কথাসাহিত্যিক মুন্সী প্রেমচন্দর কৃতিত্ব আলোচনা কর।
কথাসাহিত্যিক মুন্সী প্রেমচন্দ
প্রেমচন্দ (১৮৮০-১৯৩৬) সাহিত্য জীবনের শুরুতে উর্দুতে লিখতেন। পরে হিন্দিতে লেখেন। তার অনেক উপন্যাসই প্রথমে উর্দুতে লেখা, পরে তিনি নিজেই হিন্দি সংস্করণ প্রকাশ করেছেন। উর্দুতে লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাস হল ‘ইসরারে মহব্বত’। বেনারসের একটি উর্দু সাপ্তাহিক পত্রিকায় এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির নাম হল ‘আওয়াজ খলক’, সম্ভবত ১৯০৩ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
ঔপন্যাসিক প্রেমচন্দ
প্রেমা
হিন্দিতে লেখা প্রেমচন্দের প্রথম উপন্যাস হল ‘প্রেমা’ (১৯০৭)। এটি তার উর্দুতে লেখা ‘হমখুরমা ওয় হম সওয়ার’ উপন্যাসের হিন্দি অনুবাদ। প্রথম দিকে লেখা হলেও ‘প্রেমা’ প্রেমচন্দের খুবই উল্লেখযোগ্য রচনা। সামাজিক উপন্যাস রূপেও এর গুরুত্ব ছোট করা চলে না। বিধবা বিবাহ প্রচলিত হলেও বিধবা বিবাহের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে ‘প্রেমা’ উপন্যাসটি।
‘প্রেমা’ উপন্যাসটি শুধুমাত্র পাঠকের চিত্ত বিনোদনের জন্য লেখা হয়নি। সমাজ সমস্যার গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছেন লেখক। বিধবা বিবাহ সমস্যাকে অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী ভাষায় রূপদান করা হয়েছে ‘প্রেমা’ উপন্যাসে।
সেবাসদন
‘সেবাসদন’ উপন্যাস লিখে প্রেমচন্দ বিপুল খ্যাতি ও অর্থ উপার্জন করেন। মোট ৫৭টি অধ্যায়ে ‘সেবাসদন’ উপন্যাসটি রচিত। জন্মভর নির্লোভ থাকার পর কীভাবে সামাজিক কারণে ঘুষ নিতে বাধ্য হল দারোগা কৃষ্ণচন্দ তার বিবরণ আছে প্রথম কয়েকটি অধ্যায়ে। দশম অধ্যায়ে সুমন ও গজাধরের দাম্পত্য কলহ ও সুমনের গৃহত্যাগের ঘটনাটি ঘটে। বাকি ৪৭টি অধ্যায়ে যা বর্ণিত হয়েছে তা কোনো পারিবারিক সমস্যা নয়, একান্তভাবে একটি সামাজিক সমস্যা সেটি হল বেশ্যাদের পুনর্বাসনের সমস্যা।
প্রেমচন্দ সমাজচেতনা সম্পন্ন লেখক। সমাজের একটি জলন্ত সমস্যাকে এখানে শুধুমাত্র পাঠকের মনোরঞ্জন করার জন্য উপস্থিত করা হয়নি। ‘প্রেমা’ উপন্যাসে যেমন বিধবা বিবাহ সমস্যা কীভাবে সমাজের ভিতর থেকেই বাধা পেয়েছে তা দেখানো হয়েছে, ‘সেবাসদন’ উপন্যাসেও বেশ্যাদের পুর্নবাসন কীভাবে সম্ভব হচ্ছে না তা দেখানো হয়েছে।
প্রেমচন্দ এমন একজন ভারতীয় লেখক যিনি ভারতীয় সমাজ সমস্যাকে একেবারে সমস্যার গভীরে নিরীক্ষণ করেন এবং তার সম্ভাব্য সমাধানের কথাটাও ইঙ্গিত করেন। শরৎচন্দ্রের লেখায় সমাজ সমস্যার করুণ চিত্র থাকলেও সমস্যার স্পষ্ট সমাধান থাকে না। এই দিক থেকে প্রেমচন্দের সঙ্গে তার পার্থক্য সহজেই নজরে পড়ে। প্রেমচন্দ ‘প্রেমা’ উপন্যাসে বিধবাবিবাহের সমস্যা ও ‘সেবাসদনে’ বেশ্যাদের জীবনসমস্যা তাই স্পষ্টতই সমাধানগামী হয়। এই সমাধান যে সমাজের সবাই মেনে নেয় না তারও যেমন ইঙ্গিত আছে, কেন নেয় না তারও স্পষ্ট বিশ্লেষণ আছে এই উপন্যাসে। প্রেমচন্দের ঔপন্যাসিক বৈশিষ্ট্যের এ এক স্বাতন্ত্র্য-চিহ্নিত উদাহরণ।
প্রেমাশ্রম
দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমাজসমস্যা মূলক উপন্যাস লেখার পর প্রেমচন্দ কৃষক জীবন ও সমস্যার দিকে মন দিলেন—‘প্রেমাশ্রম’। এই উপন্যাসটির উর্দু সংস্করণটির নাম গাশ আফিয়ত বা শান্তিপূর্ণ পশ্চাদপসরণ। এই উপন্যাসে ধনতন্ত্রের উদয় ও সামন্ততন্ত্রের পরিণাম দেখানো হয়েছে।
‘প্রেমাশ্রম’ গ্রাম ভারতের ছবি। গ্রামের মানুষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার ছবি। গ্রামের চাষিদের দুঃখকষ্ট যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের নিখুঁত ছবি এই উপন্যাস। ১৯২০ সালে ব্রিটিশ রাজের জুবিলি উৎসব পালন অনুষ্ঠানে লেখক যোগ দেননি। ব্রিটিশ শক্তির এই জয়োৎসব তার কাছে ছিল অর্থহীন। পরিবর্তে গ্রামের সাধারণ মানুষের দুঃখে ও সংগ্রামে অংশ নেওয়াটাই তার কাছে অনেক বড় ছিল। ১৯২০ সালে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন তাকে উদ্দীপ্ত করেছিল। তাই গ্রামের বাস্তব ও বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে তিনি সাধারণ মানুষের জেগে ওঠার কাহিনী রচনা করেন। মানুষের জীবনের ভোগ লালসা ও তার পরিণামকে বিচিত্রভাবে লেখক উপস্থিত করেছেন।
৬৫টি অধ্যায়ের শেষে লেখক পৃথকভাবে একটি উপসংহার বর্ণনা করেছেন। বিচিত্র জীবনের ও বিচিত্র সব পরিণতি এখানে বর্ণিত। আত্মগ্লানি আর গ্রামের পাঁচজনের কথা ভেবে মনোহর জেলেই আত্মহত্যা করে। বৈভব লালসা জ্ঞানশঙ্করকে আত্মোন্মত্ত করে। প্রেমশঙ্করকে বিবাগী করে তোলে। গায়ত্রীর পরিণাম আরও দুর্ভাগ্যজনক। অন্যদিকে প্রেমাশ্রমে নিত্যসেবা ও প্রজাহিতের চর্চা চলতেই থাকে।
‘প্রেমাশ্রম’ উপন্যাসে একদিকে সমাজভাবনা, অন্যদিকে দেশভাবনার ঔপন্যাসিক রূপ। সাধারণ জীবন এবং গরিব-বড়লোক, কৃষক-জমিদার, সরকার-প্রজা প্রভৃতি বিচিত্র সম্বন্ধকে পরিস্থিতি অনুযায়ী বিচার করা হয়েছে। জ্ঞানশঙ্করের ক্রোধ, লোভ বা বিকারের ছবির, পাশাপাশি আছে প্রেমশঙ্করের উদারতা ও মহানাদর্শ।
তীব্র সমাজচেতনা যে প্রেমচন্দের উপন্যাসের প্রধান প্রেরণা তা ‘বরদান’ উপন্যাসটি পাঠ করলেও বোঝা যায়। এই উপন্যাসটির নায়ক প্রতাপচন্দ্র নিজেকে সমাজসেবার কাজে উৎসর্গ করে। প্রতাপের হৃদয় পরিবর্তন, আত্মজয় ও সেবাধর্ম গ্রহণের পটভূমি লেখক চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। প্রেমচন্দের সাহিত্য সমালোচকেরা ‘বরদান’ উপন্যাসটিকে কিশোরপাঠ্য রচনা মনে করে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চান না, কিন্তু এই ছোট উপন্যাসটিতে প্রেমচন্দের জীবনভাবনার পরিচয় মেলে।
রঙ্গভূমি
প্রেমচন্দের সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনা বিশেষভাবে পূর্ণতা পেয়েছে ‘রঙ্গভূমি’ উপন্যাসটিতে। ‘প্রেমাশ্রম’ উপন্যাসের মতই বড় ক্যানভাসে আঁকা ‘রঙ্গভূমি’। এই উপন্যাস ‘চৌগান-এ-হস্তি’ নামে উর্দুতে লেখা হলেও হিন্দিতেই প্রথম ছাপা হয় (১৯২৫)। এই উপন্যাসে দরিদ্র কৃষকের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ছবি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সামন্তপ্রভু, ধনতান্ত্রিক শক্তি ও সরকারী আমলা মিলিতভাবে দরিদ্র চাষিদের পিষে মারতে চায় আর তারই বিরুদ্ধে মিলিত সংগ্রাম বর্ণিত হয়েছে এখানে।
কায়াকল্প
