রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে বিশ্বরূপা থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।
বিশ্বরূপা থিয়েটার
২ বি, রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিট, কলকাতা
প্রতিষ্ঠা: ৭ জুন, ১৯৫৬
প্রতিষ্ঠাতা: সরকার ব্রাদার্সের তরফে রাসবিহারী সরকার
স্থায়িত্বকাল: ৭ জুন, ১৯৫৬ – ১৪ নভেম্বর, ২০০১
প্রথম নাটক: আরোগ্য নিকেতন (তারাশঙ্কর)
প্রবোধচন্দ্র গুহ প্রতিষ্ঠা করেন নাট্যনিকেতন (১৬ মার্চ, ১৯৩১)। চলে ১৯৪১-এর অক্টোবর পর্যন্ত। এবারে দায়িত্ব নেন শিশিরকুমার ভাদুড়ি। তিনি নাট্যনিকেতনের নাম পালটে রাখেন শ্রীরঙ্গম। শিশিরকুমারের পরিচালনায় শ্রীরঙ্গন খ্যাতির তুঙ্গে ওঠে। ১৯৫৬-এর ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অভিনয় চালিয়ে তাকে থিয়েটার বাড়ির দখল ছেড়ে দিতে হয়। আদালতের মাধ্যমে থিয়েটার বাড়ির দায়িত্ব পেলেন মেসার্স সরকার ব্রাদার্স অ্যান্ড প্রপার্টিস প্রাইভেট লিমিটেড (২৮-১-৫৬)। নাট্য আগ্রহী নটবর সরকারের কনিষ্ঠপুত্র রাসবিহারী সরকার কোম্পানীর তরফে উদ্যোগী হয়ে নাট্যমঞ্চ চালাবার দায়িত্ব নিলেন। সরকার ব্রাদার্সের অন্যান্য ব্যবসাও ছিল। পুরনো এই থিয়েটার বাড়িকে সরকার ব্রাদার্স নতুন করে গড়ে তোলেন। নানাভাবে সংস্কার করে শ্রীরঙ্গমের ভোল পালটে দেন। নতুন নামকরণ করা হলো বিশ্বরূপা। প্রথম নাটক অভিনীত হলো তারাশঙ্করের সদ্যপ্রকাশিত জনপ্রিয় উপন্যাস আরোগ্য নিকেতন-এর নাট্যরূপের, একই নামে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুন।
নতুন কর্তৃপক্ষ শিশিরকুমারের ‘শ্রীরঙ্গম’ নাম বদল না করে ওই নামই রেখে দিতে চেয়েছিলেন। এবং শিশিরকুমারকে সসম্মানে এই মঞ্চে যোগদানের আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আদালত কর্তৃক দেউলিয়া হিসেবে ঘোষিত সর্বরিক্ত অভিমানী শিশিরকুমার দুটো প্রস্তাবের কোনোটাতেই রাজি হননি। নিজের দেওয়া নাম ‘শ্রীরঙ্গম’ তিনি অন্য কাউকে দিতে রাজি হননি। আর নতুন করে কারো ‘গোলামি’ (তার ভাষায় ‘ভাড়াটে কেষ্ট’) করতেও তিনি সম্মত হননি।
বিশ্বরূপার তরফ থেকে এক সাংবাদিক সম্মেলনে (৪ এপ্রিল ১৯৫৬) থিয়েটারের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঘোষণা করা হলো—
- এই রঙ্গালয়কে ভারতের সর্ববৃহৎ আধুনিক নাট্যশালা করে গড়ে তোলা হবে।
- মা বাবার সঙ্গে থিয়েটারে আসা শিশুদের ক্রেশ’ তৈরি করা হবে। সেখানে শিশুরা থাকবে, তাদের দেখাশােনার লােক থাকবে এবং শিশুদের খাদ্যেরও ব্যবস্থা করা হবে।
- ১৫০টি মতো সাইকেল রাখার ব্যবস্থা থাকবে।
- রঙ্গালয়ের মোট আসন ১১২টি। নিচে ৬৬২টি এবং ওপরে ২৫০টি বসার আসন থাকবে।
