বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে অমরেন্দ্রনাথ দত্তর অবদান আলোচনা কর।
ক্লাসিক থিয়েটার ও অমরেন্দ্রনাথ দত্ত
৬৮ নং বিডন স্ট্রিট, কলকাতা
প্রতিষ্ঠা: ১৬ এপ্রিল, ১৮৯৭
স্থায়িত্বকাল: ১৬ এপ্রিল, ১৮৯৭ – মে, ১৯০৬
প্রতিষ্ঠাতা: অমরেন্দ্রনাথ দত্ত
নাটক: নলদময়ন্তী ও বেল্লিকবাজার (গিরিশচন্দ্র)
ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার (১৮৭২) পরে পঁচিশ বছর কেটে গেছে। উনিশ শতকের সেই শেষ প্রান্তে রঙ্গালয়গুলির অবস্থা ভালো নয়। বেঙ্গল থিয়েটার জরাজীর্ণ অবস্থায় উঠে যাওয়ার মুখে, মিনার্ভা নীলামে উঠবে, আর্থিক অনটনে স্টার চলছে কোনোরকমে। পুরনো খ্যাতিমান অভিনেতাদের সব বয়স হয়েছে। তিনটি থিয়েটারে একঘেয়ে নাটক ও একই মুখ দেখতে দেখতে দর্শকরাও ক্লান্ত।
ঠিক এই সময়ে, ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ এপ্রিল, গুডফ্রাইডের দিন, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত (১ এপ্রিল, ১৮৭৬-৬ জানুয়ারি, ১৯১৬) প্রতিষ্ঠিত ক্লাসিক থিয়েটারের উদ্বোধন হলো। ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় অভিনয় শুরু হল গিরিশের ‘নলদময়ন্তী’ নাটক দিয়ে, পরে প্রহসন ‘বেল্লিকবাজার’। ১২০০ টাকা অগ্রিম এবং মাসিক ২৫০ টাকা ভাড়ায় এমারে থিয়েটারের বাড়িতে ক্লাসিক থিয়েটারের পত্তন করেন।
সুদর্শন, উজ্জ্বল স্বাস্থ্যবান তরুণ যুবা অমরেন্দ্রনাথ বনেদী ও বিদগ্ধ পরিবার থেকে থিয়েটারে এলেন। কলকাতার চোরবাগানের বিখ্যাত দত্ত পরিবারের সন্তান অমরেন্দ্রনাথ অল্পবয়স থেকেই থিয়েটারের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। ইন্ডিয়ান ড্রামাটিক ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে সখের অভিনয় করতে থাকেন। পলাশীর যুদ্ধ, বেল্লিকবাজার, বিষাদ নাটকের অভিনয় করেন। ‘পলাশীর যুদ্ধে’র দ্বিতীয় অভিনয়ে, মিনার্ভায়, অমরেন্দ্রনাথ সিরাজদৌল্লার ভূমিকায় প্রথম মঞ্চাবতরণ করেন (১৮৯৫)। তাঁর সখের নাট্যাভিনয়ে অন্য সঙ্গীরা ছিলেন: সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (দানীবাবু), চুনিলাল দেব, নৃপেন বসু, সতীশ চট্টোপাধ্যায়, প্রবোধচন্দ্র ঘোষ, নীলমাধব চক্রবর্তী এবং অভিনেত্রী তারাসুন্দরী।
৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিটে গোপাল শীলের এমারেল্ড থিয়েটার (সাবেক স্টার থিয়েটার) লীজ নিয়ে পুরো পেশাদারি অভিনয়ের ব্যবস্থা করলেন। লেসী ও ম্যানেজার অমরেন্দ্রনাথ। অভিনেতৃ দলে পুরনোদের মধ্যে সতীশ চট্টোপাধ্যায় ও তারাসুন্দরী। নতুন এলেন মহেন্দ্রলাল বসু, অঘোরনাথ পাঠক, গোবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথনাথ দাস, ধর্মদাস সুর, পূর্ণচন্দ্র ঘোষ, হরিভূষণ ভট্টাচার্য, কুসুমকুমারী, নয়নতারা, শরৎসুন্দর, সরোজিনী। এদের সকলকে নিয়ে খোলা হল ক্লাসিক থিয়েট্রিকাল কোম্পানী। দীর্ঘদিনের থিয়েটার বাসনা এতদিনে কার্যকরী হল। বহু পরিশ্রম, ভাগ্য-বিপর্যয় এবং অধ্যবসায়ের শেষে অমরেন্দ্রনাথের নিজের মালিকানায় ও পরিচালনায় নিজস্ব থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হল—ক্লাসিক থিয়েটার। উদ্বোধনের রাতে মহাসমারোহে নলদময়ন্তীর অভিনয় হল। অভিনয় করলেন: অমর দত্ত—নল, তারাসুন্দরী—দময়ন্তী, অঘোর পাঠক—কলি।
ক্লাসিক থিয়েটারের প্রথম বিজ্ঞাপন (স্টেটসম্যান: ১৬-৪-১৮৯৭) থেকে জানা যায়, থিয়েটারের নেপথ্যকর্মে ছিলেন: ধর্মদাস সুর—রঙ্গভূমি সজ্জাকর। আশুতোষ বড়াল—বিজনেস ম্যানেজার। প্রমথনাথ দাস—বিজ্ঞাপন বিভাগের ম্যানেজার। অঘোরনাথ পাঠক সঙ্গীত শিক্ষক। অমরেন্দ্রনাথ দত্ত—লেসী ও ম্যানেজার। কোম্পানীর নাম—দি ক্লাসিক থিয়েট্রিকাল কোম্পানী।
পূর্ণোদ্যমে ক্লাসিক থিয়েটারের অভিনয় শুরু হয়ে গেল। বাংলা নাট্যশালায় নতুন জীবন সঞ্চার হল।
অভিনয়ের তালিকা—১৮৯৭: নলদময়ন্তী ও বেল্লিকবাজার (১৬ এপ্রিল)। পলাশীর যুদ্ধ ও লক্ষ্মণ বর্জন (১৭ এপ্রিল)। দক্ষযজ্ঞ (১৮ এপ্রিল)। বিবাহবিভ্রাট (২৪ এপ্রিল)। তরুবালা (২৫ এপ্রিল)। হারানিধি (১ মে)। বিধ্বমঙ্গল (২৩ মে)। দেবীচৌধুরাণী (নাট্যরূপ: অমর দত্ত, ২৯ মে)। হরিরাজ (শেক্সপীয়রের ‘হ্যামলেট’ অবলম্বনে নগেন্দ্রনাথ চৌধুরীর লেখা, ২১ জুন)। বুদ্ধদেব চরিত (৩০ জুন)। রাজা ও রানী (রবীন্দ্রনাথ, ২৪ জুলাই)। পূর্ণচন্দ্র (৫ সেপ্টেম্বর)। আলিবাবা (ক্ষীরোদপ্রসাদ, ২০ নভেম্বর)। আলাদীন (১২ ডিসেম্বর)। কাজের খতম (অমর দত্ত, ২৫ ডিসেম্বর)।
দু’একটি নতুন নাটক ছাড়া প্রায় সবই পুরনো নাটক এবং গিরিশের নাটক। একই সঙ্গে একাধিক নাটকের অভিনয় করা হতো। আবার একই নাটক অনেকবার অভিনয় করা হতো। উল্লেখযোগ্য, ‘হ্যামলেট’ অবলম্বনে ‘হরিরাজ’ নাটকের অভিনয়। চরিত্রলিপি: হরিরাজ—অমরেন্দ্রনাথ। শ্রীলেখা—তারাসুন্দরী। সুরমা—ক্ষুদিবালা। মলিনা—সরোজিনী। জয়াকর—হরিভূষণ ভট্টাচার্য। কূলধ্বজ—গোষ্ঠবিহারী চক্রবর্তী। দধিমুখ—ভোলানাথ দাস।
