রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে নবীন বসুর নাট্যশালার অবদান আলোচনা কর।
শ্যামবাজারে নবীন বসুর নাট্যশালা
প্রখ্যাত ধনী ও সম্রান্ত নবীনচন্দ্র বসু তার শ্যামবাজারের বাড়িতে (এখন যেখানে শ্যামবাজার ট্রাম ডিপো) রঙ্গমঞ্চ তৈরি করেন ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে। সেখানে ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকের অভিনয় করেন। এখানে ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকের প্রথম প্রযোজনা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়: ১৮৩৩। হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত: ১৮৩৩। শচীন সেনগুপ্ত (বাংলা নাটক ও নাট্যশালা): ১৮৩৩। ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়: (অভিনয় শিক্ষা): ১৮৩১ (১২৩৭) কোজাগরী পূর্ণিমারাত্রে। সুবল মিত্র সম্পাদিত অখণ্ড সরল বাংলা অভিধান (২য় সং): ১৮৩১। মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি: ১৮৩১। [সন্দর্ভ সংগ্রহ গ্রন্থের রঙ্গভূমির ইতিহাস (১ম ভাগ) প্রবন্ধ]। এখানে বছরে চার-পাঁচটি বাংলা নাটকের অভিনয় হতো বলে জানা যায়। তবে সব অভিনয়ের বিস্তৃত খবর পাওয়া যায় না। মনে হয় চার-পাঁচটি আলাদা নাটক নয়, একটি নাটককেই ৪/৫ বার অভিনয় করা হয়। মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি জানিয়েছেন: ১৮৩১ শুরু হয়ে ১৮৩৭ পর্যন্ত অভিনয় প্রবাহিত ছিল। (রঙ্গভূমির ইতিহাস, ১ম ভাগ)।
প্রসন্নকুমার ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত হিন্দু থিয়েটারের মঞ্চ দেখেই নবীন বসু তাঁর রঙ্গমঞ্চ তৈরি ও অভিনয়ের পরিকল্পনা করেন। তবে তিনি তাঁর মঞ্চে অভিনয় করান বাংলা ভাযায় নাটক। তাঁর নাট্যশালায় একটি নাটকের একাধিকবার অভিনয়ের খবর সঠিক বলে মনে হয়। ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরের কাহিনীকে এখানে নাটকাকারে অভিনয় করা হয়। ৬ অক্টোবর, ১৮৩৫। রাত্রি ১২টায় শুরু করে শেষ হয়েছিল পরদিন সকাল ৬টায়। এই অভিনয়টির খবরই বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায়।
তিনি ইংরেজি ধরনের নাট্যশালা তৈরি করে তাতে প্রথম বাংলা নাটকের অভিনয়ের ব্যবস্থা করলেন। বাঙালির উদ্যোগে প্রথম বাংলা নাটকের অভিনয় শুরু হলো। এর আগে ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে লেবেডেফ বাংলায় নাট্যাভিনয় করেছিলেন; কিন্তু তিনি ও বাঙালি নন, বহিরাগত রাশিয়ান। তাছাড়া নবীন বসুর থিয়েটারে আরেকটি যুগান্তকারী কাজ করা হলো। তাঁর উদ্যোগেই বাঙালির মঞ্চে নারীচরিত্রে অভিনেত্রীদের গ্রহণ করা হয়েছিল।
এখানে ইউরোপীয় বাঙালি হিন্দু মুসলমান মিলিয়ে প্রায় এক হাজারের ওপর দর্শক উপস্থিত ছিলেন।
এই সময়ে সখের যাত্রার আসরে ‘বিদ্যাসুন্দর’ খুবই জনপ্রিয় পালা ছিল। রামতনু মগ নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে নবীন বসু বিদ্যাসুন্দর যাত্রা শুনে উৎসাহিত হন এবং নিজের বাড়ির নাট্যশালায় সেই বিদ্যাসুন্দরেরই অভিনয়ের ব্যবস্থা করেন। কাহিনী নিলেন বিদ্যাসুন্দরের, কিন্তু উপস্থাপনা করলেন নাটকাকারে। খরচ করলেন দু’হাতে। অভিনবত্বে চমকে দিলেন দর্শকদের।