‘কায়াকল্প’ উপন্যাসে প্রেমচন্দ তার প্রচলিত উপন্যাস রচনার পথ থেকে কিছুটা সরে। আসেন। এই উপন্যাসটি একটু ফ্যানটাসি ধরনের। তবে দাঙ্গা ও অন্যান্য সামাজিক ঘটনার বর্ণনায় তার মনোযোগ লক্ষ করার বিষয়।
‘কায়াকল্প’ উপন্যাসে একটি সংক্ষিপ্ত উপসংহার সহ ৫৬টি পরিচ্ছেদ আছে। কাহিনী জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে ছয়টি ছোটবড় উপকাহিনীর মিশ্রণে। মনে হয় বড় ক্যানভাসে ছবি আঁকার প্রেরণায় প্রেমচন্দ এই উপন্যাসে অসংখ্য ঘটনা ও চরিত্রের অবতারণা করেছেন এবং অনাবশ্যক হলেও কাহিনী জটিল হয়ে পড়েছে। লক্ষণীয়, কাহিনীর শিথিলতা পাঠক মনোরঞ্জনে অবশ্য ব্যর্থ হয় না।
মূলত ফ্যানটাসি ধরনের রচনা হলেও ‘কায়াকল্প’ উপন্যাসটিতে ভারতীয় সমাজের ত্রিস্তর ছবি ফুটে উঠেছে। সামন্ত প্রভুদের বিলাসলাস্য, চাষিদের জীবনশোষণের রূপ এবং তাদের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের ছবি এবং মধ্যবিত্ত সমাজের দোদুল্যমানতার পরিচয় আছে। এই উপন্যাসের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বিষময় ফল বর্ণনা।
নির্মলা
‘নির্মলা’ উপন্যাসটি প্রেমচন্দের পরিণত প্রতিভার ফসল। ‘প্রেমা’-র মত উপন্যাসে বিধবা বিবাহ বর্ণিত হয়েছিল। ‘সেবাসদন’ উপন্যাসে বেশ্যাজীবনের সমাধানের একটা পথ খুঁজেছিলেন লেখক। ‘নির্মলা’ প্রধানত মধ্যবিত্ত পরিবারে বরপণ না দিতে পারার কঠিন পরিণামকে বাস্তবসম্মতভাবে দেখানো হয়েছে। (অসম) বিবাহ এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয়।
‘সেবাসদনে’র সুমনের-এর মতই নির্মলা সমাজের পণপ্রথার বলি। অযোগ্য পাত্রে বিবাহ হওয়ায় তার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বিধবা ননদ, প্রৌঢ় স্বামী এবং তাদের সন্দেহ ও দুর্ব্যবহার তার জীবনকে দুর্বহ ও অসহায় করে তোলে। সামাজিক কুপ্রথার পঠিত দেখানোই সমাজসচেতন লেখকের উদ্দেশ্য।
গবন
‘সেবাসদনে’র থীম আবার ফিরে দেখা দিয়েছে ‘গবন’ (১৯৩১) উপন্যাসে। ঠিক যেমন ‘প্রেমা’-র বিষয়বস্তু অবলম্বনে পুনরায় লেখা হয়েছে ‘প্রতিজ্ঞা’ (১৯২৭)।
‘গবন’ উপন্যাসে মধ্যবিত্ত মানসিকতার স্বরূপ ধরা পড়েছে। সাধ ও সাধ্যের আকাশ পাতাল ফারাক সমস্যা সৃষ্টি করেছে রমানাথের জীবনে। মিথ্যে ঠাট বজায় রেখে সে যতই স্ত্রীর মন জয় করতে চেয়েছে সমস্যা ততই জটিল হয়ে ওঠে। তার মনের সংশয় দ্বন্দ্ব ভয়কে প্রেমচন্দ চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘গবন’ ৫২টি পরিচ্ছেদে সম্পূর্ণ। এই উপন্যাসের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। অর্থভিত্তিক সম্পর্কের কাহিনী। টাকা ধার, ধার শোধের জন্য তাগাদা ও তিক্ততা। ধার শোধে অসামর্থ্য, মানসিক ভয় ও অস্থিরতা, টাকা-ভিত্তিক বন্ধুত্ব ও বিচ্ছেদ, টাকার জন্য পেয়াদার জুলুম, নালিশ, মিথ্যে সাক্ষী ইত্যাকার ঘটনার ঘনঘটা।
কর্মভূমি