হরিরাজ অভিনয় করে খুবই খ্যাতিলাভ করে। হ্যামলেটের ট্রাজেডির সূক্ষ্ম ভাব যে দর্শকের পরিতৃপ্ত করেছিল, তা ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকা জানিয়েছিল (২০ জুন, ১৮৯৭)। অভিনয়ে অমর দত্ত এবং তারাসুন্দরী খুবই কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এছাড়া দেবী চৌধুরানীর নাট্যরূপও প্রশংসিত হয়েছিল। অমর দত্ত (ব্রজেশ্বর), হরিভূষণ ভট্টাচার্য (ভবানী পাঠক), তারাসুন্দরী (প্রফুল্ল), কুসুমকুমারী (নিশি) অভিনয়ে কৃতিত্ব দেখান। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রানী’ নাটকে অমর দত্ত—বিক্রম, মহেন্দ্রলাল বসুকুমার সেন, হরিভূষণ ভট্টাচার্য—দেবদত্ত উল্লেখযোগ্য অভিনয় করেন। রবীন্দ্রনাথ এই নাটকের অভিনয় দেখতে ক্লাসিকে আসেন এবং অভিনয়ের প্রশংসা করেন।
প্রথম বছরের সবচেয়ে সফল প্রযোজনা আলিবাবা। আলিবাবা এই সময়ে মিনার্ভায় অভিনীত হচ্ছিল। প্রতিযোগিতামূলকভাবে ক্লাসিকেও ‘আলিবাবা’ নামানো হল। প্রতিযোগিতায় ক্লাসিকের বিক্রি বাড়তে থাকে এবং বাইশ শো টাকা পর্যন্ত দৈনিক বিক্রি শুরু হয়। সর্বমোট লক্ষাধিক টাকা লাভ হয়। অন্যদিকে মিনার্ভায় বিক্রি কমতে কমতে নীলামে উঠে বিক্রি হয়ে গেল (মার্চ, ১৮৯৮)। আবদালা—নৃপেন বসু এবং মর্জিনা—কুসুমকুমারী নাচ-গানে মাতিয়ে দিলেন। গীতিনাট্যটির উপযোগী দৃশ্যসজ্জা, সাজসজ্জা, আলো এবং অসংখ্য মনোহারি গান ও নয়নলোভন নাচ দর্শকদের দারুণভাবে আকর্ষণ করলো। দ্বৈত নৃত্যগীতের নাটিকায় ‘আলিবাবা’ রেকর্ড সৃষ্টি করলো। অমর দত্তের নিজের লেখা ‘কাজের খতম’ পঞ্চরং এই বছরের শেষ অভিনয়। মঞ্চের তাগিদে অমর দত্তকে নাটক লেখায় হাত দিতে হল। অভিনেতা, ম্যানেজার, নাট্য পরিচালক-এর সঙ্গে এবারে কিছু কিছু নাটক রচনার দায়িত্বও তাকে নিতে হলো।
১৮৯৮: পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস (৮ জানুয়ারি)। দোললীলা (অমর দত্ত, ৫ মার্চ)। মেঘনাদবধ (নাট্যরূপ: গিরিশ, ১৬ জুলাই)। মুকুলমুঞ্জরা (৩০ জুলাই)। দক্ষযজ্ঞ (১৪ আগস্ট)। প্রফুল্ল (২৭ আগস্ট)। ইন্দিরা (নাট্যরূপ: অমর দত্ত, ২৪ সেপ্টেম্বর)। কমলেকামিনী (৫ নভেম্বর)। নির্মলা (অমর দত্ত রচিত গীতিনাট্য, ২৪ ডিসেম্বর)।
১৮৯৮-এর ১৯ মার্চ থেকে ক্লাসিকে প্রথম ‘Cinematography’ প্রদর্শন হয়। সঙ্গে দোললীলার অভিনয়। এরপর মাঝে মাঝেই ক্লাসিকে ‘বায়স্কোপ’ দেখানো হতো। সঙ্গে অন্য নাটক থাকতো। এই বছরের জুলাই মাসে গিরিশচন্দ্র ক্লাসিকে যোগ দেন, সঙ্গে পুত্র দানীবাবু। ছিলেন একটানা ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত, নাট্যকার ও নাট্যশিক্ষকরূপে। এই বছরের মার্চের গোড়াতেই কলকাতায় ‘প্লেগ রোগ’ মহামারীরূপে দেখা দেয়। মে মাসে প্রকোপ বেড়ে গেলে গিরিশ ক্লাসিক ছেড়ে দলবল নিয়ে কলকাতার বাইরে অভিনয়ের জন্য চলে যান। কলকাতার লোকজন আতঙ্কে বাইরে পালাতে থাকেন। স্টার দেড় মাস অভিনয় বন্ধ রাখে। ক্লাসিক কিন্তু অভিনয় বন্ধ রাখেনি। অভিনেতা চুনিলাল দেব, নিখিলকৃষ্ণ দেব এবং পরে অভিনেত্রী তিনকড়ি ও প্রমদাসুন্দরী ক্লাসিকে যোগ দিলেন। এই বছর অমরেন্দ্রনাথের দুটি গীতিনাট্য ছাড়া পুরনো সব নাটক, গীতিনাট্য ও নাট্যরূপের অভিনয় হতে থাকে। দোললীলা নাচগানে সাফল্য পেল। গিরিশ পাঁচ মাস থেকে নিজের পুরনো কয়েকটি নাটকের অভিনয় করান এবং অমর দত্তের নির্মলা গীতিনাট্য নামান। তারপরে গিরিশ চলে যান, আগেই অভিনেতা মহেন্দ্রলাল বসু চলে গেছেন। ক্লাসিক অবস্থা সামাল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
১৮৯৯: নির্মলা (১ জানুয়ারি)। জনা (৮ জানুয়ারি)। রাজা ও রানী (১৫ জানুয়ারি)। বিষাদ (৪ ফেব্রুয়ারি)। ধ্রুবচরিত্র (২২ ফ্রেব্রুয়ারি)। সীতার বনবাস (৮ মার্চ)। হীরার ফুল (১৫ মার্চ)। প্রফুল্ল (১৮ মার্চ)। সিন্ধুবধ বা দশরথের মৃগয়া (রাজকৃষ্ণ রায়, ২৫ মার্চ)। আবু হোসেন (১২ এপ্রিল)। চোরের ওপর বাটপাড়ি (১৯ এপ্রিল)। বুদ্ধদেবচরিত ও চক্ষুদান (১৩ মে)। দেলদার (১০ জুন)। করমেতিবাঈ (১৫ জুলাই)। শ্রীকৃষ্ণ (অমর দত্ত, ২৬ আগস্ট)। ভ্রমর (কৃষ্ণকান্তের উইল-এর নাট্যরূপ: অমর দত্ত, ১৬ সেপ্টেম্বর)। ম্যাকবেথ (অনুবাদ: গিরিশ, ১৮ নভেম্বর)।
১৮৯৯-এর ১৮ মার্চ, মিনার্ভাতে গিরিশের পরিচালনায় প্রফুল্ল অভিনীত হয়। প্রতিযোগিতার জন্য অমর দত্ত ক্লাসিকেও ওই একই দিনে প্রফুল্ল নামান। এবং বিজ্ঞাপনে দুই প্রফুল্লের তুলনামূলক বিচারের জন্য দর্শকদের আহ্বান করেন। যোগেশের ভূমিকায় ক্লাসিকে অমর দত্ত এবং মিনার্ভায় গিরিশচন্দ্র অভিনয় করেন।