- থিয়েটার হলের সামনে ফুলের বাগান করা হবে এবং সেই বাগানের ফুল দিয়ে বাংলা নাট্যশালার পূর্ববর্তী ব্যক্তিত্বদের জন্য তৈরি বেদিতে অর্ঘ্য নিবেদন করা হবে।
- ভেতরে ‘সিট’ দেখাবার জন্য মেয়েদের (‘আসার’) নিযুক্ত করা হবে।
প্রথম নাট্যাভিনয় ৭ জুন শুরু হয়ে গেলেও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হলো ২২ জুলাই (১৯৫৬)। উদ্বোধন করেন অহীন্দ্র চৌধুরী। প্রধান অতিথি-হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। সেদিন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ও বিদ্বজ্জনের উপস্থিতিতে বিশ্বরূপা মঞ্চের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
১৯৫৬-এর ৭ জুন ‘আরোগ্য নিকেতন’ নাটক দিয়ে বিশ্বরূপার নাট্যাভিনয় শুরু হয়েছিল। নিজের উপন্যাসের নাট্যরূপ দিলেন তারাশঙ্কর। কিন্তু অভিনয়ের প্রয়োজনে এই নাট্যরূপের নানা পরিবর্তনসাধন করা হয়। নাটকটির ভূমিকায় তারাশঙ্কর সেই পরিবর্তন এবং তার ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। পরিচালনার দায়িত্বে রইলেন আরেক খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। গ্রুপ থিয়েটারের প্রখ্যাত আলোকশিল্পী তাপস সেনকে দিয়ে আলোক সম্পাতের কাজ করানো হলো। তাপস সেন-ও এই প্রথম পেশাদারি মঞ্চে যোগ দিলেন। সঙ্গীত—কমল দাশগুপ্ত। নৃত্য—অনাদিপ্রসাদ। অভিনয়ে অংশগ্রহণ করলেন সেই সময়ের থিয়েটার ও চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রীবৃন্দ: বসন্ত চৌধুরী (প্রদ্যোত)। নীতিশ মুখখাপাধ্যায় (জীবনমশাই)। কালী বন্দ্যোপাধ্যায় (শশী কম্পাউন্ডার)। সন্তোষ সিংহ (ভুবন রায়)। নবদ্বীপ হালদার (দাতু ঘোষাল)। বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় (কিশোর)। জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায় (সেতাব)। অজিত গঙ্গোপাধ্যায় (চারু ডাক্তার)। মণি শ্রীমানী (ইন্দির)। তপতী ঘোষ (মঞ্জু)। শান্তি গুপ্তা (আতর বৌ)। কমলা ঝরিয়া (মতি বৈষ্ণবী)। পূর্ণিমা দেবী (অভয়া)। মেনকা দেবী (শুভ্রা)। চিত্রা মণ্ডল (সুধা)।
‘আরোগ্যনিকেতন’-এর অভিনয় এবং বিশ্বরূপা থিয়েটারকে নিয়ে কিছু বিদ্রুপাত্মক মধ্যে সেই সময়ে কোনো কোনো সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিল। যেমন—নাট্যশালার নাম বিশ্বরূপা আর নাটকের নাম ‘আরোগ্য নিকেতন’। নাট্যশালার এখানে-ওখানে নার্সরূপিণী সেবিকার ছোটাছুটি আর নাটকের মধ্যে ব্রহ্মলোক, প্রেতলোক, মর্ত্যলোক অর্থাৎ বিশ্বরূপের ছড়াছড়ি। আমার যেন মনে হল, আরোগ্য নিকেতনে এসে ‘বিশ্বরূপা’ দেখে গেলাম।
আগের শিশিরকুমারের শ্রীরঙ্গম-এর সঙ্গেও কেউ কেউ তুলনা করে লিখলেন— ‘পূর্বতন শ্রীরঙ্গমের সঙ্গে বর্তমান বিশ্বরূপার আকাশ পাতাল তফাৎ আশা করলে হতাশ হতে হবে। অভিনয় ও প্রযোজনার কথা বাদই দিলাম। পুরাতন শ্রীরঙ্গমের গায়ে চুনকাম করা এবং সিট পাল্টানো ছাড়া তেমন কিছু পরিবর্তন হয়নি।’