শেষ জীবনে লেখা প্রেমচন্দের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা ‘কর্মভূমি’ (১৯৩২)।‘মৈদান-এঅমল’ শিরোনামে উর্দুতে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসের চরিত্রগুলি প্রায় সকলেই গান্ধীবাদী হয়ে ওঠে ও ঐ আদর্শ নিয়েই স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেয়। সুখদা যেভাবে নিজেকে পরিবর্তিত করে স্বামীর সঙ্গে দারিদ্র্য মেনে নেয় ও ঐশ্বর্যময় ভোগসুখ ত্যাগের পথ ধরে তা যথার্থই প্রশংসনীয়। উপন্যাসের অন্যান্য নারী চরিত্রগুলোর মধ্যেও এই পরিবর্তন দেখা যায়। অসংখ্য চরিত্র ও ঘটনা এই উপন্যাসটিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা ভারতীয় উপন্যাসের ইতিহাসে বিশিষ্টতা দান করেছে।
গোদান
প্রেমচন্দের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস হল ‘গোদান’। গ্রাম ভারতের এক বিশ্বস্ত ছবি এই উপন্যাসে পাওয়া যায়। দরিদ্র চাষির দুর্দশা ও ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়ার মর্মন্তুদ বিবরণ আছে এই উপন্যাসে। ঋণের অক্টোপাশ কীভাবে চাষির জীবনে নাভিশ্বাস তোলে তারই মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়েছেন প্রেমচন্দ।
ঘটনার কেন্দ্রে আছে চাষির গোরু এবং এই গোরুকে কেন্দ্র করেই একের পর এক ঘটনা ঘটে হরির জীবনে। চাষি পরিবারে গোরুই হল সম্পদ। উপন্যাসটির নায়ক হরি এক চাষি। একটি গোরু পোষার সাধ তার অনেকদিনের। অযোধ্যার বেলারি গ্রামে তার পাঁচ বিঘে জমি থেকে যা ফসল হয় তা ঋণদাতাদের টাকা শোধ করতেই চলে যায়। হরির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি ও তার বৌ ধনিয়া তার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে তাদের ছটি সন্তানের মধ্যে তিনটি মারা যায়। বড় ছেলে গোবরের বয়স ষোল আর রূপা ও সোনার বয়স যথাক্রমে বারো ও আট। হরি উচ্চ ও ধনিক শ্রেণীর শোষণের শিকার হয়ে ওঠে আর ধনিয়া প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। চাষির অধিকারের লড়াই করে গোবরও।
‘গোদান’ শুধুমাত্র চাষিজীবনের কাহিনী নয়। সামন্ত প্রভু ও ধনিক শ্রেণীর শোষণের চেহারাটাও তুলে ধরেছেন লেখক। গ্রাম ও শহর দুই-ই এর পটভূমি। ধনী ও দরিদ্র এই শ্রেণীর ছবিই এই উপন্যাসে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে। হরির জীবনে লাঞ্ছনা, দুর্ভাগ্য ও ঋণের ভার প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে দিনেদিনে।
সমগ্র ভারতীয় সাহিত্যে ‘গোদান’ উপন্যাসের তুলনা মেলা ভার। হরির জীবনকথা প্রকৃত পক্ষে দারিদ্র্য লাঞ্ছিত ভারতীয় কৃষকদেরই জীবনকথা। আর হরিকে সেই লাঞ্ছিত জীবনের প্রতীক বলা যায়। অন্যদিকে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর শোষণ ও বিত্তলালসাময় জীবনের ছবিও পাশাপাশি এই উপন্যাসে ফুটে উঠেছে।
গ্রাম জীবন তথা পল্লীসমাজের বিশ্বস্ত ছবি উপস্থাপন ‘গোদান’ উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। উত্তর ভারতের যে গ্রামের ছবি প্রেমচন্দ এঁকেছেন সেখানে ধনী আরও ধনী হয়েছে, দরিদ্র আরও দরিদ্র হয়েছে। গ্রামবাসীদের সরলতা, ধর্মপরায়ণতা, দারিদ্র্যতা, অজ্ঞতা ওঅশিক্ষার নানা টুকরো ছবি যেমন আছে তেমনি আছে সামাজিক ও আর্থিক বৈষম্য ও শোষণের নির্মম চিত্র।