কিছুদিন বাদে (১২ এপ্রিল) গিরিশ ক্লাসিকে নাট্যকাররূপে যোগ দেন। শর্ত হয় বছরে চারটি নাটক লিখতে হবে এবং শর্ত ভঙ্গে উভয় পক্ষ তিন হাজার টাকা গুণাগার দেবেন। গিরিশ এখানে থাকাকালীন এই বছরে শুধুমাত্র ‘দেলদার’ গীতিনাট্য ছাড়া আর কিছু নতুন লিখে দেননি। দেলদার খুবই সাফল্যলাভ করে। অভিনয় করেন: নৃপেন বসু—দেলদার। কুসুমকুমারী—পিয়াসী। অমরেন্দ্রনাথ—গহন। দানীবাবু—সরল। প্রমদাসুন্দরী—রেখা। অঘোরনাথ—কুহকী। নাচে-গানে নৃপেন বসু এবং কুসুমকুমারী আবার মাতিয়ে দিলেন। ‘দেলদার’—এর সাফল্যে উৎসাহিত অমরেন্দ্রনাথ ‘শ্রীকৃষ্ণ’ লিখে ফেললেন। শ্রীকৃষ্ণ দারুণভাবে জমে গেল। স্টারে ‘মৃচ্ছকটিক’, বেঙ্গল থিয়েটারে ‘বভ্রুবাহন’, মিনার্ভা ‘মদালসা’ সব নতুন নাটক-গীতিনাট্য শুরু হয়েছে। ক্লাসিকও নতুন গীতিনাট্য শ্রীকৃষ্ণ নামাল এবং অচিরাৎ সব মঞ্চকে হারিয়ে অসামান্য সাফল্যলাভ করলো। এখানে ভিড় উপচে পড়তে লাগলো। শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রলিপি: কুসুমকুমারী—শ্রীকৃষ্ণ। প্রমদাসুন্দরী—বলরাম। রানীসুন্দরী—শ্রীদাম। ভূষণকুমারী—শ্রীরাধিকা। পান্নারানী—যশোদা। কুমুদিনী—জটিলা। গুলফনহরি—কুটিলা। যতীন্দ্র ভট্ট—নন্দ ঘোষ। হীরালাল চাকী—উপানন্দ।
বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর নাট্যরূপ ‘ভ্রমর’ অভিনয় প্রতি রাত্রে ‘হাউসফুল’ হতে লাগল। খাট আলমারি সোফাসেট সব দিয়ে একেবারে বাস্তবসম্মত দৃশ্যসজ্জা, উজ্জ্বল আলো এবং অসামান্য অভিনয় এর সাফল্যের মূলে। অমর দত্তের গোবিন্দলাল সবাইকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল। কুসুমকুমারীর ভ্রমর এবং মহেন্দ্রলাল বসুর কৃষ্ণকান্ত, প্রমদাসুন্দরীর রোহিণী, হরিভূষণের হরলাল, দানীবাবুর নিশাকর সকলের প্রশংসা অর্জন করে। গোবিন্দলালরূপী অমরেন্দ্রনাথ ঘোড়ায় চেপে মঞ্চে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চকিত করতালিতে প্রেক্ষাগৃহ ভরে উঠতো। ঘোড়ায় চেপে মঞ্চে আগেও ঢুকেছেন কেউ কেউ। অমরেন্দ্রনাথের ঘোড়ার মাথায় জ্বলত আলো। তাতেই বাজার মাত করতেন তিনি। বিজ্ঞাপন বেরোত—Gobindalal on horsc-back-Statesman, 16. ৪. 1899.
১৫ নভেম্বর এখানে রুশ যাদুকর প্রোঃ বোসাকোভস্কির ম্যাজিক প্রদর্শন করা হয়েছিল। ম্যাকবেথ-এর অভিনয়ও খুব আন্তরিকতার সঙ্গে করা হয়েছিল। গিরিশের নির্দেশনায় অমর দত্ত (ম্যাকবেথ), কুসুমকুমারী ও তিনকড়ি (লেডি ম্যাকবেথ) অনবদ্য অভিনয় করেন।
১৯০০: দেবী চৌধুরাণী, শ্রীকৃষ্ণ, ভ্রমর, বিদ্বমঙ্গল, দোললীলা, আলিবাবা প্রভৃতি পূর্ব অভিনীত নাটকগুলিরই পুনরভিনয় চলে। নতুন নাটক বলতে গিরিশের ‘পাণ্ডবগৌরব’ (১৭ ফেব্রুয়ারি), অমর দত্তের গীতিনাট্য ‘দুটি প্রাণ’ (২৬ মে), নাট্যরূপ ‘সীতারাম’ (৩০ জুন), প্রহসন ‘থিয়েটার’ (২৫ আগস্ট) এই বছরের প্রযোজনা। তাছাড়াও পুরনো সরলা, সধবার একাদশী, বৃষকেতু প্রভৃতি নাটকেরও অভিনয় হয়।
গিরিশ এই বছরে শুধু পাণ্ডবগৌরব লিখেছেন এবং ১৫ এপ্রিল দলবল নিয়ে ক্লাসিক ছেড়ে মিনার্ভায় চলে যান। মিনার্ভায় সীতারাম-এর অভিনয়ের দ্বিতীয় রাতেই অমর দত্ত ক্লাসিকে সীতারাম নামান। এইভাবে সীতারাম নিয়েও দুই মঞ্চে প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। পাণ্ডবগৌরবের অভিনয়ে ছিলেন: ভীম—অমর দত্ত। কঞ্জুকী—গিরিশ। শ্রীকৃষ্ণ—দানীবাবু। সুভদ্রা—তিনকড়ি। দ্রৌপদী—গোলাপসুন্দরী। সুভদ্রা ও দ্রৌপদীর অভিনয় খুব ভালো হয়েছিল। এই নাটকে মূল চরিত্র ‘ভীম’-এর ভূমিকায় গিরিশ তাঁর পুত্র দানীবাবুকে নামাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অমর দত্ত নিজেই ভীম চরিত্র গ্রহণ করেন। তখন গিরিশ শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রকে প্রাধান্য দিয়ে নাটকটিকে পুনর্গঠিত করেন এবং পুত্রকে শ্রীকৃষ্ণ চরিত্র অভিনয় করতে দেন। এইসব নিয়ে অমর দত্ত ও গিরিশের মনোমালিন্য হওয়া স্বাভাবিক।
১৯০১: চাবুক (অমর দত্ত, ১ জানুয়ারি), অশ্রুধারা (২৬ জানুয়ারি), রামনিৰ্বাসন (গিরিশ, ১৬ মার্চ), কপালকুণ্ডলা (নাট্যরূপ: গিরিশ, ১ জুন), মৃণালিনী (নাট্যরূপ: গিরিশ, ২৭ জুলাই), গুপ্তকথা (অমর দত্ত, ৩১ আগস্ট), চৈতন্যলীলা (১৪ সেপ্টেম্বর), অভিশাপ (গিরিশ, ২৮ সেপ্টেম্বর), তোমারি (প্রফুল্ল মুখখাপাধ্যায়, ৭ ডিসেম্বর), অভিশাপ (গিরিশ, ২৮ সেপ্টেম্বর)।
এই বছরে পুরনো নাটকগুলির সঙ্গে এইসব নাটক অভিনীত হয়। এর মধ্যে অমরেন্দ্রনাথের লেখা চাবুক প্রহসন ও গুপ্তকথা লঘু নাটিকা দুটি ক্লাসিকের জন্যই লিখিত ও অভিনীত হয়। গিরিশ নতুন একটি ক্ষুদ্র নাটিকা ‘অশ্রুধারা’ লেখেন রানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যু উপলক্ষে। গিরিশের ‘চৈতন্যলীলা’র অভিনয়ে এখানে একটি নতুনত্ব লক্ষ করা যায়। চৈতন্যের লীলার তিন অংশ তিনজন অভিনেত্রী করেন। বাল্যলীলা—রানীসুন্দরী, গার্হস্থ্যলীলা—তারাসুন্দরী, বৈরাগ্যলীলা—প্রমদাসুন্দরী। ‘অভিশাপ’ পৌরাণিক গীতিনাট্য ক্লাসিকের জন্যই লেখা। এখানে বাংলা মঞ্চে প্রথম মহিলা নৃত্যপরিচালিকা হিসেবে কুসুমকুমারী নৃত্য সংযোজন ও শিক্ষা দেন। ‘তোমারি’ প্রহসনের উত্তরে মিনার্ভা ‘আমারি’ নামে এক প্রহসন অভিনয় করে উতোর-চাপান দেওয়া শুরু করে। মিনার্ভার সঙ্গে একযোগে ক্লাসিক ‘কপালকুণ্ডলার’ প্রতিযোগিতামূলক অভিনয় আরম্ভ করে। অভিনেতা মহেন্দ্রলাল বসুর মৃত্যুতে (৮-৩-১৯০১) ক্লাসিকের ক্ষতি হয়। গিরিশের ‘মনের মতন’ও এখানে প্রথম অভিনীত হয়।
