//
//

বাংলাদেশের উপন্যাসের উদ্ভব ও বিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা কর।

বাংলাদেশের উপন্যাস

বাংলাদেশের উপন্যাস হিসেবে নির্দিষ্ট সময়ের পরিধিতে যেসব গ্রন্থ রচিত হয়েছে তা বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্যেরই অনুসারী। বাংলা উপন্যাসের আদিযুগে মুসলমান ঔপন্যাসিকদের অবদান ছিল না। মুসলমানরা যখন উপন্যাস রচনায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন তখন বাংলা উপন্যাসের ধারা সমৃদ্ধির নিদর্শন নিয়ে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। সে হিসেবে তুলনামূলক বিচারে মুসলমানদের স্বতন্ত্র অবদান কিছুটা নিষ্প্রভ। তবে বাংলাদেশের পরিসীমায় তা কাটিয়ে ওঠার একটা প্রচেষ্টা প্রথম থেকেই লক্ষণীয় হওয়ার ফলে এখানকার উপন্যাসের ইতিহাস অনেকটা সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে।

সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের উপন্যাসের ধারা যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে এখানকার উপন্যাস সাহিত্য অগ্রসর হচ্ছে বলে তা নতুনতর বৈশিষ্ট্যের পরিচয়বাহক। বর্তমান বাংলাদেশের স্বতন্ত্র প্রকৃতি ও জীবন এখানকার উপন্যাসে রূপায়ণের সুযোগ বিভাগপূর্ব-কালে অনুপস্থিত ছিল। তখন যে দু একটি উপন্যাসে এখানকার জীবনচিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা সহজেই প্রশংসা পেয়েছে। তাই স্বতন্ত্র পরিবেশে এই অঞ্চলের জীবন অচিরেই উপন্যাসের উপজীব্য হয়ে উঠল। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জীবনে নতুনতর চেতনার সঞ্চার হয়েছে। স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে জীবনের গতিধারা বৈচিত্র্যপূর্ণ খাতে প্রবাহিত হতে শুরু হল। দেখা দিল নিত্য নতুন সমস্যা। যেহেতু উপন্যাসে বাস্তব জীবনের প্রতিফলন ঘটে সে কারণে ঔপন্যাসিকবৃন্দ প্রবহমান জীবনধারার নানা দিক অবলম্বনে সাহিত্যসৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। ড. রফিকল্লাহ খান তাঁর অভিসন্দর্ভ ‘বাংলাদেশের উপন্যাস বিষয় ও শিল্পরূপ’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন—‘‘মধ্যবিত্তের প্রত্যাশা-অপ্রাপ্তি, সংগ্রাম, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ এ-পর্যায়ে রচিত উপন্যাসের মৌল উপজীব্য। বিকাশশীল মধ্যবিত্তের অশক্ত, অপরিণত ভিত্তি উপকরণের প্রশ্নে ঔপন্যাসিকদেরকে করেছে গ্রামজীবনমুখী। বিষয়ভাবনায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দময় প্রকাশ। একদিকে সামন্ত আর্থ-উৎপাদন কাঠামোর পিছুটান, অন্যদিকে বিকাশকামী মধ্যবিত্তের (কর্মোদ্যোগ, সংগ্রাম ও স্বাবলম্বন প্রত্যাশা—এ দুয়ের অনিবার্য দ্বন্দ্ব উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরূপকে প্রভাবিত করেছে।’’

বাংলাদেশের শান্তস্নিগ্ধ পল্লীশ্রী এখানকার উপন্যাসে রূপায়ণের প্রচেষ্টা লক্ষণীয় হয়ে উঠলেও শহুরে জীবন উপেক্ষিত হয়নি। গ্রাম বাংলার জীবনের বৈচিত্র্যময় রূপ যেমন উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনি নাগরিক জীবনের সমস্যাও এখানে স্থান পেয়েছে। দেশ বিভাগের ফলে এখানকার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে, এখানকার মানুষের জীবনে তার প্রভাব রূপায়িত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকগণ এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনই উপন্যাসে প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়েছেন। এখনকার জীবন এতদিন সাহিত্যে যথাযযাগ্য স্থান পায়নি বলে সমকালীন লেখকদের জন্য তা বৈচিত্র্যপূর্ণ উপন্যাস সৃষ্টির উপাদানের বিপুল উৎস হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের উপন্যাসে গ্রামীণ জীবন, নাগরিক জীবন, আঞ্চলিক জীবনচিত্র, মনস্তত্ত্ব, ঐতিহাসিক চেতনা ইত্যাদি বিষয় স্থান পেয়েছে। বিষয়বস্তুর এই বৈচিত্র্যের পরিপ্রেক্ষিতে ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে মুহম্মদ আবদুল হাই মন্তব্য করেছেন—‘‘একদিকে কৃষিভিত্তিক পল্লীজীবন, অপরদিকে আধুনিক দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ নাগরিক জীবন; একদিকে পূর্ববঙ্গের ঐশ্বর্যময় বহিঃপ্রকৃতির বর্ণনা, অপরদিকে আধুনিক মানুষের জটিল অন্তর প্রকৃতির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ; একদিকে প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষণ, অপরদিকে রোমান্টিক কল্পনার বিলাস; একদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিক্ষুব্ধ পটভূমিকায় মানুষের অস্থিরতা, অপরদিকে হৃদয়াবেগের চিরন্তন পটে প্রতিষ্ঠিত প্রেমিক মানুষ, সবই আমাদের বাংলা উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে।’’

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন প্রবল প্রভাব বিস্তার করে আছে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে। একুশের চেতনা জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান। একুশের আন্দোলন  বাংলাদেশের উপন্যাসের ধারায় প্রভাব বিস্তার করেছে। একুশের চেতনা নিয়ে কিছু সংখ্যক উপন্যাস বাংলাদেশের সাহিত্যে দৃষ্টিগোচর হয়। তবে একুশের গুরুত্বের তুলনায় এ ধরনের উপন্যাস খুব বেশি রচিত হয়নি।

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের যথেষ্ট প্রতিফলন লক্ষণীয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে এখানকার জীবনে যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল তা প্রত্যক্ষদশী ঔপন্যাসিকগণ উপেক্ষা করতে পারেননি। তাই এখানকার উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের চিত্রাঙ্কনের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধোত্তর কালের জীবনের রূপায়ণেরও নিদর্শন প্রকাশিত হচ্ছে। খুব কাছে থেকে এ জীবনের চিত্রায়ণ তাই বাস্তবানুসারী হয়ে উঠেছে।

আবুল মনসুর আহমদ 

ঔপন্যাসিকগণের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদের (১৮৯৮-১৯৭৯) নাম উল্লেখযোগ্য। ব্যঙ্গরসাত্মক রচনায় খ্যাতি অর্জন করলেও উপন্যাসে তাঁর কৃতিত্ব কম নয়। ‘সত্যমিথ্যা’, ‘জীবনক্ষুধা’, ‘আবে হায়াত’ প্রভৃতি উপন্যাসেও তিনি আদর্শবাদিতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর উপন্যাসে গ্রামীণ জীবনের পটভূমিকায় সে আমলের সমাজজীবনের বাস্তব চিত্র অঙ্কনের চেষ্টা আছে। তিনি তাঁর উপন্যাসে ভাষা ব্যবহারে স্বকীয়তা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।

আবুল কালাম শামসুদ্দিন

আবুল কালাম শামসুদ্দিন (১৮৯৭-১৯৭৯) সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতিমান হলেও উপন্যাসে বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন। তবে ভাবানুবাদ জাতীয় উপন্যাসে তাঁর কীর্তি সীমাবদ্ধ। ‘অনাবাদী জমি’ (পূর্বনাম পোড়ো জমি) উপন্যাসটি রাশিয়ান ঔপন্যাসিক ইভান তুর্গেনিভের ‘ভার্জিন সয়েল’-এর অনুবাদ। ‘ঝর্ণাধারা’ (পূর্বনাম খরতরঙ্গ) উপন্যাসটি তুর্গেনিতের গল্প অবলম্বনে রচিত। তাঁর উপন্যাসগুলো মূলত অনুবাদ হলেও তাতে মৌলিক রচনার স্বাদ সহজলভ্য। ভাষা রূপায়ণে তিনি নিজস্বতার পরিচয় দিয়েছেন।