প্রেমচন্দ সাহিত্যের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে লিখেছিলেন— “যিনি জনসাধারণের, সাহিত্যিক হবেন তিনি জনসাধারণের ভাষায় লেখেন। আমাদের উদ্দেশ্য দেশে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে অভিষ্ট ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে।” লেখক জীবনে, উপন্যাস রচনার মধ্যে তিনি যে সমাজ সচেতন মন নিয়েই সেই কাজই করে গেছেন। নিজের লেখা উপন্যাস বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ইন্দ্রনাথ মদানকে লেখা এক চিঠিতে (২৬ ডিসেম্বর ১৯৩৪) তিনি লিখেছিলেন— “আমি প্রত্যেক উপন্যাসে একটি আদর্শ পাত্র রেখেছি। ‘প্রেমাশ্রমে’ জ্ঞানশঙ্কর, ‘রঙ্গভূমিতে’ সুরদাস, তেমনি রয়েছে ‘কায়াকল্পে’ চক্রধর, ‘কর্মভূমিতে’ অমরকান্ত।” একথাও তিনি জানাতে ভোলেন না যে জনমত তৈরি করাই তার উদ্দেশ্য। আর এজন্য সামাজিক বিকাশে তিনি বিশ্বাসী।
প্রেমচন্দের উপন্যাসে সেই সামাজিক বিকাশের বীজমন্ত্র নিহিত। ভারতীয় সাহিত্যে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর উপন্যাস সম্ভার শুধু হিন্দি সাহিত্যে নয়, ভারতীয় সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ।
ঔপন্যাসিক হিসাবে প্রেমচন্দ অসামান্য খ্যাতির অধিকারী ছিলেন। অবশ্য অনেক সমালোচক মনে করেন যে তিনি যদি উপন্যাস না লিখে কেবল ছোটোগল্প লিখতেন তাহলেও হিন্দি কথা সাহিত্যে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন। অনেকে ঔপন্যাসিক প্রেমচন্দ অপেক্ষা ছোটোগল্পকার প্রেমচন্দকে অধিকতর সফল বলে মত প্রকাশ করেছেন। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য, রচনারীতি এবং স্পষ্ট বক্তব্যের জন্য তিনি যথার্থ ছোটোগল্পকারের স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। ১৯০৭–১৯৩৬ দীর্ঘ ত্রিশ বৎসর ধরে তিনি প্রায় ২৭৭টি ছোটোগল্প লিখেছেন। তার গল্পরচনার সূচনা হয় ১৯০৭ সালে ‘দুনিয়া কা সবসে আনমোল রতন’ রচনার মাধ্যমে। প্রেমচন্দ যখন ছোটোগল্প রচনায় আত্মনিয়োগ করেন তার আগেই তিনি ছোটোগল্পকার লিও টলস্টয় এবং রবীন্দ্রনাথের অমর ছোটোগল্পগুলির অনুবাদকর্মে রত ছিলেন। ফলে প্রথম শ্রেণির ছোটোগল্পকারদের রচনারীতি, কাহিনিবিন্যাস ও চরিত্রায়ণ তাকে প্রভাবিত করেছিল। এদের রচনা সান্নিধ্য তার প্রতিভাকে আরও শানিত করে তোলে ফলে তার ছোটোগল্পগুলি কালজয়ী ছোটোগল্পের মর্যাদালাভে সমর্থ হয়। তার প্রথম গল্প ‘সোজে রতন’ নামক গল্পসংগ্রহ ১৯০৪ সালে প্রকাশিত হয়। কিন্তু সরকারি শিক্ষক হয়ে নবাব রায় ছদ্মনামে তার লেখা এই বই তীব্র দেশপ্রেমমূলক হওয়ায় ইংরেজ সরকারের বিষদৃষ্টিতে পড়ে এবং গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তার লেখার উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে লেখক প্রেমচন্দ ছদ্মনাম নিয়ে লিখতে শুরু করেন।
গল্পকার প্রেমচন্দ
তাঁর গল্পসংকলন গ্রন্থগুলিকে হলো— সপ্তসরোজ, নবনিধি, প্রেমপূর্ণিকা, প্রেমপচ্চীসী, প্রেম প্রসূন, প্রেম দ্বাদশী, প্রেম প্রতিভা, প্রেম প্রমোদ, অগ্নিসমাধি, পাঁচফুল, প্রেম চতুর্থী, প্রেমতীর্থ, প্রেম প্রতিজ্ঞা, প্রেম পঞ্চমী, সপ্তসুমন, সমর যাত্রা, প্রেরণা, পঞ্চপ্রসূন, নবজীবন প্রভৃতি লেখক নিজে তার বেশিরভাগ গল্প ‘মানসসরোবর’ নামক গ্রন্থে সংকলন করেছিলেন। ৮ খণ্ডে প্রকাশিত এই গল্প সংকলন ১০৩টি গল্পের ঠাঁই হয়েছে।
