপ্রাণ ধ্বনি, আর অন্য ধ্বনিগুলি হল অল্পপ্রাণ ধ্বনি। সন্নিকটস্থ বা সংযুক্ত কোনো মহাপ্রাণ ধ্বনির প্রভাবে যদি কোনো অল্পপ্রাণ ধ্বনি মহাপ্রাণ উচ্চারিত হয় তবে সেই প্রক্রিয়াকে মহাপ্রাণীভবন (Aspiration) বলে। যেমন— স্তম্ভ > থাম (স্ লোপ পেয়েছে এবং ‘ত’ মহাপ্রাণ ধ্বনি ‘ভ’-এর প্রভাবে মহাপ্রাণিত হয়ে ‘থ’ হয়ে গেছে। মহাপ্রাণ ধ্বনির প্রভাব ছাড়াই যদি কোনো অল্পপ্রাণ ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে মহাপ্রাণ হয়ে যায় তবে সেই প্রক্রিয়াকে স্বতোমহাপ্রাণীভবন (Spontaneous Aspiration) বলে। যেমন—পুস্তক > পুথি (এখানে ‘ত্’ পরিবর্তিত হয়েছে ‘থ্’-তে, কোনো মহাপ্রাণ ধ্বনির প্রভাব এখানে নেই)। তেমনি— পতঙ্গ > ফড়িং (‘প’ হয়েছে ‘ফ’, কোনো মহাপ্রাণ ধ্বনির প্রভাব ছাড়াই)।

অল্পপ্রাণীভবন (Deaspiration)

কোনো মহাপ্রাণ ধ্বনি যদি অল্পপ্রাণ উচ্চারিত হয় তবে তাকে অল্পপ্রাণীভবন (Deaspiration) বলে। যেমন— শৃঙ্খল > প্রাচীন বাংলা শিংকল > শিকল (‘খ্’ পরিবর্তিত হয়েছে ‘ক‌’-তে)। পশ্চিম বাংলার রাঢ়ী উপভাষায় প্রায়ই শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাত থাকলে শব্দের অন্তে অবস্থিত মহাপ্রাণধ্বনি অল্পপ্রাণ উচ্চারিত হতে দেখা যায়। যেমন— দুধ > দুদ, বাঘ > বাগ। পূর্ববাংলার বঙ্গালী উপভাষাতেও এক রকমের অল্পপ্রাণীভবন দেখা যায়। যেমন— ভাই > বাই, ভাত > বাত। পূর্ব-বাংলার এসব পরিবর্তনে মহাপ্রাণধ্বনি শুধু অল্পপ্রাণ হয়ে যায় না, অবরুদ্ধ বা recursive ধ্বনিতে পরিণত হয়।

কণ্ঠনালীয়ভবন (Glottalization)

সাধারণ ফুসফুস-চালিত বহির্মুখী বায়ুপ্রবাহের (Pulmonic Egressive Airstream) দ্বারা সৃষ্ট স্পর্শ ধ্বনি (Stop / Occlusive) যদি রুদ্ধস্বরপথ-চালিত অন্তর্মুখী বায়ুপ্রবাহের (Glottatic Ingressive Airstream) দ্বারা সৃষ্ট অন্তঃস্ফোটক (Implosive) ধ্বনিতে পরিণত হয় তবে তাকে কণ্ঠনালীয়ভবন (Glottalization) বলে। পূর্ববঙ্গের কোনো কোনো উপভাষায় ভ্, ধ‌, ঘ‌্ পরিবর্তিত হয়ে যথাক্রমে অন্তঃস্ফোটক ব্, দ‌্, গ‌্ রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন— ভাত > বাত, ভাই > বাই ইত্যাদি। এই ধ্বনিগুলিকে কেউ কেউ অবরুদ্ধ (Recursive) ধ্বনি বলেছেন।

নাসিক্যীভবন (Nasalization)

