ওড বা স্তুতি কবিতার সংজ্ঞা, স্বরূপ ও একটি স্তুতি কবিতা আলোচনা কর।
ওড বা স্তোত্র বা স্তুতি কবিতা
গীতিকবিতার অন্যতম প্রাচীন শাখা হল ওড (ode)। এর বাংলায় কোনো প্রতিশব্দ নেই। তথাপি একে স্তুতি বা স্তোত্র মূলক কবিতা রূপে স্বীকৃতি জানানো হয়েছে। মূলত ‘ওড’ লিরিক কবির একটি সুন্দর আবেগ স্ফূর্তির অভিব্যক্তি মহৎভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর উদ্দেশ্যে রচিত হত, ছন্দরীতিতে বৈচিত্র্য এনে একটু দৈর্ঘ্য করেই এ জাতীয় কবিতা লেখা হতো। প্রাচীন গ্রীসে ওড ছিল প্রধানত একধরনের সম্মেলন গান বা কোরাস, যা ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠান উপলক্ষে সংগীত ও নৃত্য সহযোগে গাওয়া হতো। এগুলি স্তুতিমূলক বা স্ত্রোত্র কবিতা রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
গ্রিক বীরদের অসামান্য কীর্তিকে স্বাগত জানিয়ে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে কার পিন্ডার (pindar) রচনা করে ছিলেন এমন স্তোত্র কবিতা যা দীর্ঘ, ভাবগম্ভীর এবং strophy (turn), Anti-strophe (Counter turn), Epode (after song)-47 GIGGY 108 63 বিন্যস্ত। মঞ্চে বামমুখী নৃত্যের তালে তালে গাওয়া হতো ‘Strophe’; ডান দিকে নৃত্য ভঙ্গিমারত অবস্থায় কোরাস গাইত ‘Anti-strophe’; আর স্থির ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করতো ‘Epode’। ‘Strophe’ ও ‘Anti-strophe’ সম সংখ্যক চরণে গঠিত হলেও ‘Epode’-এর লাইন সংখ্যা ছিল ভিন্ন আর গঠন বিন্যাসও ছিল আলাদা। পিন্ডারের স্তোত্র কবিতা ছিল আনুষ্ঠানিক, বিষয় ও শৈলীতে মহান তথা উচ্চভাবের গৌরব মণ্ডিত। গ্রিক নাটকে কোরাসের কণ্ঠে যে সব স্তোত্রের মন্দ্রিত উচ্চারণে রঙ্গমঞ্চে প্রাণ সঞ্চারিত হও তাদেরই অনুকরণে কবি পিন্ডার রচনা করেছিলেন বীরদের সুমহান সম্ভাষণ।
‘ওড’-এর আভিধানিক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে— “a rimed (realy unrimed) lyric, often in the form of an address; generally dignified or exalted in subject, feeling and style. And enthusiastic tone, often in varied or irregular metre, and usually between fifty and two hundred lines long.’’ Understanding poetry, James Reeves, Pan Books—1965.
Lee T. Lomon বলেছেন— ‘‘The ode was originally a chorall Song. Often comparatively long, describing in elaborately formal language the feats of a God or hero.’’
Martin Gray বলেছেন— ‘‘The ode is a born of Lyric Poem characterised by its lenght. Intricate stanza forms, grandeur of style and serious of purpose. With a venerable history in classical and post-Renai sance poetry.”
অর্থাৎ, ওড এক প্রকারের দীর্ঘ লিরিক কবিতা যার বিষয় বস্তু মহাকাব্যের মতো ভাবগম্ভীর (serious) এবং ছন্দরীতি দীর্ঘ ও বৈচিত্র্যময়। আর ওড কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল কবিতার অবয়ব একাধিক স্তবকে বিভক্ত এবং আবেগপূর্ণ অথচ শব্দ চয়নের সচেতনতায় কবিতার আঙ্গিক যথেষ্ট সমৃদ্ধ। তাই সমালোচক শ্রীশচন্দ্রের ভাষায় বলতে হয়—“অধুনা যে প্রশস্তি মূলক (address) গীতি কবিতায় কোনও সুমান গাম্ভীর্যব্যঞ্জক বিষয়-বস্তু বা উপাদান আশ্রয় করে কবি বিভিন্ন ধরনের ওজস্বী ছন্দে আত্মগত অনুভূতির ভাবমূর্তি দান করেন, তাকে ওড (ode) বা স্তোত্র কবিতা নামে অভিহিত করা হয়।”
স্তোত্র কবিতার বৈশিষ্ট্য
ওডের (ode) বৈশিষ্ট্য বৈচিত্র্যহীন। তবে—যে কটি লক্ষণ বিশেষভা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল—
- কবিতা বেশ কয়েকটি স্তবকে বিভাজিত থাকে, প্রত্যেক স্তবকে আলাদা আলাদা ভাব সংযোজিত হয়। এবং আবেগপূর্ণ শব্দ চয়নের সচেতনতায় কবিতার আঙ্গিক বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধি লাভ করে।
- চিন্তাধারার যুক্তি সংগত বিবর্তন ঘটে।
- ওডের ছন্দ সমিল অমিল দুই-ই হতে পারে।
- কবিতার অবয়ব ৫০ থেকে ২০০ লাইন দীর্ঘ হতে পারে।
- মূলত সৃষ্টি লগ্নে এই ode কোরাস রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
