//
//

বাংলাদেশের প্রবন্ধের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।

বাংলাদেশের প্রবন্ধ

প্রবন্ধ সাহিত্য বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, বিষয়ের বৈচিত্র্যে, উপস্থাপনার অভিনবত্বে ও প্রকাশভঙ্গির উপযুক্ততায় তা যথেষ্ট সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এখানকার মনীষীবৃন্দ প্রধানত প্রবন্ধ সাহিতের মাধ্যমে তাঁদের পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন। যাঁরা প্রবন্ধের ক্ষেত্রে খ্যাতিলাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে বর্ষীয়ান সাহিত্যিকগণ দেশবিভাগের পূর্বেই খ্যাতিলাভ করতে সমর্থ হন। সেজন্য এখানকার সাহিত্যিকদের অবদানের পরিচয় লাভ করতে হলে তাদের সামগ্রিক সাহিত্যসৃষ্টির সন্ধান প্রয়োজন।

বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য বিষয়বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য হয়ে উঠেছে বৈচিত্রধর্মী। জাতীয় জীবনের চিন্তাভাবনা কামনাবাসনা রূপায়িত হয়েছে প্রবন্ধের মাধ্যমে। সাহিত্যের বিভিন্ন দিক, সংস্কৃতি, জীবনী, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়াবলম্বনে প্রবন্ধ সাহিত্যের সম্প্রসারণ ঘটেছে। এর মধ্যে সাহিত্য সম্পর্কিত প্রবন্ধ গ্রন্থের সংখ্যাই সর্বাধিক। দেশবিভাগের পরিপ্রেক্ষিতে এখানকার সাহিত্যের মূল্যায়নের যে অভূতপূর্ব সুওগ আসে তার ফলেই বাংলাদেশের সাহিত্যিকগণ এ ব্যাপারে অধিকতর মনোযোগী হয়ে ওঠেন। সাহিত্য সম্পর্কিত গবেষণাকর্ম এখানকার প্রবন্ধ সাহিত্যের বিস্তৃত অঙ্গন জুড়ে ছড়িয়ে আছে।

বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্যের স্বাতন্ত্র্য ও গুরুত্ব তার বিষয়বস্তু নির্বাচনে ও উপস্থাপনায়। বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদানের বিষয়টি এতদিন যথার্থ মূল্য ও মর্যাদা লাভ করেনি। বাংলাদেশের গবেষকগণের অনুসন্ধানের ফলে এতদিনের অবহেলিত বিষয় হলোচনায় এসেছে এবং সে সব আলোচনার প্রেক্ষিতে বিষয়বস্তুর নবপরিচয় উদ্‌ঘাটন সম্ভবপর হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশের গবেষকগণ যে দৃষ্টিভঙ্গি ও মর্যাদার পরিচয় দিয়েছেন তা ইতোপূর্বে লক্ষ করা যায়নি। তাই এখানকার গবেষকদের কল্যাণে সাহিত্যের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন সম্ভব হচ্ছে, এবং বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবি সাহিত্যিকগণের অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি ঘটেছে। সাহিত্যের ইতিহাস ছাড়া আরও অনেক বিষয়ে প্রবন্ধ রচিত হয়ে বাংলাদেশের প্রবন্ধ সমৃদ্ধির পরিচয় দিয়েছে।

গবেষণার জন্য সযত্ন প্রয়াস, উন্নত শ্রেণির সাহিত্যপত্রের প্রকাশ, গবেষণাধর্মী গ্রন্থ প্রকাশের বিশেষ সুযোগ এবং দেশের প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে এখানকার প্রবন্ধ সাহিত্য যথেষ্ট সম্প্রসারিত হয়। মুসলমান কবিসাহিত্যিক সম্পর্কে এর আগে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান চালানো হয়নি, তাদের সাহিত্যের যথার্থ মূল্যায়নেও তেমন কেউ মনোযোগী ছিলেন না। তাই বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্যে এখানকার সাহিত্য ও সাহিত্যিক, সাহিত্যের নানাদিক, নানা সমস্যা ও বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন সুস্পষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকবৃন্দও এ ধরনের বিষয়ে ছিলেন বিশেষ অনুরাগী। তাই এখানকার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ সরে এবং গ্রন্থাকারে বিস্তৃত আলোচনাসমূহে মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যের অতীত ও বর্তমানের বিবরণ ও বিশ্লেষণ অত্যধিক পরিমাণে লক্ষযোগ্য।

দেশবিভাগের পর থেকে, বিশেষত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সগৌরব প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিতে শিক্ষা সংস্কৃতির বিভিন্নমুখী বিকাশ ঘটছে। ফলে সাহিত্যের বিষয়ের পরিধি যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে। স্বাধীন জীবনের প্রেক্ষিত্রে নানা বিষয় হয়েচ্ছে প্রবন্ধের উপজীব্য। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিষয়ের অনুবাদ যেমন প্রবন্ধ সাহিত্যের পরিধি বাড়াচ্ছে, তেমনি ধর্মীয় বিষয়ের বিচার-বিশ্লেষণে প্রবন্ধ সাহিত্যের অবয়বের স্ফীতি ঘটছে। পত্রপত্রিকার ব্যাপক প্রকাশও প্রবন্ধ সাহিত্যের সম্প্রসারণের অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে প্রবীণ ও নবীন লেখকগণের গুরুত্বপূর্ণ অবদানে।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ 

সাহিত্যের নানাদিক নিয়ে যারা মূল্যবান গবেষণার অপরিসীম কৃতিত্ব দেখিয়ে ছিলেন তাদের মধ্যে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের (১৮৬৯-১৯৫৩) নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাংলা সাহিত্যে মুসলমান অবদানের গবেষণার তিনি অগ্রদূত। মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর আট শতাধিক প্রবন্ধ ব্যাপক সাধনা ও অনুসন্ধানেরই ফল। তাঁর লিখিত বা সম্পাদিত পনেরোটি গ্রন্থ বাংলা গবেষণা সাহিত্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—‘রাধিকরি মানভঙ্গ’, ‘সত্যনারায়ণের পুঁথি’, ‘মৃগলুব্ধ’, ‘মৃগলুব্ধ সম্বাদ’, ‘গঙ্গামঙ্গল’, ‘জ্ঞানসাগর’, ‘শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস’, ‘সারদামঙ্গল’, ‘গোরক্ষবিজয়’, ‘পদ্মাবতী’ ইত্যাদি। ‘বাঙ্গালা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ’ গ্রন্থের দুই খণ্ডে তিনি তাঁর সংগ্রহের পরিচিতি দান করেছেন। ‘ইসলামাবাদ’ তাঁর মৌলিক রচনা। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের সহযোগিতায় ‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিগণের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবদানের পরিচয় দিয়েছেন। ‘পুথি পরিচিতি’ তাঁর সঙ্কলিত গ্রন্থ। মধ্য যুগের কতিপয় দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থেরও তিনি সম্পাদনা করেছেন। প্রাচীন সাহিত্যের অনুসন্ধান, সংগ্রহ ও সংরক্ষণকর্মে তিনি অপরিসীম যত্ন ও নিষ্ঠার পরিচয় দান করেছেন। তাঁর অসাধারণ জ্ঞানপিপাসা সারা জীবন তাঁকে মুসলমান সমাজ, সাহিত্য ও ঐতিহ্যপ্রীতি, সে সম্পর্কে অনুসন্ধান এবং উক্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার আর পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে সংযুক্ত করে রেখেছে। তিনি একক ও ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় প্রায় আড়াই হাজার হাতে লেখায় সংগ্রহ করেছিলেন। গবেষণা ও সম্পাদনায় অসাধারণ দক্ষতা ও মৌলিকতার প্রেক্ষিতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মন্তব্য করেছেন— “গ্রন্থের সম্পাদনা কার্যে যেরূপ কৌশল, যে সহৃদয়তা ও যেরূপ সূক্ষ্মদর্শিতা প্রদর্শন করিয়াছেন তাহা সমস্ত বাংলায় কেন, সমস্তু ভারতেও বোধ হয় সচরাচর মিলে না। তার প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যের অনুদঘাটিত অংশের পরিচয় প্রকাশিত হয়ে একদিকে যেমন সেসব সাহিত্যের যথার্থ মূল্যায়ন সাধিত হয়েছে, অন্যদিকে এ ধরনের নতুনতর গবেষণার ক্ষেত্রে অফুরন্ত প্রেরণার সঞ্চার করেছে। তার অবদানের প্রভাব এখন সুদূরপ্রসারী এবং সেই উদ্‌ঘাটিত ভাণ্ডার থেকে আহরিত উপাদানে বর্তমানের গবেষকগণ সৃষ্টিমুখর।’’