কোনো নাসিক্য ব্যঞ্জন (ম্, ন‌্, ইত্যাদি) যদি ক্ষীণ হতে হতে ক্রমশ লোপ পায় এবং তার রেশ স্বরূপ পূর্ববর্তী স্বরধ্বনিতে একটা আনুনাসিক অনুরণন যোগ হয় তবে সেই প্রক্রিয়াকে নাসিক্যীভবন বলে। যেমন— বন্ধ (ব্ + অ + ন‌্ + ধ‌্ + অ) > বাঁধ (ব্ + আঁ + ধ‌্)। (এখানে অনুনাসিক ব্যঞ্জন ‘ন্’ লোপ পেয়েছে, তার ফলে পূর্ববর্তী স্বর ‘অ’ দীর্ঘ হয়ে আনুনাসিক আঁতে পরিণত হয়েছে। তেমনি— অঙ্ক > আঁক, সন্ধ্যা > সঞঝা > সাঁঝ। লাতিন vinum (মদ্য) > ফরাসি vin [ve] [ভ্যেঁ]।

স্বতোনাসিক্যীভবন

শব্দ-মধ্যে নাসিক্যব্যঞ্জন না থাকলেও অনেক সময় কোনো কোনো স্বরধ্বনি আপনা থেকেই অনুনাসিক উচ্চারিত হয়। এই প্রক্রিয়াকে স্বতোনাসিক্যীভবন (Spontaneous Nasalization) বলে। যেমন—পুস্তক > পুথি > পুঁথি। (এখানে ‘পুস্তক’ শব্দে কোনো নাসিক্যব্যঞ্জন নেই, সুতরাং সেটা লোপের প্রশ্নও ওঠে না। তবে ‘পুঁথি’ শব্দে ‘উ’ ধ্বনিটা আপনা থেকেই আনুনাসিক হয়ে গেছে)। তেমনি— পেচক > পেঁচা ইত্যাদি।

বিনাসিক্যীভবন

অনেক সময় শব্দের অন্তর্গত কোনো নাসিক্যব্যঞ্জন লোপ পায়, কিন্তু তার কোনো প্রভাব বা রেশ রেখে যায় না। একে বিনাসিক্যীভবন (Denasalization) বলে। যেমন— শৃঙ্খল > শিকল > শেকল (এখানে নাসিক্যব্যঞ্জন ‘ঙ্’ লোপ পেয়েছে, অথচ তার প্রভাবে কোনো স্বর অনুনাসিক হয়নি)।

মূর্ধন্যীভবন (Cerebralization)

‘ঋ’, ‘র’, ‘য’ এবং ‘ট্’, ‘ঠ্’, ‘ড্’ প্রভৃতি মূর্ধন্যধ্বনির প্রভাবে সংশ্লিষ্ট বা কাছাকাছি অবস্থিত কোনো দন্ত্যধ্বনি (ত্, থ্, দ‌, ধ‌্ ইত্যাদি) যদি মূর্ধন্য ধ্বনিতে পরিণত হয়ে যায় তবে সেই প্রক্রিয়াকে মূর্ধন্যীভবন (Cerebralisation) বলে। যেমন— বৃদ্ধ > বুড় > বুড়া (‘ঋ’-এর প্রভাবে ‘দ’ ও ‘ধ’ যথাক্রমে মূর্ধন্যধ্বনি ‘ড্’ ও ‘ঢ‌্’-তে পরিণত হয়েছে। তেমনি বিকৃত > বিকট, উৎ + ডীন > উড্ডীন ইত্যাদি।

স্বতোমূর্ধ্যনীভবন

‘ঋ্’, র‌্’, ‘য্’ বা ‘ট’, ‘ঠ’, ‘ড’ প্রভৃতি কোনো মূর্ধন্যধ্বনির প্রভাব ছাড়াই যদি কোনো দন্ত্যধ্বনি মূর্ধন্যধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়ে যায় তবে সেই পরিবর্তনকে বলে স্বতোমূর্ধন্যীভবন (Spontaneous Cerebralisation)। যেমন— সংস্কৃত পততি > প্রাকৃত পড়ই > বাংলা পড়ে ইত্যাদি।

বিমূর্ধ্যনীভবন

যদি কোনো মূর্ধন্যধ্বনি মূর্ধন্য না থেকে দন্ত্যধ্বনি বা অন্য কোনো প্রকার ধ্বনিতে পরিণত হয় তবে সেই প্রক্রিয়াকে বলে বিমূর্ধন্যীভবন। যেমন— সংস্কৃত প্রাণ [pran] > বাংলা উচ্চারণে প্রান [pran], সংস্কৃত বিষ [bis] > বাংলা উচ্চারণে বিশ [bish] ইত্যাদি।