এই বছরেই অমর দত্ত তার অভিনীত নাটকগুলির নির্বাচিত অংশ সিনেমায় তৈরি করেন বাংলা চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ হীরালাল সেনের সহায়তায়। সিনেমার সেই নির্বাক যুগে এতদিন বিদেশ থেকে আনা সিনেমা দেখাননা হতো। ক্লাসিক প্রথম বাঙালির নিজের তৈরি করা সিনেমা রঙ্গালয়ে অভিনয়ের আগে পরে দেখানো শুরু করে। এই অভিনয় ও সিনেমার টানে প্রচুর দর্শক সমাগম হতো।
১৯০২: বহুৎ আচ্ছা (দ্বিজেন্দ্রলাল, ১৮ জানুয়ারি), শিবজী (২২ মার্চ), ফটিকজল (অমর দত্ত, ১২ এপ্রিল), শান্তি (গিরিশ, ৭ জুন), ভ্রান্তি (গিরিশ, ১৯ জুলাই), লাট গৌরাঙ্গ (অমর দত্ত, ২৭ সেপ্টেম্বর), আয়না (গিরিশ, ২৫ ডিসেম্বর)।
পুরনো নাটকের সঙ্গে এইগুলি অভিনীত হল। গিরিশ শান্তি, ভ্রান্তি ও আয়না নতুন লিখেছেন। তবে সবচেয়ে সাফল্যলাভ করে অমরেন্দ্রনাথের শিবজী নাটকটি। মনোমোহন গোস্বামীর ‘রোসেনারা’ অবলম্বনে লেখা শিবজী জাতীয়তামূলক নাটক হিসেবে অনেক দিন বাদে মঞ্চে প্রথম অভিনীত হলো। অভিনয় করেছিলেন শিবজীর ভূমিকায় অমর দত্ত এবং মাতিয়ে দিয়েছিলেন দর্শকদের। অমর দত্তের ‘ভক্তবিটেল’ নাটকটি ‘লাটগৌরাঙ্গে’র পরিবর্তিত নাম। পুলিশের নির্দেশে নাম পরিবর্তন করতে হয়।
১৯০৩: এই বছরের প্রথম আট মাস সবই পুরনো নাটক অভিনীত হয়। সেগুলিই প্রচণ্ড দর্শক আকর্ষণ করতে থাকে। এমন সময়ে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরোধিতায় জনমনে দেশপ্রেমের জাগরণে স্টার ক্ষীরোদপ্রসাদের প্রতাপাদিত্য নামায়। অমনি ক্লাসিক হারাণচন্দ্র রক্ষিতের ‘বঙ্গের শেষ বীর’ উপন্যাসকে নাট্যরূপ দিয়ে ‘প্রতাপাদিত্য’ নামিয়ে দেয় (২৯ আগস্ট)। দুই মঞ্চের আবার প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। এর আগে স্টারের মঞ্চে ‘নীলদর্পণ’ নিয়েও প্রতিযোগিতা চলেছিল এই বছরেই। এই সময়েই অমরেন্দ্রনাথ মিনার্ভা তিন বছরের জন্য লীজ নিয়ে একসঙ্গে ক্লাসিক ও মিনার্ভা চালাতে থাকেন। ক্লাসিক তখন মহাসমারোহে চলছে। ‘হিরন্ময়ী’ গীতিনাট্য (অতুল মিত্র) প্রচণ্ড সাফল্য পেল। পঁচিশ হাজার টাকা লাভ হলো।
১৯০৪: রবীন্দ্রনাথের ‘বউঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘রাজা বসন্ত রায়’ এর আগে সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনীত হয়েছে। ক্লাসিক এর নাম পালটে ‘প্রতাপাদিত্য’ অভিনয় করে ১০ জানুয়ারি। ১ ফ্রেব্রুয়ারি থেকে অমর দত্ত মিনার্ভার দলবল নিয়ে ঢাকায় যান লর্ড কার্জনের আগমন উপলক্ষে উৎসবে নাটক করতে। সেখানে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অমর দত্ত ফিরে আসেন।
ক্লাসিক তখন ‘ভ্রমর’-এর পর গিরিশের নতুন নাটক ‘সৎনাম’ নামাল (৩০ এপ্রিল)। কিন্তু চতুর্থ অভিনয় রাত্রে (২১ মে) মুসলমান দর্শকদের আপত্তিতে সলামের অভিনয় বন্ধ করে দিতে হয়। এই সময় মিনার্ভার দেনা এবং সৎনামের বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ক্লাসিকের দুর্দশা ঘনিয়ে এলো। অমরেন্দ্রনাথের অমিতব্যয়িতা, অবিমৃষ্যকারিতা, অপরিণামদর্শিতা, কর্মচারীদের ওপর অন্ধ বিশ্বাস, পেশাদারি থিয়েটার চালাবার কর্তব্যকর্মে অবহেলা প্রভৃতি কারণে ক্লাসিকে প্রচুর টিকিট বিক্রি হওয়া সত্ত্বেও অমর দত্ত দেনায় জড়িয়ে পড়লেন।
তা সত্ত্বেও নামালেন ‘পেয়ার’ (রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়), শ্রীরাধা (অমর দত্ত), তরণীসেন বধ (রাজকৃষ্ণ রায়, ২৩ জুলাই), বিক্রমাদিত্য (রাজকৃষ্ণ, ২৩ জুলাই)।
কিন্তু ততোদিনে, মিনার্ভা লীজ দিয়ে ছেড়ে দিতে হয়েছে। এদিকে মিনার্ভা থিয়েটার ও ‘রঙ্গালয়’ পত্রিকা চালাবার দরুন প্রচুর খরচ হয়ে গেছে, বাজারে তখনো তিন হাজার টাকা দেনা। এই সময়েই মিনার্ভায় দর্শকদের উপহার হিসেবে বই দেওয়া শুরু হয়। ক্লাসিকও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে বই দেওয়া শুরু করে কোনোরকমে আসর সরগম রাখার চেষ্টা করেছিল। গিরিশ আবার এই সময়েই ক্লাসিক ছেড়ে চলে যান। নানাদিকে বিপর্যস্ত অমর দত্ত এবার নিজে রবীন্দ্রনাথের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস ‘চোখের বালি’র নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় করেন (২৬ নভেম্বর)। অভিনয়ে ছিলেন: অমরেন্দ্রনাথ—মহেন্দ্র। বিহারী—মনোমোহন গোস্বামী। বিনোদিনী কুসুমকুমারী। ব্লাকী—আশা। নাটক জমলো না।
১৯০৫: দেনাগ্রস্ত অমর দত্ত ক্লাসিক বন্ধক রেখেছেন, টাকা ধার করেছেন, সবার মাইনেপত্র বাকি পড়েছে, তবুও শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শেক্সপীয়রের ‘Commedy of Errors’ অবলম্বনে ‘কোনটা কে’ অভিনয় করলেন। তারপর ‘প্রেমের পাথারে’ ও ‘সংসার’, এবং ‘শিবরাত্রি’ (অমর দত্ত, ৪ মার্চ) অভিনয়ে নামালেন। ২ এপ্রিল, ১৯০৫, রবিবার ক্লাসিকের স্বত্ত্বাধিকারীরূপে অমরেন্দ্রনাথের শেষ অভিনয়—হরিরাজ, সোনার স্বপন, শ্রীকৃষ্ণ (এবং বায়স্কোপ)। হরিরাজের ভূমিকায় অমরেন্দ্রনাথ।