মাহবুব-উল-আলম 

কথাশিল্পী মাহবুব-উল-আলম (১৮৯৮-১৯৮৯) স্মৃতিকথা ইতিহাস গল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বীয় প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। উপন্যাসেও তাঁর কৃতিত্ব ছিল। আত্মজীবনী মূলক উপন্যাস ‘মোমেনের জবানবন্দী’ তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। মনোভাবের অকৃত্রিম প্রকাশে বইটি বিশিষ্ট। সাহিত্যের বেলায় তিনি ছিলেন স্পষ্টবাক ও যুক্তিনির্ভর। তাঁর উপন্যাসের ভাষা বলিষ্ঠ ও প্রাঞ্জল। উপন্যাসে তিনি সমাজ ও বাস্তবজীবনের নিখুঁত চিত্র অঙ্কন করেছেন। ‘গাঁয়ের মায়া’, ‘মফিজন’ তাঁর অপরাপর উপন্যাস।

আবুল ফজল 

আবুল ফজল (১৯০৩-৮৩) বৈচিত্র্যধর্মী সাহিত্যপ্রতিভার পরিচয় দান করলেও উপন্যাস রচনায় তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। ‘চৌচির’, ‘সাহসিকা’, ‘জীবন পথের যাত্রী’, ‘প্রদীপ ও পতঙ্গ’, ‘রাঙ্গা প্রভাত’ প্রভৃতি তাঁর উপন্যাস। এই সব উপন্যাসে সমকালীন জীবনের চিত্র ও সমস্যা প্রতিফলিত হয়েছে। বিশেষ আদর্শবাদিতার পরিচয়ও কোন কোন ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। উপন্যাসের বিষয় হিসেবে তিনি মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেছেন। তাঁর ভাষায় প্রাঞ্জলতা ফুটে উঠেছে।

সত্যেন সেন 

সত্যেন সেন (১৯০৭-৮১) অনেকগুলো উপন্যাসের রচয়িতা। লেখকের সগ্রামীজীবনের আদর্শ উপন্যাসগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে। দীর্ঘ কারাবাসের জীবনে গ্রন্থগুলো রচিত হলেও ষাট দশকের শেষ দিকে সে সব প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর উপন্যাসগুলোর নাম—‘ভোরের বিহঙ্গী’, ‘অভিশপ্ত নগরী’, ‘পদচিহ্ন’, ‘পাপের সন্তান’, ‘মা’, ‘অপরাজেয়’, ‘শহরের ইতিকথা’, ‘আলবেরুনী’, ‘উত্তরণ’, ‘কুমারজীব’, ‘সেয়ানা’, ‘পুরুষমেধ’, ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’, ‘সাত নম্বর ওয়ার্ড’ ইত্যাদি। লেখকের উপন্যাসগুলো সুপ্রাচীন কালের পটভূমিকায় রচিত। ধর্ম সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা সমস্যা এ সবে প্রতিফলিত। সত্যেন সেন কতকগুলো গ্রন্থে সমকালীন জীবনের কথাও বলেছেন। অধিকাংশ গ্রন্থের মধ্যে নিপীড়িত গণমানুষের জীবনসংগ্রামের কাহিনী বিধৃত। মিথের নবরূপায়ণে, গদ্যরীতির ধ্রুপদী বিন্যাসে এবং বক্তব্যের সমকালীন-সংকট বিবেচনায়  ‘অভিশপ্ত নগরী’ এবং ‘পাপের সন্তান’ বাংলাদেশের উপন্যাসে স্বতন্ত্র, অনতিক্রান্ত।

খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন 

খান মোহাম্মদ মইনুদ্দিন (১৯০১-৮১) ‘নয়া সড়ক’ উপন্যাস রচনা করেছেন। যুগচেতনার বৈশিষ্ট্য তাঁর উপন্যাসে প্রতিফলিত।

বন্দে আলী মিয়া

বন্দে আলী মিয়া (১৯০৭-৭৯) কবিতা ও শিশু সাহিত্য রচনায় খ্যাতিমান। তবে তাঁর প্রতিভা বৈচিত্রধর্মী। ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর পরিচয় ‘নীড়ভ্রষ্ট’, দিবাস্বপ্ন’, ‘জাগ্রত যৌবন’, ‘ঘূর্ণি হাওয়া’, ‘অরণ্য গোধূলি’, ‘ঝড়ের সঙ্কেত’ ইত্যাদি গ্রন্থে রূপায়িত হয়েছে।

আবুল হাশেম খান

আবুল হাশেম খান (১৯০৯) ‘আলোর পরশ’ নামক উপন্যাসের রচয়িতা। উপন্যাসটি ইতিহাস ভিত্তিক। এই উপন্যাসে কৃতিত্ব দেখানোর জন্য তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছিলেন।

কাজী আবুল হোসেন 

কাজী আবুল হোসেন (১৯০৯) বহু উপন্যাসের স্রষ্টা। তাঁর উপন্যাসগুলোর নাম—‘উমাপদ যশোদা সংবাদ’, ‘কাজল আঁখির মায়া’, ‘কালো বউ’, ‘চেনা অচেনা, ‘জীবনের খেলাঘর’, ‘নারাঙ্গী বনে ঝড়’, ‘নুরবানু’, ‘পথের বুকে’, ‘বনজ্যোৎস্না’, ‘সতীনের ঘর’, ‘শ্রীভাগ্য ভাল’ ইত্যাদি। এদেশের মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সহজ সরল চিত্র তাঁর উপন্যাসে রূপ লাভ করেছে।

আশরাফুজ্জামান 

আশরাফুজ্জামান (১৯১১) ছোটগল্প রচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর উপন্যাসও রয়েছে। ‘মনজিল’ ও ‘শায়ের নামা’ তার উপন্যাস। বাংলার জীবন ও প্রকৃতি তাঁর উপন্যাসের উপজীব্য ছিল। তিনি অবহেলিত মানব জীবনের সহানুভূতিশীল রূপকার। ‘এলে নতুন দেশে’ তাঁর অনূদিত উপন্যাস। এছাড়া তিনি ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী ও শিশুতোষ গ্রন্থ রচনায়ও কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

আবু জাফর শামসুদ্দিন

আবু জাফর শামসুদ্দিন (১৯১১-৮৯) মননশীল লেখক হিসেবে বৈচিত্রধর্মী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ঔপন্যাসিক রূপে বাংলাদেশের সাহিত্যে তার একটি বিশিষ্ট আসন রয়েছে। তিনি ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ নামে সুবৃহৎ উপন্যাসের রচয়িতা। উপন্যাসটি ইতিহাসভিত্তিক এবং তাতে জাতীয় জীবনের বিবর্তন রূপায়িত হয়েছে। তাঁর অপরাপর উপন্যাস—‘মুক্তি’, ‘পরিত্যক্ত স্বামী’ রোমান্টিক ধরনের; ‘ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান’ ঐতিহাসিক পটভূমিকায় সূচিত। ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার যে প্রবণতা এখানকার উপন্যাসের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক্ষেত্রে তারই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ইতিহাসকে এসব উপন্যাসে জাতীয় জীবনের গৌরব প্রকাশে সহায়ক হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ‘সংকর সংকীর্তন’, ‘দেয়াল’ তাঁর অন্যান্য উপন্যাস। ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনাতেও তাঁর কৃতিত্ব ছিল।

মবিনউদ্দিন আহমদ

মবিনউদ্দিন আহমদ (১৯১২-৭৮) ‘রূপ হতে রূপে’, ‘সুখচর’ ইত্যাদি উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর অপরাপর সাহিত্যসৃষ্টিও রয়েছে। ছোটগল্প রচনাতেই তাঁর কৃতিত্ব সর্বাধিক।

আহসান হাবীব

আহসান হাবীব (১৯১৭-৮৫) বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। কিন্তু উপন্যাস রচনায় প্রাচুর্যের পরিচয় দিতে না পারলেও তিনি বিশিষ্টতা দেখিয়েছেন। ‘অরণ্য নীলিমা’, ‘জাফরানী রং পায়রা’, ‘রানীখালের সাঁকো’ তাঁর উপন্যাস।

