বাংলাদেশের কবি হাসান হাফিজুর রহমানের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
হাসান হাফিজুর রহমান
পঞ্চাশের দশকের অন্যতম কবি-সংগঠক হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩)। পূর্ব-পাকিস্তানের কবিতার ইতিহাসে পঞ্চাশের দশক এমন একটি দশক যে দশক এ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্প নির্মাণের এক নতুন আবেগে উন্মথিত, প্রবলভাবে শক্তিসঞ্চারী তাড়নায় অধীর। এই সময়েই এক ঝাঁক নতুন লেখকের আবির্ভাব ঘটে এই নতুন দেশের নতুন কাব্যভূমিতে। এই নতুন রক্ত ও আবেগকে সঠিক পথে দৃঢ়ভাবে চালিত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। ফলে তাঁর হাতেই এই দশকের কাব্যচেতনার ভীত গড়ে ওঠে। তাঁর ব্যক্তিজীবন ও সমাজ-মনস্কতা তাঁকে সমাজ ও স্বকাল ঐতিহ্যের ধারক করে তুলেছে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনসংকট, ক্রোধ, হতাশা সমাজজীবন থেকেই উৎসারিত। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল—বিমুখ প্রান্তর (১৯৬৩), আর্ত শব্দাবলী (১৯৬৮), অন্তিম শরের মতো (১৯৬৮), যখন উদ্যত সঙ্গীন (১৯৭২), বজ্রেচেরা আঁধার আমার (১৯৭৬), শোকার্ত তরবারী (১৯৮২), আমার ভেতরের বাঘ (১৯৮৩), ভবিতব্যের বাণিজ্যতরী (১৯৮৩)। প্রথম কাব্যেই কবি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর কবিত্ব শক্তির গুণে। কাব্যের নামকরণে বিমুখ এবং প্রান্তর শব্দদুটির ব্যবহারে তিনি নাগরিক মানুষের জ্বালা যন্ত্রণাকে কবিতায় ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি যেমন সক্রিয় আত্মশক্তিতে উজ্জ্বল এক ব্যক্তি ছিলেন তাঁর কবিতাতেও সেই উজ্জীবনে অধীর, শাণিত আশাবাদ স্পন্দিত। বিমুখ প্রান্তর কবিতায় মৃতপ্রায় জীবনেও প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করে উচ্ছসিত হয়ে উঠেছেন কবি। রুক্ষ্ম পোড়া মাটির মধ্যে সবুজাভ তরুর আবির্ভাব কবিকে আশাবাদী করে তুলেছে। কবি যেন দেখছেন মরা মাটি ফুঁড়ে জীবনের কায়া হলুদ বসন্তের আগমন ঘটিয়েছে। কিন্তু বসন্ত যেন তার প্রাণপ্রাচুর্য নিয়ে উপস্থিত হতে পারছে না। হলুদ শব্দ ব্যবহারে সেই ফিকে হওয়া বসন্তের ইঙ্গিত দিয়েছেন কবি। সমাজজীবনেও কবি দেখেছেন অবক্ষয়। স্বপ্ন আশা হারিয়ে মানুষ যেন নিস্পৃহ। সেই আশাহত মানুষের গান শোনালেন কবি—
আজানে কম্পিত কান্না;
প্রসবে প্রসন্না
অথচ সন্তানে রুচি নেই এই
মগ্না চরাচর,
আর স্বপ্ন যেন হৃত-আশা নারী
শুধুই সৌষ্ঠবে ধনী বিলাসিনী;
কিন্তু কবি উজ্জ্বল জীবনের প্রত্যাশী। তাই বন্ধ্যা, শুষ্ক জীবনের মধ্যেও কবি প্রাণের প্রত্যাশা করেন। তৃষ্ণাতুর জীবনেও কবি প্রকৃতির স্নেহ কামনা করেন। তাই স্মৃতির মধ্যে কবি প্রত্যক্ষ করেন নিসর্গের দেওয়ালে সদ্য ফুটন্ত ফুল, চিরচেনা পাখি, আঁকা-বাঁকা নদী, বনস্পতির সঘন ছায়া। বাস্তবের কশাঘাতে বিদ্ধ কবি নিসর্গের প্রাণময় হাওয়ার মধ্যেই শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে চান। তাই প্রকৃতির কাছে কবির আকুল আর্তি—
মায়ের মুখের মতো শ্যামলিমা আয়ুষ্মতী
তুমি চিত্রার্পিতা সৃষ্টি ঈশ্বরের,
আলো দাও, ধ্বনি দাও, প্রাণ দাও
অন্ন তুলে মুখে দাও
রক্তের বিষণ্ন অন্ধকারে স্রোত হয়ে
বয়ে চলো ঢলে ঢলে
তবুও সুস্থির এক দূরত্বের ফ্রেমে তুমি বাঁধা,
