বাংলাদেশের কবি শামসুর রাহমানের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
শামসুর রাহমান
পূর্ব-পাকিস্তানের পঞ্চাশের দশকের প্রধান কবি শামসুর রহমান (১৯২৯-২০০৬)। তাঁর প্রথম কাব্য ষাটের দশকের প্রথমে প্রকাশিত হলেও তাঁর কাব্যভাবনার ভিত্তিভূমি গড়ে উঠেছে পঞ্চাশের দশকে। তাঁর প্রথম ছয়টি কাব্য সংকলনের মধ্যেই স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলাদেশের অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর কাব্য সংকলনগুলি হল— প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০), রৌদ্র করোটিতে (১৯৬৩), বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৭), নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৮), নিজ বাসভূমে (১৯৭০), বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২)। তাঁর প্রথম কাব্যের অধিকাংশ কবিতায় আধুনিক নগর জীবনের নৈরাজ্য, অবক্ষয়, বিচ্ছিন্নতাবোধ, ক্লান্তি ও আশাভঙ্গের কথা ফুটে উঠেছে। একাকী মানুষের আর্তনাদ এই সময়ের কবিতায় মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে। যে সমাজ পরিবেশের মধ্যে দিয়ে কবি বেড়ে উঠেছেন তা মোটেও সুখকর ছিল না। চোখের সামনে তিনি দেখেছেন দেশভাগ, একুশে ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রে প্রিয় বর্ণমালার লাঞ্ছনা হচ্ছে, সামরিক শাসন সাধারণ মানুষের দুর্বিসহ জীবন, দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র এসবের প্রত্যক্ষ দ্রষ্টা তিনি। চারিদিকে এই অবক্ষয়ের মধ্যে কবি আশার আলো দেখতে পাননি। তাঁর মধ্যে জন্ম নিয়েছে গভীর নৈরাশ্য। এর জন্যে জীবনের নেতিবাচকতাই প্রধান হয়ে দাঁড়াল তাঁর কবিতায়—
সেখানে গভীর খাদ আছে এক কুটিল, ভয়াল:
অতিকায় সিংহের হাঁয়ের মতো অদ্ভূত শূন্যতা
চতুর্দিকে ব্যাপ্ত তার, আদিগন্ত বিভ্রমে বিহ্বল।
অতল গহ্বরে সেই আছে শুধু পাঁক, পুঞ্জীভূত
আবর্তিত ক্রুদ্ধ ক্রূর অন্ধ পাঁক, শুধু পাঁক।
আকাঙ্ক্ষিত ফুলদল, লতাগুল্ম, পদ্মের মৃণাল
অথবা চিকন মৃগ কিছুই হয় না প্রত্যাখ্যাত
গলিত শবের কীট, কৃমিপুঞ্জ—ঘৃণিত জটিল—
কিছুই জন্মে না তাতে, মৃত্যু ছাড়া জন্মে না কিছুই।
নগরজীবনের হতাশাই কবিআত্মাকে খাদের ধারে এনে দাঁড় করিয়েছে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কবি জীবনের পূর্ণতাকে নয় শূন্যতাকেই বেশি করে লক্ষ করেছেন। নিজের চতুর্দিকে কবি কেবল অবক্ষয়কেই লক্ষ করছেন। জলাশয়ের পাঁক যেমন সবকিছু্র বিনষ্টির স্মারক হয়ে থাকে, জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুর জন্ম দেউ তেমনি সমাজের মধ্যেও কবি পাঁকের প্রাধান্য দেখেছেন। বিচ্ছিনতাবোধ কোনো ইতিবাচকতার জন্ম দিতে পারে না তা কেবলই অন্ধকারের জন্ম দেয়। সেই অন্ধকারের মধ্যেই কবি ভবিষ্যৎ খুঁজে পেতে চেয়েছেন।
শামসুর রাহমানের দ্বিতীয় কাব্য ‘রৌদ্র করোটিতে’ আত্মমগ্নতা কিছুটা কম। কবি ধীরে ধীরে সমাজ-সচেতন হচ্ছেন। এই কাব্যের কবিতাগুলিতে ঢাকা ও ঢাকা শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের কৃত্রিমতা, তুচ্ছতা, একঘেয়েমি বর্ণিত হয়েছে। কবি অনেক ক্ষেত্রে সমসাময়িক স্বার্থকেন্দ্রিক জীবনধারাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপও করেছেন—
যদি মুখ খুলি কী বলব? বলার কিছুই নেই?