আবদুল কাদির মন্তব্য করেছেন— ‘‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অবিশ্রাম সেবা তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একনিষ্ঠভাবে করিয়া গিয়াছেন। তাঁহারই অনলস সাধনার ফলে আজ এ-সত্য সর্বস্বীকৃত যে, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান অপরিমেয় ও গৌরবময়। তাঁহার সুবিপুল সংগ্রহ এখনও আমাদের সাহিত্য গবেষণার সর্বপ্রধান উপকরণ। তাহার অবিচল জ্ঞানোজ্জ্বল জীবনাদর্শ আমাদের সংস্কৃতি-চিন্তাকে সঞ্জীবিত ও শাণিত করিয়াছে।’’

মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ 

ইসলামি বিষয়বস্তু অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনার যে প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছিল তাতে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর (১৮৬৯-১৯৬৮) নাম গুরুত্ব সহকারে উল্লেখযোগ্য। রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হিসেবে তাঁর বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল। তাঁর ‘মোস্তফা চরিত’ (১৯২৩), ‘মোস্তফা চরিতের বৈশিষ্টা’, ‘উম্মুল কেতাব’, ‘আমপারার তফসীর’, ‘সমস্যা ও সমাধান’, পবিত্র কুরআনের বঙ্গানুবাদ ‘তফসিরুল কোরান’, ‘মুক্তি ও ইসলাম’ ইত্যাদি গ্রন্থ ইসলামি সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। ‘মোস্তফা চরিত’ গ্রন্থটি হযরত মুহম্মদ (স) এর জীবনী । এই ধরনের সাহিত্যসৃষ্টিতে এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত। ‘মোসলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’ তাঁর অন্য একটি বিশিষ্ট গ্রন্থ। অগ্রসর মুসলমান সমাজের নবজাগরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন মাওলানা আকরম খাঁ। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের মাধ্যমে তাঁর সেই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে। ইসলামি উপকরণ তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য ছিল, তাঁর বক্তব্য ছিল যুক্তিভিত্তিক এবং তাঁর প্রকাশভঙ্গি ছিল আকর্ষণীয়। আকরম খাঁ আরবি, উর্দু, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ ছিলেন এবং বাংলা গদ্য সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট শিল্পী হিসেবে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। রাজনীতির সঙ্গে তিনি নিবিড় ভাবে জড়িত ছিলেন, সমকালীন সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি অবিভক্ত বঙ্গে মুসলমান জাগরণের আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। তাঁর রচনার ভাষা গাঢ়বদ্ধ ও সংস্কৃতানুসারী।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ 

সাহিত্য সম্পর্কিত গবেষণায় যাঁর নাম বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে তিনি ভাষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯)। তিনি গবেষণা গ্রন্থ, গল্প, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ, সম্পাদনা ইত্যাদি বিচিত্র পর্যায়ে বিশেষ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উপমহাদেশে একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত হিসেবে সর্বজনমান্য ছিলেন এবং এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনি সারা জীবন জ্ঞান-সাধনা ও জ্ঞান বিতরণে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। ইসলামি বিষয়াবলম্বনে তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন, কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর অমূল্য গবেষণামূলক আলোচনাতেই তাঁর কৃতিত্ব সর্বাধিক। ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ। ‘ভাষা ও সাহিত্য’, ‘বাংলা ব্যাকরণ’, ‘আমাদের সমস্যা’ ইত্যাদি গ্রন্থও উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যের কতিপয় মুল্যবান গ্রন্থেরও তিনি সম্পাদনা করেছেন। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ হচ্ছে—‘বিদ্যাপতি শতক’, ‘পদ্মাবতী’, ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ ইত্যাদি। ‘Buddhist Mystic Songs’ তাঁর চর্যাপদ সম্পর্কিত গবেষণাগ্রন্থ। প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যের বহু সমস্যা সমাধানে তাঁর অপরিসীম কৃতিত্ব বিদ্যমান। তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়ানো রয়েছে। অনুবাদের ক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্বপ্রকাশক গ্রন্থাবলী হচ্ছে—‘দীওয়ান-ই-হাফিজ’, ‘শিকওয়াহ ও জওয়াব-ই-শিকওয়াহ’, ‘রুবাইয়াত-ই-উমর খয়াম’, ‘মহাবাণী’, ‘বাইতনামা’, ‘অমিয়বাণী শতক’ ইত্যাদি। এসব ছাড়া তিনি কতিপয় ইংরেজি গ্রন্থের রচয়িতা।

‘‘ভাষাতত্ত্বের নিবিষ্ট পণ্ডিত তার প্রগাঢ় সংস্কৃত এবং আরবি-ফারসি ভাষা-সাহিত্যের জ্ঞান নিয়ে প্রধানভাবে আপন মাতৃভাষা বাংলার—প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আর তাঁর প্রায় সকল রচনাই গবেষণাধর্মী—গভীর অন্বেষণ এবং তীক্ষ্ণ-বিচার-বিবেচনার ফসল।’’ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের নানা তথ্য উদ্‌ঘাটনে ও জটিল গ্রন্থিমোচনে তিনি বিস্ময়কর অনুসন্ধিৎসার পরিচয় দিয়েছেন। উপযুক্ত সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়ে তিনি বহু অজানা বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। মাতৃভাষা ও সাহিত্যপ্রীতি এবং ধর্মানুরাগ তাঁর কীর্তিমান ও কর্মমুখর জীবনের বৈশিষ্ট্য।

ড. কাজী মোতাহার হোসেন 

ড. কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১) ‘সঞ্চরণ’ নামে প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করে এক্ষেত্রে তাঁর বিশিষ্টতা দেখিয়েছেন। তাঁর ‘নজরুল কাব্য পরিচিতি’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্যের ব্যাখ্যা। ‘গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস’, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’, সেই পথ লক্ষ্য করে’, ‘সিম্পোজিয়াম’, ‘আলোকবিজ্ঞান’ ইত্যাদি তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধের সংখ্যাও কম নয়। ড. কাজী মোতাহার হোসেন সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, দাবাড়ু , সঙ্গীতজ্ঞ ও বিজ্ঞানী হিসেবে বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। তৎকালীন নব্যশিক্ষিত মুসলিম তরুণদের প্রগতিশীল সাহিত্য সংগঠন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ (১৯২৬) প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। তিনি মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’র সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর প্রবন্ধের বিষয় ছিল বিচিত্র ধরনের—ধর্ম, সমাজ, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধ রচনায় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতে সুস্থ মনন ও পরিচ্ছন্ন  জীবনবোধের ঋজু পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী এবং সেই আলোকে দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভীত গড়ে তোলার জন্য সাহিত্যসাধনা করেছিলেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়, দেশের স্বাধিকার আন্দোলনে, নিজস্ব সংস্কৃতির উজ্জীবনে তার অবদান ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

