বাংলাদেশের কবি সানাউল হকের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
সানাউল হক
চল্লিশের পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্যেও যে কয়েকজন কবি সমকালের স্রোতে ভেসে না গিয়ে রোমান্টিসিজমকে অবলম্বন করে নিসর্গ প্রেমচেতনাকে তাঁদের কাব্যের উপাদান হিসাবে নির্বাচন করেছিলেন সানাউল হক (১৯২৪-১৯৯৩) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল—নদী মানুষের কবিতা (১৯৫৬), সম্ভবা অনন্যা (১৯৬২), সূর্য অন্যতর (১৯৬৩), বিচূর্ণ আর্শিতে (১৯৬৮), ছেলে বুড়োর ছড়া (১৯৬৯), ছড়া ঘরে ঘরে (১৯৭২), কাল সমকাল (১৯৭৫), একটি ইচ্ছা সহস্র পালে (১৯৭৩), প্রবাসে যখন (১৯৮১) প্রভৃতি। নদী ও মানুষের কবিতা কাব্যের নামকরণেই কবিতাগুলির বিষয়ের একটা আভাষ পাওয়া যায়। দু ধরনের কবিতা এই কাব্যে রয়েছে। কিছু কবিতা সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত। যেখানে নিপীড়িত মানুষের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। আন্যদিকে রয়েছে বেশ কিছু কবিতা যেগুলিতে প্রেম ও প্রকৃতি সমান্তরালভাবে নদীর মতো প্রবাহিত হয়েছে। প্রকৃতির যে ছায়াঘেরা রহস্যময় পরিবেশে সানাউল হকের বাল্যকাল অতিক্রান্ত হয়েছে পরিণত বয়সে তিনি কৈশোরের আবেগে সেই প্রকৃতিকেই ফিরে পেতে চেয়েছেন কবিতার মধ্য দিয়ে—
মনে পড়ে সামাজিক লেনদেন, স্নেহ অনুরাগ
কার্তিক-সোনালি-সন্ধ্যা ঝলমল ভিড়ে,
কবির সঙ্গীত-মীড় গঙ্গার পদ্মার তীরে
কেঁপে-কেঁপে গাঁথে সুর-প্রাণউষ্ণ দৃপ্ত ছন্দরাগ।
কেবল অতীতের স্মৃতিচারণায় কবি ডুবে থাকেননি। সমকাল, সমকালের মানুষগুলো আজও তাঁর কাছে সমান প্রাসঙ্গিক। তাদের উপর রাষ্ট্রযন্ত্রের কশাঘাত কবিকে ব্যথিত করে। বুকের বিন্দু বিন্দু রক্ত ঘাম দিয়ে পিতা-মাতা যে সন্তানকে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লক্ষ্যে বড়ো করে তুলতে চায় সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় শাসকের রক্তচক্ষু। তাদের গোলাবারুদের খেলায় নিমেষেই শেষ হয়ে যায় লক্ষ লক্ষ স্বপ্ন আশা। হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ে হত্যাকারীর দল। মুহূর্তে শেষ হয়ে যায় রঙিন কল্পনাগুলো। সেই আশাভঙ্গের সুরই কিছুটা ব্যঙ্গের আকারে বর্ণিত হয় লেখকের কলমে—
মাথায় আকাশ ভাঙে : অতর্কিত বিষের বিদ্রূপ!