বিলেত থেকে যন্ত্রপাতি আনিয়ে আলোর ব্যবস্থা করলেন প্রচুর অর্থব্যয় করে। আলোর কৌশলে ঝড়বিদ্যুৎ দেখিয়েছিলেন স্টেজে। পাইওনিয়ার পত্রিকার বিবরণে (২২ অক্টোবর, ১৮৩৫) এই স্টেজ ও তার দৃশ্যপট ও আলোর রকমারি ব্যবহারের খবর পাওয়া যায়। স্টেজের সেট-সেটিংস, দৃশ্যপট ও দৃশ্যাঙ্কনের কথা সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। থিয়েটারের অনুকরণে দৃশ্যপট আঁকলেও সেগুলি তত ভালো হয়নি। অঙ্কিত পটে মেঘ, জল ইত্যাদি খুবই নিম্নমানের হয়েছিল, একেবারেই বাস্তবানুগ হয়নি বলে সেযুগে পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছিল। এইসব সাধারণ চিত্রপটের মধ্যে রাজা বীরসিংহের বাড়ি, তার কন্যার ঘর তবুও একটু ভালো হয়েছিল।
দেশীয় যন্ত্রের সাহায্যে ঐকতান বাদন হয়েছিল। সেতার, সারেঙ্গি, পাখোয়াজ, বেহালা প্রভৃতি দেশীয় যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। বাদকগণের অধিকাংশই ব্রাহ্মণ ছিল—তার মধ্যে ব্রজনাথ গোস্বামী বেহালাবাদক হিসেবে নাম করেছিলেন। নাটক শুরু হতো পরমেশ্বর স্তুতি গান দিয়ে।
ডঃ হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তাঁর Indian Stage (Vol-I, P. 286) গ্রন্থে অন্য ধরনের অভিনয়ের কথা জানিয়েছেন। মঞ্চ বেঁধে নয়, ছড়ানো ভাবে ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকের অভিনয় হতো। এই ছড়ানো মঞ্চে বিচিত্র ধরন ও রীতিতে অভিনয়ের বিবরণ দিয়েছেন তিনি। দর্শকেরা উঠে উঠে গিয়ে কখনো নবীন বসুর বৈঠকখানায়, কখনো পুকুরপাড়ে অভিনয় দেখতেন। বীরসিংহ রাজার ঘর হয়েছিল বৈঠকখানায়, বাড়ির পিছন দিকে মালিনীর কঁড়ে, আর সুন্দর বসেছিল বাড়ির বাগান সংলগ্ন পুকুরঘাটে। এমনকি সুন্দরের গোপনপথে যাওয়ার জন্য সুড়ঙ্গপথও তৈরি হয়েছিল।
বিদ্যাসুন্দরের প্রথম প্রযোজনা একদিনে শেষ হয়নি। দুই রাত ধরে চলেছিল। (বিশ্বকোষ: ব্যোমকেশ মুস্তাফি)।
শোনা যায়, শান্তিপুরে চৈতন্যদেব দানলীলার অভিনয়ে প্রকৃতির বাস্তব পটভূমিকা ব্যবহার করেছিলেন। ভাগীরথী নদীর তীরে অভিনয় কালে, মাঠে গাভী চরানো, নদীতে জল-বিহার, প্রকৃত কদম্ববৃক্ষ, দধিদুগ্ধ লুণ্ঠন, সবই ঘুরিয়ে অনুষ্ঠিত হতো। অবশ্য নবীন বসু তাঁর নাট্যানুষ্ঠানে এই অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছিলেন, বলা মুশকিল।
তবে একথা ঠিক, প্রথমদিকে এইভাবে ছড়ানো মঞ্চে অভিনয় হলেও, পরের দিকে যে মঞ্চ তৈরি করে, সেই মঞ্চেই দৃশ্যপটাদিসহ, আলোর কারসাজিতে অভিনয় হয়েছিল, তা ওপরের পাইওনিয়ার পত্রিকার বিবরণ থেকেই জানা যায়। তাহলে মানতে হয় যে, পাইওনিয়ার ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে অভিনয়ের যে বিবরণ দিয়েছে, তার আগেই এখানে আও অভিনয় হয়েছিল, ওই ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকেরই।
প্রথম দিকে দৃশ্যপট ও স্থির মঞ্চের অভাবে দৃশ্যপরিবর্তনের সময়ে একজন অভিনেতা ভারতচন্দ্র থেকে সংশ্লিষ্ট দৃশ্যের আবৃত্তি করতেন, এবং দৃশ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদেরও স্থান পরিবর্তন করতে হতো। কয়েকটি অভিনয়ের পর মঞ্চ ও দৃশ্যপটের ব্যবহার হতে থাকে।