আবুল মনসুর আহমদ 

আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৭-১৯৭৯) রসরচনা ও উপন্যাস রচনায় বিশিষ্টতা দেখিয়েছেন। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থগুলো মনীষার বিশেষ পরিচায়ক। ‘পাক বাংলার কালচার’, ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’, ‘শেরেবাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’, ‘কোরানের নসিহত, ‘আত্মকথা’ তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ হিসেবে আবুল মনসুর আহমদের পরিচিতি। খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। তিনি নিজস্ব সাংস্কৃতিক ধ্যান ধারণার প্রবক্তা ছিলেন। তিনি আবহমান কালের ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি সংস্কৃতির পরিবর্তে পূর্ব বাংলার ধর্মভিত্তিক স্বতন্ত্র সংস্কৃতি সৃষ্টির প্রস্তাব করেছিলেন। এই আদর্শে তিনি তাঁর সৃষ্ট ভাষারীতির নমুনা ‘পাক বাংলার কালচার’ গ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর ব্যঙ্গ রচনায় সমাজের মুখখাশধারী মানুষের স্বরূপ উদঘাটন করা হয়েছে।

মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ 

মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ (১৮৯৮-১৯৭৪) ‘পারস্য প্রতিভা’ গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে যে মধুর ও বলিষ্ঠ ভাষারীতির পরিচয় দিয়েছিলেন তা তাঁর জন্য যথেষ্ট খ্যাতি আনয়ন করে। ‘তিনি মানুষের ধর্ম’, ‘নবীগৃহ সংবাদ কারবালা ও ইমাম বংশের ইতিবৃত্ত’, ‘নয়াজাতি স্রষ্টা হযরত মুহম্ম’, ‘হযরত ওসমান’, ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ধারা’ প্রভৃতি গ্রন্থে প্রবন্ধকার হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ ছিলেন একজন সৃজনশীল গদ্যশিল্পী। তাঁর ‘পারস্য প্রতিভা’য় পারস্যের খ্যাতনামা কবিদের জীবনী ও তাদের সাহিত্যকর্ম, ফারসি সাহিত্যের প্রেক্ষাপট, সুফীমত ও বেদান্তদর্শন এবং ‘মানুষের ধর্মে’ জগৎ ও জীবন, ইহলোক ও পরলোক, জড় প্রকৃতি ও মনোজগৎ, জীবনপ্রবাহ ও আত্মা ইত্যাদি দুরূহ তত্ত্ব ক্লাসিক্যাল বাংলা গদ্যে উপস্থাপন করেছেন।

মোতাহের হোসেন চৌধুরী 

মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-৫৬) ‘সংস্কৃতি কথা’ (১৯৫৮) নামক প্রবন্ধ পুস্তকের মাধ্যমে সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট আসন লাভ করেছেন। বুদ্ধির দীপ্তিতে পরিচ্ছন্ন রচনাভঙ্গিই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনকালে, ১৯২৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’ পত্রিকার সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। বুদ্ধির দীপ্তি, যুক্তিনিষ্ঠতা, জীবনরস ও সৌন্দর্য সুষমায় সমৃদ্ধ তাঁর রচনা এক বিশিষ্ট স্টাইলের অধিকারী। ক্লাইভ বেলের সিভিলাইজেশনের অনুবাদ ‘সভ্যতা’ এবং বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘কংকোয়েস্ট অব হ্যাপিনেস’ গ্রন্থের অনুবাদ ‘সুখ’ তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর।

মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন 

মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন (১৯০৪-৮৭) গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদানের মূল্যায়ন করেছেন। এই প্রসঙ্গে ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’ তিন খণ্ডে মুসলমান লেখকদের সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। তিনি অজস্র লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করে ‘হারামণি’ নামে দশ খণ্ডে প্রকাশ করেছেন। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ—‘শিরনী’, ‘ধানের মঞ্জরী’, ‘আগর বাতি’, ‘ইরানের কবি’ ইত্যাদি। তিনি বাংলা লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রধান সংগ্রাহক হিসেবে বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রকাশ পেয়েছে।

সৈয়দ মুর্তাজা আলী 

সৈয়দ মুর্তাজা আলী (১৯০২-৮১) নানা বিষয়ে প্রবন্ধ রচনায় দক্ষতা দেখিয়েছেন। ‘প্রবন্ধ বিচিত্রা’, ‘হযরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাস’, ‘আমাদের কালের কথা’, ‘মুজতবা কথা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ ইত্যাদি তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ। তাঁর রচনা তথ্যবহুল এবং তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিদ্যমান।

আবুল ফজল

আবুল ফজল (১৯০৫-৮৩) মননশীল লেন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থের নাম—‘সাহিত্য সংস্কৃতি জীবন’, ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা’, ‘বিদ্রোহী কবি নজরুল’, ‘সমাজ সাহিত্য রাষ্ট্র’, ‘সমকালীন চিন্তা’, ‘শুভবুদ্ধি’, ‘মানবতন্ত্র’, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’, ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন’, ‘বিচিত্র কথা’, ‘রবীন্দ্রসঙ্গ’ ইত্যাদি। ‘রেখাচিত্র’, ‘লেখকের রোজনামচা’, ‘দুর্দিনের দিনলিপি’ তাঁর স্মৃতিকথা। তিনি কতিপয় গল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন। ‘সাংবাদিক মুজিবর রহমান’, ‘শেখ মুজিব; তাকে যেমন দেখেছি’—তাঁর লেখা স্মৃতিকথা। স্বদেশপ্রীতি, অসাম্প্রদায়িক জীবনচেতনা, সত্যনিষ্ঠা, মানত ও কল্যাণবোধ ছিল তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির প্রতিপাদ্য বিষয়। তিনি মুক্তবুদ্ধির চির সজাগ প্রহরী বলে আখ্যায়িত হয়েছিলেন। জাতির বিভিন্ন সংকট ও ক্রান্তিলগ্নে তাঁর নির্ভীক ভূমিকার জন্য জাতির বিবেক বলে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন।

আবুল ফজলের প্রতিভা ছিল বৈচিত্রধর্মী। তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যে সমকালীন সমাজ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর ধ্যানধারণা ব্যক্ত হয়েছে। তিনি ছিলেন মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের অন্যতম প্রবর্তক এবং ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ (১৯২৬) নামক সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন

ড. মুহম্মদ এনামুল হক 

ড. মুহম্মদ এনামুল হক (১৯০৬-৮২) সাহিত্য সম্পর্কিত গবেষণায় বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী। তিনি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সহযোগিতায় ‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থ রচনা করেন। ‘চট্টগ্রামী বাংলার রহস্যভেদ’ তাঁর ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা এবং ‘মুসলিম বাঙ্গালা সাহিত্য’ বাংলা সাহিত্যে মুসলমান  অবদান সম্পর্কে লিখিত ইতিহাস। ‘বঙ্গে সুফী প্রভাব’, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম’ তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের ইতিহাসে মুসলমান কবিগণের অবদানের অনুসন্ধান ও মূল্যায়নের জন্য তাঁর ‘মুসলিম বাঙ্গলা সাহিত্য’ গ্রন্থটি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। ‘মনীষা মঞ্জুষা’ ২ খণ্ড তাঁর প্রবন্ধ সংকলন। এসব গবেষণামূলক আলোচনা ছাড়াও তাঁর কতিপয় সম্পাদিত গ্রন্থ রয়েছে। সেসব হচ্ছে—‘অস-সবউল-মু অলুকাত’, ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্মারক গ্রন্থ’। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের সাহিত্যসৃষ্টিতে সংখ্যার দিক থেকে তেমন প্রাচুর্য না থাকলেও পাণ্ডিত্যের গভীরতায় তা বিশিষ্ট। গবেষণা ক্ষেত্রে তাঁর অনুসন্ধিৎসা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্তিনিষ্ঠতার মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে যে বলিষ্ঠ অবদান রেখেছেন তা তুলনারহিত। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের তাত্ত্বিক পুরোধা ও নির্ভীক প্রবক্তা হিসেবে তাঁর ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন।

অসাম্প্রদায়িক শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভিত রচনার ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা ও গবেষণায় তাঁর কৃতিত্ব ছিল অপরিসীম। বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকগণের অবদানের মূল্যায়নে তিনি তৎপর ছিলেন। গবেষক, শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত ও সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী। তাঁর ভাষা ঋজু ও সাধুরীতির অনুসারী। পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধের মধ্যেও তিনি সরস কবিত্বময় স্টাইল রক্ষা করেছেন।

