//
//

নব্য ভারতীয় আর্যভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা কর।

নব্য ভারতীয় আর্যভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

নব্য ভারতীয় আর্যভাষা (আঃ ৯০০ খ্রিঃ থেকে বর্তমান কাল) হল তাহলে ভারতে প্রচলিত আর্যভাষার বিবর্তনের তৃতীয় ধাপ। বলা বাহুল্য নব্য ভারতীয় আর্যভাষা বলতে কোনো একটি ভাষাকে বোঝায় না। খ্রিস্টীয় আনুমানিক নবম দশম শতাব্দী থেকে ভারতে আর্যশাখা থেকে যেসব নবীন ভাষার জন্ম হয় তাদের সকলকেই বোঝায়। বস্তুত নব্য ভারতীয় আর্য হল ইতিহাসের একটি পর্বের নাম, আর এই পর্বের ভারতীয় আর্যভাষাগুলির নাম হল—বাংলা, হিন্দি, মারাঠি, অবধী, পঞ্জাবি ইত্যাদি।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

(ক) প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার বিষম ব্যঞ্জনের মিলনে গঠিত যুক্তব্যঞ্জন মধ্য ভারতীয় আর্যভাষায় সমীভবনের নিয়মে সম ব্যঞ্জনে গঠিত যুগ্মব্যঞ্জনে পরিণত হয়েছিল। যেমন— নৃত্য > নচ্চ, বৰ্গ (= বরগ্) > বগ্গ, পক্ব > পক্ক, অক্ষি > অক্‌খি, হস্ত > হত্ত। এই সমব্যঞ্জনে গঠিত যুগ্ম ব্যঞ্জনের মধ্যে একটি ব্যঞ্জন নব্য ভারতীয় আর্যভাষায় লোপ পেল এবং এই লোপের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ পূর্ববর্তী স্বর দীর্ঘ হল। ব্যঞ্জনধ্বনি লোপের ক্ষতিপুরণ স্বরূপ পূর্ববর্তী স্বরের এই দীর্ঘীভবনকে বলে মাত্ৰাপূরক বা ক্ষতিপূরকা দীর্ঘীভবন (Compensatory Lengthening)। যেমন— নচ্চ > নাচ (বাংলা), বগ্গ > বাগ (হিন্দি), পক্ক > পাক (হিন্দি), অক্‌খ > আঁখ।

(খ) যে যুক্তব্যঞ্জনের প্রথম ধ্বনি নাসিকা ব্যঞ্জন (ঙ, ঞ, ণ, ন, ম) সেই যুক্তব্যঞ্জনের নাসিক্য ব্যঞ্জনটি লোপ পেয়েছে এবং তার পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি দীর্ঘ স্বরধ্বনি হয়ে অনুনাসিক হয়ে গেছে। যেমন— কণ্টক > প্রাকৃত > কন্টঅ > বাংলা কাঁটা। পঞ্চ > বাংলা ও হিন্দি পাঁচ। দন্ত > বাংলা ও হিন্দি দাঁত।

(গ) পদের অন্তে অবস্থিত স্বরধ্বনি প্রায়ই লুপ্ত হয়েছে অথবা বিকৃত হয়েছে। যেমন— সংস্কৃত রাম (র্ + আ + ম‌্ + অ) > বাংলা, হিন্দি রাম্ (র্+ অ + ম‌্), অগ্নি > হিন্দি আগ। দধি > হিন্দি দহী। পদান্তিক স্বরধ্বনি অবশ্য অনেকটা রক্ষিত হয়েছে ওড়িয়া ভাষায়; যেমন-ওড়িয়া রাম = (র্ + আ + ম্ + অ।

