অদ্ভুত আচার্যের রামায়ণ সম্পর্কে যা জানো লেখ।
অদ্ভুত আচার্যের রামায়ণ
চৈতন্যোত্তর রামায়ণ অনুবাদকদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন অদ্ভুত আচার্য। অদ্ভুত আচার্য কবির আসল নাম নয়, আসল নাম নিত্যানন্দ আচার্য। ‘অদ্ভুত রামায়ণ’-এর রচয়িতা বলেই হয়তো কবি ‘অদ্ভুতাশ্চার্য’ বা ‘অদ্ভুতাচার্য’ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। ড. সুকুমার সেন মনে করেন— ‘‘অদ্ভুতাচার্য কবির নামও নহে, উপাধিও নহে। ইহা রামায়ণ-গায়কদের উদ্ভাবিত।’’ ড. সেনের ধারণা মেনে নিলে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কবি কাব্যের ভণিতায় ‘অদ্ভুত আচার্য’ এবং ‘অদ্ভুত’ কথাগুলি কেনই বা ব্যবহার করেছিলেন।
কবির আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়, তাঁর পিতার নাম শ্রীনিবাস (বা কাশী) আচার্য ও মাতার নাম মেনকা। পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার চাটমোহর রেল-স্টেশন সংলগ্ন অমৃতকুণ্ডা বা বড়বাড়ি ছিল তাঁর পৈতৃক নিবাস। কবিরা চার ভাই এবং কবির তিন পুত্র। কবি জাতিতে ব্রাহ্মণ।
কাব্যরচনার কারণ হিসেবে কবি মঙ্গলকাব্যের প্রথাগত স্বপ্নাদেশ—প্রসঙ্গই অনুসরণ করেছেন । কবি যখন ‘ সপ্ত বছরের শিশু’ (মতান্তরে পঞ্চ বছরের শিশু) তখন একদিন ‘স্বপ্নাদেশে সাক্ষাত হইল রঘুপতি’ বলে জানিয়েছেন। তাঁর ‘রঘুপতি’—
টোনাল (তৃণ) হইতে অস্ত্র খসাইয়া
লৈল হাতে।
এক মহামন্ত্র তাঁর লিখিল জিহ্বাতে।।
আত্মপরিচয়ের একটি পাঠান্তরে কবির ‘অদ্ভুত-আচার্য’ নামের কারণ বিবৃত হয়েছে—
রাম আজ্ঞা করিল রচিতে রামায়ণ।
অদ্ভুত আচার্য নাম তাহার কারণ।।
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় প্রথম এই কবির পুঁথি সম্বন্ধে আলোচনার সূত্রপাত করেন। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বুকানন নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মচারী ভূমি জরিপ কাজে কিছুকাল উত্তরবঙ্গে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর সেই ভ্রমণ ও অবস্থান সম্পর্কে যে বিবরণ প্রকাশিত হয় তাতে তিনি বলেন যে, উত্তরবঙ্গে অদ্ভুত আচার্য নামে এক কবির রামায়ণের বিশেষ প্রচার আছে। ছাপার অক্ষরে অদ্ভুত আচার্যের সেই প্রথম উল্লেখ। এরপর প্রাচীন কাব্যানুরাগী পণ্ডিতের দল এই কবি ও তাঁর কাব্য সম্বন্ধে কিছু কিছু বিবরণ সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় প্রকাশ করতে থাকেন। ১৯১৩ সালে রজনীকান্ত চক্রবর্তীর সম্পাদনায় অদ্ভুত আচার্যের রামায়ণের আদিকাণ্ড প্রকাশিত হলে পাঠকেরা এই কবি সম্বন্ধে কিছু কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হলেন। কবির অধিকাংশ পুঁথি মালদহ ও রংপুর থেকে পাওয়া গেছে। অদ্ভুত আচার্যের গ্রন্থের প্রাচীন পুঁথি সহজলভ্য না হওয়ায় ড. সুকুমার সেন তাকে সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগের কবি বলে মনে করেছেন। অন্যদিকে মণীন্দ্রমোহন বসু প্রমুখ পণ্ডিতগণ কবি ষোড়শ শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন বলে অভিমত দিয়েছেন। ড. নলিনীকান্ত ভট্টাশালী অদ্ভুত আচার্যের জন্মসন ১৬৪৭ সাল বলে রায় দিয়েছেন।
অদ্ভুত আচার্য মূল রামায়ণের অনুবাদ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি ‘আধ্যাত্ম-রামায়ণ’, ‘অদ্ভুত–রামায়ণ’, ‘যোগবশিষ্ঠ-রামায়ণ’ এবং কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ থেকেও কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। ফলে তাঁর কাব্যের কলেবর বেশ হৃষ্টপুষ্ট রূপ পেয়েছিল। ড. সেন অনুমান করেছেন কবির গ্রন্থে অন্যান্য রামায়ণী কবিদের রচনাও যুক্ত হয়েছিল, ফলে তাঁর কাব্যের আকার কৃত্তিবাসী রামায়ণকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে।
Leave a Reply