বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে অরোরা থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।
অরোরা থিয়েটার
বেঙ্গল থিয়েটারের বাড়িতে
প্রতিষ্ঠাতা: গুরুপ্রসাদ মৈত্র
প্রতিষ্ঠা: ১৭ আগস্ট, ১৯০১
স্থায়িত্বকাল: ১৭ আগস্ট, ১৯০১ – ডিসেম্বর, ১৯০২
নাটক: দক্ষিণা (ক্ষীরোদপ্রসাদ)
শরৎচন্দ্র ঘোষ প্রতিষ্ঠিত ৯ নম্বর বিডন স্ট্রিটের বেঙ্গল থিয়েটার ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বন্ধ হয়ে গেলে এই মঞ্চ ভাড়া নিয়ে গুরুপ্রসাদ মৈত্র সেখানে অরোরা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। নীলমাধব চক্রবর্তীকে ম্যানেজার করা হয়। অভিনেতা অভিনেত্রী ছিলেন—শরৎচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কুসুম (বিষাদ), হরিমতী, প্রবোধচন্দ্র ঘোষ, অক্ষয় চক্রবর্তী, গোপাল ও নীলমাধব স্বয়ং।
১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘দক্ষিণা’ নাটক দিয়ে অরোরা থিয়েটারের উদ্বোধন হয়। অভিনয়ে ছিলেন: ভৈবর—শরৎচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সুষমা—কুসুম। সুরমা—হরিমতী। সাদামাটা অভিনয় দিয়ে অরোরার অভিনয়ের যাত্রা শুরু হলো। পরের দিনই অভিনীত হলো ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘জুলিয়া’ এবং অমৃতলাল বসুর ‘কৃপণের ধন’। তারপর আলিবাবা ও বেল্লিকবাজার। গিরিশের বেশ কয়েকটি নাটক এখানে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দেই অভিনীত হল। যেমন চৈতন্যলীলা, বিশ্বমঙ্গল, হীরার ফুল প্রভৃতি। তাছাড়া অমৃতলাল বসুকৃত স্বর্ণলতা উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘সরলা’, তাজ্জব ব্যাপার অভিনীত হয়েছিল। বঙ্কিমের দেবী চৌধুরাণীর নাট্যরূপ (অতুলকৃষ্ণ মিত্র) এখানে অভিনীত হয়ে খুবই প্রশংসিত হয়েছিল। দেবী চৌধুরানীর চরিত্রলিপি:নীলমাধব চক্রবর্তী—ভবানী পাঠক। প্রবোধচন্দ্র ঘোষ—ব্রজেশ্বর। অক্ষয় চক্রবর্তী—হরবল্লভ। গোলাপ—প্রফুল্ল। নিশি—কুসুম (বিষাদ)।
১৯০১ খ্রিস্টাব্দে সাড়ে চার মাস অভিনয় চালিয়ে অরোরা মোটামুটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। ১৯০২-তে নীলমাধব চক্রবর্তীকে ম্যানেজারের পদ থেকে সরিয়ে মালিক গুরুপ্রসাদ নিজেই ম্যানেজার হলেন। নাট্যশিক্ষক রইলেন সঙ্গীতসমাজের নগেন্দ্রনাথ চৌধুরী। এই সময়ে প্রখ্যাত অভিনেত্রী তারাসুন্দরীকে এখানে আনা হয়। তারাসুন্দরী আসার ফলে অরোরার খ্যাতি বেড়ে গেল। তারা গিরিশচন্দ্রের নলদময়ন্তী ও বিশ্বমঙ্গল নামাল। তাতে দময়ন্তী ও চিন্তামণির ভূমিকায় তারাসুন্দরীর অনবদ্য অভিনয় দর্শকদের পরিতৃপ্তি দিয়েছিল।