- সাম্প্রতিক কালের স্তোত্র মূলক কবিতায় বহু বৈচিত্র্য সম্পাদিত হয়েছে।
ইংরেজী সাহিত্যে—Milton-এর ‘ode one the Morning of Christ’s Nativity’, Dry den-এর-‘Alexander’s Feast’, Gray-র ‘The Bard’, Collins-এর ‘ode to Evening’, words worth-এর ‘Intimations of Immoations Immortality’, shelley-এর ‘ode to the west wind’, keats-এর ‘ode to a Nightingale’, টেনিসনের ‘ode one the Death of the Duke of wellington’ প্রভৃতি কয়েকটি বিখ্যাত স্তোত্র (ode)।
বাংলায় বিহারীলালের ‘সারদামঙ্গল’, ‘সাধের আসন’, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘ব্রজাঙ্গনা’, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘মাতৃস্তুতি’, অক্ষয় বড়ালের ‘মানব বন্দনা’, রবীন্দ্রনাথের ‘বসুন্ধরা’, সমুদ্রের প্রতি’, ‘উর্বশী’, ‘বর্ষশেষ’, শাজাহান’, ‘শিবাজী’, ‘পৃথিবী’, সতেন্দ্রনাথ দত্তের ‘নমস্কার’, মোহিতলাল মজুমদারের ‘পান্থ’, ‘নারী স্তোত্র’, জীবনানন্দ দাশের—‘বনলতা সেন’, বুদ্ধদেব বসুর ‘ইলিশ’, সুধীন্দ্রনাথের ‘জেমস’, বিষ্ণুদে’র ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’, অমিয় চক্রবর্তীর ‘সন্ত অ্যালবার্ট’ প্রভৃতি ওড জাতীয় কবিতা।
একটি সার্থক বাংলা স্তোত্র কবিতা
রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষশেষ’ এই পর্বের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন রূপে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ১৩০৫ বঙ্গাব্দের ৩০ চৈত্র কালবৈশাখীর উদ্দামতার প্রেক্ষাপটে লেখা আলোচ্য কবিতাটি সতেররোটি স্তবকের এক দীর্ঘ স্তোত্র কবিতা। একটি দীর্ঘ ও একটি হ্রস্ব চরণের দ্বারা গঠিত আট লাইনের একেকটি স্তবক যার দ্বিতীয় ও চতুর্থ এবং ষষ্ঠ ও অষ্টম চরণগুলি পারস্পরিক অন্ত্যমিল যুক্ত, কখ গখ ঘঙ চঙ। চৈত্র শেষের ঝপড়ো তাণ্ডবে বর্ষশেষের যে ইঙ্গিত তা অপূর্ব গতিময় ছন্দোবদ্ধ, চিত্ররুপ মণ্ডিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে—
পশ্চিমে বিচ্ছিন্ন মেঘে সায়াহ্নের পিঙ্গল আভাস।
রাঙাইয়ে আঁখি
বিদ্যুৎ বিদীর্ণ শূন্যে ঝাকে ঝুঁকে উড়ে চলে যায়।
উৎকণ্ঠিত পাখি।।
রবীন্দ্রনাথ সশ্রদ্ধ স্তুতিভাষণে জয়গান গেয়েছেন বর্ষ শেষের প্রলয়ঙ্করী ঝড় ও অবিরল বারি ধারাকে। স্তোত্র কবিতার বৈশিষ্ট্য যে উদাত্ত আহ্বান ও উদ্দীপিত সম্ভাষণ ‘বর্ষশেষ’ কবিতাকে দিয়েছে দুর্বার গতি ও মহিমময়তা—
(ক) হে দুর্দম, হে নিশ্চিত, হে নূতন, নিষ্ঠুর নূতন….
(খ) তোমারে প্রণমি আমি হে ভীষণ, সুস্নিগ্ধ শ্যামল….
(গ) হে কুমার হাস্য মুখে তোমার ধনুকে দাও টান….
(ঘ) হে কিশোর তুলে নাও তোমার উদার জয়ভেরি।
চৈত্র শেষের আচ্ছন্ন ঝড় ঝঞ্জার মুহূর্তে বিগত বর্ষের অবসানে সমাগত নববর্ষের। সম্ভাবনাকে স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়েছেন কবি ছন্দের ঝংকারময় উদাত্ত উচ্চারণে। স্তবক। থেকে স্তবকে চিন্তা ও কল্পনার পরম্পর্যে কবিতা পৌছে যায় রসঘন পরিণতিতে। ভাববস্তুর উচ্চ মহিমায়, আবেগ মণ্ডিত সম্ভাষণে, উপলব্ধির গাম্ভীর্যে এবং ভাষা ও ছন্দের মর্যাদায় ‘বর্ষশেষ’ স্তোত্র কবিতার সার্থক নিদর্শন।
তথ্যসূত্র:
কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত | Download |
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাস | Download |
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরী | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাস | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যাল | Download |
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাস | Download |
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদার | Download |
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত | Download |
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দী | Download |
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যাল | Download |
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেন | Download |
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষ | Download |
Leave a Reply