হাইকোর্টের রায়ে অমর দত্ত ক্লাসিক ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, রিসিভার নিযুক্ত হলেন অতুলচন্দ্র রায় ও পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী।
ভগ্নমনোরথ অমর দত্ত দলবল নিয়ে কিছুদিন ‘গ্রান্ড থিয়েটার’ খুলে অভিনয় চালাবার চেষ্টা করলেন। তবে আর মালিক নন, শুধু অধ্যক্ষ। এদিকে অমরেন্দ্রনাথ ব্যতিরেকেই ক্লাসিকের অভিনয় আবার চালু হলো। কিন্তু সফল হলো না। তখন মালিক অতুল রায় অমরেন্দ্রনাথকে মাসিক পাঁচশো টাকা বেতনে ম্যানেজার করে নিয়ে এলেন। থিয়েটারের মালিক অমর দত্ত এবারে ম্যানেজার, মাস মাইনের চাকুরিয়া। গ্রান্ড থিয়েটারের দলবল নিয়ে ক্লাসিকে আবার অমর দত্ত অভিনয় শুরু করলেন (২১ অক্টোবর, ১৯০৫) পৃথ্বিরাজ (মনোমোহন গোস্বামী, ৪ নভেম্বর), হল কি (সুরেন্দ্রনাথ বসু, ৪ নভেম্বর), প্রণয় না বিষ (অমর দত্ত, ২৩ ডিসেম্বর), এস যুবরাজ (অমর দত্ত, ৩০ ডিসেম্বর)।
‘বঙ্গভঙ্গে’র উন্মাদনার যুগে অমর দত্ত কখনো ব্রিটিশ বিরোধী নাটক (বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ, কিংবা ‘হল কি’) অভিনয়ের সঙ্গে ব্রিটিশ তোষণের নাটক ‘এস যুাজ’ অভিনয় করে তার দ্বৈত মানসিকতার পরিচয় রেখে গেছেন।
১৯০৬: সিরাজদৌল্লা (গিরিশ, ২৭ জানুয়ারি) অভিনীত দল। মিনার্ভাতেও এই সময়ে সিরাজদৌল্লা নামিয়েছিল। আবার প্রতিযোগিতা চলল। ক্লাসিকে সিরাজ—অমর দত্ত, করিম—হরিভূষণ ভট্টাচার্য, জহরা—কুসুমকুমারী। মিনার্ভায় সিরাজ—দানীবাবু, করিম—গিরিশ এবং জহরা—তারাসুন্দরী।
ক্লাসিকে অভিনয় কিছুতেই জমছিল না। উপহার-প্রথা চালু রেখেও প্রাণ সঞ্চার করা গেল না। মানসিক ও শারীরিক অসুস্থ অমর দত্তের সঙ্গে রিসিভার অতুল রায়ের মনোমালিন্যের কারণে, অমর দত্ত ক্লাসিক ছেড়ে দিলেন (মে ১৯০৬)।
রিসিভার অতুল রায় অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তারাসুন্দরীকে এনে ক্লাসিক চালাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। ক্লাসিকের সব কিছু অমরেন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে সেখানে প্রাণ সঞ্চার করা সম্ভব হলো না।
তাঁর পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ জর্জ থিয়েটার নামে একটি অভিনয় সম্প্রদায় গঠন করেন। থেসপিয়ান টেম্পল-এ (বেঙ্গল থিয়েটার মঞ্চে) কিছুদিন অভিনয় করেন। পরে সেখানে বায়স্কোপ দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়।
ক্লাসিক থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেল। জমিদার শরৎকুমার রায় ক্লাসিকের থিয়েটার বাড়ি কিনে নিয়ে সেখানে খুললেন কোহিনূর থিয়েটার।
উনিশ শতকের শেষ দিকে বাংলা থিয়েটারের দুর্দিনে অমরেন্দ্রনাথ এসেছিলেন। একেবারে আনকোরা তরুণ সুদর্শন যুবা ও খ্যাতিমান বনেদী পরিবারের সন্তান অমর দত্ত তার পারিবারিক ঐতিহ্য, পরিচিতি এবং নিজের অভিনয় ক্ষমতায় ও প্রযোজনার কৃতিত্বে শীঘ্রই দর্শকের মন জয় করে নিলেন। শুধু অভিনয় দিয়ে থিয়েটার চলে না, আনুষঙ্গিক আরো প্রক্রিয়া থাকে, যার মধ্য দিয়ে সমকালে অন্য থিয়েটারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠা যায়। অমর দত্ত নানাভাবে, নানা প্রক্রিয়ায় তার থিয়েটারকে দর্শক সাধারণের কাছে উপস্থিত করতে পেরেছিলেন।
রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে ক্লাসিক থিয়েটারের অবদান
- ক্লাসিকে অমর দত্ত পৌরাণিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক নাটক, প্রহসন, নক্সা, পঞ্চরং, গীতিনাট্য, অপেরা—সে যুগের দর্শক সাধারণের মনোমত সব রকমের এবং বিভিন্ন রসের ও বিষয়বস্তুর ক্রমাগত প্রযোজনা করে গেছেন।
- সেই সময় সর্বাধিক জনপ্রিয় গিরিশকে ক্লাসিক মঞ্চে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে। গিরিশের পুরনো জয়প্রিয় নাটকগুলির অভিনয় করেছেন, নতুন নাটক লিখিয়ে প্রথম অভিনয় করেছেন। গিরিশের খ্যাতি ও প্রতিভাকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছেন, যখনই সুবিধে হয়েছে।
- তখন মঞ্চে অল্পদিনের ব্যবধানেই নতুন প্রযোজনা নামাতে হত। তাই সবসময়ে অন্য নাট্যকারের মুখাপেক্ষি না থেকে অমর দত্ত নিজেই নাটক রচনা করে নিয়েছেন। তিনি নাট্যকার নন মূলত, তার লেখা নাটকগুলিও খুব উচ্চাঙ্গের নয়। কিন্তু তৎকালীন মঞ্চে কোন্ ধরনের নাটক ভাললা চলতে পারে, এ ব্যাপারে তার ধারণা ছিল খুবই পরিষ্কার। মঞ্চের চাহিদা ও দর্শকের মানস-উপযোগী নানা ধরনের নাটক রচনা ও অভিনয় করে প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। অমরেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা নাটক: ‘মজা’ প্রহসন (১৯০০), থিয়েটার (১৯০০), চাবুক (১৯০১), গুপ্তকথা (১৯০১), ঘুঘু (১৯০৫), লাটগৌরাঙ্গ (১৯০২),। সবগুলিই প্রহসন। শেষের দুটি ব্রিটিশের অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের ধাক্কায় অভিনয় বন্ধ রাখতে হয়। এছাড়া বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ (১৯০৫), আশা কুহকিনী (১৯০৫), নেপোলিয়ান বোনাপার্ট-ও রচনা করেন। গোড়ার দিকে কয়েকটি গীতিনাট্য লিখেছিলেন—ঊষা, মানকুঞ্জ, শ্রীকৃষ্ণ (১৮৯৯) দুটি প্রাণ, নির্মলা (১৮৯৮)। পঞ্চরং জাতীয় রচনা—এস যুবরাজ, কাজের খতম। এছাড়া তিনি বঙ্কিমের কৃষ্ণকান্তের উইল-এর নাট্যরূপ দেন ‘ভ্রমর’ নামে (১৮৯৯)। রবীন্দ্রনাথের চোখের ‘বালি’র নাট্যরূপ (১৯০৪) এবং বঙ্কিমের সীতারাম উপন্যাসের নাট্যরূপ তারই দেওয়া।
