//
//

সঞ্জয়ের মহাভারত সম্পর্কে আলোচনা কর।

সঞ্জয়ের মহাভারত

সঞ্জয় নামে একজন মহাভারত অনুবাদকের কথা কেউ কেউ বলে থাকেন। আবার অনেকে এই নামের কোন কবির অস্তিত্ব অস্বীকার করে সমস্যার সৃষ্টি করেছেন। “সঞ্জয়-বিরচিত মহাভারত’’ প্রকাশিত হয়েছে সুপরিকল্পিত পুঁথিভিত্তিক ভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ সংস্করণরূপে। এতে কবি সঞ্জয়ের রচনার প্রামাণিক পরিচয় পাওয়া যায়। এবং এর সম্পাদক সঞ্জয়কে বাংলায় মহাভারতের প্রথম অনুবাদক বলে অভিহিত করেছেন। সিলেট থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত অঞ্চলে সঞ্চয়ের মহাভারতের অনেক পুঁথি পাওয়া গেছে। এতে অনুমান করা হয় কবি সিলেট অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। সঞ্জয়ের মহাভারতের সঙ্গে কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মহাভারতের অনুবাদ সাদৃশ্য এতটাই যে, উভয়কে এক কবি বলে মনে হয়। নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে—“সঞ্জয়ের ভারত পাচালী ও কবীন্দ্রের পরাগলী ভারত এক ছাঁচে ঢালা।’’ কবীন্দ্র পরমেশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই, কিন্তু সঞ্জয়ের কোন পরিচয়ই পাওয়া যায়নি। তাই মনে করা হয়, কবীন্দ্রের মহাভারত সামান্য পরিবর্তনসহ সঞ্জয়ের নামে চলছে। ভণিতা থেকে মনে হয়, কবি সঞ্জয় পৌরাণিক সঞ্জয়ের অন্তরালে নিজেকে গোপন করেছেন। অবশ্য ড. দীনেশচন্দ্র সেন সঞ্জয় নামে

একজন কবির ভণিতা উল্লেখ করেছেন—

সঞ্জয় কহিল কথা রচিল সঞ্জয়।

অথবা

সঞ্জয় রচিয়া কহে সঞ্জয়ের কথা।

এতে সঞ্জয়ের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা আছে। একটি পুঁথিতে আছে—

হরিনারায়ণ দেব দীন হীন মতি।

সঞ্জয়াভিমানে কৈলা অপূর্ব ভারতী॥

ব্যাসদেব হৈতে মহাভারত প্রচার।

সঞ্জয় রচিয়া কৈল পাঞ্চালী পয়ার॥

এখান থেকে জানা যায় যে হরিনারায়ণ নামে কোন কবি সঞ্জয় ছদ্মনামে মহাভারত লিখেছিলেন। ড. দীনেশচন্দ্র সেন এসব অনুমানের পরও মন্তব্য করেছেন—“কোন কোন পুথির অধিকাংশই অপরাপর কবির লিখিত, অথচ গ্রন্থের নাম “সঞ্জয়-মহাভারত।’’

বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন যে, কোন গায়ক বা সংকলক কবীন্দ্র পরমেশ্বরের রচনায় পৌরাণিক সঞ্জয়ের নাম জুড়ে দিয়ে এ কাব্যের উপাদেয়তা ও উৎকর্ষ বৃদ্ধির চেষ্টায় দ্ব্যর্থবোধক ‘সঞ্জয়’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি স্বতন্ত্র কবি হলে ভণিতায় অবশ্যই আরও পরিচয় বিধৃত হত। ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন— “কবীন্দ্রের রচনাকে অবলম্বন করিয়া কোন অল্পমেধাবী লেখক, লিপিকর বা পাঁচালীগায়ক পৌরাণিক সঞ্জয়ের নামের অন্তরালে বসিয়া কবীন্দ্রের যশে ভাগ বসাইয়াছেন।’’ সঞ্জয়ের মহাভারতে কবীন্দ্রের রচনা হুবহু স্থান পেয়েছে, যেখানে দু এক কথা নিজের সেখানে কৃতিত্বহীনতার নিদর্শন বিদ্যমান। ড. আহমদ শরীফ তাঁর ‘বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য’ গ্রন্থে সঞ্জয় সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ পর্যালোচনা করে এই বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন—‘‘আমাদের ধারণায় সঞ্জয় কবিযশ প্রার্থী কোন গায়েন-কবি। কবীন্দ্র মহাভারতই তাঁর অবলম্বন। তাঁর স্বকীয় যোজনাও রয়েছে, এমনকি গায়েন-লিপিকর পরম্পরায় পাচালীর স্থানিক ও  কালিক স্ফীতিও ঘটেছে। সঞ্জয় নকলবাজ বলেই কুলপদবী ব্যবহার করেন নি। অথবা তাঁর প্রকৃত নাম হরিনারায়ণ দেব।’’

বিজয় পণ্ডিতের মহাভারত নামে অন্য একটি কাব্য রয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেছিলেন। কিন্তু আসলে ব্যাপারটি নকল এবং এই নামে কোন কবি ছিলেন না। কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মহাভারতই এ নামে চলছিল। কবীন্দ্রের ‘বিজয় পাণ্ডব কথা’ লিপিকর-প্রমাদে ‘বিজয় পপ্তিত কথা’ নামে প্রচারিত হয়েছে।

ষোড়শ শতকের মহাভারত অনুবাদক হিসেবে রামচন্দ্র খান ও দ্বিজ রঘুনাথের নাম উল্লেখযোগ্য। রামচন্দ্র খান ‘জৈমিনির অশ্বমেধপর্ব’ কাব্য ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে রচনা করেছিলেন। রঘুনাথ লিখেছিলেন ‘অশ্বমেধ পর্ব’। কবি উৎকলাধিপতি মুকুন্দদেবের, সভায় নিজের কাব্য পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। ১৫৬৭-৬৮ সালে কাব্যটি রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এই কাব্যের সঙ্গে কাশীরাম দাসের কাব্যের সাদৃশ্য বিদ্যমান। কোচবিহাররাজ নরনারায়ণের ভাই শুক্লধ্বজের নির্দেশে কবি অনিরুদ্ধ ভারত পাঁচালী রচনা করেছিলেন। তিনি কামরূপের অধিবাসী ছিলেন এবং রাম-সরস্বতী উপাধি ব্যবহার করেছেন। ষোড়শ শতকের অন্যান্য মহাভারত রচয়িতাগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন পিতা-পুত্র কবি যষ্ঠীবর সেন ও কবি গঙ্গাদাস সেন। ষষ্ঠীবর সেনের ‘স্বর্গারোহণ পর্ব’ এবং গঙ্গাদাস সেনের ‘আদি পর্ব’ এককালে জনসমাদৃত হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!