শ্রেষ্ঠ চৈতন্যজীবনীকার কৃষ্ণদাস কবিরাজের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতম্
ক্ৰান্তদর্শী কবিমনীষী কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্য জীবনীকার হিসাবে শুধু শ্রেষ্ঠ নয়, মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে একজন অন্যতম দার্শনিক কবি। সুগভীর পাণ্ডিত্য, অসাধারণ দার্শনিকতা ও ভক্তিশাস্ত্রে অতন্দ্র নিষ্ঠা তাঁকে মধ্যযুগের অন্যতম কবির মর্যাদা দিয়েছে। গৌড়, উৎকল, বৃন্দাবন তথা দক্ষিণ ভারতের ভক্তিধর্ম ও দার্শনিকতাকে তিনি যেভাবে রূপ দিয়েছে তাতে তাঁকে মধ্য যুগের ভারতীয় সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলতেই হয়।
কৃষ্ণদাস কবিরাজের কবি পরিচিতি
কবিরাজ গোস্বামী অকৃতদার বৈষ্ণব ছিলেন। কবির জন্ম বর্ধমান জেলার কাটোয়ার কাছে ঝামটপুর গ্রামে। তিনি সম্ভ্রান্ত বৈদ্যবংশজাত। তাঁর পিতা ভগীরথ, মা সুনন্দা দেবী। কবি ছিলেন নিত্যানন্দের শিষ্য। গুরু নিত্যানন্দের দ্বারা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তিনি বৃন্দাবনে চলে যান এবং সেখানে বৈষ্ণব মহাজনদের কাছে ভক্তি শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করেন।
কৃষ্ণদাসের জন্মকাল ও গ্রন্থ রচনাকাল সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। বিমানবিহারী। মজুমদারের মতে কবির জন্মকাল ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে। আবার জগদ্বন্ধু ভদ্র ও সতীশচন্দ্র রায়ের মতে কৃষ্ণদাসের জন্ম ১৪৯৬ খ্রিস্টাব্দ। সুকুমার সেনের মতে ১৫৬০-৮০ খ্রিস্টাব্দ গ্রন্থটির রচনাকাল। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দের পর কৃষ্ণদাস কাব্য রচনায় হস্তক্ষেপ করেন। কৃষ্ণদাস সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে কাব্যটি সমাপ্ত করেন। অন্যমতে সম্রাট আকবরের সময়ে ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে বৃন্দাবনের গোবিন্দ মন্দির নির্মাণের পর কবি আলোচ্য গ্রন্থটি রচনা আরম্ভ করেন।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, বৃন্দাবনদাস রচিত শ্রীচৈতন্যভাগবতের পরিপূরক গ্রন্থ। বৃন্দাবন দাস তাঁর চৈতন্যজীবনী গ্রন্থে চৈতন্যজীবনের আদি ও মধ্যপর্বের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। অপরদিকে কৃষ্ণদাস কবিরাজ, চৈতন্যলীলার অন্ত্যপর্বের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তিনটি খণ্ডে ৬২টি অধ্যায়ে তাঁর কাব্য বিভক্ত করেছেন। আদি খণ্ডে ১৭টি অধ্যায়—চৈতন্য সন্ন্যাস গ্রহণের সময় পর্যন্ত কাহিনী বর্ণিত, মধ্য খণ্ডে ২৫টি অধ্যায়—রায় রামানন্দের সঙ্গে সাধ্যসাধন সম্পর্কিত আলোচনা, রূপ সনাতনের পরাভব প্রভৃতি ঘটনা বর্ণিত। অন্ত্য খণ্ডে ২০টি অধ্যায়—শ্রীচৈতন্যের শেষ বার বৎসরের দিব্যোন্মাদ অবস্থার বর্ণনা আছে। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের কাব্যমূল্য অসাধারণ। কৃষ্ণদাস কবিরাজের বিস্ময়কর প্রতিভার গুণে দর্শনগ্রন্থেও কাব্যগুণ সঞ্চারিত হয়েছে। শ্রীচৈতন্যের জীবনের উপাদানগুলি তিনি বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করেছেন। বৈষ্ণব গোস্বামীদের গ্রন্থগুলি তিনি অভিনিবেশ সহযোগে পাঠ করেছিলেন। সেইজন্য তাঁর গ্রন্থের সমস্ত বিশ্লেষণ শাস্ত্রবাক্য দ্বারা সমর্থিত। গ্রন্থটি ১১৫২৬টি শ্লোকে সমন্বিত। এর মধ্যে চারহাজার শ্লোক সংস্কৃত শ্লোকের উদ্ধৃতি। কবিরাজ গোস্বামী সেই সব শ্লোকের উৎসও উল্লেখ করেছেন, শ্রীমদভাগবত, শ্রীমদভাগবতগীতা, ব্রহ্মসংহিতা, বিষ্ণুপুরাণ, কুর্মপুরাণ, পদ্মপুরাণ, নৃসিংহপুরাণ, মহাভারত, রামায়ণ, রঘুবংশ, অভিজ্ঞানশকুন্তলম্, কিরাতারজুনীয়, নৈষধচরিত, জয়দেবের গীতগোবিন্দ, অমরকোষ, সাহিত্যদর্পণ। এছাড়াও, শ্রীরূপ গোস্বামীর ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, উজ্জ্বলনীলমণি, স্বরূপ দামোদরের কড়চা, মুরারি গুপ্তের কড়চা, রঘুনাথদাস গোস্বামীর স্তবাবলী, সনাতন গোস্বামীর হরিভক্তিবিলাস, শ্রীজীব গোস্বামীর ভাগবৎসন্দর্ভ, কবি কর্ণপুরের চৈতন্যচরিতামৃত প্রভৃতি গ্রন্থ থেকেও প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি গ্রহণ করেছেন।
শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত যে কেবলমাত্র পুরাণ, সংস্কৃত গ্রন্থাদি কিংবা বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থের সারাৎসার তাই নয়, এর কাব্যগুণও স্বতন্ত্ররূপে উল্লেখ্য। কবি চমৎকার উপমাপ্রয়োগে যেমন তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করেছেন, তেমনি, সুললিত পয়ার, ত্রিপদী ছন্দেও তাকে সংহত করেছেন; এর দুটি প্রসিদ্ধ উদাহরণ হল নিম্নরূপ—
অরসজ্ঞ কাক চুষে জ্ঞাননিম্বফলে।
রসজ্ঞ কোকিল খায় প্রেমাম্রমুকুলে।।
কিংবা
এ সব সিদ্ধান্ত রস আমের পল্লব।
ভক্তগণ কোকিলের সর্বদা বল্লভ।।
অভক্ত উষ্ট্রের ইথে না হয় প্রবেশ।
তবে চিত্তে হয় মোর আনন্দ বিশেষ।।
সামগ্রিক বিচারে, শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত মধ্যযুগীয় বাংলা বৈষ্ণবকাব্যে শুধু নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যেরই এক অমূল্য সম্পদ।
কৃষ্ণতত্ত্ব
গৌড়ীয় বৈষ্ণবধারা অনুসারে পরমব্রহ্মের পূর্ণ প্রকাশ হলেন শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীকৃষ্ণ প্রসঙ্গে বলছেন—
সচ্চিদানন্দতনু ব্রজেন্দ্রনন্দন।
সর্বৈশ্বর্য সর্বশক্তিপূর্ণ।।
শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান। তিনি সর্ব অবতারের মূল, সর্বকারণের মূল কারণ। তিনিই অনন্ত বৈকুণ্ঠ, অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের মূলাধার। তিনি সৎ, চিৎ ও আনন্দের সমাহার। তাঁর মধ্যেই সর্ব ঐশ্বর্য, সর্বশক্তির বিকাশ। তিনিই আবার সর্বরসের আধার। তিনি রসস্বরূপ; আবার রসই ব্ৰহ্ম। শ্রীকৃষ্ণই পরম ঈশ্বর। তিনি অনাদি, অনন্ত। কিন্তু তিনি এই শ্রীকৃষ্ণের, যতেক লীলা/ সর্বোত্তম নরলীলা/ নরবপু তাঁর স্বরূপ। তাঁর অবতার রূপ গ্রহণের দুটি কারণ বর্ণিত হয়েছে, বহিরঙ্গ কারণে তিনি ভূ ভার হরণ করেন ও ধর্মের সংস্থাপন করেন; অন্তরঙ্গ কারণে প্রেম নামের বিস্তারেই অবতীর্ণ। তিনি মানুষের প্রতি অনুগ্রহ বশে মনুষ্যদেহ ধারণ করে লীলা করেন। আবার সেই লীলার কথা শুনে মানুষ ভগবৎপরায়ণ হয়ে ওঠে। শ্রীকৃষ্ণের মহিমা এইখানে যে, তিনি রাগমার্গেই অধিক আনন্দে বিচরণ করেন—‘আমারে ঈশ্বর মানে আপনাকে হীন/তার প্রেমে বশ আমি না হই অধীন’; বিপরীতক্রমে,- আপনারে বড় মানে – আমারে সম হীন/ সৰ্ব্বভাবে আমি হই তাহার অধীন। তাই তো ব্রজের নন্দনরূপে বিরাজ করেন। যশোদার বাৎসল্য, শ্রীদাম–সুদামে সখ্য, গোপীগণের প্রেম তাঁর পরম আকাঙ্ক্ষিত। রসরূপে তিনি আস্বাদ্য, আবার রসিকরূপেও তিনি রসিকরূপে তিনি আস্বাদকও বটেন। সেই রসবিলাসের কারণেই ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণাবতারে অবতীর্ণ।
রাধাতত্ত্ব
পরম ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণ অনন্ত বৈচিত্র্যের অধিকারী। তাঁর মধ্যে তিনটি শক্তি প্রধান। কবিরাজ গোস্বামীর মতে—
কৃষ্ণের অনন্ত শক্তি, তাতে তিন প্রধান।
চিচ্ছক্তি, মায়াশক্তি, জীবশক্তি নাম।।
অন্তরঙ্গা বহিরঙ্গা তটস্থা কহি যারে।
অন্তরঙ্গা স্বরূপ শক্তি সবার উপরে।।
কৃষ্ণের অনন্ত শক্তি রয়েছে। এদের মধ্যে তিনটি শক্তি প্রধান—চিৎ শক্তি, জীব শক্তি ও মায়া শক্তি। এই চিৎ শক্তি সর্বদা শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপে অবস্থিত থাকে বলে একে স্বরূপ শক্তিও বলে। মায়াশক্তির অপর নাম বহিরঙ্গা শক্তি। আর জীবশক্তির অন্য নাম তটস্থা শক্তি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কোনো স্থূল রক্তমাংসের দেহধারী নন। তিনি সৎ, চিৎ, আনন্দের অপ্রাকৃত চিন্ময় সত্তাবিশেষ। তাঁর আনন্দাংশের যে শক্তি, তার নাম হ্লাদিনী। এই শক্তির দ্বারা শ্রীভগবান নিজে যেমন আনন্দ অনুভব করেন, তেমনি অপরকে আনন্দ অনুভব করান। হ্লাদিনী শক্তির সার হল প্রেম। বৈষ্ণবমতে এই প্রেম হল—কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা। চিত্তের মালিন্য দূরীভূত করে, কৃচ্ছসাধনের দ্বারা, কৃষ্ণের স্বরূপ অনুভবের পর কৃষ্ণপ্রীতি সম্পাদনের যে বাসনা তাকেই বলে প্রেম। এই যখন উৎকর্ষপ্রাপ্ত হয়, তাকে বলে ভাব। আবার ভাব যখন চরমোৎকর্ষে উপনীত হয় তার নাম হয় মহাভাব। এই অবস্থায় শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অনুরাগের আধিক্য লক্ষিত হয়, প্রিয়জনকে নিত্যনতুন বলে মনে হয়, তাঁকে পাওয়ার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষায় আত্মলোপের ও ইচ্ছা