কর্পোরেশন অ্যাক্ট (১৯০৮) ও নাট্যাভিনয় সম্পর্কে আলোচনা কর।

কর্পোরেশন অ্যাক্ট (১৯০৮) ও নাট্যাভিনয়

ব্রিটিশশাসিত ভারতে কলকাতা কর্পোরেশন থিয়েটারের ওপর একটি নিষেধাজ্ঞামূলক আইন জারি করে। ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এই নতুন আইন চালু হয়। ‘ক্যালকাটা কর্পোরেশন অ্যাক্ট’ নামে এটি প্রচলিত হয়।

এই আইনের নির্দেশ অনুযায়ী কলকাতায় কোনো থিয়েটার রাত্রি একটার পর নাট্যাভিনয় চালু রাখতে পারবে না। অর্থাৎ রাত্রি একটার মধ্যে যে কোনো নাট্যাভিনয় বন্ধ করে দিতে হবে। নাটক অভিনয়ের ওপর এই নতুন আইনের নিষেধাজ্ঞায় থিয়েটার কর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়ে। তাই নিয়ে প্রতিবাদ ও লেখালেখি শুরু হয়। ফলে ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসেই আইনটি সংশোধিত হয়। তাতে বলা হয়, পঁচিশ টাকা জরিমানা দিলে রাত্রি একটার পরেও অভিনয় করা যেতে পারে। অমরেন্দ্রনাথ দত্ত গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের তখন মালিক। তিনি পচিশ টাকা জরিমানা দিয়েও তার থিয়েটারে সারারাত্রি অভিনয় চালাতেন। তাতে মফঃস্বলের দর্শকদের নাটক দেখে ভোরবেলা বাড়ি ফেরার সুবিধে হতো। দর্শক আনুকূল্য লাভ করেছিলেন তাদের সুবিধের কথা ভেবেই।

এই সময়ে রাত্রি সাড়ে আটটায় নাটক আরম্ভ হয়ে অনেক রাত পর্যন্ত অভিনয় চলতো। অনেক রাত পর্যন্ত রঙ্গমঞ্চে অভিনয় চলা নিয়ে অনেক কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনা সেই সময়ে হয়েছিল। অনেক প্রতিবাদও হয়েছিল। বিশেষ করে রুচিবাগীশের দল এবং ব্রাহ্ম মতাবলম্বীরা অভিযোগ তুলেছিল রঙ্গমঞ্চে বারাঙ্গনা অভিনেত্রীদের বিষয়ে। বারাঙ্গনা অভিনেত্রী নিয়ে বেলেল্লাপনার আসর হয়ে উঠেছে রঙ্গমঞ্চগুলি—এমন অভিযোগ করে চলেছিল এরা। দীর্ঘরাত্রিব্যাপী অভিনয়ের বিরোধিতা এই দিক দিয়েই এসেছিল। কাগজপত্রে লেখালেখি এবং অন্য নানাভাবে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল এই নীতিবাগীশের দল। রাত্রিব্যাপী অভিনয়ের বিরুদ্ধে এই জনমতকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ সরকার এই আইনটি জারি করে। ১৮৭৬-এর কুখ্যাত অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইনের পাশাপাশি এই আইন প্রবর্তন করে, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলনের সময়কার থিয়েটারের প্রতিবাদী ভূমিকাকে খর্ব করার চেষ্টা করেছিল। নীতিবাগীশের ভূমিকাকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ সরকার আবার বাংলা থিয়েটারের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিল।

রাত্রি একটার মধ্যে নাটকাভিনয় বন্ধ করে দেওয়ার এই আইনটি কলকাতা কর্পোরেশন তার এলাকায় জারি করে। কলকাতার সব রঙ্গমঞ্চই এই আইনটি মানতে বাধ্য হয় এবং রাত্রি একটার মধ্যে অভিনয় বন্ধ করে দিতে থাকে।

বেশি রাত অবধি অভিনয় চললে, দূরের দর্শকদের সুবিধে হতো। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ভোর হলেই গাড়িঘোড়া চলতে শুরু করে। তখন বাড়ি ফেরার সুবিধে। বিশেষ করে মফঃস্বলের দর্শকদের। আর রাত্রি একটায় অভিনয় শেষ হলে বাড়ি ফেরার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো।

তাই তখনকার নাটকগুলিকে বৃহদায়তন করে অভিনয় করতে হতো। এক নাটকে রাত কাবার না হলে দু তিনটি নাটক, প্রহসন-গীতিনাট্যের পসরা সাজিয়ে রাত শেষ করতে হতো। ক্রমে কলকাতার আশেপাশের এবং বাইরের লোকেরাও কলকাতার থিয়েটারে দর্শক হিসেবে আসতে থাকলে, তাদের সুবিধের জন্যই সারারাত ধরে অভিনয় চালাতে হতো। তাই যে থিয়েটারে ভোররাতে নাটক শেষ হবে, সেখানেই মফঃস্বলের দর্শকদের এবং বেশ কিছু অংশে কলকাতার দর্শকদেরও ভিড় বাড়তে থাকে।

