বাংলাদেশের কবি হেলাল হাফিজের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
হেলাল হাফিজ
ষাটের দশকের কবি হেলাল হাফিজ (১৯৪৮-) সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র কবি যিনি সবচেয়ে কম লিখে সবথেকে বেশি কবিখ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি লিখেছেন কম কিন্তু জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ঈর্ষণীয়, কল্পনাতীত। সম্ভবত আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তার কারণেই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যের পর তিনি আর কোনো কাব্য প্রকাশ করেন নি পাঠক হারানোর ভয়ে। হেলাল হাফিজের একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ (১৯৮৬) কাব্যের মোট কবিতা সংখ্যা ছাপান্নো। পরবর্তীকালে আরো পনেরোটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘কবিতা একাত্তর’ (২০১২)। এই একাত্তরটি কবিতার মধ্যে কিছু কবিতায় কবির ব্যক্তিজীবন ও প্রণয়জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে আর কিছু কবিতায় বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি সরাসরি উঠে এসেছে। পাঠক তাঁর কবিতার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের তুলনায় বহিরাঙ্গের ভাবকে অধিক পরিমাণে উপলব্ধি করেই আনন্দ লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের যে আবেগকে তিনি কবিতায় সঞ্চারিত করেছেন পাঠক তাতেই ভেসে যেতে আকুল। তাঁর আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাতেই তিনি যৌবনের উদ্দামকে চিনিয়ে দিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ বাঙালির আবেগ যেন শব্দ হয়ে ঝরে পড়েছে তাঁর কলমে। স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল সময়কে দক্ষ শিল্পীর মতো পাঠকের মনে সঞ্চারিত করে তিনি বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে সক্ষম হয়েছেন। কবিতার নামকরণ ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ রেখে তিনি ঊনসত্তরের অগ্নিগর্ভ সময়ের উত্তাপকে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। যুব সমাজের প্রতি জানিয়েছেন তাঁর ঐতিহাসিক আহ্বান—
এখন যৌবন যার, মিছিলে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
উপরোক্ত পংক্তি দুটো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ বাঙালির জীবনমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যৌবন যে মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়, এই সময়ে মানুষ ইচ্ছা করলে যে কোনো বাধাকে সরিয়ে দিতে সক্ষম সেই কথা যেন কবিতার মাধ্যমে লক্ষ কোটি বাঙালি স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলেন কবি। তাঁর এই আহ্বান যে ব্যর্থ হয় নি তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধে। স্ত্রী-কন্যা-সুখী গৃহকোণ ছেড়ে সেদিনের লক্ষ লক্ষ যুবসমাজ হাতে মারণাস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু মিছিলের মুখের মধ্যে কবি কামনার একতা লক্ষ করেন নি। তিনি লক্ষ করেছেন কেউ এসেছে নিঃস্বার্থ দেশের কথা ভেবে, কেউবা নিজের মতো সুন্দর দেশ গঠনের আশায়। তাদের সেই ভাবনা বৈচিত্র্যকে কয়েকটি পংক্তির মাধ্যমে অনবদ্যভাবে তুলে ধরেছেন কবি—
মিছিলের সব হাত
কণ্ঠ
পা এক নয়।
সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,
কেউ আসে রাজ পথে সাজাতে সংসার
কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার।
কবি দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ অংশগ্রহণ করলেও অনেকে সংসার-সমৃদ্ধির কথা ভেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। দেশের থেকে নিজের সংসারকে তারা অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে। অথচ কবি দেখেছেন লক্ষ লক্ষ বাঙালি নিজের কথা না ভেবে, পরিবারের কথা না ভেবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাই কতিপয় সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তকে আক্রমণ করে বলেছেন—
মানব জন্মের নামে হবে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই,
উত্তম পুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন নিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই।
একাত্তরের নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ের বাঙালি ছিনিয়ে নিয়েছিল স্বাধীনতা, নতুন ভূখণ্ড, বাঁচার আশ্রয়। এই নয় মাসের লড়াইয়ে কবি নিজের প্রেমিকাকে ভুলে অস্ত্রকেই একমাত্র প্রেমিকা ভেবেছিলেন। নয় মাস এই প্রেমিকাকে সঙ্গে নিয়েই তিনি পাকিস্তানী ঘাতকবাহিনির সঙ্গে সম্মুখ সংগ্রাম করেছেন। এই প্রেমিকাকে সঙ্গে নিয়েই বহু রাত কবি জঙ্গলে কাটিয়েছেন, অসংখ্যা শত্রুকে নিধন করে অবশেষে দেশকে স্বাধীন করেছেন। আজ কবি মনে করেন এই অস্ত্রের আর কোনো দরকার নেই কারণ অস্ত্রশক্তি মানবসভ্যতার একমাত্র বিকল্প হতে পারে না। প্রেম-ভালোবাসার পথেই গড়ে উঠবে আমাদের আগামী সভ্যতা। তাই অস্ত্রপ্রেমিকার সঙ্গে নয় মাসের সম্পর্ক ছিন্ন করে কবি আজ গৃহে ফিরে যেতে চান। এই বোধ কেবল কবির অন্তরের অনুভূতি নয় আমরা জানি স্বাধীন বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরেই মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কবি বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ ফেরাতে পারেননি। কিন্তু প্রয়োজন হলে তিনি যে আবার এই প্রেমিকার কাছেই ফিরে আসবেন সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কবি বলেছেন—
যদি কোনোদিন আসে আবার দুর্দিন,
যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে
ভেঙে সেই কালো কারাগার
আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার।
দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর দেশে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা তা হয় নি তার বদলে দলতন্ত্র জাঁকিয়ে বসল। স্বাধীন বাংলাদেশে সবকিছুই আছে কিন্তু যারা রক্তের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীণ করল তাদের প্রতি রাষ্ট্রের কোনো মানবিকতা নেই। দেশের জনগণ ভেবেছিল তাদের সকল দায়দায়িত্ব বোধহয় রাষ্ট্র নিজের হাতে তুলে নেবে, অবসান হবে তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা-বৈষম্যের কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে প্রকাশ পেয়েছে রাষ্ট্রের নির্মম রূপ। দেশের মানুষ দেখলো নামেই তারা স্বাধীন। শাসক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু শাসনব্যবস্থা অপরিবর্তিত থেকে গেছে। শোষণের ধারা সামরিক শাসনে ছিল তা যেন আজও বহমান। এসব দেখে কবি নিশ্চুপ থাকতে পারেন না। তাই নিজের কামনা আর না পাওয়ার হতাশাকে ক্ষোভের সঙ্গে ব্যক্ত করলেন তিনি—