স্তব্ধ-মুখ, অবারিত স্রোতে, স্বদেশ আমার, আমরা উৎস, প্রতিধ্বনি-এসব কবিতায়ও কবি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা করেছেন। রাত্রি-দিনের রুক্ষ্ম তিমির অতিক্রম করে কবি অরণ্যানীর কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করেছেন। অন্ধকারের বন্যা পেরিয়ে যে দ্বীপের মিনার কবির মনে জাগবে, যেখানে মাটির পরতে মিশে আছে যন্ত্রণার ইতিহাস সেই আবেগে মাটির কাছেই ফিরে যেতে চান কবি।
আর্ত শব্দাবলী কাব্যের অধিকাংশ কবিতার রচনাকাল ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। আলোচ্য কাব্যের অধিকাংশ কবিতায় সমকালীন সমাজজীবনের অবক্ষয়কে প্রকাশ করার জন্য কবি গ্রিক পুরাণ, ইংরেজি সাহিত্যের আশ্রয় নিয়েছেন। বর্তমানের উদভ্রান্ত সময়ে দিকভ্রান্ত জাতিসত্তার কাছে সবচেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল আত্মানুসন্ধানের সংকট। দীর্ঘকালের পাকিস্তানী শাসনে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ যে বন্দীদশা ভোগ করেছিল তাকে কবি তুলনা করেছেন গ্রিক পুরাণের নায়ক ওডেসিউসের সঙ্গে। তিনি দীর্ঘকাল দেবী ক্যালিপসোর প্রণয়ে আবদ্ধ থাকার পর মুক্তি পেয়ে সমুদ্র পাড়ি দেন। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে কবি পূর্ব-পাকিস্তানের মুক্তিকামী মানুষের ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। এমনকি চোখের সামনে নিজের স্বদেশকে পাকিস্তানী শাসকের হাতে অত্যাচারিত হতে দেখে দেশের সন্তান হিসাবে কবির মনে ঝড় বয়ে গেছে। এই ঘটনাকে কবি হ্যামলেটের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পিতার মৃত্যুর পর নিসঙ্গ হ্যামলেট যে ব্যাভিচার প্রত্যক্ষ করেছিল আজ কবি যেন সেই হ্যামলেটের প্রতিমূর্তি। কিন্তু এতকিছুর পরেও কবির কাছে তাঁর জন্মভূমি একমাত্র সত্য। তাই আমৃত্যু মাতৃভূমির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কবি জানালেন—
আমার হৃৎপিণ্ডের মতো
আমার সত্তার মতো
আমার অজানা স্নায়ুতন্ত্রীর মতো
সর্বক্ষণ সত্য আমার দেশ
আমার দেহের আনন্দ কান্নায় তোমাতেই আমি সমর্পিত
সমাজসচেতন কবি সমাজের বুকে ক্রমাগত ঘটে যাওয়া অত্যাচারগুলিকে দেখতে দেখতে নিজেই আর্তনাদ করে ওঠেন। বাংলাদেশের কবিতায় ষাটের দশক ছিল রক্তক্ষরণের কাল। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশকে নষ্ট করে সাম্প্রদায়িক বীজ বপন করার উদ্দেশ্যে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে জারি হয় সামরিক শাসন। এরপর টানা দশ বছর এই সামরিক শাসনেই কাটাতে হয় এদেশের জনসাধারণ ও শিল্পী সাহিত্যিকদের। সামরিক শাসনের যাঁতাকলে মানুষের স্বতস্ফূর্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশের পথই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই সময় কবিরা যে আত্মসংকটে ভুগেছিলেন তা আসলে পূর্ব-পাকিস্তানের জাতীয় সংকট। এই সংকটের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় ‘অন্তিম শরের মতো’ কাব্যের কবিতাগুলিতে। সমকালীন সমাজ ও জীবনের যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি কাব্যের নামকরণেই রয়েছে। নাম কবিতাতেই রয়েছে জাতিসত্তার সংকটের ছবি—
অদ্ভুত সময় এক স্বভাবের
গূঢ় নাড়ি দেয় কেটে। সত্তায় নিবিড় থেকে
অবিচল পায়ে যাবো হেঁটে এমন শুকনো শক্ত
মাটি নেই কোথাও জীবনে, চোরাবালি নেয় টেনে