উনিশ শতকের নাটকের যে দীর্ঘ আয়তন তার মূলে এই দীর্ঘরাত্রিব্যাপী অভিনয়ের প্রভাব মানতেই হবে। পাঁচ অঙ্কের নাটক, তাতে প্রতিটি অঙ্কে অনেকগুলি দৃশ্য, প্রচুর গান, অনেক নৃত্য—এইসব নিয়ে নাটকগুলি দীর্ঘায়িত হয়ে ওঠার একটা বড়ো কারণ যে, এই রাত্রিব্যাপী অভিনয়ের তাগিদ তা অস্বীকার করা যাবে না।

অথচ যুগীয় প্রভাব, সমাজ-পরিবর্তন ও সভ্যতার বিবর্তনে আজকের সময়ে নাটক আর বৃহদায়তন হলে চলে না। আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই নাটককে বেঁধে রাখতে হয়। সন্ধ্যে ছ’টা কিংবা সাড়ে ছয়টায় আরম্ভ করে রাত্রি সাড়ে আটটা কিংবা নয়টার মধ্যে এখন নাটকাভিনয়কে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। নাটক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি এই যুগীয় প্রভাব ও পরিবেশের চাপ বাংলা নাটককে দীর্ঘাকৃতি থেকে মধ্যাকৃতিতে রূপান্তরিত করেছে।

কলকাতা কর্পোরেশনের আইনে অবশ্য বিশেষ উৎসব-অনুষ্ঠানের দিনগুলিতে আইন শিথিল করার কথা ছিল। যেমন জন্মাষ্টমী, দুর্গাপূজা, দোল-উৎসব ইত্যাদিতে সারারাত্রি অভিনয়ের অনুমতি দেওয়া হতো। তখন আর রাত্রিব্যাপী অভিনয় করলে জরিমানা দিতে হতো না।

কলকাতায় আগে থেকেই এইসব উৎসব অনুষ্ঠানের দিনগুলিতে সারারাত্রি অভিনয় চলতো। একটি নাটকে না হলে একাধিক নাটক অভিনয় করা হতো। দোল, জন্মাষ্টমী, দুর্গাপূজা নিয়ে নাটক কিংবা গীতিনাট্য রচিত হয়ে এই সময়ে অভিনীত হতো। তাই দেখি, উনিশ শতকের অনেক নাট্যকারেরই এই বিষয়ক নাটক বা গীতিনাট্য রয়েছে। ব্রিটিশ সরকার বাঙালির উৎসব-অনুষ্ঠানে হাত দিতে চায়নি। বাংলা থিয়েটারও তাই এই সময়ে চুটিয়ে সারারাত্রি অভিনয় চালিয়ে যেত।

স্বাধীন ভারতে কলকাতায় এখনো নাট্যদলগুলিকে অভিনয়ের সময়ে কলকাতায় কপপারেশনের অনুমতি নিতে হয় এবং পারফরমেন্স ট্যাক্স জমা দিতে হয়। রাত একটার পর এখন আর কলকাতায় কোনো থিয়েটারেই অভিনয় হয় না। তাই জরিমানা দিয়ে সারারাত্রি অভিনয়ের প্রসঙ্গ এখন বাতিল হয়ে গেছে।

১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা কর্পোরেশন নাটকের প্রতিঅভিনয়ের ওপর চল্লিশ টাকা করে কর বসায়। তার প্রতিবাদে নাট্যজগৎ মুখর হয়ে ওঠে। গঠিত হয় ‘নাট্যসঙ্কট প্রতিরোধ কমিটি’ ১৯৬৬-এর ১ এপ্রিল। ২৯ এপ্রিল, ১৯৬৬ পথে নামেন নাট্যকর্মীরা। আন্দোলনের চাপে কর্পোরেশন এই আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়।

১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে আবার থিয়েটারের ওপর প্রমোদ কর চাপানো হয়। পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ওঠে ‘নাটক বাঁচাও’ আন্দোলন।

কর আদায়ের ব্যাপারে কর্পোরেশন নাটক অভিনয়ের অনুমতি দেওয়া বন্ধ করে দিল। এরই প্রতিবাদে শুরু হলো বিক্ষোভ। এবারও বাড়তি করের আদেশ প্রত্যাহার করা হলো।

নাট্যসঙ্কট প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ছিলেন নাট্যকার মন্মথ রায়। আহ্বায়ক ছিলেন তাপস সেন ও সবিতাব্রত দত্ত।

এরই বিরুদ্ধে আরেকটি সংগঠন গড়ে ওঠে। আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর আহ্বানে সৃষ্ট এই সংগঠনের নাম হয় ‘সারা বাংলা নাট্যসংগ্রাম সমিতি’। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬-এর ১৯ এপ্রিল। দুই ভিন্নমুখি সংগ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আন্দোলন। কর আদায় বহাল রয়ে গেল।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!