তালব্যীভবন

সংস্কৃতে ই, ঈ, চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, য, শ-কে তালব্যধ্বনি বলা হত (ই-চু-ষ-শানান্তালু)। এইসব তালব্যধ্বনির প্রভাবে কোনো দন্ত্যধ্বনি বা অন্য ধ্বনি যদি তালব্যধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়ে যায় তবে সেই প্রক্রিয়াকে বলে তালব্যীভবন (Palatalisation)। যেমন— সন্ধ্যা > সঞঝা (এখানে য-ফলার প্রভাবে দন্ত্যধ্বনি ‘ন‌্’ ও ‘ধ‌্’ পরিবর্তিত হয়ে তালব্যধ্বনি যথাক্রমে ‘ঞ্’ ও ‘ঝ্’-তে পরিণত হয়েছে) > সাঁঝ। সংস্কৃত বিষ [bis] > খাঁটি বাংলা উচ্চারণে বিষ [bish]। institute > ইন্‌স্‌টিচিউটু। অনেক সময় কোনো তালব্যধ্বনির প্রভাব ছাড়াও দন্ত্য বা দন্তমূলীয় ধ্বনি তালব্যধ্বনিতে পরিণত হয়। এটাকে স্বতোতালব্যীভবন (Spontaneous Palatalisation) বলতে পারি। যেমন— graduate > গ্র্যাজুয়েট।

উষ্মীভবন

ধ্বনি উচ্চারণে শ্বাসবায়ু পূর্ণ বাধা পেলে স্পর্শধ্বনি (stop) এবং আংশিক বাধা পেলে উষ্মধ্বনি (Spirant/Fricative) সৃষ্ট হয়। স্পর্শধ্বনি উচ্চারণ করতে গিয়ে যদি এমন হয় যে, শ্বাসবায়ু পূর্ণ বাধা পাচ্ছে না, আংশিক বাধা পাচ্ছে, তবে স্পর্শধ্বনি উষ্মধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ার নাম হল উষ্মীভবন। যেমন— হয়, হয় জানতে পারো না > ‘অয় অয় জান্তি পারো না’ (জ > z)। কালীপূজা > চট্টগ্রামের উপভাযায় খালি ফুজা [xali fuza]।

সকারীভবন

উম্মীভবনের ফলে যদি স্পৃষ্ট বা ঘৃষ্টধ্বনি ‘স’, ‘শ’ বা ‘জ’ [sfz]-তে পরিণত হয় তবে সেই প্রক্রিয়াকে বলে সকারীভবন (assibilation)। যেমন— আগাপাছতলা > আগাপাস্‌তলা, খেয়েছে > পূর্ব বাংলার উচ্চারণে > খাইসে।

রকারীভবন

‘স‌্’ [s] অনেক সময় পরিবর্তিত হয়ে প্রথমে সঘোষ ‘জ্’ [z] এবং পরে ‘র’ [r]-তে পরিণত হয়। এই পরিবর্তনকে রকারীভবন (Rhotacism) বলে। যেমন—লাতিন ausosa > auzoza aurora৷

সঙ্কোচন

উচ্চারণের দ্রুততার জন্যে অথবা উচ্চারণ প্রয়াস লাঘব করার জন্যে অনেক সময় আমরা কোনো শব্দের সবকটি ধ্বনি পূর্ণরূপে স্পষ্টরূপে উচ্চারণ না করে কতকগুলি ধ্বনিকে মিলিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত উচ্চারণ করি। এর ফলে অধিক সংখ্যক ধ্বনি স্বল্প কয়েকটি ধ্বনিতে সঙ্কুচিত হয়ে আসে; একে সঙ্কোচন (Contraction) বলে। যেমন— বৈবাহিক > বেয়াই > ব্যাই, যাহা ইচ্ছা তাই > যাচ্ছেতাই, পেঁয়াজ > প্যাঁজ।