আদর্শ ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য সমূহের যথার্থ বাস্তবায়ন আমরা প্রেমচন্দের ছোটোগল্পসমূহে পাই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চারপাশে অসংখ্য ঘটনাসমূহের মধ্য থেকেই তুলে আনা হয়েছে গল্পের চরিত্রাবলি এবং বিষয়বস্তুকে, গোষ্পদে আকাশ দর্শনই ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য। তাই জীবন থেকে তুলে আনা এক একটি ঘটনা অসংখ্য ঘটনার, প্রতিনিধিরূপে আমাদের চিত্তে দোলা দেয়। সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজের দৈনন্দিন ঘটনার, তাদের আচার আচরণের, অর্থনৈতিক জীবনের এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের পটচিত্র হল লেখকের গল্পরাজি। উত্তর প্রদেশে অসংখ্য হরিজন বা দলিত সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের বাস। একদিকে জমিদার অন্যদিকে মহাজন এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা তাদের শোষণের স্টিম রোলার চালিয়ে হরিজনদের জীবনকে ওষ্ঠাগত করে তুলত। দলিত জাতির প্রতি তার আন্তরিক সমবেদনা ঝরে পড়েছে এই পর্যায়ের ছোটোগল্পগুলিতে। এই পর্যায়ের গল্পগুলির মধ্যে মন্দির, দুধ কা দাম, খুনে সফেদ, ঠাকুর কা কুঁয়া, কফন, সদগতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের প্রতি লেখকের সহানুভূতির অত্যুজ্জ্বল নিদর্শনরূপে ‘সদগতি’ এবং ‘কফন’ গল্পটির উল্লেখ করা যায়।
প্রেমচন্দের প্রথম পর্বের অনেক ছোটোগল্প তার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ও দেশভক্তিকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। ইংরেজ সরকারে ভ্রান্তনীতির বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করার জন্য তাকে ইংরেজ সরকারের বিষদৃষ্টিতে পড়তে হয়েছে। দেশপ্রেম মূলক গল্পসংকলন গ্রন্থ সোজে রতন এর মুখবন্ধে লেখক নিজেই বলেছেন “বঙ্গাল কে বিভাজন নে লোগাঁ কো দিলো মে বিদ্রোহ কী চেতনা জাগাই হ্যায়। সাহিত্য পর ভী ইসকা অসর হোগা হী। ইস সংগ্রহ মে প্রস্তুত কহানিয়োঁ মেঁ যহ চেতনা মুখর হুই হ্যায়”, অর্থাৎ বঙ্গবিচ্ছেদ লোকের মনে বিদ্রোহের চেতনা সঞ্চারিত করেছিল এবং সাহিত্যের পাতায় তার প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর গান্ধিজির ডাকে প্রেমচন্দ ইংরাজ সরকারের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। তার মনে বিশ্বাস জন্মে যে সরকারি চাকরি করা মানেই চাটুকারিতা করা। তার দেশভক্তি ও ঐতিহাসিক গল্পগুলি যথা—শতরঞ্জ কী খিলাড়ী, সতী ও রানী সারন্ধা এই পর্যায়ভুক্ত।
প্রেমচন্দের উপন্যাসে আমরা নারীজীবনের সমস্যা ও যন্ত্রণার অসংখ্য ছবি পেয়েছি। সর্বত্রই তিনি নারীকে অন্ধ কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন। বাংলা কথা সাহিত্যে আমরা শরৎচন্দ্রের লেখনীতে নারী জীবনের জটিল সমস্যাসমূহের উল্লেখ পেয়েছি। অবৈধ ও অসামাজিক প্রেমের কাহিনিকে শরৎচন্দ্রের ন্যায় প্রেমচন্দ ও তার সাহিত্যে চিত্রিত করেছেন। এদের দুজনের সাহিত্যেই পতিতা এবং অসতীরা মনুষ্যত্বের মানদণ্ডে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রেমচন্দের এই পর্যায়ের গল্পসমূহের মধ্যে ‘বড়ে ঘর কী বেটী’, ‘আধার’, ‘স্বামীনী’, ‘মাতা কা হৃদয়’, ‘উদ্ধার’, ‘অগ্নিসমাধি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