নীলমাধব চক্রবর্তী আবার ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিয়ে ‘সরলা’ নামালেন। কিন্তু সকলের সমবেত প্রচেষ্টা এবং নীলমাধব ও তারাসুন্দরীর অনবদ্য অভিনয় সত্ত্বেও ‘সরলা’ দর্শক আকর্ষণে ব্যর্থ হলো। ফলে নীলমাধবকে আবার ম্যানেজারের পদ ছেড়ে দিতে হল। তারপরেই, ১৯০২-এর মে মাসে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি অরোরায় যোগ দিলেন ম্যানেজার, নাট্যশিক্ষক ও অভিনেতা হিসেবে। অর্ধেন্দুশেখর যোগ দিয়েই অতি সত্বর নামালেন মনোমোহন রায়ের ‘রিজিয়া’ নাটক (১৭ মে, ১৯০২)। তার সঙ্গে ‘কালপরিণয়’ ও ‘আবুহোসেন’। গিরিশের আবুহোসেন নাটকে আবুহোসেন-এর ভূমিকায় অর্ধেন্দুর অসাধারণ অভিনয় জনসমাদরে ধন্য হলো। ‘রিজিয়া’র অভিনয় অরোরার ভাগ্য ফিরিয়ে দিল। প্রচুর দর্শক সমাগম হতে থাকল রিজিয়ার অভিনয়ে। ‘রিজিয়া’ নাটকটি এই থিয়েটারেই প্রথম অভিনীত হল। তারাসুন্দরী রিজিয়ার ভূমিকায় অর্ধেন্দুশেখরের শিক্ষকতায় ও নিজ প্রতিভায় খুবই উচ্চ ধরনের অভিনয় করেন। রিজিয়ার অভিনয় সম্পর্কে প্রখ্যাত নট ও পরিচালক অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লেখেন—‘‘এই থিয়েটারে যতগুলি নাটক অভিনীত হইয়াছিল, তন্মধ্যে একমাত্র ‘রিজিয়াই উল্লেখযোগ্য আর বাঙ্গালা রঙ্গমঞ্চের গৌরবাস্পদা অভিনেত্রী শ্রীমতী তারাসুন্দরীর যশোমুকুটে অতিশয় সাফল্যের যতগুলি রত্ন আছে, এই রিজিয়ার ভূমিকায় অভিনয় নৈপুণ্য তন্মধ্যে মধ্যমণি স্বরূপ।’’ (রঙ্গালয়ে ত্রিশ বৎসর)। তারাসুন্দরীর রিজিয়ার অভিনয় দেখেই প্রখ্যাত বিপিনচন্দ্র পাল তার ‘The Bengali Stage’ প্রবন্ধে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তাকে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠা অভিনেত্রীদের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
খ্যাতি ও অর্থপ্রাপ্তির আনন্দে অরোরা থিয়েটার পরপর অভিনয় করে যেতে লাগলো। তরুবালা (অমৃতলাল) ও পশুশাসন (অতুল মিত্র), ২৮ মে ১৯০২ অভিনয় করল। তারপর সধবার একাদশী (১ জুন) অভিনয়ে অর্ধেন্দু প্রথম নিমচাঁদের ভূমিকায় নামেন। জীবনচন্দ্রের চরিত্রেই এতদিন তার খ্যাতি ছিল। এবারে নিমচাঁদ চরিত্রও তিনি গভীরভাবে উপস্থাপন করলেন। তারপরে নলদময়ন্তী, আবুহোসেন, জেনানাযুদ্ধ (১৬ জুলাই), কালপরিণয় (রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়) ও গিরিশের আলাদীন (২৬ জুলাই), বিষবৃক্ষ ও প্রমোদরঞ্জন (ক্ষীরোদপ্রসাদ, ২৭ জুলাই), বিধ্বমঙ্গল ও তাজ্জব ব্যাপার (অমৃতলাল, ৩০ জুলাই), একাদশ বৃহস্পতি (নিত্যবোধ বিদ্যারত্ন, ২ আগস্ট), রাধারানী (নাট্যরূপ: হরিচরণ আচার্য, ২৩ আগস্ট), প্রফুল্ল (গিরিশ, ২৩ নভেম্বর) অভিনয় করা হল। এই নাটকগুলির মধ্যে অর্ধেন্দুশেখর