জাগে। নিজের সুখ- দুঃখ অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হয়। শ্রীমতী রাধা এই মহাভাবেরই মূর্তবিগ্রহ। তিনি অনন্ত গুণ সম্পন্না। সর্বগুণের আকর। তিনি কৃষ্ণের সর্বশ্রেষ্ঠ কান্তা, গোপীগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠা। শ্রীরাধা হ্লাদিনী শক্তির সারভূতা, কৃষ্ণসুখের জন্যই সদা সক্রিয়। কবিরাজ গোস্বামীর মতে— ‘রাধা পূর্ণশক্তি, কৃষ্ণ পূর্ণশক্তিমান/ দুই বস্তুভেদ নাহি শাস্ত্রী পরমাণ’। স্বরূপে তাঁরা অভিন্ন, লীলারস আস্বাদনের জন্য দুইরূপ ধারণ করেছেন। শ্রীকৃষ্ণই পূর্ণশক্তি, তিনিই জগতমোহন; তবু শ্রীরাধার প্রেমমাধুর্যে তিনিও বিহ্বল হয়ে পড়েন—না জানি রাধার প্রেমে আছে কত বল/ যে বলে আমায় করে সর্বদা বিহ্বল। তাই বৈষ্ণব ধর্মে শ্রীরাধিকার অপার মহিমা স্বীকৃত।
গোপীতত্ত্ব
কবিরাজ গোস্বামীর মতে, কৃষ্ণকান্তাগণ তিনপ্রকার—লক্ষ্মীগণ, মহিষীগণ, ব্রজাঙ্গনারূপ কান্তাগণ। এঁদের সকলের বিস্তার শ্রীরাধিকা থেকে। এঁদের মধ্যে লীলা বিলাস রসবৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্য রাধারই কায়বহুরূপে গোপীগণের সৃজন। এই গোপীগণের মধ্যেও স্কুল কামনা-বাসনা থাকে না। তাঁরা একান্তই পবিত্র। কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছাই তাদের একমাত্র লক্ষ। কেননা, কৃষ্ণের সঙ্গে তাদের লীলা, কৃষ্ণকেই সুখী করবার জন্য। কৃষ্ণকে সুখী করবার জন্য এরা লোকধর্ম, বেদধর্ম, কুল–শীল, সবকিছু উপেক্ষা করে কৃষ্ণসুখে মত্ত হন। কৃষ্ণসেবার প্রকারভেদে গোপীদের দুটি প্ৰকরে বিভক্ত করা যায়—সখী ও মঞ্জরী। নিজের অঙ্গ দিয়ে যারা শ্রীকৃষ্ণের প্রীতিসাধন করেন তাঁরা হলেন সখী; আর যে সকল গোপী রাধাকৃষ্ণের মিলনলীলায় সহায়তা করেন, তারা হলেন মঞ্জরী। ললিতা, বিশাখা এরা হলেন সখী। আর, শ্রীরূপমঞ্জরী, অনঙ্গমঞ্জরী এঁরা হলেন মঞ্জরী। শ্রীরাধিকা যদি হন কৃষ্ণপ্রেম কল্পলতা তবে গোপীগণ হলেন সেই কল্পলতার পুষ্পপাতা। তাই রাধা আর গোপীগণ মৌল বিচারে অভিন্ন।
সাধ্যসাধনতত্ত্ব
শ্রী শ্রী চৈতনচরিতামৃত গ্রন্থের মধ্যলীলা অষ্টম পরিচ্ছেদে সাধ্যসাধন তত্ত্ব বিষয়ক আলোচনা আছে। রায় রামানন্দ ও চৈতন্যদেবের কথোপকথনের মাধ্যমে এই তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সাধ্য বলতে বোঝায় কাম্য বা অভীষ্ট বস্তু। আর সাধন বলতে বোঝানো হয় সাধ্যলাভের যে পদ্ধতি বা উপায়। মানুষ জীবনে বহু কাম্যবস্তুর প্রত্যাশা করে। কিন্তু সব কামনাই তো শ্ৰেয়োলাভের পথ প্রদর্শন করে না। এই তত্ত্বের দ্বারা গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে সাধ্য কী? আর তা সাধনের পন্থা অন্বেষণ করা হয়েছে। প্রেমভক্তিই গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতে পঞ্চম পুরুষার্থ বা সাধ্যবস্তু। এই সাধ্যবস্তু নির্ধারণ এবং তাকে কীভাবে পাওয়া যায় পন্থা এই তত্ত্বে আলোচিত হয়েছে।