শওকত ওসমান

শওকত ওসমান (১৯১৯-৯৮) ছিলেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান কথা সাহিত্যিক গণের অন্যতম। তিনি উপন্যাস ছোটগল্প নাটক প্রবন্ধ অনুবাদ ইত্যাদি বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্ষেত্রে স্বীয় প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছেন। তবে কথাশিল্পী হিসেবেই তাঁর পরিচয়  সমধিক এবং তাঁর সাহিত্যসৃষ্টিও নানা পরীক্ষানিরীক্ষায় সমৃদ্ধ। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হচ্ছে—‘জননী’, ‘বনি আদম’, ‘ক্রীতদাসের হাসি’, ‘সমাগম’, ‘বেড়ী’, ‘দুই সৈনিক’, ‘ক্ষুদে সোশ্যালিস্ট’, ‘চৌরসন্ধি’, ‘জাহান্নাম হতে বিদায়’, ‘রাজা উপাখ্যান’, ‘নেকড়ে অরণ্য’, ‘পতঙ্গপিঞ্জর’, ‘রাজসাক্ষী’, ‘জলাংগী’, ‘পুরাতন খঞ্জর’ ইত্যাদি। ‘জননী’ উপন্যাস লিখেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। গ্রাম্য জীবনের পটভূমিকায় রচিত এ উপন্যাসে চরিত্রসৃষ্টির দক্ষতা ও সমাজচিত্রের রূপায়ণ লক্ষণীয়। লেখকের গভীর জীবনজিজ্ঞাসা ও অন্তদৃষ্টির পরিচায়ক হিসেবে এই উপন্যাস বিশিষ্ট। আঙ্গিকের কলাকৌশলের পরীক্ষানিরীক্ষায় শওকত ওসমান সফলকাম শিল্পী । ‘ক্রীতদাসের হাসি’ ও ‘সমাগম’ নতুন আঙ্গিকে লেখা উপন্যাস দুটি তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ‘ক্রীতদাসের হাসি’ প্রতীকাশ্রয়ী উপন্যাস। ‘‘দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস, গোলাম কেনা যায়, বান্দী কেনা সম্ভব—ক্রীতদাসের হাসি কেনা যায় না।’’ নায়কের এই উক্তি উপন্যাসের সারকথা। ‘সমাগমে’ শওকত ওসমান ফ্যান্টাসির জগতে পদচারী। ‘রাজা উপাখ্যান’ প্রতীকাশ্রয়ী হলেও গল্পরস প্রধান, পরিচর্যায় বিবরণধর্মী এবং নাটিকা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর ভিত্তি করে তাঁর কতিপয় গ্রন্থ রচিত। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে স্বল্পসময়ে বাঙালির সংগ্রাম ও সাধনার পরিচয় লিপিবদ্ধ করার জন্য তিনি কতিপয় গ্রন্থ রচনা করেন। এতে সমকালীন জীবনের পরিচয় বিধৃত এবং এ ধরনের রচনার ক্ষেত্রে অনেকটা পথিকৃৎ রূপে তাঁর স্থান।

আকবর হোসেন 

আকবর হোসেন (১৯১৫-৮১) কতিপয় উপন্যাস রচনা করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। সাধারণ পাঠকের হৃদয় আকর্ষণ করার মত উপাদান তাঁর উপন্যাসে ছড়ানো। ‘অবাঞ্ছিত’, ‘কি পাইনি’, ‘মোহমুক্তি’, ‘ঢেউ জাগে’, ‘দুদিনের খেলাঘর’, ‘মেঘ বিজলী বাদল’, ‘আলোছায়া’, ‘নতুন পৃথিবী’ প্রভৃতি উপন্যাসে প্রেমের বিচিত্র কাহিনী সহজ সরলভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। কাহিনীর উপাদেয়তা ও বর্ণনায় সরলতার জন্য এক শ্রেণির পাঠকের কাছে এসব রচনা হৃদয়গ্রাহী। সমসাময়িককালে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক রূপে তাঁর বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছিল।

দৌলতুন্নেসা খাতুন 

দৌলতুন্নেসা খাতুন (১৯১৮-৯৭) ‘পথের পরশ’ নামক সামাজিক উপন্যাস লিখে খ্যাতি লাভ করেছেন। ‘বধূর লাগিয়া’ তাঁর অপর উপন্যাস।

আবু রুশদ

আবু রুশদ (১৯১৯) যে কয়েকটি উপন্যাস রচনা করেছেন তাতে তাঁর প্রতিভার উৎকর্ষের প্রকাশ ঘটেছে। ‘এলোমেলো’, ‘সামনে নূতন দিন’, ‘ডোবা হল দীঘি’, ‘অনিশ্চিত রাগিণী’, ‘নোঙর’, ‘স্থগিত দ্বীপ’ প্রভৃতি তাঁর উপন্যাস। ‘নোঙর’ উপন্যাসটি তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে বিবেচনার যোগ্য। দেশবিভাগের পটভূমিকায় গ্রন্থটি রচিত এবং জাতীয় জীবনের বিশেষ আদর্শ তাতে প্রতিফলিত হয়েছে।  চরিত্র চিত্রণে এবং ভাষাব্যবহারে লেখকের বিশেষ কৃতিত্ব বিদ্যমান। ছোটগল্প রচনাকারী হিসেবেও তাঁর কৃতিত্ব অপরিসীম। সাহিত্য সমালোচনা, আত্মজীবনী রচনা ও অনুবাদে তাঁর প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রয়েছে।

শামস রশীদ 

শামিল রশীদের (১৯২০-২০০২) উপনাসের নাম—‘উপল উপকূলে’, ‘নীলাঞ্জনা’, ‘প্রাণবসন্তু’, ‘দয় উপবন’, ‘পালিকা’, ‘সিন্ধু বারোয়া’, ‘মনকোরক’, ‘মনপ্রসূন’, ‘পর্বত বুরুঞ্জী’ ইত্যাদি। সংখ্যার দিক থেকে খুব বেশি গ্রন্থের রচয়িতা তিনি নন, কিন্তু বিশিষ্টতার জন্য সেসব প্রশংসিত।

কাজী আফসারউদ্দিন আহমদ

কাজী আফসারউদ্দিন আহমদ (১৯২১-৭৫} বহু উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হচ্ছে—‘কলাবতী কন্যা’, ‘চরভাঙ্গা চর’, ‘নীড় ভাঙ্গা ঝড়’, ‘নোনাপানির ঢেউ’, ‘বাতাসী’, ‘সুরের আগুন’ ইত্যাদি। পল্লীর জীবন ও সমাজ তাঁর উপন্যাসের উপজীব্য। তাঁর কিছু গল্পগ্রন্থ ও প্রবন্ধ রয়েছে।

নীলিমা ইব্রাহীম

ড. নীলিমা ইব্রাহীম (১৯২১-২০০২) গবেষণামূলক সাহিত্যসৃষ্টিতে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। কিন্তু গদ্যসাহিত্যের বৈচিত্রপূর্ণ ক্ষেত্রে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। তাঁর উপন্যাসগুলো হচ্ছে—‘কেয়াবন সঞ্চারিণী’, ‘পথশ্রান্ত’, ‘বিশ শতকের মেয়ে’, ‘একপথ দুই বাঁক’, ‘বহ্নিবলয়’ ইত্যাদি। সমসাময়িক জীবনের সমস্যা এইসব উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে।

মোজাহারুল ইসলাম 

মোজাহারুল ইসলাম (১৯২১) ‘সোনাঝরা দিন’, ‘কখনো অন্য মনে’, ‘আমার পৃথিবী তুমি’, ‘হৃদয়ের রং’, ‘হীরাঝিল’, ‘বেগম থেকে বাঈ’, ‘এক নায়ক দুই নায়িকা’, ‘আলো ঝরা রাত’ ইত্যাদি উপন্যাসে সংসারের সাধারণ প্রেমপ্রীতির আলেখ্য অঙ্কন করেছেন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ 

প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-৭১) প্রথমে ‘লালসালু’ নামক উপন্যাস লিখে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে বাংলাদেশের উপন্যাসে আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ ও যথার্থ আধুনিক উপন্যাস লেখক বিবেচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্যে যে সব উপন্যাস প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তাদের মধ্যে ‘লালসালু’র স্থান অনন্য। গ্রামীণ জীবনের পটভূমিকায় এই উপন্যাসটি রচিত। ধর্মের নামে স্বার্থান্ধ মানুষের কার্যকলাপ এখানে রূপলাভ করেছে। গ্রামবাংলার বাস্তব চিত্র হিসেবে এই উপন্যাসটি অত্যন্ত মূল্যবান। ‘লালসালু’ উপন্যাসের উপকরণ হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে পশ্চাদপদ গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামো লালিত জীবন।’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বিষয়বস্তু নির্বাচনে এবং অভিনব আঙ্গিক প্রয়োগে বিশিষ্টতা দেখিয়েছেন বলে স্বল্পসংখ্যক গ্রন্থ রচনা করে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। তাঁর অপর দুটি উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ বিশেষ পরীক্ষা নিরীক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ। দার্শনিক চেতনাসমৃদ্ধ উপন্যাস হিসেবে এগুলো বিবেচ্য। ভাষার কারুকার্যে, দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায়, আঙ্গিকের সুষ্ঠু রূপায়ণে ও পটভূমির বৈচিত্র্যে লেখকের কৃতিত্ব বিদ্যমান। ছোটগল্প ও নাটক রচনায়ও তাঁর সমান দক্ষতা ছিল।