- গিরিশ এবং নিজের নাটক ছাড়াও তিনি প্রয়োজনে রাজকৃষ্ণ রায়, মনোমোহন গোস্বামী, ক্ষীরোদপ্রসাদ প্রমুখ নাট্যকারের নাটক অভিনয় করেছেন। তখন একেবারেই অপরিচিত নবীন নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘আলিবাবা’ নির্বাচন করে, সম্পাদনা ও সঙ্গীত-নৃত্য যোজনা করে সেযুগের জনপ্রিয়তম প্রযোজনায় পরিণত করেছিলেন। কুসুমকুমারী ও নৃপেন্দ্রচন্দ্র বসুর অভিনীত মর্জিনা আবদালা নাচে গানে মাতিয়ে দেয়। অমরেন্দ্রনাথের অভিনীত হুসেন চরিত্র রূপে শুণে দর্শকদের মোহিত করেছিল।
- রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রানী’ নাটক অন্তত কুড়ি রাত্রি ক্লাসিক অভিনয় করে। তাছাড়া ‘চোখের বালি’র নাট্যরূপ এবং রাজা বসন্ত রায়ের পরিবর্তিত নাম ‘প্রতাপাদিত্য’ অভিনয় করে।
- শুধু ভালো নাটক বা নাট্যকার নয়, ক্লাসিকে তখন সেরা অভিনেতা অভিনেত্রীদের জড়ো করা হয়েছিল। অমরেন্দ্রনাথ স্বয়ং, তাছাড়া গিরিশ, দানীবাবু, অঘোর পাঠক, মহেন্দ্রলাল বসু, প্রবোধচন্দ্র ঘোষ, চুনিলাল দেব, হরিভূষণ প্রভৃতি অভিনেতা এবং তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, গুলফন হরি, তিনকড়ি (ছোট), রানীসুন্দরী, প্রমদাসুন্দরী প্রমুখ খ্যাতিময়ী অভিনেত্রী ক্লাসিকে অভিনয় করতেন। তাছাড়া নৃত্যগীতে নৃপেন বসু ও কুসুমকুমারী মাতিয়ে দিতেন।
- অনেক ভালো নেপথ্য-শিল্পীর সহযোগিতা ক্লাসিক পেয়েছিল। অঘোর পাঠক (সঙ্গীত শিক্ষক), ধর্মদাস সুর (রঙ্গসজ্জা), নৃপেন বসু (নৃত্য শিক্ষক), অমৃতলাল ঘোষ (বংশীবাদক), ভূতনাথ দাস (হারমোনিয়াম শিক্ষক) এবং দেবকণ্ঠ বাগচী (সঙ্গীতাচার্য) প্রভৃতির নেপথ্য সহযোগিতায় যে-কোনো প্রযোজনা জমে যেত।
- বঙ্কিমের নাটকীয় উপাদানে ভরা উপন্যাসগুলির নাট্য প্রযোজনা সে যুগে খুবই জনপ্রিয় ছিল। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি বঙ্কিমের বেশ কয়েকটি উপন্যাসের নাট্যরূপ অভিনয় করেছিলেন। ভ্রমর (কৃষ্ণকান্তের উইল), কপাকুণ্ডলা, দুর্গেশনন্দিনী, সীতারাম, দেবী চৌধুরাণী, ইন্দিরা ক্লাসিকের অতি নিপুণ ও সফল প্রযোজনা
- মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ’, নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যের নাট্যরূপ; শেক্সপীয়রের ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, কমেডি অফ এররস নাটকের অনুবাদ ও রূপান্তর অতি উৎসাহের সঙ্গে ক্লাসিকে অভিনীত হয়েছিল। ভিন্ন নাট্যরসের স্বাদ দর্শকদের দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল।
- আলিবাবা, হিরন্ময়ী, শ্রীকৃষ্ণ প্রভৃতি গীতিনাট্য অপেরার অভিনয়ে কৃতিত্ব ও সাফল্য বাংলা মঞ্চে আদর্শস্থানীয় হয়েছিল। এগুলির অসম্ভব জনপ্রিয়তা ক্লাসিকের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করে তুলেছিল।
- অন্য রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে একই নাটক তিনি প্রতিযোগিতামূলকভাবে ক্লাসিকে অভিনয় করতেন। এইভাবে মিনার্ভার সঙ্গে প্রতিযোগিতা চালিয়ে প্রফুল্ল, সীতারাম, কপালকুণ্ডলা, সিরাজদৌল্লা এবং স্টারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নীলদর্পণ, প্রতাপাদিত্য করা হয়েছিল। একাদিক্রমে কয়েক রাত্রি দুই থিয়েটারে একই নাটকের অভিনয়ের ফলে দর্শকদের মধ্যে তুমুল উদ্দীপনা ও আলোড়ন সৃষ্টি হতো। দর্শকদের দুটো নাটক দেখতে হতো এবং তুলনামূলক বিচারে প্রবৃত্ত হতে হতো। থিয়েটারে বিক্রি বেড়ে যেতো স্বাভাবিক ভাবেই। বিজ্ঞাপন:–অশ্বপৃষ্ঠে সীতারাম। কি অপূর্ব শোভা! ছুটে যেন রোধিবারে গিরিশ প্রতিভা! নাট্যগুরু সনে রণ/দম্ভে করে আস্ফালন/ক্লাসিকের সীতারাম বলদৃপ্ত যুবা।
- এমারেল্ড থিয়েটার লীজ নিয়ে ক্লাসিক’ খোলার সময়ে সব ছিল জীর্ণ ও ভাঙাচোরা। সেই থিয়েটার সারিয়ে, মঞ্চের উৎকর্ষ সাধন করে তিনি থিয়েটারটিকে আকর্ষণীয় করে তোলেন। দর্শকাসন বাড়িয়ে দর্শকসংখ্যা বৃদ্ধি করেন। আলো, গাড়ি রাখার ব্যবস্থা, আপ্যায়ন—সবকিছু দিয়েই আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলেন।