সন্ন্যাস গ্রহণের পর মহাপ্রভু দাক্ষিণাত্য গমন করেন। দাক্ষিণাত্যে গোদাবরী তীরে রায় রামানন্দের সঙ্গে মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ হয়। রামানন্দের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর মহাপ্রভু প্রীত হলে, দ্বিতীয় সাক্ষাৎ হয় জনৈক বিপ্রের গৃহে। সেইখানে তাঁদের আলাপচারিতায় সাধ্যসাধন তত্ত্বের মূল ধারণাটি বর্ণিত হয়। মহাপ্রভু রামানন্দকে বললেন—‘পঢ় শ্লোক সাধ্যের নির্ণয়’। এই জিজ্ঞাসার উত্তরে রামানন্দ পর্যায়ক্রমে তাঁর তত্ত্বকথাকে ব্যক্ত করলেন। প্রথমে রামানন্দ বললেন, স্বধর্মাচরণে বিষ্ণুভক্তি হয়। এই কথার অর্থ হল এই যে, বিষ্ণুভক্তিলাভের উপায় হল নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী আচরণ অর্থাৎ কর্তব্য করাতেই বিষ্ণুভক্তি হয়। দেখা যায় যে, প্রত্যেক মানুষ তার স্বধর্ম অনুযায়ী আচরণের কালে তার চিত্তকে একাগ্র করতে সক্ষম হয়। তখন জীবের হৃদয়ে একটি একাগ্রতার কারণে একধরনের তন্ময় ভক্তিভাব জাগ্রত হয়। সেমতাবস্থায় ব্যক্তি যদি অনুকূল গুরু লাভ করেন তার মাধ্যমে তাঁর চিত্তে ভক্তিভাব জাগ্রত হয়। কিন্তু মহাপ্রভু একে গুরুত্ব দিলেন না, প্রভু কহে এহো বাহ্য আগে কহ আর। কারণ স্বধর্মাচরণে প্রকৃত ভক্তি হয় না। ভক্তির ভাব জাগরিত হয় মাত্র। আর প্রকৃতভক্তি না হলে, পরমতত্ত্ব বা সাধ্যবস্তু সম্পর্কে ধারণা জাগ্রত হতে পারে না।
দ্বিতীয়স্তরে রামানন্দ বলেন—‘কৃষ্ণে কর্মার্পণ সাধ্যসার’। ফলের আকাক্ষা না করে সমস্ত কর্মফল কৃষ্ণের পায়ে অর্পণ করলেও সাধ্যবস্তু লভ্য হতে পারে। কারণ স্বধর্মাচরণে কর্মে আসক্তি লক্ষ করা যায়। আর ফলের আশা না করে যে কর্ম, সেখানে কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়। গীতায় শ্রীভগবানও অর্জুনকে এই উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু মহাপ্রভু একেও অসার বলেছেন। কেননা, কৃষ্ণার্পণেও থাকে আত্মবোধের পরিচয়, নিষ্কাম ভক্তির লেশ এতে নেই। এখানেও সকাম ভক্তির লক্ষণ থাকায় মহাপ্রভু একেও বাহ্যবস্তু বলে নির্দেশ করে অন্য পন্থার সন্ধান করেছেন।
তৃতীয় স্তরে রামানন্দ বলেন—‘স্বধর্মত্যাগ এই সাধ্যসার’। যিনি অনন্য ভক্তিতে দৃঢ়চিত্ত হয়ে বর্ণাশ্রমধর্ম বিহিত কর্মাদি পরিত্যাগ করেন, তিনি যথার্থ কৃষ্ণভক্তি লাভ করতে পারেন। কিন্তু মহাপ্রভু এমতও স্বীকার করেননি। কারণ স্বধর্মত্যাগ বিষয়ের মধ্যেও সকল সময় অনাবিল ভক্তি ও স্বতস্ফূর্ততা লক্ষিত হয় না। সেখানে অকর্তব্য ও কর্তব্যবোধ জাগরূক থাকে। কখনো আত্মতৃপ্তিও জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু যথার্থভক্তি হবে আত্যন্তিক প্রীতিময়। দুর্নিবার আকর্ষণে তা বাঞ্ছিতের উদ্দেশে সব বাধা বিপত্তি অগ্রাহ্য করে ছুটে যেতে পারে। প্রাণের সেই আকর্ষণ না থাকায় মহাপ্রভু একেও অসার রূপে জ্ঞান করলেন।