উতরোল মৃগয়ায় বারুদের নখরের দাঁও:
বুকের সোনাধন অকস্মাৎ কোথায় উধাও—
বাজ-চিল দাঁড়কাক একজোট মদির লোলুপ।
সম্ভবা অনন্যা কাব্যের কবিতাগুলো প্রবাসজীবনে রচিত। বিদেশে থাকাকালীন তাঁর প্রিয় পূর্ব-বাংলার স্নেহছায়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আক্ষেপ কবিতাগুলিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। মাতৃভূমি ও প্রবাসের ব্যবধানজনিত বিচ্ছেদ এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—
আরো কত রয়ে যায় বাকি। নিরিবিলি
তাই কি মহড়া? অতিচেনামুখ বধূ
কভু সন্ধ্যাতারা–যেন প্রিয়মুখী দেশ
বিশ্বহাটি উজ্জ্বপ্রবাহে : ঝিলিমিলি
রৌদ্রালোকে কান্নার শ্রাবণে। আরো মধু
ক্ষরা— যেন তোমার স্নানোত্তর কেশ।
‘সূর্য অন্যতর’ কাব্যের কবিতাগুলিতে প্রেম-প্রকৃতি মিলে মিশে আছে। রোমান্টিক চোখ দিয়ে কবি পৃথিবীর সৌন্দর্য অবলোকন করতে চেয়েছেন। কবি জানেন এই পৃথিবী রূপে, রসে, গন্ধে, বর্ণে অতুলনীয়। কিন্তু এই সুন্দরের বাগানে আবশ্যক উপাদান মানুষকে তিনি বিস্মৃত হননি। প্রকৃতি কবির কাছে গুরুত্বডপূর্ণ হলেও মানুষের গুরুত্ব তাঁর কাছে আরো বেশি। পৃথিবীর প্রাকৃতিক রূপ ছাড়া বাদবাকি সৃষ্টি মানুষের হাতে। মানুষের কর্ম ও ভাবনাই দিনে দিনে জগতের সুষমা বৃদ্ধি করে চলেছে। মানবজাতির সেই অবদানের কথা উল্লেখ করে কবি বললেন—
পৃথিবী অনেক বড়: আরো বড়
কোনো-কোনো মানুষের, মনীষার মন
এই কাব্যের ‘তিতাশ’ একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবিতা। আলোচ্য কবিতায় নদীর দুই তীরের জনজীবনের বৈচিত্র্য প্রকৃতির তটভূমিতে নতুন ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। বনের ছায়া কবির চোখে কাজল পরা রূপসী বাংলার স্মৃতিকে উজ্জ্বল করে তোলে। নদী যেন ঘাটের মায়া ত্যাগ করে কুয়াশার সঙ্গে কথোপকথনে ব্যস্ত। সমস্ত নদী তীরকেন্দ্রিক বর্ণনায় কবি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত। প্রকৃতির বেশ ধারণ করেই তিনি প্রকৃতির মধ্যে লীন হয়েই প্রকৃতির ভাষা বুঝতে চেয়েছেন। তাই কবির বাল্যকালের ছবি স্মৃতির ঢেউয়ের মতোই আছড়ে পড়ে কবির মনের মোহনায়। কিন্তু স্মৃতি অন্তত কবির কাছে সতত সুখের হয় নি। তাই সুখের সঙ্গে মিশে থাকে দুঃখের বোবা কাহিনি—
তীরে-তীরে কতো-না বন্ধন, নানা নীড় পাখি
কত বউ কলসিনী ধান ও ধসের ইতিহাস
হাসিঝরা প্রিয়মুখ, ছলছল অভিমানী আঁখি;
ভাঙামঠ রাঙামাঠ একপাল মোরগাবি হাঁস।
কাশফুল গো-বাথান জেলেপাড়া বুড়ো কুঁজোবাড়ি :
এই নদী কারিগর তটশিল্পী হয়তো-বা কবি—
ধ্যানীজ্ঞানী যাযাবর খেয়ালী কি আজন্ম নেশাড়ী :
বুকে গান ঠোঁটে রস কটিবাঁকে কতো ফোটে ছবি।
বিচূর্ণ আর্শিতে’ কাব্যে কবি নদীর আবেগকে নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন। স্বদেশ-সমকাল-প্রকৃতি-প্রিয়জন ক্রমান্বয়ে কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। নদীর বাধাহীন অক্লান্ত গতিবেগের মধ্যেই কবি জীবনের ভালোবাসা সন্ধান করেছেন। আবেগের ঢেউ প্রতিমুহূর্তে কবির চিন্তাভাবনাকে আলোড়িত করে চলেছে—
আমি নদী আত্মীয়ের উপচারে
পলিমাটি ঢেউ-সহবাসে
ভরাডুবি নিমজ্জনে
প্রান্তরের প্রাত্যহিক ঘাসে।
নদীর গতিধারার মধ্যে দিয়ে কবি জীবনের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছেন। আবেগের উচ্ছাসে তিনি ভাসেননি। খণ্ড খণ্ড জীবনের রূপকেই তিনি প্রকৃতির পূর্ণতায় ধরতে চেয়েছেন। ক্ষণিকের স্মৃতিকে চিরস্থায়ী আসন দিতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে সহায় হয়েছে নদী। তাই সমালোচক রফিকুল ইসলাম বলেছেন— ‘‘সানাউল হকের অভিজ্ঞতা স্বদেশ ও প্রবাস যেখান থেকেই উৎসারিত হোক না কেন মূর্ছনার বিদ্যুৎ-ছোঁয়া তার মধ্যে উজ্জ্বল প্লাবন সৃষ্টি করেনি। তিতাশের শীতলপাটি রূপই কবি প্রত্যক্ষ করেছে, কবির তিতাশে ঝড় ওঠেনি কখনও।’’
Leave a Reply