বিস্ফোরণ বা প্রসারণ

শব্দের দীর্ঘ উচ্চারণের জন্যে শব্দের নির্দিষ্ট সংখ্যক ধ্বনিকে বাড়িয়ে উচ্চারণ করাকে বিস্ফোরণ বা প্রসারণ (Expansion) বলে। যেমন— পর্তুগীজ পেরা > বাংলা পেয়ারা, সংস্কৃত পর্যঙ্ক > ব্রজবুলি পরিযঙ্ক।

একীভবন (Merger)

ভাষার কোনো স্বনিম (Phoneme) যদি তার উচ্চরণগত স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে অন্য কোনো স্বনিমের সঙ্গে এক হয়ে যায় তবে সেই প্রক্রিয়াকে বলে একীভবন (Merger)। যেমন— সংস্কৃতের মূর্ধন্য- ‘ণ’ বাংলায় তার উচ্চারণগত স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে এখন দন্ত্য ‘ন’-এর সঙ্গে উচ্চারণের দিক থেকে এক হয়ে গেছে। এইভাবে মূর্ধন্য ‘ণ্’ ও দন্ত ‘ন‌্’ বাংলায় আসলে পৃথক্ স্বনিম নয়, একই স্বনিম। সঙ্কোচন ও একীভবন একই প্রক্রিয়া নয়। সঙ্কোচনে কোনো শব্দের ধ্বনিসংখ্যা কমে যায়; কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ভাষার সামগ্রিক ধ্বনিসংখ্যা কমে গেল; কিন্তু একীভবনে ভাষার একটি স্বনিম নিজের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে অন্য স্বনিমের সঙ্গে এক হয়ে যায়, এতে ভাষার সামগ্রিক স্বনিম-সংখ্যাই কমে যায়।

ব্যঞ্জনদ্বিত্ব (Gemination)

কোনো শব্দে জোর দেবার জন্যে আমরা যখন বিশেষ অক্ষরে শ্বাসাঘাত দিই তখন স্বরমধ্যবর্তী একক ব্যঞ্জন দ্বিত্বপ্রাপ্ত হয়। এই প্রক্রিয়াকে ব্যঞ্জনদ্বিত্ব (Gemination) বলে। যেমন বড় কষ্ট > বড্ড কষ্ট; কোথাও পাবে না > কোত্থাও পাবে না।

ধ্বনির স্থানান্তর 

বিপৰ্যাস

শব্দের মধ্যে কাছাকাছি অবস্থিত বা সংযুক্ত দুটি ধ্বনি যদি নিজেদের মধ্যে স্থান-বিনিময় করে তবে ধ্বনির সেই স্থান-বিনিময়কে বিপৰ্যাস (Metathesis) বলে। যেমন বাক্স (box) > বাস্ক (ব্ + আ + স্ + ক্ + অ) (এখানে কৃ’ ও ‘স’ নিজেদের মধ্যে স্থান-বিনিময় করেছে)। তেমনি রিকশা (rickshow) > রিস্কা।

ভাষার অন্তরঙ্গ ও অর্থপ্রভাবিত কারণে ধ্বনিপরিবর্তন

সাদৃশ্য (Analogy)

মনে রাখার সুবিধার জন্যে বা উচ্চারণ-বৈষম্য হ্রাস করার জন্যে যখন আমরা কোনো ধ্বনি বা রূপ বা অর্থকে অন্য কোনো শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে তার সাদৃশ্যে শব্দের পরিবর্তন করে নিই বা একটি কোনো শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে আমরা অনুরূপ কোনো নতুন শব্দ গড়ে নিই তখন সেই প্রক্রিয়াকে বলে সাদৃশ্য (Analogy)। সাদৃশ্যের ফল চার রকম হতে পারে— (১) শব্দের ধ্বনিপরিবর্তন, (২) শব্দের রূপপরিবর্তন, (৩) শব্দের অর্থপরিবর্তন এবং (৪) নতুন শব্দসৃষ্টি। বাংলায় বিশিষ্টার্থক পদগুচ্ছ ‘টাকার কুমীরে’র ‘কুমীর’ শব্দটি এসেছে ধনসঞ্চয়ের দেবতা ‘কুবের’ থেকে। সুতরাং বাংলায় পদগুচ্ছটি হওয়া উচিত ছিল ‘টাকার কুবের’ বা ‘টাকার কুবীর’। কিন্তু বাংলায় হয়েছে ‘টাকার কুমীর’। এখানে ‘কুবীর’ শব্দটি ‘কুমীর’ শব্দের সাদৃশ্যে পরিবর্তিত হয়ে এই রূপ লাভ করেছে—এখানে ‘ব’ থেকে ‘ম’ এই ধ্বনিপরিবর্তনটি সাদৃশ্যের প্রভাবেই ঘটেছে।