আবদুল কাদির

আবদুল কাদির (১৯০৬-৮৪) কবি হিসেবে খ্যাতিলাভ করলেও গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনায় তাঁর সবিশেষ কৃতিত্ব বিদ্যমান। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ছান্দসিক, গবেষক ও মননশীল প্রবন্ধকার। ১৯২৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামক সংগঠনের মাধ্যমে যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল তিনি ছিলেন তার অন্যতম উদ্যোক্তা। এই সংগঠনের মুখপত্র ‘শিখা’র তিনি ছিলেন প্রকাশক ও লেখক। সাহিত্য সম্পর্কিত অজস্র মূল্যবান প্রবন্ধ তিনি রচনা করেছেন। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থাবলীর ভূমিকাও তথ্যের আকর। তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ—‘বাংলা কাব্যের ইতিহাস : মুসলিম সাধনার ধারা’, ‘কবি নজরুল’, ‘মওলানা মোহাম্মদ নইমুদ্দীন’, ‘কাজী আবদুল ওদুদ’, ‘ড. মুহম্মদ এনামুল হক বক্তৃতামালা’, ‘লোকায়ত সাহিত্য’। ছন্দ সম্পর্কিত তাঁর আলোচনা বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি সাধন করেছে। ‘ছন্দসমীক্ষণ’ তাঁর ছন্দের আলোচনা সম্পর্কিত গ্রন্থ। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে—‘কাব্য মালঞ্চ’, ‘নজরুল রচনাবলী’, ‘রোকেয়া রচনাবলী’, ‘লুৎফর রহমান রচনাবলী’, ‘মুসলিম সাহিত্যের সেরা গল্প’, ‘সিরাজী রচনাবলী’, ‘এয়াকুব আলী চৌধুরী রচনাবলী’, ‘আবুল হোসেন রচনাবলী’, ‘কাব্যবীথি’ ইত্যাদি।

মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন কাশিমপুরী 

মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন কাশিমপুরী (১৯০১-৭৯) লোকসাহিত্যের সহ সম্পাদনা ও আলোচনায় কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। ‘লোকসাহিত্যে ছড়া’, ‘লোকসাহিত্যে ধাঁধা ও প্রবাদ’, ‘বাংলার লোকসাহিত্য পরিচিতি’, ‘বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত পরিচিতি’ প্রভৃতি তাঁর বিশিষ্ট গ্রন্থ। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান লোকসংগীত, ছড়া, প্রবাদ, প্রবচন, ধাঁধা ইত্যাদি সংগ্রহ করে সেসবের যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন তাতে তাঁর প্রবল অনুসন্ধিৎসা ও গভীর পাণ্ডিত্যের প্রকাশ ঘটেছে। সমগ্র জীবন নিরবচ্ছিন্ন সাধনা দ্বারা তিনি বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের বহু অমূল্য সম্পদ সংগ্রহ ও প্রকাশ করে গেছেন।

বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ 

বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ (১৯০৮-৬৪) পুণ্যময়ী’, ‘রোকেয়া জীবনী’, ‘বেগম মহল’, ‘আমার দেখা তুরস্ক’, ‘নজরুলকে যেমন দেখেছি’, ‘শিশুর শিক্ষা’, ‘ফুল বাগিচা’ ইত্যাদি গ্রন্থের মাধ্যমে স্বীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। এদেশের নারী সমাজের জাগরণের জন্য বেগম রোকেয়ার আদর্শ অনুসরণে ও তাঁর সান্নিধ্যে জাতির সেবায় নিয়োজিত হন। নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করে গেছেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা ‘রোকেয়া জীবনী’। এতে বেগম রোকেয়ার কর্মময় জীবনের স্বরূপ উদ্‌ঘাটন করে তা অনুসরণের জন্য নারী সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। শিক্ষা, সাহিত্য ও সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে তাঁর অবদান নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক পরিবেশে বেড়াজালের মধ্যে থেকেও তিনি জীবনের যে রূপায়ণ ঘটিয়েছিলেন তা ছিল বিস্ময়কর।

রণেশ দাশগুপ্ত 

রণেশ দাশগুপ্ত (১৯১২-৯৭) সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘উপন্যাসের শিল্পরূপ’, ‘শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে’, ‘আলো দিয়ে আলো জ্বালা’, ‘ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তি সংগ্রাম’, ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’ প্রভৃতি তাঁর রচনা।

মনিরউদ্দীন ইউসুফ

মনিরউদ্দীন ইউসুফ (১৯১৯-৮৭) বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, চরিতকথা, আত্মজীবনী, অনুবাদ ও কিশোর পাঠ্য রচনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ফারসি ও উর্দু থেকে অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। পারস্যের মহাকবি ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’ কাব্যের পূর্ণাঙ্গ বঙ্গানুবাদ তাঁর বিশিষ্ট কীর্তি। তাঁর অন্যান্য অনুবাদ হল—‘ইকবালের কাব্য সঞ্চয়ন’, ‘দীওয়ান-ই-গালিব’, ‘কালামে রাগিব’, ‘রুমীর মসনবী’ ইত্যাদি। সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধগুলো তাঁর কৃতিত্বের পরিচায়ক। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হল—‘বাংলা সাহিত্যে সুফী প্রভাব’, ‘উর্দু সাহিত্যের ইতিহাস’, ‘আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি’, ‘কারবালা একটি সামাজিক ঘূর্ণাবর্ত’, ‘সংস্কৃতি চর্চা’, ‘বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রগতির লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব’, ‘নব মূল্যায়নে রবীন্দ্রনাথ’। তাঁর রচিত জীবনীগ্রন্থ–‘ছোটদের রসূল চরিত’, ‘হযরত ফাতেমা’, ‘হযরত আয়েশা’। তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার  জীবন আমার অভিজ্ঞতা’ মূল্যবান গ্রন্থ।

মুহম্মদ আবদুল হাই

মুহম্মদ আবদুল হাই (১৯১৯-৬৯) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব সম্পর্কিত তাঁর আলোচনা অত্যন্ত মূল্যবান। ‘ধ্বনি বিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’ গ্রন্থ তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা অভিনবত্বের পরিচায়ক এবং বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমধর্মী রচনা। ধ্বনিতত্ত্ব সম্পর্কিত তাঁর কতিপয় ইংরেজি গ্রন্থও রয়েছে। ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, ‘ভাষা ও সাহিত্য’, ‘তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা’ প্রভৃতি তার সাহিত্য আলোচনামূলক প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি সৈয়দ আলী আহসানের সহযোগিতায় ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ নামে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছেন। এতে গদ্য লেখক সম্পর্কিত আলোচনা অংশটি মুহম্মদ আবদুল হাই রচিত। এই গ্রন্থে আধুনিক যুগের মুসলমান লেখক সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে তা তথ্য পরিবেশনে ও মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কতিপয় সম্পাদিত গ্রন্থও রয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত ষান্মাসিক সাহিত্য পত্রিকা সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যে গবেষণা পত্রিকা হিসেবে মূল্যবান সংযোজন। এই পত্রিকা কেন্দ্র করে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের প্রেরণায় বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার সূত্রপাত হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ বিধানের জন্য তিনি তাঁর জীবনব্যাপী সাধনা করে গেছেন। বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল গভীর। বাংলা সাহিত্যের উন্নতির জন্য তাঁর উদ্যোগ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য তিনি কঠোর সংগ্রাম করে গেছেন। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মর্যাদাকে সমুন্নত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম পাঁচ ভাগে বিভক্ত হতে পারে—ক. অনুবাদ ও ভ্রমণকাহিনি, খ. সাহিত্য আলোচনা, গ. লোকসাহিত্য, ঘ. ভাষাতত্ত্ব এবং ঙ. পত্রিকা সম্পাদনা। তাঁর সম্পর্কে আজহারউদ্দিন খান মন্তব্য করেছেন—‘‘অধ্যাপক ও সাহিত্যসেবী হিসেবে তিনি চিরকাল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অপরিসীম মমতা প্রকাশ করে গেছেন। বাংলা ভাষার বদলে উর্দু বা আরবির প্রচলন, আরবিতে বাংলা লিখন-পদ্ধতি প্রবর্তন, রোমান হরফে বাংলা লেখার ব্যবস্থা, বাংলা বর্ণমালা শুদ্ধিকরণ, বাংলা বানান সংস্কার, রবীন্দ্র-বিরোধী আন্দোলন, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উৎখাত প্রচেষ্টা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি প্রবলভাবে লড়েছেন।’’ ‘ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান’ তাঁর অনুবাদ গ্রন্থ। ‘বিলাতে সাড়ে সাত শ দিন’ তাঁর ভ্রমণকাহিনি। বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী, ধ্বনিবিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে তাঁর পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে একজন চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক হিসেবেও সুনাম অর্জন করেছিলেন।