প্রেমচন্দের বাল্যকাল এবং কৈশোর গ্রাম্য পরিবেশে অতিবাহিত হয়েছিল। তার সমগ্র চেতনায় গ্রামের পরিবেশ সম্পৃক্ত। তাই গ্রাম এবং গ্রামের মানুষজন তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রেমচন্দের লেখনী মূলে ভিড় জমিয়েছে। জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে জীবিকার সন্ধানে তাকে শহরমুখী হতে হলেও গ্রামের মানুষজন চিরদিন তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করেছিল। অনাহারক্লিষ্ট, দরিদ্র চাষিদের জীবনের বাস্তবায়ন নিয়ে তার ছোটোগল্পগুলির মধ্যে ‘মুক্তিমার্গ’, ‘অগ্নিসমাধি’, ‘বেটী কা ধন’, ‘বলিদান’, ‘পঞ্চ পরমেশ্বর’, ‘রোশনী’, ‘মুক্তিধন’, ‘পুস কী রাত’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
প্রেমচন্দ কিছু Satire ধর্মী ছোটোগল্প রচনা করেছিলেন। ‘মোটেরাম’ নামে একটি চরিত্রকে অবলম্বন করে আমাদের সমাজব্যবস্থার দোষ-ত্রুটিগুলিকে প্রকাশ করার সাহস দেখিয়েছেন। সরকারি অব্যবস্থা, মহাজন ও ইংরাজদের অর্থলিপ্সা, হরিজনদের সঙ্গে উচ্চবর্ণের সংঘর্ষ ইত্যাদি কাহিনিই এই পর্যায়ের ছাটোগল্পগুলির উপজীব্য। ‘মোটেরাম শাস্ত্রী’, ‘মোটর কী ছীটে’, মনুষ্য কা পরম ধর্ম’, ‘নিমন্ত্রণ’ ইত্যাদি ছোটোগল্পগুলি এই পর্যায়ে পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’র কমলাকান্ত চক্রবর্তী চরিত্রের সঙ্গে ‘মোটেরামের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
বাল্যাবস্থায় প্রেমচন্দ প্রিয়জনদের স্নেহবঞ্চিত ছিলেন। স্নেহবুভুক্ষু প্রেমচন্দ নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে শিশুমনের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য স্নেহের পরশের মূল্য জ্বরজ্বালার থেকে অনেক গুণ বেশি। মানুষের মর্যাদাবোধ লেখককে খুব নাড়া দিত। ব্যক্তিসত্তার সুষ্ঠু পরিচর্যার জন্য সুস্থ সামাজিক পরিবেশের গুরুত্বকে লেখক উপলব্ধি করেছিলেন। তার এই মানসিকতার পরিচয় সমৃদ্ধ গল্পগুলির মধ্যে ‘ঘরজমোহ’, ‘বিমাতা, ‘প্রেরণা’, ‘চোরী কজাকী’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
কয়েকটি ছোটোগল্পে প্রেমচন্দ মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে মানুষের আত্মিক যোগসূত্র রচনার প্রয়াস পেয়েছেন। শরৎচন্দ্র তার ‘মহেশ’ গল্পে গফুর জোলার সঙ্গে মৃক পশু মহেশের এক আত্মিক যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন। অনুরূপভাবে ‘পুস কী এক রাত’ গল্পে মনুষ্যেতর প্রাণী কুকুর ‘জবরা’র মধ্যে মানবোচিত গুণাবলির প্রকাশ ঘটিয়ে গরিব চাষি হল্লুর আত্মিক যোগসূত্র ঘটিয়েছেন। এই গল্পে একটি গৃহপালিত পশুকে মানবজীবনের সঙ্গে একসূত্রে গ্রথিত করে লেখক গল্পটিকে অনন্যসাধারণ করে তুলেছেন। এই পর্যায়ে আমরা ‘দো বয়লো কী কথা’ এবং ‘স্বত্বরক্ষা’ গল্পগুলির উল্লেখ করতে পারি।