সাদৃশ্যের প্রভাব শব্দরূপের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। সংস্কৃতে ‘নর’ শব্দের ষষ্ঠীর একবচনের রূপ নরস্য, কিন্তু ‘মুনি’ শব্দের ষষ্ঠীর একবচনের রূপ ‘মুনেঃ’। প্রাকৃতে কিন্তু ঐ ‘নরস্‌স’ রূপের সাদৃশ্যে ‘মুনি’ শব্দেরও ষষ্ঠীর একবচনে হয়েছিল ‘মুণিস্‌স’। আদিমধ্য যুগের বাংলায় ‘রা’ বিভক্তি যোগ করে শুধু সর্বনামের কর্তৃকারকের বহুবচনের রূপ গড়া হত। যেমন—আহ্মারা, তোহ্মারা ইত্যাদি। সাদৃশ্যের প্রভাবে ভাষায় আরো দু’রকম প্রক্রিয়া ঘটে। পুরানো শব্দের অর্থপরিবর্তন এবং নতুন শব্দসৃষ্টি। ধ্বনিপরিবর্তনের ধারায় এই দুটি প্রক্রিয়া যদিও পড়ে না তবু সাদৃশ্যের সামগ্রিক প্রভাব বোঝাবার জন্যে প্রক্রিয়া দুটি এখানে ব্যাখ্যা করা হল। বৈদিক শব্দ ‘ক্রন্দসী’র মূল অর্থ ছিল ‘গর্জনকারী প্রতিদ্বন্দ্বী দুই সৈন্য।’ আবার বৈদিক ‘রোদসী’ শব্দের অর্থ হল ‘দুই জগৎ’ (স্বর্গ ও পৃথিবী) > অন্তরীক্ষ। এই ‘রোদসী’ শব্দের সাদৃশ্যে ‘ক্রন্দসী’ শব্দটির নতুন অর্থ রবীন্দ্রনাথ করেছেন ‘অন্তরীক্ষ’। রবীন্দ্র-প্রয়োগে ‘রোদসী’ শব্দের সাদৃশ্যে ‘ক্রন্দসী’ শব্দের অর্থপরিবর্তন ঘটেছে।

সাদৃশ্যের প্রভাবে ভাষায় নতুন শব্দ সৃষ্টির অনেক উদাহরণ ভাষাবিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। ড. সুকুমার সেন দেখিয়েছেন— মূল শব্দ ‘বধূটি’ থেকে বাংলায় ধ্বনিপরিবর্তনের ফলে এসেছে ‘বউড়ী’। এই বউড়ী শব্দের সাদৃশ্যে বাংলায় ‘শাশুড়ী’, ‘ঝিউড়ী’ প্রভৃতি নতুন শব্দের সৃষ্টি হয়েছে।

বিমিশ্রণ/মিশ্রণ

যদি একটি শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে তার সঙ্গে ভাবানুষঙ্গের জন্যে অন্য কোনো শব্দ মনে এসে যায় এবং মূল শব্দের অংশবিশেষ বাদ দিয়ে সেই জায়গায় মনে-আসা শব্দটি যোগ করে দেওয়া হয় এবং তার ফলে একটি নতুন শব্দ সৃষ্টি হয়, তবে তাকে বিমিশ্রণ বা মিশ্রণ (Contamination) বলে। যেমন—পর্তুগীজ আনানস (annanas) শব্দের ‘নস’ অংশটুকু বাদ দিয়ে তার জায়গায় বাংলা ‘রস’ শব্দ যোগ করা হয়েছে এবং তার ফলে ‘আনারস’ শব্দটি সৃষ্ট হয়েছে। এখানে যে ফলের কথাটি বলা হয়েছে তার মধ্যে রস থাকে বলে বাংলা ‘রস’ শব্দটির কথা মনে এসেছে। এখানে ‘আনানস’ ও ‘রস’ শব্দের মিশ্রণে নতুন শব্দ সৃষ্টি হয়েছে—‘আনারস’।