ইচ্ছে ছিলো রাজা হবো
তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে
শুধু তুমি অন্য ঘরে।
প্রত্যাশিত দেশ না পাওয়ার ফলে কবির হৃদয়ে একধরনের ক্ষোভের জন্ম হয়েছে। এই ক্ষোভ কবির ব্যক্তিজীবনে অভিমানে রূপান্তরিত হয়েছে। কৈশোর বয়স থেকে কবি মনের গভীরে প্রেমিকার জন্য ভালোবাসা পোষণ করে এসেছেন। নিজেকে যোগ্য করে তোলার জন্য অবিরাম ভাঙা-গড়ার খেলায় মেতেছেন, আজীবন নিষ্কলঙ্ক থেকেছেন। কিন্তু আজ কবি দেখছেন যার জন্য কবি সারাজীবন অপেক্ষামান থেকেছেন সে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্যের জীবনসঙ্গিনী হয়েছে। এর জন্য কবির ক্ষোভ নেই তিনি আজও বিশ্বাস করেন এই বিরহই তাঁর প্রেমকে উজ্জ্বল করে রাখবে আজীবন—
শুনেছি সুখেই বেশ আছো। কিছু ভাঙচুর আর
তোলপাড় নিয়ে আজ আমিও সচ্ছল, টলমল
অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে
মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল।
কবি শতচেষ্টা করেও অতীত প্রেমকে ভুলতে পারেন না। লোকে কবির এই প্রেমকে মোহ বললেও কবি জানেন সোনালি দিনের এই প্রেম আজ কবির গৌরব। প্রেমিকাকে না পেয়ে কবি আজ সন্ন্যাসী হয়েছেন। ভোগের মধ্যে যে প্রেমকে তিনি পাননি আজ ত্যাগের মধ্যে সেই প্রেমের আস্বাদ লাভ করতে চান তিনি। কবির জীবনে আজ যে পতন দেখা দিয়েছে আর একটা পতনের মধ্য দিয়েই কবি পতনের পত্তন ঘটাতে চান। প্রেমিকাকে না পাওয়ার জন্য কবি দায়ী করেছেন নিজের উদাসীনতাকে। এই উদাসীনতা তাঁর মধ্যে একধরনের অপরাধবোধের জন্ম দিয়েছে। জীবনের যে সবুজ সকালে প্রেমিকার সঙ্গে যাত্রার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কবি তা তিনি রক্ষা করতে পারেন নি। দেশমাতার সম্মান রক্ষার্থে তাকে জীবন নদীর উল্টো জলে সাঁতার দিতে হয়েছে। যৌবনের প্রেমকে উপেক্ষা করেই দেশের জন্য যৌবনকে বাজি ধরেছেন। দেশকে কবি অত্যাচারীর হাত থেকে উদ্ধার করতে পেরেছেন কিন্তু নিজের হৃত প্রেমকে পাননি। আজ কবি নিঃসঙ্গ। কবির একমাত্র সঙ্গী আজ দুঃখ। কিন্তু কবি দুঃখের সঙ্গে সারাজীবন চলতে চান না। তিনি ফিরে পেতে চান তাঁর প্রেম, উদ্ধার পেতে চান পাপ থেকে, পঙ্কিলতা থেকে, নিশ্চিত পতনের হাত থেকে। তাই প্রেমিকার কাছেই ফেরার আর্তি জানিয়ে তিনি বলেছেন—
এখন তুমিই বলো নারী
তোমার উদ্যান ছাড়া আমি আর কোথায় দাঁড়াবো।
আমাকে দাঁড়াতে দাও বিশুদ্ধ পরিপূর্ণতায়,
ব্যাকুল শুশ্রূষা দিয়ে আমাকে উদ্ধার করো
নারী তুমি শৈল্পিক তাবিজ,
এতোদিন নারী ও রমণীহীন ছিলাম বলেই ছিলো
দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।
যুদ্ধের ফেরিওয়ালা থেকে আজ তিনি কষ্টের ফেরিওয়ালায় পরিণত হয়েছেন। কবির এই কষ্ট দ্বিমাত্রিক। প্রত্যাশিত দেশ ও প্রেমিকা উভয়কেই তিনি আজ হারিয়েছেন। যে প্রেমিকার জন্য তিনি কৈশোর কাল থেকে অপেক্ষা করেছেন সেই প্রেমিকা তাকে ত্যাগ করেছেন আর যে দেশ মাতাকে উদ্ধার করার জন্য তিনি প্রেমিকাকে প্রাপ্য সময়-সম্মান দিতে পারেননি সেই দেশ মাতাও কবিকে তৃপ্তি দিতে পারেননি কারণ দেশ মাতার শাসন কর্তারা আজো দেশমাতাকে পূর্বের মতোই নিজেদের শাসনের বেড়াজালে বন্ধ করে রেখেছে। ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনের এই যুগ্ম-বিপর্যয়ের জন্যই দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ।
Leave a Reply