ইসহাক চাখারী

ইসহাক চাখারী (১৯২২) কয়েকটি উপন্যাসের রচয়িতা। ‘পরাজয়’, ‘মায়ের কলঙ্ক’, ‘‘মেঘবরণ কেশ’, ‘বোব জোয়ার’ তাঁর উপন্যাসগুলোর নাম। সামাজিক জীবনের নানা সমস্যা তাঁর উপন্যাসে রূপায়িত হয়েছে। তিনি বক্তব্য সহজ সরল ভাবে পরিবেশন করে বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছেন।

সরদার জয়েনউদ্দিন

সরদার জয়েনউদ্দিন (১৯২৩৮৬) ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম লব্ধপ্রতিষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তাঁর উপন্যাসগুলোর নাম হচ্ছে—‘আদিগন্ত’, ‘নীল রং রক্ত’, ‘পান্নামোতি’, ‘অনেক সূর্যের আশা’, ‘বেগম শেফালী মির্জা’, ‘ বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ’, ‘শ্রীমতী ক খ এবং শ্রীমান তালেব আলী’, ‘কদম আলীদের বাড়ি’। সমকালীন জীবনের সমস্যা তাঁর উপন্যাসে রূপ লাভ করেছে। ‘আদিগন্ত’ উপন্যাসটি সাম্প্রদায়িকতা ও দাঙ্গাবিরোধী সমাজসংস্কারমূলক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। ‘নীল রং রক্ত’ অবিভক্ত বাংলায় নীলকরদের অত্যাচারের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রচিত উপন্যাস। ‘পান্নামোতি’ সমাজের অভিজাত ও নিচুস্তরের মানুষের কাহিনী! অনেক সূর্যের আশা’ লেখকের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিকায় বিস্তৃত পরিসরে এই উপন্যাসটি রচিত। এ উপন্যাসের বিস্তৃত ক্যানভাসে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, মানুষের নৈতিক অধঃপতন, আর্থিক সংকট, মানুষের জীবনযুদ্ধের বহুভুজ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। চরিত্রচিত্ৰণ ও বর্ণনাভঙ্গি আকর্ষণীয়। ‘বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ’ ভাষা আন্দোলনভিত্তিক মলনশীল রাজনৈতিক উপন্যাস।

নূরুন্ নাহার 

নূরুন নাহার (১৯২৩) ‘বৈরাগীর আখড়া’ ও ‘জাঙ্গালের মেয়ে ’উপনাস রচনা করেছেন।

বেদুঈন সামাদ 

বেদুঈন সামাদ (১৯২৪-২০০১) ‘দুই নদী এক ঢেউ’, ‘ধূমনগরী’, ‘নিষ্পত্তি’, ‘পথে যেতে যেতে’, ‘বেলাশেষে’ প্রভৃতি উন্যাসের রচয়িতা।

খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস

খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস (১৯২৩-৯৫) আদর্শবাদী লেখক হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর ‘কত ছবি কত গান’ বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম উপন্যাস। অসংখ্য ঘটনাবলীর মাধ্যমে সংগ্রামী মানুষের কথা এই উপন্যাসে রূপায়িত হয়ে উঠেছে। তত্ত্বের প্রাধান্য গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য। বিশেষ আদর্শ সামনে রেখে উপন্যাসটি রচিত। তাই এতে তত্ত্বকথার গুরুত্ব গল্পরসের প্রকাশ বাধাগ্রস্ত করেছে। সমকালীন রাজনীতি তাঁর রচনায় বিষয়বস্তু হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে।

রশীদ করীম 

রশীদ করীম (১৯২৫) ‘উত্তম পুরুষ’ উপন্যাস রচনা করেই সাহিত্য পুরস্কার ও খ্যাতি লাভ করেছিলেন। নগরজীবনের বৈশিষ্ট্য অবলম্বনে রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে এই উপন্যাসের স্থান গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর অন্যান্য জনপ্রিয় উপন্যাস হচ্ছে—‘প্রসন্ন পাষাণ’, ‘আমার যত গ্লানি’ ও ‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’। এসব গ্রন্থেও নাগরিক জীবনের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। ‘আমার যত গ্লানি’ উপন্যাসটি একজন যন্ত্রণাক্লিষ্ট অধঃপতিত কিন্তু চৈতন্যমুখর আধুনিক মানুষের উপাখ্যান। ‘মায়ের কাছে যাচ্ছি’, ‘একালের রূপকথা’, ‘পদতলে রক্ত’, ‘চিনি না’, ‘সাধারণ লোকের কাহিনী’ তাঁর অপরাপর উপন্যাস।

আবদুর রাজ্জাক

এই প্রসঙ্গে ঔপন্যাসিক আবদুর রাজ্জাকের (১৯২৬-৮১) কথাও উল্লেখযোগ্য। তাঁর সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত উপন্যাস ‘কন্যা কুমারী’। ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক আভিজাত্য, অবক্ষয়ী গ্রামজীবন এবং আধুনিক শহরের বাহ্যিক জৌলুসের পটভূমিতে এই উপন্যাস রচিত।

আবু ইসহাক

গ্রামবাংলার অনন্য চিত্র রূপায়িত হয়ে উঠেছে আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩) রচিত ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ উপন্যাসে। বাংলাদেশের সমাজজীবনের বাস্তব চিত্র হিসেবে এ উপন্যাসের বিশেষ মর্যাদা। পঞ্চাশ সনের মন্বন্তর, দেশবিভাগ এবং স্বাধীনতা লাভের স্বপ্নের আনন্দ ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত উন্মলিত-অস্তিত্ব মানুষের জীবনসংগ্রাম এই উপন্যাসে চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। একটি বিশিষ্ট সামাজিক উপন্যাস হিসেবে এই গ্রন্থের পরিচয়। সমালোচকেরা ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ উপন্যাসটিকে বিস্ময়কর, শিল্পকুশল, সার্থক সাহিত্য, স্মরণীয় সাহিত্য বলে আখ্যা দিলেও কেউ কেউ এটাকে স্কেচধর্মী রচনা বলে অভিহিত করেছেন। নিরাসক্ত জীবনদৃষ্টি দিয়ে লেখক ঢাকা শহরের কাছের জীবনধারা, স্বাধীনতা উৎসব, ঈদ উদযাপন ইত্যাদির যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তা গতিমান। গ্রামের দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে স্বার্থপর মানুষের অত্যাচার-উৎপীড়নের বাস্তব চিত্র এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে। জীবন-নির্বাচনে সমকালমনস্কতা এবং রূপায়ণে বস্তুনিষ্ঠনিরাসক্তি এ উপন্যাসকে নবতর মাত্রা দান করেছে। বাংলাদেশের উপন্যাসের ক্ষেত্রে যে কয়টি গ্রন্থ বাস্তব জীবনের সার্থক চিত্রণের উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত এ গ্রন্থটি তার অন্যতম।

আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী

আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী (১৯৯৬) কবিতা রচনা করেন। তিনি উপন্যাসও রচনা করেছেন। ‘প্রেম পরিণয়’, ‘বান’ তাঁর উপন্যাস।