জোড়কলম শব্দ

একটি শব্দের বা তার অংশবিশেষের সঙ্গে অন্য শব্দ বা তার অংশবিশেষ যোগ করে যদি একটি নতুন শব্দ তৈরি করা হয় তবে সেই শব্দকে বলে জোড়কলম শব্দ (Portmanteau word)। যেমন— আরবি ‘মিন্নৎ’ শব্দের প্রথমাংশের সঙ্গে সংস্কৃত ‘বিজ্ঞপ্তি’ শব্দের শেষাংশ যোগ করে করা হয়েছে মিনতি। বাংলা তফাৎ + ইংরেজি difference > তফারেন্স। এখন বহু প্রচলিত ধোঁয়া + কুয়াশা = ধোঁয়াশা।

সঙ্কর শব্দ

বিভিন্ন ভাষার উপাদান যোগ করে একটি নতুন শব্দ গঠিত হলে তাকে সঙ্কর শব্দ বা মিশ্র শব্দ (Hybrid Word) বলে। যেমন— ইংরেজি শব্দ ‘মাস্টার’ (Master) + বাংলা প্রত্যয় ‘ঈ’ = মাস্টারী; বাংলা পুরঃসর্গ ‘নি’ + ফারসি শব্দ খরচা = নিখরচা। বিমিশ্রণ ও জোড়কলমে দু’টি বা একটি শব্দের অংশবিশেষ নেওয়া হয়, কিন্তু সঙ্কর শব্দে যে উপাদানটি নেওয়া হয় সেটি গোটাই নিয়ে যোগ করা হয়।

লোকনিরুক্তি

নিরুক্তি মানে ব্যুৎপত্তি বা উৎস নির্ণয়। শিক্ষিত মানুষের নয়, লোক-সাধারণের অর্থাৎ অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত জনসাধারণের জ্ঞান-বিশ্বাস অনুসারে নির্ণীত ব্যুৎপত্তির উপরে নির্ভর করে শব্দের যে ধ্বনিপরিবর্তন হয় তাকে লোকনিরুক্তি (Folk-Etymology).বলে। যেমন— বৈদিক ভাষায় মাকড়সার প্রতিশব্দ ছিল ‘উর্ণবাভ’। এই মূল শব্দটি ‘বভ্’ (= বয়ন করা) ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এই ‘বভ্’ ধাতু পরে অপ্রচলিত হয়ে যায় এবং লোকসাধারণের মধ্যে এই বিশ্বাস গড়ে উঠে যে মাকড়সা নিজের নাভি থেকে সুতোর মতো একরকম লালা বের করে তা থেকে জাল রচনা করে। লোকবিশ্বাসের ঐ ‘নাভি’ শব্দের উপরে ভিত্তি করে শব্দটির নতুন ব্যুৎপত্তি করে নেওয়া হয় এবং ‘উর্ণবাভ’ শব্দটির সেই অনুযায়ী ধ্বনিপরিবর্তন হওয়ায় শব্দটি হয়ে যায় ‘ঊর্ণনাভ’।

শব্দবিভ্রম

কখনো কখনো অজ্ঞানতাবশত একটি শব্দের বদলে তার জায়গায় প্রায় সমধ্বনিযুক্ত অন্য একটি শব্দ ব্যবহার করা হয়। একেই বলে শব্দবিভ্রম (Malapropism)। যেমন— “আমার একটি নীতি আছে’’ এই অর্থে অনেক লোককে বলতে শোনা যায়—আমার একটি প্রিন্সিপ্যাল আছে; আসলে এখানে হবে আমার একটি প্রিন্সিপল (Principle) আছে। প্রিন্সিপ্যাল (Principal) মানে ‘অধ্যক্ষ’, প্রিন্সিপল (principle) মানে ‘নীতি’।

