আখ্যানকাব্যের সংজ্ঞা, স্বরূপ ও একটি আখ্যানকাব্য আলোচনা কর।
আখ্যানকাব্য
কোনো আখ্যায়িকা বা বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে যখন কাব্য রচিত হয় তখন তাকে আখ্যানকাব্য বলে অথবা বলা যায় যে কাব্যে আখ্যান বা কাহিনি থাকে তাকে আখ্যান কাব্য বলে। পৌরাণিক বা প্রচলিত বা কল্পিত কোনো কাহিনি যখন কাব্যে রূপায়িত হয় তখনই তা আখ্যানকাব্যের রূপ নেয়। আখ্যানকাব্যের সঙ্গে গাথা বা Ballad-এর অনেকাংশে সাদৃশ্য আছে। আখ্যানকাব্যকে বলা যেতে পারে কাহিনিকেন্দ্রিক কাব্য। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বৃত্রসংহার’, নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’, রবীন্দ্রনাথের ‘বিদায় অভিশাপ’ সবই কাহিনিকেন্দ্রিক কবিতার উদাহরণ।
আখ্যানকাব্যের শ্রেণিবিভাগ
আখ্যানকাব্যের অনেকগুলি ভাগ লক্ষ করা যায়—
১. মঙ্গলকাব্য
২. জীবনীকাব্য
৩. রূপক কাব্য
৪. গীতিকবিতা
৫. ব্যঙ্গকবিতা।
কোনো কোনো সমালোচক মহাকাব্যকেও আখ্যানকাব্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
আখ্যানকাব্যের বৈশিষ্ট্য
- একটি কাহিনি বর্ণনা করা হয়। আনুপূবির্ক ধারাবাহিকতা রেখে গল্প বা কাহিনি বিবৃত করা হয়।
- মহাকাব্যের মতো আখ্যানকাব্যের সূচনা (Beginning), মধ্যভাগ (Middle) এবং পরিণতি থাকে। কাহিনি এখানে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। চরিত্র অনেকখানি গৌণ হয়ে পড়ে।
- কাহিনি বা আখ্যান যেন সংক্ষিপ্ত না হয়, লেখক সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।
- আখ্যানের মধ্যে পারিপার্শ্বিক বর্ণনা থাকতে পারে কিন্তু তা কখনোই আখ্যানকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।
- আখ্যান সহজ, সরলভাবে প্রকাশিত হবে, কোনোমতেই তা বিশ্লেষণধর্মী হবে না।
- ছন্দ সম্পর্কে দৃঢ় পিনদ্ধ নিয়মের বন্ধন আখ্যান কাব্যে নেই। এখানে অলংকার প্রকাশের বাহুল্যও তাকে না।
- বিষয়ের একমুখীনতা আখ্যানকাব্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।
- দেশজয়, প্রেম, রোমান্স, কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা, কোনো বীরের কার্যকলাপ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আখ্যানকাব্য রচিত হতে পারে। কিন্তু অনেকগুলি বিষয় যেন একত্রে গ্রন্থিবদ্ধ না হয়ে পড়ে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
একটি সার্থক আখ্যানকাব্য
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ একটি সার্থক বাংলা আখ্যানকাব্য। বাংলা কাব্যে প্রথম ইতিহাসাশ্রিত রোমান্স হলো ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ (১৮৫৮)। এখানে মুসলমানদের সঙ্গে রাজপুত সংঘর্ষ, উনিশ শতকের নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধে ভারতীয় বীরদের স্বদেশ ও স্বাধীনতার জন্য বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামরূপে চিত্রিত হয়েছে। এইসময় রঙ্গলালের মতো অনেক বাঙালি লেখকই কর্ণেল টডের—‘‘Annals and Antiquities of rajasthan” থেকে রাজস্থানের ইতিহাসাশ্রিত ও কিংবদন্তিমূলক রাজপুতদের শৌর্যবীর্যের কাহিনিগুলোকে সংগ্রহ করে সাহিত্যে রূপ দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। এই গ্রন্থে আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণ এবং জহরব্রতে আগুন লাগিয়ে পদ্মিনীর আত্মাহূতিদানের বর্ণনা পাওয়া যায় ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ তারই ওপর ভিত্তি করে রচিত।
এই কাব্যে রঙ্গলাল দেশপ্রেমের আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দিন চিতোরের রাণি পদ্মাবতীর রূপ লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে লাভ করার জন্য চিতোর আক্রমণ করেন। পদ্মিনীর সতীত্ব, বীরত্ব, রাজপুতজাতির শৌর্যবীর্য ও দেশপ্রেম মনে রাখার মতো। ভীমসিংহ-পত্নী প্রেমকে সর্বস্ব জেনে বলেছেন—
যাক রাজ্যগঠন, নাহি প্রয়োজন
হই হব দুঃখ ভাগী।
রাণী, রাজাকে সাহস দিয়ে বলেছেন দুর্জন দমন সুজন পালন। এই রাজার সম্মান রক্ষা করতে ও সতীত্ব রক্ষা করতে পদ্মিনী আগুনে আত্মাহূতি দিয়েছেন।
পদ্মিনী উপাখ্যানের কাহিনি, চরিত্র খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয় কিন্তু রচনার মধ্যে যে বীররস, রৌদ্ররস ও করুণরসের স্বচ্ছন্দ প্রকাশ ঘটেছে, শুধু তার জন্যই ’পদ্মিনী উপাখ্যান’ স্মরণীয় আছে। ক্ষত্রিয়দের প্রতি রাণা ভীমসিংহের উৎসাহবাণী সমকালীন পাঠককের মধ্যেও উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলেছিল—
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়।
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়।।
এই গান বাঙালির স্বাধীনতার উদ্ভাবনলগ্নে সমর সঙ্গীতের কাজ করেছিল। আখ্যানকাব্যের যে সকল বৈশিষ্ট্যগুলি থাকা প্রয়োজন যেমন, কাহিনির একমুখীনতা, সহজ সরল প্রকাশভঙ্গিসহ অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই ‘পদ্মিনী উপাখ্যানে’র মধ্যে লক্ষ করা যায়। তাই এটি বাংলা সাহিত্যের একটি সার্থক আখ্যানকাব্য।
তথ্যসূত্র:
কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত | Download |
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাস | Download |
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরী | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাস | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যাল | Download |
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাস | Download |
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদার | Download |
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত | Download |
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দী | Download |
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যাল | Download |
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেন | Download |
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষ | Download |
Leave a Reply