যাই হোক, প্রচলিত যাত্রার চাইতে থিয়েটারের নতুনত্ব ও অভিনবত্বই এখানে বড় কথা। থিয়েটারের এই চমক ও জাঁকজমক এবং ইংরেজি থিয়েটারে বাংলা নাটকের অভিনয়—এই সব দিয়ে নবীন বসুর নাট্যশালা আমন্ত্রিত ইঙ্গবঙ্গ দর্শকদের মুগ্ধ করে দিয়েছিল।
সুন্দরের ভূমিকায় অভিনয় করেন শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। স্ত্রীচরিত্রের মধ্যে বিদ্যার ভূমিকায় রাধামণি বা মণি নামে এক ষোল বছরের বালিকা অভিনয় করে। রাণী ও মালিনীর দুটি চরিত্রেই অভিনয় করে জয়দুর্গা নামে প্রৌঢ়া রমণী। বিদ্যার সখীর ভূমিকায় ছিল রাজকুমারী বা রাজু নামে আরেক মহিলা। নবীন বসু নিজে কালুয়া এবং রাজা বৈদ্যনাথ রায় ‘ভুলুয়া’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যাত্রায় তখন কালুয়াভুলুয়া চরিত্র বিশেষ টাইপ হিসেবে জনপ্রিয় ছিল। তারই প্রভাবে ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকে কালুয়া-ভুলুয়া চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই নিয়ে সেকালে ছড়ায় গান বাঁধা হয়েছিল—
নবীন বসু কালুয়া
রাজা বৈদ্যনাথ ভুলুয়া
বরাহনগরের শ্যামাচরণ
হলেন সুন্দর।
নতুন থিয়েটারের আকর্ষণ তৈরি হলেও দেশীয় রেশ তখনো কাটানো যাচ্ছে না। ‘বিদ্যাসুন্দর’ পালাকে নাটকায়িত করা এবং ‘‘কালুয়া-ভুলুয়া চরিত্রসৃষ্টি করা এবং সঙ্গীত ব্যবহার করা সেই যাত্রার অনুষঙ্গগত প্রমাণ হিসেবে রয়ে গেল।’’ (দ্রঃ নবীন বসুর থিয়েটার—কৌশিক সান্যাল। অনুষ্টুপ শারদীয়, ১৯৯৬, ক্রোড়পত্র-২ পৃ. ১-৫৫)।
স্ত্রী ভূমিকাগুলির অভিনয় খুবই সুন্দর হয়েছিল। তাদের অভিনয় এবং সঙ্গীত পরিবেষণ সবাইকার পরিতৃপ্তির কারণ হয়েছিল। ‘হিন্দু পাইওনীয়ার’ পত্রিকা এই অভিনয়ের এবং বিশেষ করে স্ত্রীচরিত্রের সপ্রশংস উল্লেখ করেছিল। অথচ ‘ইংলিশম্যান অ্যান্ড মিলিটারী ক্রনিকল’ পত্রিকা এই অভিনয়ের তীব্র নিন্দাসূচক এক পত্র প্রকাশ করে, তাতে স্ত্রীলোক নিয়ে এই অভিনয় নিম্নরুচি ও শালীনতাহীনতার কথা বলা হয়। মঞ্চে অভিনেত্রী গ্রহণ করা নিয়ে পরবর্তীকালেও বাঙালির রঙ্গমঞ্চ-বিদ্বেষ লক্ষ করা যায়।
বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে নবীন বসুর থিয়েটারের অবদান
নবীন বসুর থিয়েটারের কৃতিত্বগুলি সূত্রাকারে বলা যায়—
- বিদেশী থিয়েটারের মঞ্চ।
- মঞ্চে নাটক উপস্থাপনা।
- বাংলা নাটকের থিয়েটারি অভিনয়।
- নাট্যবিষয়ে যাত্রার অনুসরণ এবং উপস্থাপনায় যাত্রার কিছু অনুষঙ্গ ব্যবহার।
- বাঙালির মঞ্চে প্রথম অভিনেত্রী গ্রহণ।
- সর্বোপরি, বাঙালির উদ্যোগে প্রথম বাংলা নাটক অভিনয়ের কৃতিত্ব নবীন বসুর অবশ্যপ্রাপ্য।
- যাত্রার আসর বর্জন করে, ইংরেজি নাটক বা অনুবাদ নাটক বর্জন করে, এক অভিনব আঙ্গিকে জনপ্রিয় বিদ্যাসুন্দর পালা নাটকাকারে পরিবেষণ করেন। ছড়ানো মঞ্চে বিভিন্ন দৃশ্যের অভিনয়, একাধিক রাত্রি ধরে অভিনয় করেন।
- বিদ্যাসুন্দরের প্রযোজনা যাত্রা নয়। আবার এটির পরিবেষণা তৎকালীন।
কলকাতায় প্রচলিত বিদেশি থিয়েটারের রীতির অনুসারীও নয়।
Leave a Reply