অভিনয় করেছিলেন—রিজিয়াতে ঘাতক, সধবার একাদশীতে নিমচাঁদ, আবুহোসেনে আবুহোসেন, জেনানাযুদ্ধে পদ্মলোচন, কালপরিণয়ে জগদীশ এবং প্রফুল্লতে যোগেশ। রিজিয়াতে ঘাতকের ছোট্ট ভূমিকায় অর্ধেন্দুশেখর সকলকে মুগ্ধ করেন। পরবর্তীকালে শিশির ভাদুড়িও এই নাটকে ওই একই ভূমিকায় অভিনয় করতেন। তিনি বলেছেন, রিজিয়াতে অর্ধেন্দুবাবু ‘ঘাতক’ করতেন, তার জন্যই চলতো (শিশির সান্নিধ্যে)। প্রফুল্ল নাটকে তিনি যোগেশের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের দেখিয়ে দেন যে তিনি কমেডির মতো ট্রাজেডি চরিত্রের অভিনয়েও সমান পারদর্শী। গিরিশের অভিনয়ে প্রতিষ্ঠিত নিমচাঁদ ও যোগেশের চরিত্র দুটিকে অর্ধেন্দুশেখর তাঁর অভিনয়ে নতুন মাত্রা (ডাইমেনশান) ও ভঙ্গি এনে দিয়ে সে যুগের বোদ্ধা দর্শকদের চমৎকৃত করেছিলেন।
নীলমাধব ক্লাসিকে যোগ দিলেন। এরপর অর্ধেন্দুশেখর অরোরা ছেড়ে স্টারে চলে গেলেন। অন্য অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীও অন্যত্র চলে গেলেন। অরোরা কর্তৃপক্ষ খুবই বিপাকে পড়ে গেলেন। এইভাবে চলতে চলতে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর, এখানে শেষ অভিনয় হল। নাটক পরিতোষ, নাট্যকার রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। অরোরা থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেল।
এক বছর চার মাস অরোরা থিয়েটারের স্থায়িত্বকাল। বাংলা নাট্যশালার ইতিহাসে এই রকম অনেক থিয়েটার তৈরি হয়েছে আবার বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে রিজিয়ার মতো দু একটি নতুন নাটক ছাড়া আর সবই পুরনো অভিনীত নাটকেরই অভিনয় হয়েছে। গিরিশচন্দ্র, অমৃতলাল, অতুলকৃষ্ণ মিত্র, ক্ষীরোদপ্রসাদ প্রভৃতি খ্যাতিমান নাট্যকারদের সঙ্গে সঙ্গে কিছু অখ্যাত নাট্যকারের নাটকও এখানে অভিনীত হয়েছে।
এ ই থিয়েটারের উল্লেখের মতো ঘটনা হল—এখানে রিজিয়া, আবুহোসেন ও প্রফুল্লের অভিনয়। বিশেষ করে তারাসুন্দরী ও অর্ধেন্দুশেখরের অভিনয় মাহাত্ম্য অরোরা কিছুটা খ্যাতিলাভ করেছিল। সেই একই সময়ে স্টার (হাতিবাগান), ক্লাসিক, মিনার্ভা প্রভৃতি প্রথম শ্রেণীর রঙ্গমঞ্চগুলি প্রবল প্রতাপে অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে খ্যাতিমান নাট্যকারের ভালো ভালো নতুন নাটক এবং জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অনবদ্য অভিনয় দর্শকদের আকর্ষণ করে রেখেছে। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অরোরা তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারেনি। স্বল্পায়ু এই থিয়েটার অচিরাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল।
Leave a Reply