(ঘ) দুই স্বরের মধ্যবর্তী একক অল্পপ্রাণ স্পর্শব্যঞ্জন মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার কোনো কোনো উপভাষায় লুপ্ত হয়ে যেত। কিন্তু ঐ ব্যঞ্জনের সংশ্লিষ্ট স্বরটি লোপ পেত না। এই সংরক্ষিত স্বরকে বলা হয় অবশিষ্ট বা উদ্বৃত্ত স্বর (residual vowel)। যেমন— ঘৃত (ঘ্ + ঋ‌্ + ত‌্ + অ) > ঘিঅ (ঘ্ + ই + অ)। এখানে ‘ত’ লোপ পেয়েছে, এবং তৎসংলগ্ন ‘অ’ থেকে গেছে। এই ‘অ’ হল অবশিষ্ট বা উদ্ধৃত স্বর। নব্য ভারতীয় আর্যভাষাগুলিতে এই ধরনের উদ্বৃত্ত স্বরের নানা রকম পরিণতি হয়েছে। কখনো এই উদ্বৃত্ত স্বর লোপ পেয়েছে। যেমন—ঘৃত > ঘিঅ > বাংলা ঘী। কখনো উদ্বৃত্ত স্বরটির সঙ্গে পাশ্ববর্তী স্বরের সন্ধি হয়ে গেছে। যেমন গত > গঅ। ইল্ল > বাংলা গেল (অ + ই = এ)। কখনো বা উদ্বৃত্ত স্বরটি পার্শ্ববর্তী স্বরের সঙ্গে মিলিত হয়ে দ্বিস্বরে (Diphthong) পরিণত হয়েছে। যেমন বধু > বউ > বৌ, মধু > মউ > মৌ (বাংলা)।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

(ক) প্রাচীন ভারতীয় আর্যে লিঙ্গ নির্ণয় করা হত অনেক ক্ষেত্রে পদান্তিক স্বরধ্বনি অনুসারে। যেমন— ঈ-কারান্ত শব্দ নদী স্ত্রী লিঙ্গ, আ-কারান্ত শব্দ ‘লতা’ স্ত্রী লিঙ্গ। পদের অন্তে অবস্থিত স্বরধ্বনি বিকৃত অথবা লুপ্ত হওয়ায় প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার লিঙ্গবিধি নব্য ভারতীয় আর্য ভাষায় থাকেনি। নব্য ভারতীয় আর্যভাষায় লিঙ্গবিধি অনেক ক্ষেত্রে নতুন ধরনের। প্রাচীন ভারতীয় আর্যে লিঙ্গ নির্ণীত হত অনেক ক্ষেত্রে শব্দের অর্থ নিরপেক্ষভাবে শব্দের গঠন অনুসারে। ফলে অপ্রাণীবাচক শব্দও কখনো কখনো ক্লীবলিঙ্গ না হয়ে স্ত্রীলিঙ্গ বা পুংলিঙ্গ হয়েছে। যেমন সংস্কৃতে ‘লতা’ শব্দ স্ত্রীলিঙ্গ। কিন্তু অনেক নব্য ভারতীয় আর্যে লিঙ্গ নির্ণয় করা হয় শব্দের অর্থ অনুসারে। যেমন বাংলায় পুরুষবোধক শব্দ পুংলিঙ্গ, স্ত্রীবোধক শব্দ স্ত্রীলিঙ্গ; অপ্রাণীবোধক শব্দ ক্লীবলিঙ্গ (যেমন ‘লতা’ শব্দ বাংলায় ক্লীবলিঙ্গ)। আর কোনো কোনো নব্যভারতীয় আর্যভাষায় শব্দের লিঙ্গ অর্থনিরপেক্ষ হলেও সংস্কৃতের লিঙ্গ-বিধি থেকে তা স্বতন্ত্র হয়ে নিজস্ব প্রথানুসারে গড়ে উঠল। যেমন— সংস্কৃতে ‘দধি’ শব্দ ছিল ক্লীবলিঙ্গ, কিন্তু নব্য ভারতীয় আর্য হিন্দিতে দধি থেকে জাত শব্দ ‘দহী’ হল পুংলিঙ্গ, সিন্ধিতে ‘দহী’ স্ত্রীলিঙ্গ, মারাঠিতে ‘দহি’ ক্লীবলিঙ্গ।

(খ) প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় প্রত্যেক কারকের সুনির্দিষ্ট বিভক্তি ছিল এবং শব্দের সঙ্গে এইসব বিভক্তি যুক্ত হওয়ার ফলে প্রায় প্রত্যেক কারকে শব্দের স্বতন্ত্র রূপ হত। কিন্তু নব্য ভারতীয় আর্যে এই বিভক্তিগুলি প্রায় সবই লুপ্ত হল। মাত্র দু-একটি প্রাচীন বিভক্তির পরিবর্তিত রূপ রয়ে গেল। যেমন গৃহাণাম্ > পঞ্জাবি ঘঁরা। আর যেসব ক্ষেত্রে প্রাচীন বিভক্তিগুলি লুপ্ত হল সেসব ক্ষেত্রে বিভক্তির অর্থ প্রকাশের জন্যে নতুন প্রত্যয়, প্রত্যয়স্থানীয় শব্দ ও অনুসর্গের ব্যবহার প্রচলিত হল। যেমন— সম > হিন্দি সে (কলম সে = কলমের দ্বারা, ঘর সে = ঘর থেকে)।