শামসুদ্দীন আবুল কালাম 

শামসুদ্দীন আবুল কালাম (১৯২৬-৯৭) উপন্যাস রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। গল্প রচনায়ও তাঁর দক্ষতা ছিল। ‘আশিয়ানা’, ‘জীবনকাব্য’, ‘কাঞ্চনমালা’, ‘আলম নগৱেৱ উপকথা’, ‘দুই মহল’, ‘কাশবনের কন্যা’, ‘জায়জঙ্গল’ প্রভৃতি তাঁর উপন্যাস। বাংলাদেশের বিচিত্র মানুষের চিত্র রূপায়ণের জন্য যেসব উপন্যাসের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে তাদের মধ্যে ‘কাঞ্চনমালা’ ও ‘কাশবনের কন্যা’ উপন্যাস দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জেলে ও বেদেদের জীবনকাহিনী এগুলোতে রূপলাভ করেছে। এই শ্রেণির সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ আনন্দবেদনার বাস্তব চিত্র হিসেবে উপন্যাস দুটির মর্যাদা অত্যধিক। ‘আলমনগরের উপকথা’ উপন্যাসটি ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচিত। সুদক্ষ কথাশিল্পীর কৃতিত্বের স্বাক্ষর হিসেবে লেখকের গ্রন্থগুলো পাঠকহৃদয় জয় করে নিয়েছে। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস হচ্ছে—‘নবান্ন’, ‘সমুদ্র বাসর’, ‘যার সাথে যার’, ‘মনের মত ঠাই’ ইত্যাদি।

শহীদুল্লাহ কায়সার 

শহীদুল্লাহ কায়সার (১৯২৬-৭১) ঔপন্যাসিক হিসেবে পুরস্কৃত ও খ্যাতিমান ছিলেন। তাঁর মাত্র দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু সেই স্বল্পতার মধ্যেই তাঁর অপরিসীম কৃতি প্রকাশিত। তাঁর ‘সারেং বৌ’ গ্রন্থে সমুদ্র উপকূলের নাবিকদের জীবনকাহিনী রূপ দেওয়া হয়েছে। বাস্তব চিত্র হিসেবে এর মর্যাদা অনেক। বিষয়কল্পনা ও জীবনজিজ্ঞাসার বিচারে ‘সারেং বৌ’ এক অনবদ্য সৃষ্টি। সংশপ্তক’ উপন্যাসের বিরাট কলেবরে গ্রাম ও নগর জীবনের পরিচয় প্রকাশমান। এই উপন্যাসে যুগচেতনা, শিল্পচেতনা এবং জীবনচেতনার সমন্বয় ঘটেছে। উপন্যাসটি এপিকধর্মী। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি, চরিত্র চিত্রণে দক্ষতা এবং আকর্ষণীয় গল্পরস সৃষ্টিতে কৃতিত্ব থাকার ফলে তাঁর উপন্যাস সংখ্যায় কম হলেও সার্থকতার নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। পাঠক হৃদয় জয় করার বিরল ক্ষমতা তাঁর উপন্যাসে রয়েছে। সমালোচকের মতে, জীবনাদর্শ ও শিল্পনির্মিতি উভয় মানদণ্ডেই ‘সংশপ্তক’ বাংলা উপন্যাসের ধারায় এক অসামান্য সংযোজন।

রোমেনা আফাজ

রোমেনা আফাজ (১৯২৬) অনেকগুলো উপন্যাস রচনা করেছেন। ‘কাগজের নৌকা’, ‘জানি তুমি আসবে’, ‘প্রিয়ার কণ্ঠস্বর’, ‘লেখকের স্বপ্ন’, ‘সোনালী সন্ধ্যা’, ‘হারানো মাণিক’ প্রভৃতি তাঁর উপন্যাস। রহস্যোপন্যাস রচনায়ও তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

মেসবাহুল হক 

মেসবাহুল হক (১৯২৭) ‘পূর্বদেশ’ নামে সুবৃহৎ উপন্যাস রচনা করেছেন। উপন্যাসটি ইতিহাসের ভিত্তিতে রচিত। ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনী এর উপজীব্য। ‘আরেক পৃথিবী’, ‘শতাব্দীর ডাক’ তাঁর অপরাপর উপন্যাস।

আনোয়ার পাশা

আনোয়ার পাশা (১৯২৮-৭১) বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। উপন্যাস রচনায় তাঁর কৃতিত্ব বিদ্যমান। ‘নিধুতি রাতের গাথা’, ‘নীড়সন্ধানী’ ও ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ তাঁর উপন্যাস। শেষোক্ত উপন্যাসটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিকায় রচিত। সংগ্রামের কিছু দিনের লেখকের মর্মান্তিক বাস্তব অভিজ্ঞতার চিত্র এখানে অঙ্কিত হয়েছে। উপন্যাসটি ‘আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার বস্তুনিষ্ঠশিল্পরূপ।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে লেখক বাঙালির দুঃখ-বেদনা ও আশা-এষণার শিল্পরূপ এক অপরূপ সাহিত্যকর্ম হিসেবে রূপায়িত হয়ে উঠেছে।

আনিস চৌধুরী

আনিস চৌধুরী (১৯২৯-৯০) কতিপয় উপন্যাস রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর উপন্যাসের নাম ‘সখের পুতুল’, ‘সরোবর’, ‘সৌরভ’, ‘মধুগড়’, ‘ঐ রকম একজন’, ‘ময়নামতী’ ইত্যাদি। আধুনিক জীবনের জটিলতা, হৃদয়ের দ্বন্দ্ব এই সব উপন্যাসের বিষয়বস্তু। মধ্যবিত্ত মানুষের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, দুঃখ-দারিদ্র্য ও সংগ্রামী চেতনা তাঁর উপন্যাসে রূপায়িত হয়ে উঠেছে নাট্যরচনাতেও তাঁর বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে।

মোহাম্মদ মোর্তজা

মোহাম্মদ মোর্তজা (১৯৩১-৭১) ‘চরিত্রহানির অধিকার’ নামে একটি বিশিষ্ট উপন্যাস রচনা করেছিলেন। অনুবাদেও তিনি দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন শোষিত-নিপীড়িত জনগণের মুক্তির নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক। তিনি সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি ও চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

আতাহার আহমদ

আতাহার আহমদ কয়েকটি বিশিষ্ট উপন্যাসের রচয়িতা। ‘উন্মোচন’, ‘পিপাসা’, ‘সূর্যের নিচে’ তাঁর উপন্যাসের নাম। এসব উপন্যাসে সমকালীন জীবনের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। নাগরিক জীবনের জটিলতা উপন্যাসগুলোতে বিধৃত।

নাজমুল আলম 

নাজমুল আলম (১৯২৭) ‘নিশি হলো ভোর’, ‘সন্ধ্যারাগ’, ‘ফুলমতি’, ‘অলৌকিক’ প্রভৃতি উপন্যাস রচনা করেছেন। নাট্যকার ও ছোটগল্পকার হিসেবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন।

রাজিয়া মজিদ

রাজিয়া মজিদ (১৯৩০) উপন্যাস রচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর উপন্যাসের নাম—‘তমসা বলয়’, ‘দিগন্তের স্বপ্ন’, ‘মেঘের জলতরঙ্গ’, ‘নক্ষত্রের পতন’, ‘দাড়িয়ে আছি একা’, ‘সেই তুমি’, ‘অশঙ্কিনী সুদর্শনা’, ‘দিনের আলো’, ‘রাতের আঁধার’, ‘এই মাটি এই প্রেম’, ‘অরণ্য জনতা’, ‘শতাব্দীর সূর্যশিখা’, ‘সুন্দরতম’, ‘জ্যোৎস্নায় শূন্য মাঠ’, ‘অন্তুরলোকে জ্বলে জোনাকী’, ‘বৃষ্টি ভেজা মুখ’, ‘ভালবাসার সেই মুখ’, ‘যুদ্ধ ও ভালবাসা’ ইত্যাদি।

