//
//

বাংলাদেশের কবি সিকদার আমিনুল হকের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

সিকদার আমিনুল হক

ষাটের দশকের ক্ষণজীবী কবি সিকদার আমিনুল হক (১৯৪২-২০০৩)। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের এক উত্তাল সামাজিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক পরিবেশের মধ্যে তিনি কাব্যজগতে পদার্পণ করেছিলেন। জীবনের শুরু থেকে কবিতাকেই নিজের পেশা হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই জানিয়েছেন— ‘‘আমার কাজ কবিতা লেখা, শুধুই কবিতা লেখা। সৌভাগ্য একটাই, আমার কলম এখনও থামেনি। লেখাকে দৈব ব্যাপার বলেই ছেড়ে দিয়েছি; ভালো লেখার চেষ্টা থাকতে পারে-কিন্তু সফলতা-অসফলতার হাতে কবিকে শেষ পর্যন্ত নিঃশব্দে আত্ম-সমর্পণ করতে হয়।’’ অর্থাৎ কবিতা রচনায় নিজের মননকে হৃদয়াবেগের তুলনায় অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন কবি। অহেতুক শিল্পের জটিল জগতে প্রবেশ করেন নি। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল— দূরের কার্নিশ (১৯৭৫), তিন পাপড়ির ফুল (১৯৭৯), পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা (১৯৮২), আমি সেই ইলেকট্রা (১৯৮৫), বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে (১৯৮৭), পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল (১৯৮৭), এক রাত্রি এক ঋতু (১৯৯১), সতত ডানার মানুষ (১৯৯১), রুমালের আলো ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯৫) প্রভৃতি।

বাংলাদেশের কবিতায় নগর জীবনের ছায়াপাত ঘটিয়েছেন শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরীর মতো কবিরা। সিকদার আমিনুল হকও সেই নাগরিক চেতনাকে কাব্যজ উপাদান হিসাবে ব্যবহার করেছেন। তবে নাগরিক জীবন তাঁর কবিতায় পরিশীলিত রূপ লাভ করেছেন। নগরজীবনের হতাশাকে, নিজের ব্যক্তিগত জীবনের অপূর্ণতার মধ্যেই মিশিয়ে দিয়েছেন কবি। প্রেমিকার প্রবঞ্চনা কবির মনে ক্ষোভের জন্ম দিলেও তিনি সেই ক্ষোভকে অভিমানে পরিণত করেছেন—

প্রতিশ্রুতি দিতে পারে কুটিল যন্ত্রণা

কালবিনাশী স্মৃতি,

মেঘের মতো সহজলভ্য তোমার প্রবঞ্চনা

স্নিগ্ধ আত্মাহুতি।

চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলাতে গিয়ে কবি দেখেছেন নিজেদের মধ্যে বেড়ে যাওয়া দূরত্বকে। যে প্রেমিকা এতদিন কবির হৃদয়ের কাছে ছিল আজ তার সঙ্গে সহস্র যোজনের ব্যবধান। কবির অধিকারও আজ সীমিত। চাইলেই আজ তিনি তাঁর প্রেম ফিরে পেতে পারেন না। কারণ কবির শান্তিমুখর জীবন আজ কবির প্রেমিকার কাছে বড়োই একঘেয়ে। শর্তযুক্ত প্রেমে অনিচ্ছুক কবি তাই প্রেমিকার কাছে আজ আর প্রিয় নয় বরং অতিথি। তাই নিজের হাতেই রেখাতেই কবি নিজের ভবিষ্যৎ দেখছেন। সবুজ হ্রদের জলে কবি উদভ্রান্ত দিনের প্রতিচ্ছবি লক্ষ করেছেন। কবি প্রিয়ার মতো গাছেরা যেন উচ্চাঙ্ক্ষায় প্রতিনিয়ত বেড়ে। কিন্তু কবি উচ্চাকাঙ্ক্ষী নন। পুকুরের স্থিরতার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন কবি।

ক্লান্তিকর নগর জীবনে কবি শান্তি প্রত্যাশী। কিন্তু নাগরিক জীবনে মানুষের যন্ত্রপ্রীতি কবিকে পীড়া দেয়। মানুষের কাছে অর্থই বড়ো হয়ে ওঠে। রোদের উজ্জ্বলতা স্বর্ণলোভীদের উল্লাসে ম্লান হয়ে যায়। ধনের কামনায় মানুষ কেবলই প্রকৃতিকে ক্ষতবিক্ষত করে চলে। ভোগবিলাসের এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় কবি নির্জনতা খোঁজেন। কিন্তু সারাদিনের অর্থপিপাসা নিবৃত্ত হলেই সমাজে শান্তি নামে না। শুরু হয় ধর্মের ঘর্ঘর। ধর্ম আর অর্থের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে প্রকৃতির কাছে ছুটে যান মুক্তির প্রত্যাশায়—