(গ) শব্দরূপের বিচারে নব্যভারতীয় আর্য ভাষায় কারক পাই দুটি—মুখ্য কারক (Direct case) বা কর্তৃকারক এবং গৌণকারক বা তির্যক্ কারক (Oblique case)। সংস্কৃতে কর্তৃকারকের নিজস্ব বিভক্তি ছিল প্রথমা বিভক্তি। নব্য ভারতীয় আর্যে প্রথমায় প্রায়ই শূন্য বিভক্তি (অর্থাৎ বিভক্তিহীনতা) দেখা যায়। এ ছাড়া তৃতীয়ার অবক্ষয়-জাত বিভক্তিও নব্য ভারতীয় আর্যে কর্তৃকারকে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। যেমন— সংস্কৃতে অনুক্ত কর্তায় যে তৃতীয়া বিভক্তির ব্যবহার ছিল তার অবক্ষয়িত রূপ থেকে বাংলায় কর্তৃকারকের -‘এ’ বিভক্তির প্রচলন বলে অনেকে মনে করেন। (সংস্কৃত ‘পুত্রেণ খাদ্যতে’ > অপভ্রংশ ‘পুত্তে খাইঅই’ > বাংলা ‘পুতে খায়’)। অর্থাৎ মুখ্য কারকে (কর্তৃকারকে) হয় শূন্য বিভক্তি, নয় তৃতীয়ার অবক্ষয়জাত বিভক্তি প্রচলিত হল। আর গৌণ কারকে বা তির্যক কারকে ষষ্ঠী বিভক্তি বা সপ্তমী বিভক্তি যোগ করে তার সঙ্গে অনুসর্গ যোগের রীতি প্রচলিত হল। যেমন বাংলা ‘আমার সঙ্গে’, হিন্দি ‘মেরে সাহ্’।

(ঘ) অধিকাংশ নব্যভারতীয় আর্যভাষায় একবচন ও বহুবচনের রূপভেদ রইল না। সেসব ভাষায় বহুবচন বোঝায় শব্দের পৃথক রূপ দিয়ে নয়, বহুত্ববাচক। পৃথক শব্দ দিয়ে অথবা ষষ্ঠী বিভক্তির অবক্ষয়িত রূপ দিয়ে। যেমন বাংলা পুরুষ + এর (ষষ্ঠী বিভক্তি) = পুরুষে > পুরুষেরা। কিন্তু পশ্চিমা হিন্দি, সিন্ধি, মারাঠি প্রভৃতি কয়েকটি নব্য ভারতীয় আর্যভাষায় একবচন ও বহুবচনের পৃথক রূপ লক্ষ্য করা যায়। যেমন— পশ্চিমা হিন্দি একবচন— লড়কা, বহুবচন লড়কে, একবচন বাত, বহুবচন— বাতেঁ (< বার্তানি)।

(ঙ) নব্যভারতীয় আর্যভাষায় ক্রিয়ারূপেও সরলীকরণ হয়েছে খুব বেশি। প্রাচীন ভারতীয় আর্যে ক্রিয়ার পাঁচ ভাবে (Mood) ও পাঁচ কালে পৃথক পৃথক রূপ ছিল, এই রূপবৈচিত্র্য সাধিত হত পৃথক পৃথক বিভক্তি যোগ করে। নব্য ভারতীয় আর্যে শুধু কর্তৃবাচ্যে ও কর্মভাব বাচ্যে বর্তমানের বিভক্তি-ঘটিত রূপ স্বাতন্ত্র্য বজায় আছে, আর ভাবের মধ্যে শুধু বর্তমান কালে নির্দেশক ও অনুজ্ঞার স্বতন্ত্র রূপ আছে। অন্যদিকে অতীত কালের রূপ রচিত হয় নিষ্ঠা প্রত্যয়, আর ভবিষ্যৎ কালের রূপ রচিত হয় শতৃ প্রত্যয় যোগে। যেমন— চ্‌ল + ক্ত = চলিত-এর অনুসরণে ॥ চল + ইল্ল বাংলা—চলিল।

(চ) নব্য ভারতীয় আর্যভাষায় একাধিক ধাতুর সংযোগে গঠিত যৌগিক কালের রূপ দেখা দিল। যেমন— বাংলা কর + ইয়া (এ) + / আছ + এ = করেছে। (এখানে ‘কর’ ও ‘আছ’— দুটি ধাতু মিলে একটি ক্রিয়া গঠিত হয়েছে)।

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!