আলাউদ্দিন আল আজাদ

আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯) গল্প উপন্যাস কবিতা নাটক প্রবন্ধ প্রভৃতি বৈচিত্র্যপূর্ণ সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ব্যতিক্রমধর্মী ছোটগল্প রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়ে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম ছোটগল্প গ্রন্থ ‘জেগে আছি’-এর মাধ্যমে তিনি না বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিতে পেরেছিলেন। তাঁর উপন্যাসে বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব বিদ্যমান। ‘কর্ণফুলী’ উপন্যাসটি তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত। এই গ্ৰন্থে তিনি কর্ণফুলী নদী তীরের চট্টগ্রামের উপজাতীয় জীবনের কিছু চিত্র অঙ্কন করেছেন। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের প্রভাব জনগণের ওপর পড়ে। তার ফলে মানুষের জীবনে আসে সঙ্কট। স্বার্থলোলুপ মানুষের হাত পড়ে অসহায় মানুষের ওপর। জীবনের আনন্দবেদনার চিত্রই এই উপন্যাসের উপজীব্য। এই উপন্যাসে লেখক আঞ্চলিক লোকজীবন ও তার ভাষার পরিচয় দানের চেষ্টা করলেও তা যথার্থ আঞ্চলিক উপন্যাস হয়ে ওঠেনি। বরং বাইরের জগতের অভিঘাত-সংঘাতে আঞ্চলিক জীবনের রূপের কী ধরনের রূপান্তর ঘটতে পারে তা এখানে দেখানো হয়েছে। ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ গ্রন্থে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং ‘শীতের শেষ রাত বসন্তের প্রথম দিন’ উপন্যাসে যৌনচেতনার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। ‘ক্ষুধা ও আশা’ উপন্যাসটিতে রূপায়িত হয়েছে যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ-পীড়িত সামাজিক অবস্থায় সংগ্রামী মানুষের চিত্র। উপন্যাসটি মানবিক মূল্যবোধ ও তীক্ষ্ণ জীবনচেতনায় সমৃদ্ধ। গ্রামজীবনের বৈচিত্র্য শহর জীবনের অন্ধকার রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং একটি বিশেষ যুগের সার্বিক পরিচয় ‘ক্ষুধা ও আশায়’ সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে। আলাউদ্দিন আল আজাদের বস্তুনিষ্ঠ জীবনবোধ ও মনোবিশ্লেষণী অন্তরঙ্গতার স্বাক্ষর ‘ক্ষুধা ও আশা’। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস—‘খসড়া কাগজ’, ‘শ্যামল ছায়ার সংবাদ’, ‘জ্যোৎস্নার অজানা জীবন’, ‘যেখানে দাঁড়িয়ে আছি’, ‘পাটরানী’, ‘স্বাগতম ভালোবাসা’, ‘অপর যোদ্ধারা’, ‘পুরানা পল্টন’, ‘অন্তরীক্ষ বৃক্ষ রাজি’, ‘প্রিয় প্রিন্স’, ‘পুরুদ্রজ’, ‘কামপাস’, ‘অনূদিত অন্ধকার’, ‘স্বপ্নশিলা’, ‘কালো জ্যোৎস্নার চন্দ্রমল্লিকা’, ‘বিশৃঙ্খলা’ ইত্যাদি।

জহির রায়হান

জহির রায়হান (১৯৩৩-৭২) উপন্যাস রচনায় উৎকর্ষপূর্ণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’, ‘আর কত দিন’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘কয়েকটি মৃত্যু’ ও ‘তৃষ্ণা’ তাঁর উপন্যাস। শেষোক্ত উপন্যাস দুটি তাঁর মৃত্যুর পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। জহির রায়হানের অধিকাংশ উপন্যাসে আধুনিক মানুষের দ্বন্দ্বসংঘাতময় নাগরিক জীবনের কথা রূপায়িত হয়ে উঠেছে। হাজার বছর ধরে শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পুরস্কৃত। বাংলার পল্লীর পরিসরে যে জীবনধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে তারই রসমধুর বাস্তবচিত্র এই উপন্যাসটি। লেখকের আকর্ষণীয় বর্ণনাভঙ্গি পাঠককে সহজেই বিমুগ্ধ করে। এই উপন্যাস সম্পর্কে ড. রফিকুল্লাহ খান তাঁর ‘বাংলাদেশের উপন্যাস: বিষয় ও শিল্পরূপ’ অভিসন্দর্ভে মন্তব্য করেছেন— ‘‘বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনবাস্তবতার সুদীর্ঘ পরিসর উপজীব্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসে। জীবনের এই আয়তন-কল্পনার পেছনে ঔপন্যাসিকের রোমান্টিক মন-মানসিকতার ভূমিকাই মুখ্য। যে কারণে, আবহমান বাংলা ও বাঙালির চলমান জীবনরূপ আবেগী শব্দরূপায়ণের মধ্যেই হয়ে পড়েছে সীমাবদ্ধ। তবে দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ময় বিন্যাসে হাজার বছরের মন্থর জীবনস্রোতের মধ্যেও তরঙ্গিত হয়েছে মানবীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা—অচরিতার্থতা-বেদনার রূপ বৈচিত্র্য।’’ তাঁর কোন কোন রচনার অবয়ব সংক্ষিপ্ত কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির নতুনত্ব, বর্ণনার আকর্ষণীয়তা এবং চরিত্র চিত্রণের দক্ষতা তার প্রতিটি সৃষ্টিকে সমাদৃত করেছে। জহির রায়হান জীবনবোধে রোমান্টিক, দৃষ্টিতে আবেগপ্রবণও চিত্ৰাত্মক।

আবদুল গাফফার চৌধুরী

আবদুল গাফফার চৌধুরী (১৯৩৪) কথাসাহিত্যিক হিসেবে বিশেষ খ্যাতিমান। তাঁর উপন্যাস হচ্ছে—‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’, ‘নাম না জানা ভোর’, ‘নীলযমুনা’, ‘শেষ রজনীর চাঁদ’। ‘চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান’ উপন্যাসটি ঐতিহাসিক চেতনায় সমৃদ্ধ, কিন্তু গ্রামজীবনকেন্দ্রিক এর কাহিনী। এই উপন্যাসটিতে আছে মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ সম্বলিত শ্রেণিচেতনার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু আবদুল গাফফার চৌধুরী মনে বুর্জোয়া রোমান্টিক এবং মানবতাবাদী; মননে শ্রেণিসচেতন। উপন্যাসে চন্দ্রদ্বীপ এমন একটি নিসর্গশোভাসমৃদ্ধ স্থান সেখানে চারিদিকে বঙ্গোপসাগরের জলকল্লোল, আকাশে অনিয়ম প্রকৃতির নির্মম বিধাতার মত রাজত্ব, আর নিচে জমিদারের বংশগত, চিরচিরিত শাসন ও শোষণ, চন্দ্রদ্বীপের মানুষ একেই পৃথিবীর স্বাভাবিক জীবন বলে জানে।’’ এই পটভূমিকায় লেখক বাংলাদেশের সমাজ বিকাশের ধারা রূপ দিয়েছেন। ‘নাম না জানা ভোর’ সাধারণ মানুষের জীবনালেখ্য।

সৈয়দ শামসুল হক

সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫) উপন্যাসে যে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পরিচয় দিয়েছেন তাতে তাঁর স্বাতন্ত্র্য লক্ষণীয়। ‘অনুপম দিন’, ‘এক মহিলার ছবি’, ‘দেয়ালের দেশ’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘দূরত্ব’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। এসব উপন্যাসে জৈবিক প্রবৃত্তির পরিচয় স্পষ্ট। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো অন্তর্দ্বন্দ্বে সুতীব্র; ভাষা সাবলীল ও বেগবান। তাঁর রচনায় আছে পরীক্ষানিরীক্ষার নিদর্শন। ‘কয়েকটি মানুষের সোনালী যৌবন’, ‘তুমি সেই তরবারী’, ‘ত্রাহী’, ‘স্তব্ধতার অনুবাদ’, ‘এক যুবকের ছায়াপথ’, ‘বারো দিনের শিশু’, ‘বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল’,  ‘কাল ধর্ম’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘নীলদংশন’ ইত্যাদি তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস। বাংলাদেশের বিকাশশীল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জীবনের বহুভঙ্গিমা জটিলতার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাসসমূহে। জীবনের উপরিতলের পরিবর্তে মনো-অন্বেষাই সৈয়দ শামসুল হকের বৈশিষ্ট্য।

রাবেয়া খাতুন 

রাবেয়া খাতুন (১৯৩৫) ‘অনন্ত অন্বেষা’, ‘মধুমতী’, ‘মন এক শ্বেত কপোতী’, ‘রাজারবাগ শালিমারবাগ’, ‘সাহেব বাজার’ ইত্যাদি উপন্যাস রচনা করে মহিলা ঔপন্যাসিক হিসেবে বিশিষ্টতা দেখিয়েছেন। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস—‘ফেরারী সূর্য’, ‘অনেক জনের একজন’, ‘জীবনের আর এক নাম দিবসরজনী’, ‘বায়ান্ন গলির এক গলি’, ‘বাগানের নাম মালনিছড়া’, ‘এই বিরহকাল’, ‘ই ভরা বাদর মাহ ভাদর’, ‘প্রিয় গুলশানা’ ইত্যাদি।