বিষমচ্ছেদ বা ভ্রান্তবিশ্লেষ বা নিষ্কালন

শব্দের অন্তর্গত উপাদানগুলির বা শব্দের ব্যুৎপত্তির সঠিক জ্ঞান না থাকার ফলে আমরা অনেক সময় শব্দকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করি যাতে শব্দটিকে ঠিক-ঠিক অংশে ছেদন না করে ভুল অংশে ছেদন করে ফেলি এবং ঐ ভ্রান্ত অংশগুলি নিয়ে আবার নতুন শব্দ গঠন করে ফেলি। এই প্রক্রিয়াকে বলে বিষমচ্ছেদ বা ভ্রান্তবিশ্লেষ বা নিষ্কালন (Metanalysis)। যেমন— একজন জনপ্রিয় অধ্যাপকের আসল নাম শ্ৰীযুক্ত বাবুরাম প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। নামটি একবার টাইপে ভুল জায়গায় বিশ্লিষ্ট হওয়ার ফলে হয়ে গিয়েছিল শ্রীযুক্তবাবু রামপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনি টাইপের ভুলেই একবার God is now here হয়ে গিয়েছিল God is no where; শুধু ‘now’-এর ‘w’ বিশ্লিষ্ট হয়ে here-এর সঙ্গে যোগ হয়ে যাওয়ায় বাক্যটির অর্থই উল্টে গেছে।

ভুয়া শব্দ (Ghost Word)

অনেক সময় শব্দের একটা কল্পিত মূল উপাদান খাড়া করে নিয়ে তার সঙ্গে বিভক্তি, প্রত্যয় ইত্যাদি যোগ করে এমন শব্দ গঠন করা হয় যার মূল উৎস ভাষায় ছিলই না। যেমন— ‘প্রোথিত’ শব্দ। এখানে কল্পিত মূল উপাদান হচ্ছে ‘প্রোথ’ ধাতু। এর সঙ্গে ‘ইত’ যোগ করে হয়েছে প্রোথিত। কিন্তু এর মূল যে ‘পোথ’ ধাতু সেটি কাল্পনিক ধাতু, সংস্কৃতে এর উৎস পাওয়া যায় না।

পুনর্গঠন বা পূর্বস্তরীয় গঠন

কোনো বিদেশি বা নতুন শব্দকে পরিবর্তিত করে নিজের দেশের প্রাচীন ভাষার ছাঁদে নতুন রূপে গড়ে তোলাকে বলে পুনর্গঠন বা পূর্বস্তরীয় গঠন (Back Formation)। যেমন— গ্রীক ‘দ্রামে’ থেকে সংস্কৃত ‘দ্রম্য’, গ্রীক কামেলস্ (Kamelos) থেকে সংস্কৃত ক্ৰমেলক, পর্তুগীজ voila থেকে সাধু বাংলা বেহালা, জার্মান মাক্‌সসম্যূলর (Max Muller) থেকে সাধু বাংলায় ‘মোক্ষমূলর’।

সমমুখ ধ্বনিপরিবর্তন

ধ্বনিপরিবর্তনের ফলে যদি একাধিক শব্দ পরিবর্তিত হয়ে উচ্চারণ ও বানানে সম্পূর্ণ একই রকম রূপ লাভ করে তবে সেই ধরনের পরিবর্তনকে সমমুখ ধ্বনিপরিবর্তন (Convergent Phonenic Change) বলে। যেমন— সংস্কৃত পততি > বাংলা পড়ে (falls), সংস্কৃত পঠতি > বাংলা পড়ে (reads)। এখানে দুটি শব্দ ‘পততি’ ও ‘পঠতি’ ধ্বনিপরিবর্তনের ফলে সম্পূর্ণ একই রকম রূপ লাভ করেছে— ‘পড়ে’।

বিমুখ ধ্বনিপরিবর্তন

একই শব্দ যদি ধ্বনিপরিবর্তনের ফলে একাধিক রূপ লাভ করে অর্থাৎ ধ্বনির পরিবর্তনের ফলে যদি একই শব্দ থেকে একাধিক শব্দের জন্ম হয় তবে সেই ধরনের পরিবর্তনকে বিমুখ ধ্বনিপরিবর্তন (Divergent Phonemic Change) বলে। যেমন— ভণ্ড > ভান ও ভাঁড়, চিত্র > চিতা ও চিত্তির, শ্রদ্ধা > সাধ ও ছেদ্দা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!