চতুর্থ স্তরে রামানন্দ বলেন—‘জ্ঞানমশ্রাভক্তি সাধ্যসার।’ অর্থাৎ শুদ্ধজ্ঞানের সঙ্গে ভক্তি মিশ্রিত হলে তাকে সাধ্যবস্তু বলা যেতে পারে। জীব কী? ব্ৰহ্ম কী? জীবের সঙ্গে ব্রহ্মের সম্পর্ক সম্বন্ধ নির্ণয়—এইসব বিষয়গুলি শুদ্ধজ্ঞানের অঙ্গীকৃত। এর সঙ্গে প্রয়োজন ভক্তিযোগের সাধন। এইজ্ঞানমিশ্র ভক্তিকেই তিনি সর্বসাধ্যসার বলেছেন। কিন্তু মহাপ্রভু এহো বাহ্য বলে একেও অসার রূপে নির্দেশ করলেন। কেননা, জ্ঞানমার্গের সাধন সেব্য–সেবক বোধের বিরোধী। শুদ্ধ ভক্ত মুক্তি চান না। তিনি ব্রহ্মের উপাসনায় ভক্তিমার্গেই ভজনা করেন। সুতরাং জ্ঞানমিশ্রিত ভক্তি অবলম্বনে পরাভক্তি লাভ করা সম্ভব হয় না। তাই মহাপ্রভু রামানন্দকে অন্যতর পন্থা জিজ্ঞাসা করলেন।
পঞ্চম স্তরে রামানন্দ বলেন—‘জ্ঞানশূন্য ভক্তি সাধ্য সার।’ জীব ও ব্রহ্মের সম্যক জ্ঞান না জেনেও যে ভক্তির সাধনা তাকে এর দ্বারা নির্দেশ করা হয়েছে। সাধুমুখে ঈশ্বরের লীলামাধুর্য শ্রবণ করে ভক্তের হৃদয়ে ভক্তিরস জাগ্রত ও গাঢ়তাপ্রাপ্ত হয়। একেই রামানন্দ নির্দেশ করেছেন। এই পন্থায় ব্রহ্ম ও জীবের মধ্যে সেব্য ও সেবকের ভাব সঞ্চারিত হয়। ঈশ্বরের প্রতি জীবের ভক্তি ও সেবার আকাঙ্ক্ষা সঞ্চারিত হয়। এজন্য প্রভু এই পন্থাকে স্বীকার করলেন—‘এ হো হয়’ বলে। কিন্তু এর আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রত্যাশা করলেন।
ষষ্ঠ স্তরে রামানন্দ বলেন—‘প্রেমভক্তি সর্বসাধ্যসার।’ ঈশ্বরকে ভালোবাসা ও তাঁর প্রতি সেবাবাসনার আকাঙ্ক্ষা হল প্রেম। এই প্রেমমিশ্রিত ভক্তিই রামানন্দ সাধ্যবস্তু বলে নির্দেশ করলেন। এর দ্বারাই ভক্তের চিত্তের মালিন্য দূর হয়ে যায়। শুদ্ধ কৃষ্ণরতি লভ্য হয়। তাই মহাপ্রভু এর সার স্বীকার করেছেন। কিন্তু এই প্রেমেরও স্তরভেদ আছে। তাই মহাপ্রভু এর সঙ্গেই জানালেন—‘এহো হয় আগে কহ আর।’
প্রেমভক্তি পাঁচপ্রকারের হয়ে থাকে—শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর। শান্তরসের কথা প্রথমে রামানন্দ উল্লেখ করলেন। এখানে ভক্তের তদগতচিত্ত নিষ্ঠার কথা আছে, সেবা নেই। তাই মহাপ্রভু আরও গভীর প্রেমভক্তির কথা শুনতে চাইলেন। এরপর, রামানন্দ বললেন, দাস্যপ্রেমের কথা। এখানে ঈশ্বর প্রভু, ভক্ত দাস। ভক্ত নিষ্ঠাভরে সেবা করেন সত্য; তবু সে সসঙ্কোচ সেবা। প্রভুর ঐশ্বর্যজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন ধারণা থাকায় এখানে অকুণ্ঠ প্রেমভাব দেখা যায় না। তাই দাস্যভাবের সেবা স্বীকার করলেও মহাপ্রভু আরও গভীর স্তরের কথাও জানতে চাইলেন। তখন রামানন্দ আরও অগ্রসর হয়ে জানালেন—‘সখ্যপ্রেম সর্বসাধ্যসার’ । সখ্যপ্রেমে আছে কৃষ্ণের প্রতি নিষ্ঠা, দাস্যের সেবা, তদুপরি ঈশ্বরের প্রতি সখ্যতার ভাব। সখ্যভাবের ভক্ত, কৃষ্ণের প্রতি অনুগতপ্রাণ। উপরন্তু থাকে সখ্যের অকুণ্ঠচিত্ততা। এইজন্য