বলব কি দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া রমনার শান্ত গাল
দিয়েছে রাঙিয়ে, বলব কি আর দশজন মরে মরুকগে,
আমার সকালে চাই রোজ দুটি আধাসেদ্ধ ডিম,
রুটি-মাখনের সঙ্গে-জ্যাম না-ই হোক, ক্ষতি নেই
নগরের নকল জীবনযাত্রাই কবিকে আক্রমণাত্মক করে তুলেছে। মানুষের দ্বিচারিতা কবিকে কঠোর হতে বাধ্য করেছে। সমাজের একশ্রেণির মানুষ যখন মুক্তির প্রত্যাশায় রক্ত ঝরাচ্ছে তখন তাদের প্রতিবেশীরাই বিন্দুমাত্র সহানুভূতি না দেখিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। একই সমাজ পরিবেশে মানুষের এই ব্যবহার কবিকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। তবে কবি আশাবাদী। তিনি মনে করেন এই পথেই মুক্তি আসবে। প্রকৃতির মধ্যে কবি সেই পূর্ণতাকে খুঁজতে চেয়েছেন। তাই বাস্তবের যন্ত্রনির্ভর ট্রাফিকের ক্লান্তিকর ধ্বনি কবির চেতনায় ঐকতান হয়ে ওঠে। প্লেনের আওয়াজে শূন্যতাও শব্দময় হয়ে ওঠে। আসলে যে নগরজীবন কবিকে ক্রমাগত পীড়িত করেছে সেই নগরজীবনের চোরাগলিতেই কবি জীবনের আলোর সন্ধান করেছেন। নগরজীবনের অবক্ষয়কে আপন সত্তার মধ্যে ধারণ করে তাকে জীবনের নতুন তাৎপর্যে বিকশিত করতে চেয়েছেন—
বাঁচার আনন্দে আমি চেতনার তটে
প্রত্যহ ফোটাই ফুল, জ্বালি দ্বীপাবলি
ধ্যানী অন্ধকারে। আর মৃত্যুকে অমোঘ
জেনেও স্বপ্নের পথে, জেনেও আমার
পৃথিবীতে খুঁজি
জীবনের দান গানে গানে, প্রাণলোকে
খুঁজে ফিরি অপসৃত সুন্দরের স্মৃতি।
‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ গ্রন্থে ষাটের অস্থির সময়কে রূপ দিয়েছেন কবি। পূর্বের কাব্যগুলিতে কবির ব্যক্তিচেতনা প্রাধান্য পেলেও এখানে কবির সেই ব্যক্তিগত মূল্যবোধ অনেকটা স্তিমিত। কবি সমকালীন সমাজের সংকটকে চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করছেন। প্রতিনিয়ত দেখছেন মানুষের আত্মিক মৃত্যু। যুগের সংকট কবির দেহ থেকে আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। মানুষ শোষিত হতে হতে অনুভূতিশূন্য, ভাবলেশহীন জড়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। তাঁর অতিযান্ত্রিক জীবনের মধ্যে কবি মৃত্যপ্রায় সত্তাকে উপলব্ধি করেছেন—
আমি এক কংকালকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটি, প্রাণ খুলে
কথা বলি পরস্পর। বুরুশ চালাই তার চুলে,
বুলোই সযত্নে মুখে পাউডার, দর্জির দোকানে নিয়ে তাকে
ট্রাউজার, শার্ট, কোর্ট ইত্যাদি বানিয়ে ভদ্রতাকে
সঙ্গীর ধাতস্থ করি; দু’বেলা এগিয়ে দিই নিজে
প্রত্যহ যা খাই তাই। কখনো বৃষ্টিতে বেশি ভিজে
এলে ঘরে মাথাটা মুছিয়ে তপ্ত চায়ের পেয়ালা
রাখি তার টেবিলে আর শোনাই বেহালা
কবির বিদ্রুপ এখানে স্পষ্ট। মানুষের নিষ্ক্রিয়তা কবিকে হতবাক করেছে। চারিদিকে মানুষের আচরণ কবির কাছে দুবোর্ধ্য। চেনা স্বদেশের মধ্যে কবি এক অচেনা জন্মভূমিকে দেখছেন যেন।
‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যের কবিতাগুলি কবির সমাজ সচেতন মনের সৃষ্টি। সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক পটভূমি, আন্দোলন-অবরোধ কবি চিত্তে যে উত্তেজনা সঞ্চারিত করেছে তারই ধারাভাষ্য এই কাব্যের কবিতাগুলি। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে মাতৃভাষার লাঞ্ছনা কবি প্রত্যক্ষ করেছেন। নিজের প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে উপলব্ধি করেছেন ভাষা শহিদদের যন্ত্রণা। চরম দুর্দিনে মাতৃভাষার বঞ্চনা দেখে কবি দিশেহারা—
তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
উনিশশো’ বাহান্নোর দারুণ রক্তিম পুস্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছ সগৌরবে মহীয়সী।
সে-ফুলের একটি পাঁপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে
কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউরের পৌষমাস!