বিচিত্র আপোষে, নিজেরি একান্ত রক্ত নীরব ক্ষরণে
লেখে নাম বাঁকে বাঁকে, নিজেরি বিদ্রূপ হাঁকে
বিভিন্ন বিরোধী উচ্চারণে।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে হাসান হাফিজুর রহমানের কাব্যচেতনায় উল্লেখযোগ্য বাঁকবদল ঘটে। স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। ফলে একাত্তরের নয়মাসের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতায় শিল্পিত রূপ পেয়েছে। বাংলা বর্ণমালার মধ্যে কবি বাঙালি জাতির পরিচয় খুজতে চেয়েছেন। তাই বর্ণমালার আদি অক্ষর ‘অ’-এর মধ্যেই কবি সভ্যতার প্রতিচ্ছবি লক্ষ করেছেন। পূর্ব প্রজন্মের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার একটাই উপায় হল ভাষা সংস্কৃতি। কবি মনে করেন আদিম অক্ষর রাশি অ আ ক খ কবিকে পূর্বজন্মের সঙ্গে একসূত্রে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে। নিরাপরাধ পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের উপর পাকিস্তানী ঘাতক বাহিনির অত্যাচার কবিকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কবির স্মৃতিতে ফিরে এসেছে একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতি। তাই কবিও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়ে শপথের ডাক দিয়েছেন—
নিহত ভায়ের লাশ কাঁধে বয়ে ঢের
গড়েছি মিনার, হেঁটে গেছি পথ।
আর নয়, চাই শত্রুর লাশ চাই,
-এইবার এই বজ্র শপথ।
এই শপথ ব্যর্থ হয়নি। নয় মাসের রক্তযুদ্ধে বাঙালি ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের বাসভূমি। কিন্তু যুদ্ধোত্তর স্বদেশের রূপ কবিকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছে। স্বদেশের বিদীর্ণ দেহ, জীর্ণতা, ঐতিহ্যের অবলুপ্তি এবং কদাকার বাস্তবতা কবিকে পীড়িত করে। নিসঙ্গ কবি তাঁর সমস্ত আবেগ দিয়ে স্বদেশকে কাছে পেতে চেয়েছেন কিন্তু স্বদেশ তাঁর ডাকে সাড়া দেয়নি। কবি তাঁর জীবনের সমস্ত আবেগ দিয়ে নদীকে ডেকেছেন কিন্তু নদী তাঁর হৃদয়ের ডাক শোনেনি। এমনকি নিজের হৃদয়ের অসীম গভীরে সমুদ্রকে লীন করতে চেয়েছেন কিন্তু সমুদ্র কবির সুমধুর আবেদনে সাড়া না দিয়ে লবণাক্তই থেকে গেছে। কেবল প্রকৃতি নয় মানুষের ব্যবহারেও কবি হতবাক—
মানুষ মানুষ’ বলে চিৎকারে চৌচির হয়ে
চিরকাল ফেটে যাচ্ছি, কোথায় মানুষ?
স্নেহের সঙ্গে হিংসা, সখ্যতায় ক্রূরতা,
আস্থার বদলে বিশ্বাসঘাতকতা, অমৃতের ভেতর বিষ
উঠে আসে, যাকে খুঁজি কোথায় সে?
এই জীবনজিজ্ঞাসাই হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তি ও সমাজের সংকটকে তিনি হৃদয়ঙ্গম করেন। প্রত্যাখ্যান করতে চান হৃদয় যন্ত্রণাকে। কিন্তু হৃদয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তির অঙ্গীকার তাঁর কবিতার স্নিগ্ধতায় চাপা পড়ে যায়। তাঁর আবেগের ঢেউ আশাবাদের পাহাড় পর্যন্ত পৌছায় না। বিশ্বাসের ব্যাকুলতায় কবি অস্থির—
মাটি যদি শস্য না দিতো
মা শব্দ বলা হতো না,
নারীতে প্রসব না এলে
কে বানাতো ঘর?
হাসান হাফিজুর রহমানের এই সমাজ-সংলগ্ন স্বর তাঁকে জনপ্রিয় কবিতে পরিণত করেছে। তাঁর কবিতায় মানুষ, মানুষের বিষাদ, বিমর্ষতা যেমন আছে তেমনই রয়েছে উজ্জ্বল জীবনের অঙ্গীকার। ভাঙাগড়ার মধ্যে মানব জীবনের যে বৈচিত্র্য তা তাঁর কবিতাকে পঞ্চাশের অন্যান্য কবিদের থেকে একইসঙ্গে উজ্জ্বল ও পৃথক করে তুলেছে।
Leave a Reply