এতোসব বিরূপ মন্তব্য সত্ত্বেও নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্বরূপা তার প্রথম নাট্যপ্রযোজনার মধ্যে দিয়েই জনমনে স্বীকৃতি লাভ করলো। জনসমর্থন লাভ করে ‘আরোগ্য নিকেতন’ দীর্ঘদিন অভিনীত হলো এখানে।
দ্বিতীয় নাটক ‘ক্ষুধা’। প্রথম অভিনয়: ২১ এপ্রিল, ১৯৫৭ (৭ বৈশাখ, ১৩৬৪)। নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য। পরিচালনায় নরেশচন্দ্র মিত্র। সহ-পরিচালক—কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গীত—নচিকেতা ঘোষ। আলো—তাপস সেন।
বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো—‘জাতির ও জীবনের নাটক ক্ষুধা। বেকার তিন যুবক (সদা গজা রমা)-এর নানা লাঞ্ছনা ও দুর্গতির মধ্যে দিয়ে জীবনসংগ্রাম এবং বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাই এই নাটকের বিষয়বস্তু। বেকার জীবনের মর্মন্তুদ একটি বিষয়কে অনাবিল হাস্য এবং বেদনাবিধুর কারুণ্যের মিশ্রণে প্রকাশ করা হয়। সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল— ‘‘বিশ্বরূপার নতুন নাটক ‘ক্ষুধা’ শুধু আক্ষরিক অর্থে নয়, ভাবের দিক দিয়েও নাটকটি নতুন। জমিদার আর তার নায়েব-গোমস্তাসহ সামন্ততন্ত্রী যুগকে অতীতের নিস্তরঙ্গ শান্তির মধ্যে রেখে নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য ও পরিচালক নরেশ মিত্র দর্শকদের সম্মুখে যে যুগ আর যে সমস্যাকে উপস্থিত করেছেন, তা একান্তই আধুনিক। ভঙ্গ বঙ্গদেশের প্রধান সমস্যা ক্ষুধা, তারই তরঙ্গ রঙ্গমঞ্চে এ নাটকের মাধ্যমে এসে লেগেছে; অন্তত এই একটি কারণেই নাট্যরসিকেরা ক্ষুধাকে গ্রহণ করবেন।’’
প্রয়োগনৈপুণ্য এবং দলগত অভিনয় নাটকটিকে অসামান্য জনপ্রিয় করে তোলে। একটানা ৫৭৩ রাত্রি অভিনয় চলে। শেষ অভিনয় হয় ৩০ আগস্ট, ১৯৫৯। বিশ্বরূপার ক্ষুধা বাংলা মঞ্চাভিনয়ের এতোদিনকার সব রেকর্ড ভেঙে দিল। এর আগে স্টারে শ্যামলী (৪৮৪ রাত্রি), রঙমহলে উল্কা (৫০৭ রাত্রি) টানা অভিনয়ের যে ধারা তৈরি করেছিল, বিশ্বরূপার ক্ষুধা টানা ৫৭৩ রাত্রি অভিনয়ের মাধ্যমে তা ভেঙে দেয়। অভিনয়ে ছিলেন—বসন্ত চৌধুরী (রমা)। কালী বন্দ্যোপাধ্যায় (গজা)। তরুণকুমার (সদা)। এছাড়া নরেশ মিত্র, কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্তোষ সিংহ, নবদ্বীপ হালদার, মণি শ্রীমাণি, জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, শান্তি গুপ্তা, তপতী ঘোষ, জয়শ্রী সেন, সুব্রতা সেন, আরতি দাস প্রমুখ সেই যুগের সিনেমা ও থিয়েটারের খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রীবৃন্দ। পরের দিকে বসন্ত চৌধুরীর পরিবর্তে অসিতবরণ রমা চরিত্রে অভিনয় করেন।