প্রেমচন্দের সামাজিক গল্প ‘কফন’ তার শ্রেষ্ঠ গল্পের মর্যদা পাবার দাবিদার, এই গল্পের প্রধান চরিত্র দুটি হল যীশু ও মাধব আসলে বাবা ও ছেলে। চুরি করাই তাদের পেশা। মাধবের গর্ভবতী স্ত্রী সারাদিন পরিশ্রম করে তাদের মুখের অন্ন জোগাত। তারা খেটে খেতে চায় না। মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীর সামনে তারা পিতাপুত্রে চুরি করা আলু পুড়িয়ে গোগ্রাসে গিলতে ব্যস্ত। তারা এত অলস যে স্ত্রীর মৃত্যুর পরে তার কফন কেনার পয়সা জোগাড় করার চেষ্টা থেকেও বিরত থাকে। গ্রামবাসীরা কফন কেনার পয়সা দিলে তারা সেই পয়সায় মদ্য পান করে। মদ্যপ যীশু সদ্যমৃত পুত্রবধূকে আশীর্বাদ করছে কারণ সে মরেও তাদের মদ্যপানের ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে। আমাদের হৃদয়হীন নিষ্ঠুর সমাজব্যবস্থার অর্থনৈতিক অবিচারের ফাঁদ কীভাবে দরিদ্র প্রজাদের গলায় চেপে বসেছে তারই জ্বলন্ত দলিলরূপে এই গল্পটি আমাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
কথাসাহিত্যিক প্রেমচন্দের রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্য
ভারতীয় সাহিত্যের এক উজ্জ্বল রত্ন মুন্সী প্রেমচন্দ। ভারতীয় সমাজ জীবনের ছবি শিল্পশ্রী প্রেমচন্দের রচনায় অসাধারণ ভঙ্গিতে কিন্তু সাধারণ ভাষাতেই রূপায়িত। নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষের সমস্যাকে তিনি অত্যন্ত সহমর্মিতা ও সহানুভূতির সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রেমচন্দের সমাজ চেতনার স্বরূপ বুঝতে হলে তাই বুঝে নিতে হবে ভারতীয় সমাজ সমস্যাকে তিনি কীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রেমচন্দের রচনায় ভারতীয় যে সমাজের ছবি ধরা পড়েছে তার পিছনে সমাজ সচেতন এক শিল্পীকে চিনে নেওয়া যায়। তাঁর রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্যগুলি হলো—
- সামাজিক শোষণের ছবি।
- জমিদারি প্রথা ও জমিদার কৃষক সম্পর্কের ছবি।
- কৃষক জীবনের দুর্দশার অন্তরঙ্গ ছবি।
- শ্রমিক জীবনের অর্থনৈতিক দুর্দশার ছবি।
- পুঁজিপতি ও মহাজনের বৈচিত্র্যময় পরিচয়।
- মধ্যবিত্ত জীবনের বিস্তৃত পরিচয়।
- দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও দেশপ্রেমের মর্মস্পর্শী চিত্র।
- নারীজীবনের অবহেলা ও বঞ্চনার চিত্র।
- মুসলমান সমাজের অন্তরঙ্গ ছবি।
- মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের নিপুণ চিত্র।
এই সবসূত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে প্রেমচন্দের সমাজ চেতনার স্বরূপ বোঝা সম্ভব। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ওই সব প্রধান প্রধান সূত্রগুলো থেকে সূক্ষ্মতর দিকের নানা চিত্রও পাওয়া যায়। প্রেমচন্দের কথাসাহিত্য মূলত লেখকের সমাজ ভাবনারই রূপ। লেখকের অভিজ্ঞতা ও অনুভব এই সব রচনায় শিল্পরূপ লাভ করেছে। প্রাক্-স্বাধীনতা কালে ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস, শ্রেণীবৈষম্য, আর্থ-সামাজিক দুর্দশা ও শোষণ, লিঙ্গভেদ জনিত বৈষম্য, আত্মবিকাশের জন্য সংগ্রাম প্রভৃতি বিষয়গুলো প্রেমচন্দের সমাজচেতনার সঙ্গে ওতপোত জড়িত। ফলে কথাসাহিত্যিক প্রেমচন্দ্র হয়ে উঠেছেন সমাজের কথাকার।
Leave a Reply