মহাপ্রভু সখ্যকে উত্তমরূপে স্বীকার করলেন। কিন্তু এর আরও গভীরতর প্রেমভক্তিরও সন্ধান করলেন। এরপর রামানন্দ বললেন—‘বাৎসল্যপ্রেম সর্বসাধ্যসার’। বাৎসল্য প্রেমভক্তিতে ভক্ত ঈশ্বরকে সন্তানজ্ঞানে লালন করেন। এখানে ঈশ্বর্যজ্ঞানের কোনো প্রকাশ নেই। ভক্ত ভগবানকে ভর্ৎসনা ও শাসনও করে থাকেন। তাই সখ্যপ্রমের থেকেও এটি শ্রেয়। মহাপ্রভু একে স্বীকার করেও বললেন, আগে কহ আর। রামানন্দ শেষে উপনীত হলেন কান্তাপ্রেমে। মধুর রসাশ্রিত ভক্তিতে। এতে শান্তের নিষ্ঠা, দাস্যের সেবা, সখ্যের অন্তরঙ্গতা, বাৎসল্যের অনুগ্রাহ্যতা ছাড়াও আছে নিজ অঙ্গ দিয়ে কৃষ্ণসুখের জন্য সেবাবাসনা। এর উদাহরণ ব্রজগোপীগণ। তাঁরা কৃষ্ণসুখ বিধানার্থে সমাজ সংসার উপেক্ষা করে কৃষ্ণসেবাকেই একমাত্র অভীষ্ট মনে করেছেন। শ্রীরাধা এই গোপীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠা। তাই রাধার প্রেম সাধ্য শিরোমণি। ভক্তের সর্বশ্রেষ্ঠ উপচার ভগবানের প্রতি এই আত্মবিস্মৃত, অহৈতুকী প্রেম। একেই শেষপর্যন্ত মহাপ্রভু সাধ্যবস্তু বলে স্বীকার করেছেন।
সাধ্যতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনায় রায় রামানন্দ স্বধর্মাচরণ থেকে আরম্ভ করে ক্রমে অগ্রসর হয়ে প্রেমভক্তিরসের শেষকথা সাধ্যশিরোমণি রাধাতে উপনীত হলেন। এখন এই সাধ্যকে পাওয়ার জন্য কোন সাধনের কথা তিনি বললেন, তা কেবলমাত্র সখীজন বিদিত। তা শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্যের গোচরীভূত নয়—‘রাগানুগা মার্গে তারে ভজে যেইজন/সেইজন পায় ব্রজে ব্রজেন্দ্রনন্দন… সিদ্ধদেহ চিন্তি করে তাহাই সেবন/সখীভাবে পায় রাধা কৃষ্ণের চরণ।
রায় রামানন্দের সঙ্গে মহাপ্রভু চৈতন্যের সাধ্যসাধন তত্ত্বের আলোচনা প্রশ্নোত্তর মূলক ও যুক্তিসিদ্ধ। শ্রীচৈতন্যদেব বললেন—‘পঢ় শ্লোক সাধ্যের নির্ণয়’। অতঃপর রামানন্দ বিষ্ণুপুরাণ থেকে উদ্ধার করলেন তত্ত্ব ও তা উল্লেখ করলেন। প্রভু রামানন্দের বক্তব্যের অসম্পূর্ণতা অনুভব করলেন ও বললেন—‘এহো বাহ্য আগে কহ আর।’ এই ভাবে উক্তি-প্রত্যুক্তি এবং যুক্তি ও জ্ঞানের ক্রমারোহণের দ্বারা এই তত্ত্বালোচনা সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়াও লক্ষ্যণীয় এটি তত্ত্বালোচনা হলেও, এখানে কৃষ্ণদাস নাটকীয়তার দ্বারা বিষয়ের উৎকণ্ঠতা বজায় রেখেছেন। নাটকে যেমন ধীরে ধীরে ঘটনাক্রমের বিন্যাসে বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ বিন্যাস ফুটে ওঠে; তেমনি এখানেও রায় রামানন্দ মহাপ্রভুর জিজ্ঞাসা ও অতৃপ্তির সূত্র ধরে ক্রমান্বয়ে মূল তত্ত্বের অভিমুখে অগ্রসর হয়েছেন। তাই আলোচ্য অংশে নাটকীয় সংলাপধর্মিতা ও ঘটনার ক্রমিক নাটিক বিন্যাস এর দ্বারা বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও আলোচনাতে নৈয়ায়িক সুলভ যুক্তির পরম্পরাও রক্ষিত হয়েছে।
Leave a Reply