শহীদ আখন্দ 

শহীদ আখন্দ (১৯৩৫) ‘পান্না হলো সবুজ’, ‘পাখির গান বনের ছায়া’, ‘দু দণ্ড শান্তি’, ‘একদা এক বসন্তে’, ‘সেই পাখি’, ‘আপন সৌরভ’, ‘ভালবাসায় বসবাস’, ‘এইখানে কখনো’, ‘আবার আসিব’, ‘কখন কে জানে’ প্রভৃতি উপন্যাসের রচয়িতা। মানব জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার চিত্র এসব উপন্যাসে রূপায়িত হয়েছে।

রাজিয়া খান

রাজিয়া খান (১৯৩৬) ‘অনুকল্প’, ‘বটতলার উপন্যাস’, ‘চিত্রকাব্য’, ‘প্রতিচিত্র’, ‘হে মহাজীবন’, ‘দ্রৌপদী’, ‘পদাতিক’ নামক উপন্যাস রচনা করেছেন। এই সকল উপন্যাসে আধুনিক নিঃসঙ্গতা, শূন্যতাবোধ, প্রেম এবং সংস্কারের দ্বন্দ্ব রূপায়িত হয়েছে।

শওকত আলী 

শওকত আলী (১৯৩৬) ‘পিঙ্গল আকাশ’ (১৯৬৩) উপন্যাস রচনা করে খ্যাতি লাভ করেছেন। এ উপন্যাসে নারীহৃদয়ের আশা-আকাক্ষার ব্যর্থতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। ‘যাত্রা’, ‘গন্তব্যে অতঃপর’, ‘ওয়ারিশ’, ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোত’, ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’, ‘উত্তরের খেপ’, ‘পতন’, ‘প্রেমকাহিনী’, ‘দলিল’, ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, ‘অপেক্ষা’, ‘সম্বল’, ‘ভালোবাসা কারে কয়’, ‘যেতে চাই’, ‘বাসর ও মধুচন্দ্রিমা’ ইত্যাদি তাঁর উপন্যাস।

আল মাহমুদ

আল মাহমুদ (১৯৩৬) ‘উপমহাদেশ’, ‘কাবিলের বোন’, ‘ডাহুকী’, ‘ময়ূরীর সুখ’, ‘দিন যাপন, ‘কবি ও কোলাহল’, ‘যে ভাবে বেড়ে উঠি’ প্রভৃতি উপন্যাস রচনা করে বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস—‘নিশিন্দা নারী’, ‘আগুনের মেয়ে’, ‘পুরুষ সুন্দর’, ‘পুত্র’ ইত্যাদি।

বদরুন্নেসা আবদুল্লাহ

বদরুন্নেসা আবদুল্লাহ (১৯৩৪) বেশ কয়েকটি উপন্যাস রচনা করেছেন। ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘কাজল দীঘির উপকথা’, ‘বরবৰ্ণিনী’, ‘বনচন্দ্রিকা’, ‘সমুদ্রের ঢেউ’, ‘নূপুর নিক্কণ’, ‘আজকের পৃথিবী’, ‘নিরুত্তর’, ‘আমার সংসার’, ‘মাথুরের পথ’, ‘জীবনের পাতা থেকে’, ‘বড়বাড়ি কথা’, ‘ডাঃ প্রিন্স’, ‘সমুদ্রের ঢেউ’ প্রভৃতি তাঁর উপন্যাস।

দিলারা হাসেম

দিলারা হাসেমের (১৯৩৬) ‘ঘর মন জানালা’ উপন্যাসে নগরজীবনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর অপরাপর উপন্যাস–‘আমলকীর মৌ’, ‘একদা এবং অনন্ত’, ‘স্তব্ধতার কানে কানে’, ‘বাদামী বিকেলের গল্প’, ‘কাকতালীয়’, ‘মিউর‍্যাল’, ‘শখকরাত’, ‘অনুক্ত পদাবলী’, ‘সদর অন্দর’ ইত্যাদি।

রিজিয়া রহমান

রিজিয়া রহমান (১৯৩৯) উপন্যাস রচনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলো হচ্ছে—‘ঘর ভাঙা ঘর’, ‘উত্তরপুরুষ’, ‘রক্তের অক্ষর’, ‘বং থেকে বাংলা’,  ‘অরণ্যের কাছে’, ‘শিলায় শিলায় আগুন’, ‘অলিখিত উপন্যাস’, ‘ধবল জ্যোৎস্না’, ‘সূর্য সবুজ রক্ত’, ‘শুধু তোমার জন্য’, ‘একটি ফুলের জন্য’, ‘প্রেম আমার প্রেম’, ‘একাল চিরকাল’, ‘ঝড়ের মুখোমুখি’, হারুন ফেরেনি’, ‘হে মানব মানবী’ ইত্যাদি।

রাহাত খান

রাহাত খান (১৯৪০) ‘হে অনন্তের পাখি’, ‘হে শূন্যতা’, ‘অমল ধবল চাকরি’, ‘এক প্রিয়দর্শিনী’ ইত্যাদি উপন্যাসের রচয়িতা। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস ‘ছায়াদম্পতি’,  ‘সংঘর্ষ’, ‘শহর’, ‘আকাক্ষা’, ‘কয়েকজন’, ‘অগ্নিদাহ’ ইত্যাদি।

মকবুলা মনজুর

মকবুলা মনজুর (১৯৩৮) রচিত উপন্যাসের নাম ‘আর এক জীবন’, ‘জল রং ছবি’, ‘বৈশাখে শীর্ণ নদী’, ‘অবসন্ন গান’, ‘আত্মজ ও আমরা’, ‘পতিতা পৃথিবী’, ‘প্রেম এক সোনালী নদী’, ‘শিয়রে নিয়ত সূর্য’, ‘অচেনা নক্ষত্র’, ‘কনে দেখা আলো’, ‘নদীতে অন্ধকার’, ‘লীলাকমল’, ‘কালের মন্দিরা’ ইত্যাদি।

মাহমুদুল হক

মাহমুদুল হক (১৯৪০-২০০৮) উপন্যাস সাহিত্যে বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর রচিত উপন্যাস—‘যেখানে খঞ্জনা পাখি’, ‘নিরাপদ তন্দ্রা’, ‘জীবন আমার বোন’, ‘অনুর পাঠশালা’, ‘কালো বরফ চিক্কোর কাবুল’, ‘খেলাঘর’, ‘মাটির জাহাজ’ ইত্যাদি।

মাহবুব তালুকদার 

মাহবুব তালুকদারের (১৯৪০) উপন্যাসের নাম ‘ক্রীড়নক’, ‘অবতার’। সমাজ ও জীবনসচেতন উপাখ্যান হিসেবে এগুলোর গুরুত্ব। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস—‘অপলাপ’, ‘আরেকজন আমি’, ‘পলাশ ও শিমুলের গল্প’, ‘বদ্ধভূমি’ ইত্যাদি।

আমজাদ হোসেন

আমজাদ হোসেন (১৯৪২) উপন্যাস রচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর উপন্যাস ‘স্থির পাখি’, ‘আমি এবং কয়েকটি পোস্টার’, ‘নিরক্ষর স্বর্গে’, ‘উঠোন’, ‘অবেলায় অসময়’, ‘মাধবীসংবাদ’, ‘মাধবীর মাধব’, ‘মাধবী ও হিমানী’, ‘আগুন লাগা সন্ধ্যা’, ‘শেরজনী’, ‘কেউ কোনদিন’, ‘যুদ্ধে যাবো’, ‘যুদ্ধ যাত্রার রাত্রি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ইত্যাদি।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস 

আফতরারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-৯৭) ‘চিলে কোঠার সেপাই’ উপন্যাস রচনা করে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। ‘খোয়াবনামা’ তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।

আহমদ ছফা

আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১) ‘সূর্য তুমি সাখী’, ‘ওঙ্কার’, ‘একজন আলি কেনানের উত্থান পতন’, ‘মরণবিলাস’, ‘অলাতচক্র’, ‘গাভি বিত্তান্ত’, ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’, ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ’ ইত্যাদি উপন্যাসের রচয়িতা।

সেলিনা হোসেন 

সেলিনা হোসেন (১৯৪৭) ‘উত্তর সারথি’, ‘জলোচ্ছ্বাস’, ‘জ্যোৎস্নায় সূর্যজ্বালা’, ‘পদশব্দ’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘মগ্ন চৈতন্যের শিস’, ‘যাপিত জীবন’, ‘নীল ময়ূরের যৌবন’, ‘চঁদ বেনে’, ‘নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’, ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’, ‘ক্ষরণ’, ‘খুন ও ভালোবাসা’, ‘কালকেতু ও ফুসুরা’, ‘টানাপড়েন’, ‘গায়ত্রীসন্ধ্যা-এক’, ‘গায়ত্রীসন্ধ্যা-দুই’, ‘গায়ত্রীসন্ধ্যা-তিন, ‘দীপান্বিতা’, ‘যুদ্ধ’ ইত্যাদি উপন্যাসগুলো রচনা করেছেন।