গলিগুলি ভয়াবহ, রৌদ্রে-রক্তে সোনার চিৎকার

কুলিরা খুঁড়ছে হিরে, শকুনেরা কাঁপায় বন্দর;

মাতৃভাষা পরিভাষা-আঞ্চলিক সারা দিন শুনে

যখন খুঁজছি স্বস্তি, শুরু হলো ধর্মের ঘর্ঘর।

কিছু শান্তি ছুটিছাটা, যদি চাও আরো কিছু দূরে

কাপ্তাই কক্সবাজার, রাঙামাটি সূর্যের মন্দির,

প্রাকৃতিক শান্ত ভোজে যদি পাও জীবন সন্ধির

স্বাধীনতাকামী কবি সমাজের মধ্যেই এক ধরনের অসুখ লক্ষ করেছেন। যে সমাজ বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করেছিল তা তারা পায় নি। কারণ যারা সেই আশার আলো দেখিয়েছিল, সাধারণ মানুষের মনে স্বপ্নের বীজ বুনেছিল তাদের দ্বিচারিতা কবিকে অবাক করে। অতীত মিথ্যে হয়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশনেতারাও দেশের স্বার্থ ভুলে আপন স্বার্থসিদ্ধিতে মেতে ওঠে—

লোকে জা বলে তা সত্য নয়-

চেনা প্রতীক এক দশকের ঢলে

কোথায় চলে যায়-

গেরুয়া জল পায় না ছোঁয়া তোমার পদযুগল!

সত্যি নাকি প্রভু?

তাই কবি সমাজ থেকে মুখ ফেরান আপন কবিতার জগতে। কিন্তু বিষয়বস্তুর অভাবে কবির কবিতা অস্তিত্বহীনতায় ভোগে। কবিও নিজের কবিতায় দিঘিতে বাঁচার আশ্রয়ে সাঁতার কেটে বেড়ান। বিষয়ের খোঁজে কবি পর্বত থেকে মরুপ্রদেশে জেদি যাযাবরের মতো ছুটে চলেন। কখনো বা রাখালের সঙ্গে ঘুরে নিতে চান হাল্কা জীবনের আস্বাদ। সরাইখানায় সুরাপান, জুয়াখেলা, ভিনদেশিদের সঙ্গে মুদ্রা বিনিময়ের মধ্যেও কবি জীবনের আস্বাদ নিতে চান, সঞ্চয় করতে চান আপন আপন অভিজ্ঞতা। কিন্তু নাগরিক বিকৃতির পথ এড়িয়ে শেষপর্যন্ত প্রকৃতির কাছেই কবি খুঁজে পান জীবনের আস্বাদ, বাঁচার রসদ—

বিষয় বস্তুর জন্য আমার কবিতা আর আমি

গেছি নষ্ট মহিলার বুদোয়ারে। কিন্তু যৌবনের

তিক্ত বিষে পরাজিত ফিরেও এসেছি! অভিজ্ঞতা

তোমার জন্যই এত কিছু করা! বালিতে জ্যোৎস্না

পড়ে ঘন হয়-শান্ত কুয়োতলা; আমি ও কবিতা

নকশা বুনেছি ঢের রহস্যের। কুমারীর ওষ্ঠে

পাখি ছেড়ে দিয়ে হায়, কত দিন অবরুদ্ধ সুখ

করেছি সঞ্চয় শুধু শব্দোচ্ছল ঠান্ডা অন্ধকারে।

আকস্মিক বান আসে, গভীর জঘনে মেঘমালা

আমার কবিতা ঋণবদ্ধ থাকে রূপসীর কাছে।

সমগ্র কাব্যজীবনে কবির ভাবনার কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে নি। নাগরিক কাব্যবোধ তাঁর কবিতায় প্রথম থেকেই বহমান। তবে নাগরিক চেতনার প্রকাশে তিনি সরব নন বরং অন্তর্মুখী। তাঁর শিল্পিমনের প্রসন্নতা তাঁর কবিতাকে এক ধরনের প্রশান্তি দিয়েছে, কবিতায় এসেছে শৈল্পিক ছোঁয়া। তাই ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে প্রতিবাদী কবিদের তুলনায় তিনি একটু দূরেই অবস্থান করেছেন। কিন্তু নিজ গুণে তাঁর কবিতা পাঠকের মনে স্থান লাভ করেছে অনায়াসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!