আবদুল হক 

আবদুল হক (১৯২০-৯৭) ‘ক্রান্তিকাল’, ‘সাহিত্য ঐতিহ্য মূল্যবোধ’, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, ‘সাহিত্য ও স্বাধীনতা’, ‘ভাষা আন্দোলনের আদিপর্ব’, ‘নিঃসঙ্গ চেতনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ প্রভৃতি প্রবন্ধ গ্রন্থের লেখক। নাটক ও ছোটগল্পেও তাঁর দক্ষতার পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। তবে প্রবন্ধ রচনায় তিনি বিষয়-বৈচিত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন—সাহিত্য, রাজনীতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি তাঁর প্রবন্ধের বিষয় ছিল। তাঁর বক্তব্যে আছে গভীরতা, ভাষায় আছে ঋজুতা এবং চিন্তায় আছে মৌলিকতার পরিচয়।

ড. নীলিমা ইব্রাহিম

ড. নীলিমা ইব্রাহিম (১৯২১-২০০২) উপন্যাস নাটক ভ্রমণকাহিনি অনুবাদ প্রভৃতি বিচিত্রধর্মী সাহিত্যসৃষ্টি করলেও প্রবন্ধ রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ‘ঊনবিংশ শতকের বাঙালি সমাজ ও বাংলা নাটক’ তাঁর গবেষণা গ্রন্থ। এছাড়া ‘শরৎ প্রতিভা’, ‘বাংলার কবি মধুসূদন’, ‘বাংলা নাটক: উৎস ও ধারা’, ‘বাঙালি মানস ও বাংলা সাহিত্য’, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য পাঠের ভূমিকা’ ইত্যাদি গ্রন্থ সাহিত্যের বিভিন্ন দিক অবলম্বনে রচিত। তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থ—‘বেগম রোকেয়া’, ‘সাহিত্য সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ’, ‘সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত : অতঃপর অমানিশার অন্ধকার’’, ‘অগ্নিস্নাত বঙ্গবন্ধুর ভস্মাচ্ছাদিত কন্যা আমি’, ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’, ‘বেগম ফজিলতুননেসা মুজিব’ ইত্যাদি। তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থ—‘বিন্দু বিসর্গ’ এবং ভ্রমণকাহিনি ‘শাহী এলাকার পথে পথে’।

ড. আহমদ শরীফ 

ড. আহমদ শরীফ (১৯২১-৯৯) মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে অনেকগুলো গবেষণামূলক প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর গবেষণায় মধ্যযুগের অনেক মুসলমান কবির কাব্যসম্পর্কে তথ্য ও তত্ত্ব উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। ‘সৈয়দ সুলতান, তাঁর গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ’ গবেষণামূলক আলোচনা। ‘বিচিত্র চিন্তা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চিন্তা’, ‘পুঁথির ফসল’, ‘স্বদেশ অন্বেষা’, ‘জীবনে সমাজে সাহিত্যে’, ‘কালিক ভাবনা’, ‘যুগযন্ত্রণা’, ‘মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ’, ‘বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য’ ২ খণ্ড, ‘প্রত্যয় ও প্রত্যাশা’ ইত্যাদি তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ। তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থ হল—‘একালে নজরুল’, ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চালচিত্র’, ‘এবং আরো ইত্যাদি’, ‘ইদানিং আমরা’, ‘কালের দর্পণে স্বদেশ’, ‘বাঙালীর চিন্তাচেতনার বিবর্তন ধারা’, ‘’বাংলার বিপ্লবী পটভূমি’, ‘মানবতা ও গণমুক্তি’, ‘সাম্প্রদায়িকতার ও সময়ের নানা কথা’, ‘গণতন্ত্র সংস্কৃতি স্বাতন্ত্র ও বিচিত্র ভাবনা’, ‘বাঙলা, বাঙালি ও বাঙালিত্ব’, ‘জাগতিক চেতনার বিভিন্ন প্রসূন’, ‘সংস্কৃতি, শাস্ত্র সমাজ ও নারীমুক্তি’, ‘সংকট: জীবনে ও মননে’, ‘মুক্তি নিহিত: নতুন চেতনায় ও নতুন চিন্তায়’, ‘প্রগতির বাধা ও পন্থা’, ‘এই শতকে আমাদের জীবনধারার রূপরেখা’, ‘সময় সমাজ মানুষ’, ‘দেশ কাল জীবনের দাবী ও সাক্ষ্য’, ‘স্বদেশ চিন্তা’, ‘জিজ্ঞাসা ও অন্বেষা’, ‘উজান স্রোতে কিছু আষাঢ়ে চিন্তা’ ইত্যাদি। মধ্যযুগের কতগুলো কাব্যের সম্পাদনাকালে তিনি মূল্যবান আলোচনা করেছেন। তাঁর গবেষণামূলক সম্পাদিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—’নীতিশাস্ত্রবার্তা’, ‘মুসলিম কবির পদসাহিত্য’, ‘চন্দ্রাবতী’, ‘লায়লী মজনু’, ‘বাউলতত্ত্ব’, ‘পুঁথি পরিচিতি’, ‘মধ্যযুগের কাব্যসংগ্রহ’, ‘মধ্যযুগের গীতিকবিতা’, ‘তোহফা’, ‘রসুলবিজয়’, ‘সত্যকলি বিবাদ সংবাদ’, ‘শা বারিদ খান গ্রন্থাবলী’, ‘মধ্যযুগের রাগতালনামা’, ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’, ‘সওয়াল সাহিত্য’, ‘সিকান্দর নামা’ ইত্যাদি। ড. আহমদ শরীফ তাঁর অফুরন্ত গবেষণার মাধ্যমে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অঙ্গন আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছেন। গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর অনুসন্ধিৎসা, সুতীক্ষ যুক্তি ও আকর্ষণীয় প্রকাশভঙ্গি তাঁর রচনাকে বিশিষ্টতা দান করেছে।

সৈয়দ আলী আহসান 

সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২) বাংলাদেশের কাব্যে অন্যতম আধুনিক কবি রূপে খ্যাতিমান হলেও প্রাবন্ধিক হিসেবে তাঁর অবদান কম নয়। তিনি মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সঙ্গে ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে কাব্য ও নাটক সম্পর্কিত আলোচনাসমূহ লিখেছেন। তাঁর রচনায় পাণ্ডিত্য ও রস সমালোচকের পরিচয় বিধৃত। ‘কবিতার কথা’, ‘নজরুল ইসলাম’, ‘কবি মধুসূদন’, ‘আধুনিক বাংলা কবিতা; শব্দের অনুষঙ্গ’, ‘রবীন্দ্রনাথ; কাব্যবিচারের ভূমিকা’, ‘কবিতার রূপকল্প’, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আদিপর্ব’, ‘মধুসূদন; কবিকৃতি ও কাব্যাদর্শ’, ‘আধুনিক জার্মান সাহিত্য’, ‘সতত স্বাগত’, ‘শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য’, ‘আমাদের আত্মপরিচয় এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ ইত্যাদি বিশিষ্ট সাহিত্য ও শিল্প সমালোচনা গ্রন্থ রচনা করে সৈয়দ আলী আহসান বাংলাদেশের সাহিত্য ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছেন। ‘পদ্মাবতী’, ‘মধুমালতী প্রভৃতি সম্পাদিত গ্রন্থেও তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয় নিহিত। মাইকেল মধুসূদনের কতিপয় গ্রন্থের সম্পাদনাও তিনি করেছেন। তিনি কয়েকটি নাটকের রচয়িতা, কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থও তাঁর রয়েছে। সৈয়দ আলী আহসানের গদ্য রসমধুর, বক্তব্য যুক্তিনিষ্ঠ, তাঁর ভাষারীতিতে আছে নিজস্ব একটা স্টাইল।