- নাট্যপ্রযোজনার ক্ষেত্রে মঞ্চব্যবস্থা একটি বড়ো হাতিয়ার। বাংলা থিয়েটারে যে মঞ্চব্যবস্থা চলে আসছিল অমর দত্ত তার পরিবর্তন করলেন। দৃশ্যপট ও সাজসজ্জায় নতুনত্ব নিয়ে এলেন। দৃশ্যপটের ক্ষেত্রে আগে গুটনো সীন, কাটা সীন, ঠ্যালা সীন ব্যবহৃত হতো। চিত্রকরকে দিয়ে নাট্য নির্দেশিত স্থানের (যেমন বনপথ, মন্দির, রাস্তা, শয়নকক্ষ ইত্যাদি) চিত্র বড়ো করে আঁকিয়ে গুটিয়ে তুলে রাখা হতো। অভিনয়ের সময়ে প্রয়োজনে গুটনে সীন নামিয়ে পেছনে ঝুলিয়ে দৃশ্যসজ্জা করা হতো। ঠ্যালা বা কাটা সীনও সেইভাবে ব্যবহৃত হতো। এইসব দৃশ্যপট প্রায়শই বর্জন করে অমর দত্ত তার বদলে উইংস, কার্টেন, প্রসেনিয়াম এগুলির ব্যবহার শুরু করলেন। এবং দৃশ্যপটের পরিবর্তন হিসেবে অনেক সময়েই তিনি বাস্তবানুগ মঞ্চসজ্জার। দিকে নজর দিলেন। শয়নকক্ষ ইত্যাদির ক্ষেত্রে তিনি নকলের বদলে আসল খাট, আলমারি, সোফা-সেট, টেবিল, চেয়ার, আয়না ইত্যাদি ব্যবহার শুরু করেন। গোটা মঞ্চটিকেই এভাবে নাটকের প্রয়োজনীয় বাস্তব দৃশ্যে রূপান্তরিত করে নেওয়া হত। দর্শকের চমৎকারিত্ব সৃষ্টিতে এই নতুন ব্যবস্থার জুড়ি ছিল না।
- অমর দত্ত থিয়েটারে বিদ্যুৎ-আলোর সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৯৯-তেই কলকাতায় বিজলী আলো এসে যায়। তিনি এই নতুন ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ঝকমকে নানা আলোর ঝর্ণা বইয়ে দিতেন। আবার নাট্যাভিনয়ের সময়ে রঙীন আলো, স্পট লাইটের ব্যবহার করতেন। আলো দিয়ে চমক সৃষ্টির চেষ্টা করা হত প্রায়ই।
- দর্শকদের চমক দেবার জন্য, আজকের ভাষায় যাকে ‘গিমিক’ বা ‘স্টান্ট’ বলে, অমর দত্ত মঞ্চে তার ব্যবহার প্রায়ই করতেন। কৃষ্ণকান্তের উইলে গোবিন্দলালরূপী অমরেন্দ্রনাথ ঘোড়ায় চড়ে স্টেজে ঢুকতেন। বাংলা মঞ্চে এটা নতুন নয়। অমর দত্তর ‘স্টান্ট’ হল, তিনি ঘোড়ার মাথায় ইলেকট্রিক আলো জ্বালিয়ে দিলেন। জলমগ্না রোহিণীকে গোবিন্দলাল একেবারে জলসিক্তা অবস্থায় মঞ্চে তুলে আনতেন। জলে ঝাঁপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জলের শব্দের সাথে জলও ছিটিয়ে পড়তো দর্শকদের মধ্যে। তাছাড়া, আকাশে উড়ে যাওয়া, ফোয়ারার জল, বিদ্যুৎচমক, রিভলবার পিস্তলের গুলি ছোঁড়ার শব্দ; জীবন্ত পশুপাখি—সবই তিনি অবলীলাক্রমে মঞ্চে দেখাতেন। অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলি নাট্যব্যতিরিক্ত হতো, কিন্তু দর্শক তাতেই আকৃষ্ট হতো বেশি।
- আধুনিক ব্যবসায়ের বড় একটি দিক হল বিজ্ঞাপন। গুণগত মানের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনের প্রচার—যে কোন উৎপাদনকেই বাজারে চালিয়ে দেয়। ব্যবসায়িক থিয়েটারের বিজ্ঞাপনের ধারাটিকেই আমূল পাটে দেন অমর দত্ত। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া, হ্যান্ডবিল, রাস্তার দেওয়ালে প্লাকার্ড—এগুলি তিনিও করেন। কিন্তু বিজ্ঞাপনের ভাষাকে আকর্ষণীয় করে তোলা, মাত্রাচ্যুতি ঘটলেও হতোদ্যম না হওয়া, হ্যান্ডবিলের সস্তা চোতা কাগজের পরিবর্তে দামী ও রঙীন কাগজ ব্যবহার শুরু করলেন তিনি। হাতপাখার পেছনে, মুদিখানার ঠোঙার ওপরে তার থিয়েটারের বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে দিলেন। নতুন নাটক নামলে সম্প্রদায়ের সকলকে বেশ কিছু ফ্রি-পাশ দিতেন, যাতে অনেক লোক দেখতে আসে আবার তাদের মাধ্যমেই নাটকটির প্রচার হয়ে যেত নানা দিকে। ফুটবল ফাইনালে ইস্ট ইয়র্কসকে হারিয়ে (১৯১১) মোহনবাগান হৈচৈ ফেলে দেয়। অমর দত্ত’র বিজ্ঞাপন—‘‘Mohunbagan has won the shield. Baji Rao has gained the Victory.’’ (বাজিরাও নাটক)।
- উপহার প্রথায় তিনিও মেতে ওঠেন। দর্শকদের তিনি নানা ধরনের বই উপহার দিতেন। গিরিশ গ্রন্থাবলী, মাইকেল গ্রন্থাবলী, শ্রীরাধা নাটক। দর্শক নাটকের টিকিটের সঙ্গে একটি করে গ্রন্থ পেয়ে যেত।
- থিয়েটারের মালিকের সদিচ্ছা এবং থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত অন্য সকলের সহযোগিতা ভিন্ন অভিনয় চালানো অসম্ভব। মালিক অমর দও তাই সম্প্রদায়ের সকলের সুখ-দুঃখের দিকে নজর রাখতেন। তিনিই উদ্যোগী হয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রী, নৃত্য-সঙ্গীত-শিক্ষক, বাজনদার, শিফটার সকলের মাইনে বাড়িয়ে দেন। কুড়ি-পঁচিশ টাকার পরিবর্তে দুশো তিনশো টাকা বেতন এবং হাজার দু’হাজার টাকা বোনাস তিনি চালু করেন। তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অন্য দিকেও নজর দেন। শিল্পীদের প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্যের জন্য তিনিই বাংলা মঞ্চে প্রথম ‘বেনিফিট নাইটে’র ব্যবস্থার প্রচলন করেন।
- থিয়েটারের মালিকানা, নাট্যরচনা ও পরিচালনা, নিজের অভিনয়—এগুলি তো তাঁর থিয়েটার কর্তব্যকর্মের মধ্যেই ছিল। তারই ফাঁকে তিনি নাট্যসম্বন্ধীয় পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। নাট্যসম্বন্ধীয় পত্রিকা যে নাটকের দর্শক তৈরি করে এবং সেই দর্শকের মানসিক উন্নতি বিধান ঘটায়, অমর দত্ত সেটা বুঝেই সেই যুগে তিনিই প্রথম নাট্যপত্রিকা প্রকাশ করেন। এবং একটি নয়, তিনটি। ‘সৌরভ’ মাসিক পত্রিকা (প্রথম প্রকাশ শ্রাবণ, ১৩০২ সাল), ‘রঙ্গালয়’ সাপ্তাহিক পত্রিকা (প্রথম প্রকাশ ১৭ ফাল্গুন, ১৩০৭ সাল), ‘নাট্যমন্দির’ মাসিক পত্রিকা (প্রথম প্রকাশ শ্রাবণ, ১৩১৭ সাল)। সৌরভের সম্পাদক গিরিশচন্দ্র, রঙ্গালয়ের পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নাট্যমন্দিরের মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনটি পত্রিকার সর্বেসর্বা ছিলেন অমরেন্দ্রনাথ। প্রথম দিকে সম্পাদনাও করেছেন। পরে থিয়েটারের চাপে এবং আর্থিক ঝঞ্ঝাট পোহাতে না পেরে অন্যদের দায়িত্ব দেন। তিনটি পত্রিকাতেই অভিনেতা অভিনেত্রীদের লেখা, দেশ-বিদেশের থিয়েটারের ও নট-নটীদের খবর বেরোত ছবিসহ। থিয়েটার ও অভিনয় সম্বন্ধীয় নানা লেখাও প্রকাশিত হতো। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস বর্ণনায় এই থিয়েটার সম্পর্কীয় পত্রিকা প্রকাশের কথা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। রঙ্গালয় পত্রিকাতেই দুটি আত্মকথা প্রকাশিত হয়। ধর্মদাস সুরের আত্মজীবনী এবং অভিনেত্রী বিনোদিনীর আত্মকথা। (গ্রন্থাকারে আমার কথা)। দুটিই বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
- উনিশ শতকের শেষ পঁচিশ বছর বাংলা থিয়েটারে পৌরাণিক নাটকের প্লাবন বয়ে যায়। রঙ্গক্ষেত্র একেবারে তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়। বাঙালি দর্শকের ধর্মপ্রাণতার সুযোগ নিয়ে সব মঞ্চই পৌরাণিক নাটকের নামে ভক্তিরসের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। অমর দত্ত ভাবপ্লাবনের সেই উচ্ছ্বাসে ‘পৌরাণিক নাটক’কে একেবারে বাদ দিতে পারেননি, কিন্তু তার ক্লাসিক থিয়েটারকে ধর্মক্ষেত্রেও পরিণত করেননি। বরং গীতিনাট্য-অপেরার নতুন ঢঙ নিয়ে এসে দর্শকদের অন্যভাবে মাতিয়ে দিয়েছিলেন। নৃত্যে নতুন ভঙ্গিমা, গায়কীতে নতুন আমেজ তৈরি করে তখনকার দর্শকের কাছে গীতিনাট্যগুলিকে চিত্তাকর্ষক করে তুলেছিলেন। তাছাড়া, সামাজিক নাটক, প্রহসন ও নক্সাগুলিতে অভিনয়ের নতুন রীতি নিয়ে এসে দর্শকদের নতুনের স্বাদ দিয়েছিলেন। ফলে ধর্মক্ষেত্র থেকে ক্লাসিক থিয়েটার আমোদ-প্রমোদের রঙ্গক্ষেত্রে রূপান্তরিত হলো। ভক্তিরসের ভাবাবেগের বাইরে দর্শকেরা প্রথম তাদের নিজেদের জীবনের আবর্তের মধ্যেই স্ফূর্তির ফোয়ারা উছলে পড়তে দেখল। অন্যদিকে অমরেন্দ্রনাথ নিজে এবং সঙ্গী দুই প্রধান অভিনেত্রী তারাসুন্দরী ও কুসুমকুমারী ভক্তিরসের চরিত্রাভিনয়ে সার্থকতা লাভ করতে পারেননি। সেই তুলনায় তেজোদ্দীপ্ত অভিনয়, কৌতুক বা নৃত্যগীতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। সেই কারণেও, ক্লাসিকে পৌরাণিক নাটক থেকে তারা মুক্তি পেতে চেয়ে থাকতে পারেন।
- অমর দত্ত তার নিজের এবং ক্লাসিক থিয়েটারের মর্যাদা বাড়াবার জন্য প্রায়ই বিভিন্ন ক্ষেত্রের খ্যাতিমান লোকদের থিয়েটারে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসতেন। সে যুগের ছোটলাট থেকে শুরু করে বড় বড় সরকারি আমলা (দেশিয় ও বিদেশিয়), জজ-ম্যাজিস্ট্রেট, লেখক-শিল্পী, বিদ্বজ্জন-পণ্ডিত মানুষের সমাগম থিয়েটারে হতে থাকল। একদিকে থিয়েটারের প্রতি এই জাতীয় মানুষের আকর্ষণ বাড়ানাে তার উদ্দেশ্য ছিল। অন্যদিকে এইসব মানুষের সমাগমে তার থিয়েটারের মর্যাদা অনেক বেড়ে যেত। সাধারণ দর্শকও এতে আকৃষ্ট হতো বেশি।
- ক্লাসিকে অমরেন্দ্রনাথ ছিলেন মালিক, নাট্যশিক্ষক, অভিনেতা ও নাট্যকার। তাঁর আবির্ভাবের সময়ে মিনার্ভা ছিল হতশ্রী, বেঙ্গল থিয়েটারের শেষ অবস্থা। উত্থানপতনের সাক্ষী স্টারে প্রবীণ অমৃতলাল বসুর পরিচালনায় কঠোর নিয়মকানুন দর্শকের পছন্দ ছিল না। অমরেন্দ্রনাথ এসব ভেঙে দিলেন। তার থিয়েটারে দর্শকেরা প্রাণ খুলে নাটক দেখতে এলো, উপভোগ করল, আনন্দ মজা, সুখ দুঃখের উপলব্ধি জানান দিল। একটা খোলামেলা আনন্দের হাট বসিয়ে দিলেন অমরেন্দ্রনাথ। ক্লাসিক মানেই তখন আনন্দের, ক্লাসিক মানেই তখন যৌবনের। উনিশ শতকের শেষের দিকে ঝিমিয়ে পড়া বাংলা থিয়েটারে নতুন প্রাণস্পন্দন ও উত্তেজনা সৃষ্টি করে বাংলা নাটকাভিনয়ের ধারাকে প্রাণবন্ত ও সচল করে তুলেছিলেন। অমরেন্দ্রনাথের দশ বৎসরের ক্লাসিক থিয়েটার-এর সেখানেই সিদ্ধি। এইসব কারণেই বোধকরি, শিশিরকুমার ভাদুড়ি অমরেন্দ্রনাথকে বাংলা মঞ্চের ‘নেপোলিয়ান’ বলে আখ্যাত করেছেন। (দেবনারায়ণ গুপ্ত-একশো বছরের নাট্যপ্রসঙ্গ)
- বুদ্ধি, অধ্যবসায় দিয়ে কর্মবীর অমরেন্দ্রনাথ নব নব উদ্যমে ক্লাসিক চালিয়েছেন। নানাভাবে দর্শক আকর্ষণ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছেন। কিন্তু পেশাদারি ও ব্যবসায়িক থিয়েটার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জ্ঞান, দক্ষতা ও উদ্যমের অভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। অমিতব্যয়িতা ও উজ্জ্বলতাও এজন্য দায়ী। ফলে এক সময়ে তাকে ক্লাসিক ছেড়ে দিতে হয়, পরে এই থিয়েটারেই কর্মী হিসেবে চাকরি নিতে হয়। শেষ অবধি ‘দেউলিয়া’ হয়ে যেতে হয়। অর্থের অভাব, দলের লোকের শত্রুতা, ভালো নাটকের অভাব-কোনো কিছুই তাকে বিচলিত করেনি। কিন্তু একটি মানুষের অপরিণামদর্শিতার এই ভয়ঙ্কর পরিণাম বাংলা থিয়েটারের আবহাওয়াকে শ্বাসরোধকারী করে তুলেছে।
Leave a Reply