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে বাংলার অগণিত মানুষ যখন জীবন বাজি রেখে লড়াইয়ে প্রস্তুত তখন শামসুরের চোখে ভেসে ওঠে ভিন্ন চিত্র। সুদূর পলাশতলির কঙ্কালসার কৃষক, নৌকার মাঝি, চটকলের শ্রমিক, খ্যাপা কুমোর, নিঃসঙ্গ তাঁতি, করুণ কেরানি, তরুণ শিক্ষার্থী, সিনেমা হলের কর্মচারী, সার্কাসের তরুণী, নতুন যুগের কবি-সবাই যেন সারিবদ্ধভাবে কবির চেতনায় এসে ভীড় করে। কবি বুঝতে চান তাদের মনের ভাষা। অবশেষে তিনি বুঝতে পারেন এদের হৃদয়ের ভাষা। এরা সবাই জীবনের ডাকে ঘরকে বাহির আর বাহিরকে ঘর ভেবে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে। তাদের এই সংকল্প কবিকে আশা দেখতে সাহস যোগায়। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি পুনরায় নতুন প্রত্যাশা নিয়ে কবি চেতনায় ফিরে আসে—
বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ,
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।
সালামের বুক আজ উন্মথিত মেঘনা,
সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা।
গণ-অভ্যুত্থান বাঙালি জীবনে যুগান্তকারী ঘটনা। ঘাতক বাহিনির অত্যাচারকে প্রতিরোধ করার জন্য আপামর বাঙালি সেদিন একত্রিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে প্রাণ গিয়েছিল তরুণ যুবক আসাদের। তাঁর মৃত্যু সেদিনের বাঙালিকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলেছিল। তাঁর রক্তমাখা শার্ট বাঙালি চেতনায় নতুন করে বিদ্রোহ সৃষ্টি করেছিল। কবি এই শার্টকে কেন্দ্র করে স্মৃতিচারণ করেছেন। এই শার্টে হয়তো তার বোন যত্ন করে বোতাম লাগিয়েছে, মা পরমস্নেহে রৌদ্রে সেই শার্ট মেলিয়েছে আজ আর ঘাতক বাহিনীর সঙ্গে সংগ্রামে আদরের সেই শার্ট রাজপথে রক্তের স্রোতে ভাসমান। এই শার্টই আজ—
ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চূড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে-কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।
পাকিস্তানের অত্যচারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, নিজেরদেশ পাওয়ার জন্য সেদিনের জনগণ ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল তাদের ব্যাকুলতার পরিচয় দিতে গিয়ে কবি উপমায় ভরিয়ে তুলেছেন কবিতার শরীর। কবি চোখে ভেসে উঠছে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য সদ্য অনাথ শিশু পিতার লাশের উপর হামাগুড়ি দিচ্ছে, উজাড় হচ্ছে ছাত্রাবাস, মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধও দাওয়ার বসে স্বাধীনতার অপেক্ষায়, এমনকি স্বামীহারা বিধবাও আজ স্বাধীনতার পথ চেয়ে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে। শুধু এরা নয় শাহাবাজপুরের জোয়ান কৃষক, মেঘনার দক্ষ মাঝি, ঢাকার রিক্সাওয়ালা সবাই আজ স্বাধীনতার প্রত্যাশায় দিন গুনছে। কবি জানেন এতলোকের আশা ব্যর্থ হবেনা। স্বাধীনতা আসবেই। সেই স্বাধীনতাকে তিনি কৃষিনির্ভর বাংলার বুকেই দেখতে চান। তাই স্বাধীনতার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন—
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শাণিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
মানুষকে তাদের এই স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে, সামাজিক সংকট থেকে সমাজকে, স্বদেশকে রক্ষা করতে কবি কলম ছেড়ে অস্ত্র ধরতেও প্রস্তুত। তাই সর্বহারা শ্রেণির মাঝেই কবি জীবনের তাৎপর্য সন্ধান করেছেন। স্বদেশ ও সমাজের জন্যই কবি কলম ধরেছিলেন। কিন্তু কবি দেখছেন তাঁর কবিতা স্বদেশ ও মানুষকে বাঁচাতে অক্ষম।তাই কবিতাকে জ্বলন্ত মশালে রূপ দিয়েছেন কবি। তাই প্রেম-নারী-নিসর্গকে বুকের ডান পাশে রেখে বাম পাশে কবি ধারণ করেছেন জনগণের রোষ, মুক্তির আকাঙ্খাকে। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তিনি সর্বহারা শ্রেণির মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। হয়ে উঠেছেন তাদের বেদনার অংশীদার।
Leave a Reply