মুনীর চৌধুরী 

মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-৭১) নাট্যকার গল্পলেখক, শ্রোতাসম্মোহনকারী বক্তা, কৃতী অধ্যাপক, সমালোচক, প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী হিসেবে দেশের একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী বলে খ্যাত ছিলেন। প্রবন্ধ সাহিত্যেও তাঁর অবদান রয়েছে। তাঁর ‘মীরমানস’ সমালোচনা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংওজন। ‘তুলনামূলক সমালোচনা’ ও ‘বাংলা গদ্যরীতি তাঁর আলোচনা গ্রন্থ। নাটক রচনার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হিসেবেও তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। আশ্চর্য সুন্দর বক্তব্য, রসসমৃদ্ধ ভাষা, চমৎকার উপস্থাপনা ইত্যাদি  তাঁর রচনাকে বিশিষ্টতা দান করেছে।

ড. মযহারুল ইসলাম

ড. মযহারুল ইসলাম (১৯২৫-২০০৩) কবি হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। তবে গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যযুগের কয়েকজন কবির জীবনী ও কাব্য তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু। লোকসাহিত্যের আলোচনার ক্ষেত্রেও তাঁর বিশিষ্টতা রয়েছে। ‘কবি হেয়াত মামুদ’, ‘কবি পাগলা কানাই’, ‘ফোকলোর পরিচিতি ও লোকসাহিত্যের পঠনপাঠন’, ‘লোককাহিনি সংগ্রহের ইতিহাস’, ‘সাহিত্য পথে’, ‘ফোকলোর চর্চায় রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি’ ইত্যাদি তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধগ্রন্থ। তাঁর সম্পাদিত কয়েকটি গ্রন্থও বিদ্যমান। তিনি কতিপয় পত্রপত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে শেখ মুজিবুর রহমানের সুবৃহৎ জীবনী রচনা করেছেন এবং ইংরেজি থেকে তার কিছু অনুবাদও রয়েছে।

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী 

মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (১৯২৬-৭১) সাহিত্যালোচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। ‘রবি পরিক্রমা’ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত তাঁর কতিপয় প্রবন্ধের সঙ্কলন। ‘সাহিত্যের নবরূপায়ণ’, ‘বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার’, ‘রঙিন আখর’ ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ।

ড. কাজী দীন মুহম্মদ

ড. কাজী দীন মুহম্মদ (১৯২৭-২০১১) চার খণ্ডে ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ রচনা করেছেন। তাঁর অপরাপর প্রবন্ধ গ্রন্থ হচ্ছে—‘সাহিত্যসম্ভার’, ‘সাহিত্য শিল্প’, ‘মানব জীবন’, ‘জীবন সৌন্দর্য’, ‘সুফীবাদের গোড়ার কথা’, ‘ইসলামি সংস্কৃতি’, ‘সেকালের সাহিত্য’, ‘সাহিত্য ও আদর্শ’, ‘ভাষাতত্ত্ব’, ‘সুখের লাগিয়া’, ‘বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাব’, ‘আল কাওসার’, ‘নাস্তিকতা ও প্রান্তিকতা’ ইত্যাদি।

ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম

ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম (১৯২৭) ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্য’ নামক প্রবন্ধগ্রন্থে কয়েকজন মুসলমান লেখকের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁর অপর প্রবন্ধগ্রন্থ—‘সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত’। ‘নজরুল ইসলাম’, ‘আবহমান বাংলা’ তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ। ‘আমাদের মাতৃভাষা-চেতনা ও ভাষা আন্দোলন’ তাঁর অপর প্রবন্ধগ্রন্থ। ‘বাংলাদেশে মুসলিম শিক্ষার ইতিহাস এবং সমস্যা’ তাঁর অনুবাদ গ্রন্থ। তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধগ্রন্থ হল—‘মোহাম্মদ মেহেরুল্লা’, ‘উচ্চ শিক্ষায় এবং ব্যবহারিক জীবনে বাংলা ভাষার প্রয়োগ’, ‘সমকালে নজরুল ইসলাম’, ‘আমাদের মাতৃভাষা চেতনা ও ভাষা আন্দোলন’, ‘আমাদের বাঙালিত্বের চেতনার উদ্বোধন ও বিকাশ’, ‘সময়ের মুখ তাহাদের কথা’ ইত্যাদি।

আবদুস সাত্তার 

আবদুস সাত্তার (১৯২৭-২০০০) কবি হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ—‘আরণ্য জনপদে’, ‘আরণ্য সংস্কৃতি’, ‘উপজাতীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য’, ‘আধুনিক আরবি সাহিত্য’, ‘ফারসি সাহিত্যের কালক্রম’, ‘আরবি লোকসাহিত্য’, ‘আদিবাসী সংস্কৃতি ও সাহিত্য’, ‘আরবি সাহিত্যে লৌকিক উপাদান’, ‘গারোদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’, ‘ফারসি সাহিত্যে লৌকিক উপাদান’, ‘আলোকের সন্ধানে শেখ সাদী’, ‘কাহিনীকাব্য নয় কাব্য কাহিনী’ প্রভৃতি। আবদুস সাত্তার এদেশের উপজাতীয় জীবন, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গবেষণা করে তা রূপায়িত করেছেন তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে। তাঁর প্রতিভা বৈচিত্র্যধর্মী এবং সে কারণে বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ রচনায় তাঁর কৃতিত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। তিনি অনুবাদের ক্ষেত্রেও বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। আরবি-ফারসি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ তিনি বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত করেছেন এবং সেসব সাহিত্যের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। রম্যরচনা ও শিশুতোষ রচনাতেও তাঁর কৃতিত্ব বিদ্যমান।

ড.  আশরাফ সিদ্দিকী 

ড. আশরাফ সিদ্দিকী (১৯২৭) লোকসাহিত্যের গবেষণায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ‘লোকসাহিত্য’ দুই খণ্ড তাঁর গবেষণামূলক রচনা। ‘কিশোরগঞ্জের লোককাহিনী’, ‘কিংবদন্তির বাংলা’ ইত্যাদি গ্রন্থে লোকসাহিত্যের উপাদান সংগৃহীত হয়েছে। তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রস্থ হচ্ছে ‘লোকায়ত বাংলা’, ‘শুভ নববর্ষ’, ‘আবহমান বাংলা’ ইত্যাদি। তাঁর কতিপয় সম্পাদিত গ্রন্থও বিদ্যমান। সাহিত্যসৃষ্টিতে তিনি বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। কবি হিসেবে তিনি খ্যাতিমান। গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য ও অনুবাদে তাঁর দক্ষতা আছে। স্মৃতিকথা রচনাতেও তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ‘যা দেখেছি যা শুনেছি যা পেয়েছি’, ‘রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন’, ‘স্মৃতির আয়নায়’ ইত্যাদি গ্রন্থে তিনি জীবনের বিচির স্মৃতিকে রসরূপ দান করেছেন। লোকসাহিত্য তাঁর আলোচনার বিষয়, সেই সঙ্গে শিশুমানসের প্রতি আছে তাঁর অফুরন্ত সহানুভূতি।