বুলবুল চৌধুরী

বুলবুল চৌধুরী (১৯৪৭) উপন্যাস রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস—‘কিহ কামিনী’, ‘পাপপুণ্যি’, ‘জলটুঙ্গি’, ‘ঘরবাড়ি’, ‘দম্পতি’, ‘বলো কি অনুভব’, ‘যাও পাখি বলো তারে’, ‘অপরূপ বিল ঝিল নদী’, ‘খাটের বাও’ প্রভৃতি।

হুমায়ূন আহমে

হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২) উপন্যাস রচনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। বাংলাদেশে সমকালে সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ। সংখ্যার আধিক্যে, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে, কাহিনী রূপায়ণে, ভাষার মাধুর্যে হুমায়ূন আহমেদ অনন্য। চরিত্র চিত্রণের আশ্চর্য দক্ষতা তাঁর রচনায় পরিলক্ষিত হয়। রসমধুর করে গল্প পরিবেশন করা তাঁর অনন্য গুণ। বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের চিরপরিচিত আলেখ্য তাঁর উপন্যাসের উপজীব্য। কাহিনী উপস্থাপনায় তাঁর একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ভাষা ব্যবহারে সারল্য তাঁর বর্ণনাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তাঁর উপন্যাসগুলোর নাম—‘নন্দিত নরকে’ (১৯৭২), ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘নির্বাসন’, ‘অচিনপুর’, ‘সৌরভ’, ‘অন্যদিন’, ‘এই বসন্তে’, ‘সবাই গেছে  বনে’, ‘তারা তিনজন’, ‘তোমাকে’, ‘একা একা’, ‘অমানুষ’, ‘প্রথম প্রহর’, ‘আমার আছে জল’, ‘দেবী’, ‘১৯৭১’, ‘ফেরা’, ‘মহাপুরুষ’, ইত্যাদি।

ইউসুফ শরীফ

ইউসুফ শরীফ (১৯৪৮) উপন্যাস ছোটগল্প ও ভ্রমণকাহিনী রচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর উপন্যাসের নাম—‘গ্রহণ’, ‘শুধু বাঁশি শুনেছি’, ‘স্বপ্নের চারুলতা’, ‘পরম মাটি’, ‘নদীর মতো’, ‘তোমাকেই শুধু’, ‘সেই মেয়েটি’ ইত্যাদি। এসব উপন্যাসে তিনি যেমন সমকালীন জীবন জিজ্ঞাসা ও মানব মানবীয় হৃদয়ানুভূতির পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি আকর্ষণীয় গল্পরস সৃষ্টিতে উপাদেয় প্রকাশভঙ্গি ব্যবহৃত হয়েছে।

ইমদাদুল হক মিলন

ইমদাদুল হক মিলন (১৯৫৫) বাংলাদেশের উপন্যাসে একটি বিশেষ জনপ্রিয় আসন অলংকৃত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর রচনায় আছে প্রাচুর্য, কাহিনী বর্ণনায় আছে আকর্ষণীয়তা। ইমদাদুল হক মিলন ‘অভিমানপর্ব’, ‘দিনগুলি’, ‘নায়ক’, ‘যাবজ্জীবন’, ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’, ‘তোমাকে ভালোবাসি’, ‘মেয়েমানুষ’, ‘ভূমিকা’, ‘যা কিছু’, ‘ভালোবাসা’, ‘হে প্রেম’, ‘দ্বিতীয় প্রেম’, ‘যৌবনকাল’, ‘নিরাপত্তা হই’, ‘উপনায়ক’, ‘বালকের অভিমান’, ‘বনমানুষ’, ‘সম্পর্ক’, ‘পরকীয়া’, ‘প্রেম ভালোবাসা’, ‘সখা তুমি সখি তুমি’, ‘আজকের দেবদাস’, ‘রাত বারোটা’, ‘কালোঘোড়া’, ‘টোপ’, প্রভৃতি উপন্যাস রচনা করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। মঞ্জু সরকার

মঞ্জু সরকার (১৯৬০) গল্প ও উপন্যাস রচনায় পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। উপন্যাস রচনায় তাঁর স্বাতন্ত্র পরিলক্ষিত হয়। তাঁর রচিত উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—‘তমস’ (১৯৮৪), ‘নগ্ন আগন্তুক’, ‘প্রতিমা উপাখ্যান’, ‘দাঁড়াবার জায়গা’, ‘আবাসভূমি’, ‘ভাঙনের সময়’, ‘ভালবাসা’, ‘অমৃতা’, ‘স্বপ্নচোর’, ‘যমুনা’, ‘অবগুণ্ঠন’ ইত্যাদি।

শিরীন আখতার

শিরীন আখতার (১৯৫৬) ‘অবাক পৃথিবী’, ‘নন্দিনী থামো’, ‘অথচ পবিত্র’, ‘ক্ষুদিরাম যুগে যুগে’, ‘গোলাপী বারুদে নূর হোসেন’, ‘সূর্যের চোখে জল’, ‘আবার আসিব ফিরে’, ‘স্বর্গ থেকে ফেরা’, ‘রাতের অতিথি’, ‘তবুও বেঁচে আছি’, ‘পরমা’, ‘প্রিয় বান্ধবী’, ‘কাজলের স্বাধীনতা’, ‘তোমার জন্যে’, ‘অনন্তের পাখিরা’, ‘অভিমান’, ‘অপু বিজয় দেখেনি’, ‘উনিশ শ একাত্তর’ প্রভৃতি উপন্যাস রচনা করে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

মঈনুল আহসান সাবের

মঈনুল আহসান সাবের (১৯৫৮) ‘পাথর সময়’, ‘চার তরুণ তরুণী’, ‘এক রাত’,  ‘এসব কিছুই না’, ‘কয়েকজন অপরাধী’, ‘আগামী দিনের গল্প’, ‘আদমের জন্য অপেক্ষা’, ‘পরাজয়’, ‘এ এক জীবন’, ‘পরাস্ত সহিস’, ‘মামুলী ব্যাপার’, ‘কেউ জানে’, ‘কবেজ লেঠেল’, ‘সতের বছর পর’, ‘ফেরা হয় না’, ‘অগ্নিগিরি’, ‘নীল খাম’, ‘স্বজন’, ‘দুপুর বেলা’, ‘হারানো স্বপ্ন’, ‘অপরাজিতা’, ‘কয়েকটি প্রেমপত্র’, ‘এক ঝলক’, ‘তুমি আমাকে নিয়ে যাবে’, ‘সুদূর’, ‘প্রেম ও প্রতিশোধ’ ইত্যাদি উপন্যাস রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

নাসরিন জাহান 

নাসরিন জাহান (১৯৬৪) কথাসাহিত্যিক হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি ছোটগল্প ও উপন্যাস উভয় ক্ষেত্রেই পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। ছোটদের জন্যও তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি প্রশংসনীয়। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলো হল ‘উড়ুক্কু’ (১৯৮৩), ‘চন্দ্রের প্রথম কলা’, ‘যখন চারপাশের বাতিগুলো নিভে আসছে’, ‘সোনালি মুখোশ’, ‘লি’, ‘বৈদেহী’, ‘কুয়াশার কণা’, ‘ঈশ্বরের বামহাত’, ‘উড়ে যায় নিশিপক্ষী’ ইত্যাদি।

বাংলাদেশের উপন্যাসের ধারায় অসংখ্য ঔপন্যাসিক নিজ নিজ কৃতিত্ব প্রকাশের সাধনায় বর্তমানে লিপ্ত। তাঁদের অনেকেই নবাগত। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁদের সৃষ্টিধারার অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে। তাঁদের গতিপথ বিস্তীর্ণ এবং সম্মুখে প্রচুর সম্ভাবনাও বিদ্যমান। তাঁদের দৃষ্টিতে নতুন আশার আলো প্রাণে সীমাহীন ঐশ্বর্য। তাই এখানকার সাম্প্রতিক কালের উপন্যাস সাহিত্যের সাধকগণের অনেকের প্রচেষ্টায় উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!