ড. কাজী আবদুল মান্নান

ড. কাজী আবদুল মান্নান (১৯২৮-৯৪) গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’ গ্রন্থে তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদানের পর্যালোচনা করেছেন। ‘সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী’ তাঁর সংক্ষিপ্ত আলোচনা গ্রন্থ। ‘রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও মুসলিম সমাজ’ তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থ। তিনি ছিলেন দক্ষ অধ্যাপক, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, বুদ্ধিদীপ্ত বক্তা ও অনুসন্ধিৎসু গবেষক। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানদের সাহিত্যিক প্রয়াস ও সমকালীন সামাজিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণমূলক গবেষণায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

ড. গোলাম সাকলায়েন

ড. গোলাম সাকলায়েন (১৯২৮-২০০৯) ‘বাংলা মর্সিয়া সাহিত্য’ নামে গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর সাহিত্য সম্পর্কিত অপর গ্রন্থ—‘মুসলিম সাহিত্য ও সাহিত্যিক’, ‘অন্তর আলোকে ডক্টর শহীদুল্লাহ’, ‘কবি মোজাম্মেল হক ও ফেরদৌসী চরিত’, ‘ফকীর গরীবুল্লাহ’, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সুফী সাধক’, ‘শেখ ফজলল করিম’, ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদান’, ‘সাহিত্য পরিচয়’ ইত্যাদি।

মুহম্মদ আবু তালিব 

মুহম্মদ আবু তালিব (১৯২৮-২০০৭) সাহিত্য বিষয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করে নিজস্ব ধ্যানধারণার পরিচয় দিয়েছেন। ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় তাঁর রচনায় বিদ্যমান। ‘বাংলা সাহিত্যের ধারা’, ‘লালন শাহ ও লালনগীতিকা’, ‘লালন পরিচিতি’, ‘লোক সাহিত্য’, ‘মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী’, ‘মুসলিম বাংলা গদ্যের প্রাচীনতম নমুনা’,  ‘বিশ্ব ইতিহাসের তিন অধ্যায়’, ‘উত্তরবঙ্গের সাহিত্য সাধনা’, ‘ফকির নেতা মজনু শাহ’, ‘বাংলা সনের জন্মকথা’, ‘উপেক্ষিত সাহিত্য সাধক’, ‘ভাষা লিপি ও সাহিত্য’ ইত্যাদি তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ।

আনোয়ার পাশা 

আনোয়ার পাশা (১৯২৮-৭১) কবিতা গল্প উপন্যাস রচনা করেছিলেন। প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও তাঁর প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল। ‘রবীন্দ্র-ছোটগল্প সমীক্ষা’, ‘সাহিত্যশিল্পী আবুল ফজল’ তাঁর আলোচনা গ্রন্থ। রবীন্দ্র-সাহিত্যের অনুরাগী ভক্ত ও প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী এই লেখক ‘রবীন্দ্র-ছোটগল্প সমীক্ষা’ গ্রন্থের দুই খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলোর মূল্যায়ন করেছেন।

ড. সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়

ড. সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায় (১৯২৯-৮৪) গবোমূলক প্রবন্ধের রচনাকারী। ‘জসীম উদ্দীন’, ‘কবি ফররুখ আহমদ’, ‘মোজাম্মেল হক’, ‘সাহিত্য সমীক্ষা’ তাঁর সাহিত্য সমালোচনা গ্রন্থ। তাঁর অন্যান্য গ্রস্থ হচ্ছে—‘হোরেসের কাব্যতত্ত্ব’, ‘কাব্যনির্মাণকলা; আরিস্টটল’, ‘লঙিনুগের সাহিত্য’ ইত্যাদি। ‘জসীমউদ্দীনের কবি মানস ও কাব্য সাধনা’ তাঁর অভিসন্দর্ভ।

বদরুদ্দীন ওমর

বদরুদ্দীন ওমর (১৯৩১-) মননশীল ও গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর গ্রন্থ হচ্ছে ‘সংস্কৃতির সংকট’, ‘সাম্প্রদায়িকতা’, ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’, ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তু ও বাংলাদেশের কৃষক’, ‘যুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশ’, ‘যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে, ‘সামরিক শাসন ও বাংলাদেশের রাজনীতি’, ‘ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, ‘বাংলাদেশের মার্কসবাদ’ ইত্যাদি। ভাষা আন্দোলন, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি তাঁর প্রবন্ধের আলোচনার বিষয়। বদরুদ্দীন ওমর রাজনৈতিক বিষয়ে আরও অনেক প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর আলোচনায় রাজনেতিক মতাদর্শের বিশ্লেষণ ঘটেছে এবং তিনি সমকালীন পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর বক্তব্য যুক্তিনিষ্ঠ, বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী এবং ভাষা বক্তব্যবিষয়ের উপযোগী।

মোবাশ্বের আলী

মোবাশ্বের আলী (১৯৩১-২০০৫) সাহিত্য সম্পর্কিত আলোচনা করেছেন। ‘মধুসূদন ও নবজাগৃতি’, ‘নজরুল প্রতিভা’, ‘বিশ্বসাহিত্য’ তাঁর আলোচনা গ্রন্থ। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ হল—‘বাংলাদেশের সন্ধানে’, ‘শিল্পীর ট্র্যাজেডি’, ‘রবীন্দ্রনাথ: অন্তুরঙ্গ আলোকে’, ‘শেলী: জীবন ও সাহিত্য’, ‘বরিস পাস্তেরনাক’, ‘এন্টিগোনি’, ‘নজরুল: সমাজ পরিবেশ ও কাল’, ‘নজরুল ও সাময়িকপত্র’, ‘গ্রীক ট্র্যাজেডি’ ইত্যাদি। বিশ্ব সাহিত্যের মূল্যবান সৃষ্টি সম্পর্কে তাঁর অনুসন্ধিৎসা বাঙালি পাঠকদের কাছে তা পরিচিত করে তুলতে সহায়তা করেছে।

আবদুল লতিফ চৌধুরী

আবদুল লতিফ চৌধুরী (১৯২৬) কয়েকটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা গ্রন্থের রচয়িতা। ‘কবি কায়কোবাদ’, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’, ‘মীর মশাররফ হোসেন’ ইত্যাদি তাঁর গ্রন্থ।

ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ

ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৯) বৈচিত্র্যধর্মী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি কবি, কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার। প্রবন্ধরচনায়ও তাঁর দক্ষতা আছে। ‘শিল্পীর সাধনা’, ‘সাহিত্যের আগন্তুক ঋতু’ তাঁর মূল্যবান প্রবন্ধের বই। তাঁর অপরাপর প্রবন্ধ গ্রন্থ হল—‘নজরুল গবেষণা: ধারা ও প্রকৃতি’, ‘মায়াকভস্কি ও নজরুল’, ‘রবীন্দ্রক্লাসিক আবিষ্কার’, ‘সাহিত্য সমালোচনা’, ‘অজিতকুমার গুহ’, ‘মুজফফর আহমদ’, ‘হামিদুর রহমান’ ইত্যাদি। শিশু সাহিত্যেও তাঁর অবদান রয়েছে।

ড. রফিকুল ইসলাম

ড. রফিকুল ইসলাম (১৯৩৪) ‘নজরুল নির্দেশিকা’, ‘নজরুল জীবনী’, ‘বীরের এ রক্তস্রোত’, ‘মাতার এ অশ্রুধারা’, ‘ভাষাতত্ত্ব’, ‘নজরুল ইসলাম : জীবন ও সাহিত্য’, ‘ঢাকার কথা’, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম’, ‘ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার’, ‘আবদুল কাদির’, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’, ‘ভাষাআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য’, ‘বাংলাদেশের সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ’, ‘কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সৃষ্টি’, ‘নজরুল প্রসঙ্গে’, ‘ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধাবলী’ ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেছেন।

ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (১৯৩৫) সাহিত্য সমালোচনামূলক অনেক প্রবন্ধের রচয়িতা। ‘অন্বেষণ’ তাঁর অন্যতম প্রবন্ধ গ্রন্থ। ‘কাব্যের স্বভাব’, ‘এরিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব’ প্রভৃতি তাঁর সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কিত অনুবাদ। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ হচ্ছে—‘আধুনিক ইংরেজি সাহিত্য’, ‘শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ’, ‘বঙ্কিমচন্দ্রের জমিদার ও কৃষক’, ‘কুমুর বন্ধন’, ‘স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি’, ‘উপর কাঠামোর ভিতরেই’, ‘উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ’, ‘গণতন্ত্রের পক্ষ-বিপক্ষ’, ‘বাঙালি কাকে বলি’, ‘বৃত্তের ভাঙা গড়া’, ‘স্বাধীনতার স্পৃহা সাম্যের ভয়’, ‘বাঙালিকে কে বাঁচাবে’, ‘টলস্টয়: অনেক প্রসঙ্গের কয়েকটি’, ‘নেতা জনতা ও রাজনীতি’, ‘শ্ৰেণী সময় ও সাহিত্য’, ‘বাঙালির জয় পরাজয়’, ‘এর পথ ওর প্রাচীর’, ‘পতঙ্গ, ভৃত্য ও দৈত্য’, ‘রাষ্ট্রের মালিকানা’ ইত্যাদি।

যতীন সরকার

যতীন সরকার (১৯৩৬) প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হল—‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’, ‘বাংলাদেশের কবিগান’, ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘কেদারনাথ মজুমদার’, ‘সিরাজুদ্দিন কাশিমপুরী’, ‘হরিচরণ আচার্য’, ‘চন্দ্রকুমার দে’, ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শন’, ‘ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের ভূত ভবিষ্যৎ’ ইত্যাদি। ‘গল্পে গল্পে ব্যাকরণ’ তাঁর ছোটদের উপযোগী বই।

মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ

মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ্ (১৯৩৬) অনেকগুলো সাহিত্য সমালোচনামূলক গ্রন্থের রচয়িতা। ‘নজরুল ইসলাম ও আধুনিক বাংলা কবিতা’, ‘মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ’, ‘বাংলা কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্য’, ‘সমকালীন সাহিত্যের ধারা’, ‘নজরুল কাব্যের শিল্পরূপ’, ‘সাহিত্য সংস্কৃতি জাতীয়তা’, ‘মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতা’ ও ‘আবুল কালাম শামসুদ্দিন’ প্রভৃতি তাঁর প্রাবন্ধিক প্রতিভার নিদর্শন। তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধগ্রন্থ হল—‘সাহিত্য ও সাহিত্যিক’, ‘কবিতা ও প্রসঙ্গকথা’, ‘সাহিত্যের রূপকার’, ‘বুদ্ধির মুক্তি ও রেনেসাঁ আন্দোলন’, ‘বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা প্রীতি’ ইত্যাদি। কবিতা রচনাতেও তাঁর দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছে।

ড. আনিসুজ্জামান 

ড. আনিসুজ্জামান (১৯৩৭) গবেষণা সাহিত্যে বিশেষ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান সম্পর্কে পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাঁর ‘মুসলিম বাংলার সাময়িক পত্র’ নামক সুবৃহৎ গ্রন্থটি সাময়িক পত্রে মুসলমানদের অবদানের বিবরুণ। ‘মুনীর চৌধুরী’ তাঁর সংক্ষিপ্ত আলোচনা গ্রন্থ এবং ‘স্বরূপের সন্ধানে’, ‘আঠারো শতকের বাংলা চিঠি’ ও ‘পুরানো বাংলা গদ্য’ তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ। ‘রবীন্দ্রনাথ’ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখকের প্রবন্ধের সম্পাদনা। তাঁর অপর প্রবন্ধ গ্রন্থ—‘মহম্মদ শহীদুল্লাহ’, ‘মোতাহের হোসেন চৌধুরী’, ‘আমার একাত্তর’ ইত্যাদি। তিনি অনেকগুলো গ্রন্থের সম্পাদনাও করেছেন।

ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান

ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (১৯৩৬-২০০৮) কবিতা সমালোচনা গবেষণামূলক প্রবন্ধ গান ও অনুবাদে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর সাহিত্য সম্পর্কিত গবেষণামূলক গ্রন্থ হচ্ছে—‘আধুনিক বাংলা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক’, ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্য’, ‘বাংলা কবিতার ছন্দ’, ‘আধুনিক কাহিনী কাব্যে মুসলিম জীবন ও চিত্র’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাঙালি ব্যক্তিত্ব’, ‘সাময়িক পত্রে সাহিত্য চিন্তা: সওগাত’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ইতিহাস’, ‘সাহিত্যে উচ্চতর গবেষণা’, ‘মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী’, ‘রবীন্দ্রচেতনা’, ‘আধুনিক বাংলা কাব্য: প্রাসঙ্গিকতা ও পরিপ্রেক্ষিত’, ‘ভাষা আন্দোলন: শিক্ষায় ভাষা পরিকল্পনা’, ‘মধুসূদন’, ‘নজরুল চেতনা’ ইত্যাদি। তিনি অনেক গ্রন্থের সম্পাদনাও করেছেন।

ড. ওয়াকিল আহমদ

ড. ওয়াকিল আহমদ (১৯৪১) সাহিত্য সম্পর্কিত আলোচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম—‘সুলতানী আমলে বাংলা সাহিত্য’, ‘বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান’, ‘বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত’, ‘বাংলার লোকসংস্কৃতি’, ‘বাংলায় বিদেশী পর্যটক’, ‘উনিশ শতকে বাঙালী মুসলমানের চিন্তা চেতনার ধারা’, ‘বাংলার মুসলিম বুদ্ধিজীবী’, ‘মধ্যযুগে বাংলা কাব্যের রূপ ও ভাষা’, ‘প্রবাদ ও প্রবচন’, ‘ধাধা’, ‘মন্ত্র’, ‘বাংলা লোকসঙ্গীত: ভাওয়াইয়া’, ‘বাংলা লোকসঙ্গীত: ভাটিয়ালী গান’, সারিগান ইত্যাদি।

হোসনে আরা শাহেদ

হোসনে আরা শাহেদ (১৯৪২) প্রবন্ধ জাতীয় রচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ‘সমকালীন জীবনের সমস্যা’ তাঁর প্রবন্ধের উপজীব্য। তাঁর রচিত প্রবন্ধের বই—‘চলমান দিন’, ‘নিহত আগন্তুক’, ‘জনারণ্যে’, ‘বৈরীসমাজ’, ‘কেন এ দুয়ারটুকু’, ‘দুঃখের কাছাকাছি’, ‘ডায়নার ছেলে’, ‘সোনাভানের মেয়ে’ ইত্যাদি। সমকালীন জীবনের নানা অসংগতি তিনি পরিহাস মধুর ভাষায় তাঁর লেখনীর মাধ্যমে রূপায়িত করে তুলেছেন। মহৎ আদর্শে উদীপ্ত মানসিকতা নিয়ে তিনি মানবমনের বিচিত্র আচরণের পর্যালোচনা করেছেন। তাঁর আলেখ্য জাতীয় রচনা হচ্ছে—‘গিন্নির ডায়েরী’, ‘জীবন থেকে’, ‘নেপথ্যে জনারণ্যে’, ‘অনন্ত ফেরারি’, ‘জীবনান্দমের জামিন’ ইত্যাদি। তাঁর রম্যরচনা—‘পঞ্চমন্ত্র’, ‘টাকা দেবে গৌরি সেন’। ‘মনোলোক’ তাঁর গল্পগ্রন্থ এবং ‘টম চাচার কুড়ে’ ছোটদের জন্য রচনা।

নরেন বিশ্বাস

নরেন বিশ্বাস (১৯৪৫-৯৮) সাহিত্যের অলঙ্কার ও সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কে গবেষণা করেছিলেন। এসব বিষয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ— ‘অলঙ্কার অন্বেষা’, ‘কাব্যতত্ত্ব অন্বেষা’, ‘প্রসঙ্গ: বাংলা ভাষা’, ‘ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব’। তাঁর অমরকীর্তি ‘বাংলা উচ্চারণ অভিধান’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!