শিল্পীদের অসামান্য অভিনয় নাটকটিকে আকর্ষণীয় করে তোলে। নিখুঁত অভিনয়ের এমন টিমওয়ার্ক বিরল। উন্নতমানের অভিনয়ের এক সামগ্রিক প্রাণপ্রাচুর্য স্থানে স্থানে নাটককে কোন সার্থকতার পর্যায়ে তুলে নিয়ে যেতে পারে, শিল্পীরা তার স্বতঃস্ফূর্ত নজির দেখিয়েছেন এই নাটকে।
আলোকসম্পাতে তাপস সেনের কুশলী ব্যবহার ক্ষুধা নাটকটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছিল।
এই সময়ে বিশ্বরূপা থিয়েটার, বিশেষ করে কর্ণধার রাসবিহারী সরকারের উদ্যোগে, কয়েকটি কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বাংলা নাটক ও নাট্যশালার সার্বিক উন্নতির প্রচেষ্টায় এই কার্যক্রমগুলি সে সময়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। কোনো থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ এর আগে বাংলা থিয়েটারের উন্নতিকল্পে এই ধরনের কোনো পরিকল্পনা কখনো গ্রহণ করেনি। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনার কার্যক্রম হলো—
১. নাট্যউন্নয়ন পরিকল্পনা পরিষদ গঠন।
২. নাট্য সাহিত্য বিষয়ক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা।
৩. পূর্ণাঙ্গ ও একাঙ্ক নাটকের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নাট্য উন্নয়ন। নাম দেওয়া হল ‘গিরিশ নাট্যপ্রতিযোগিতা’।
৪. রবীন্দ্র নাট্য প্রতিযোগিতা।
৫. গিরিশ নাট্য উৎসব।
৬. বার্ষিক বঙ্গনাট্য সাহিত্য সম্মেলন
৭. নাট্যবিষয়ক আলোচনা এবং বিতর্কসভা
৮. শিশু নাট্যশাখা গড়ে তুলে সেখানে নাচগান নাটকের আয়োজন করা।
এইভাবে নানা দিক দিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে সেদিন বিশ্বরূপা রঙ্গমঞ্চ বাংলা থিয়েটারে নাটক, নাট্যাভিনয়, নাট্যরচনা ও নাট্যসমালোচনার নানাদিকের উন্নতিসাধন করার চেষ্টা করেছিলেন।
১৯৬২ থেকে বিশ্বরূপা কর্তৃপক্ষ তাদের নাট্যউন্নয়ন পর্ষদের তরফে বাংলা যাত্রাকে পরিপুষ্ট করার চেষ্টা করেন। এখানে ব্যাপকতরভাবে যাত্রা উৎসব পালন করা হয়, যা ১৯৬১-তেই শোভাবাজার রাজবাড়িতে নিখিলবঙ্গ যাত্রা উৎসব রূপে চালু হয়েছিল। বিশ্বরূপায় নিয়মিতভাবে কলকাতার যাত্রাভিনয়ের আয়োজন হতে থাকে। দেখাদেখি, কলকাতার অন্য মঞ্চগুলিতেও এরপর থেকে যাত্রাভিনয় হতে থাকে।
এগুলি তো ছিলই। এছাড়া নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের প্রতি শ্ৰদ্ধাৰ্ঘে ‘গিরিশ থিয়েটার’ নামে নাট্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রতি রবিবার সকালে ‘গিরিশ থিয়েটার’—এর নামে নাট্যানুষ্ঠান হতো। প্রথমেই সলিল সেনের ‘ডাউন ট্রেন’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়, ৩১ জুলাই, ১৯৬০-এর সকাল সাড়ে দশটায়। নাটকটি পরিচালনা করেন বিধায়ক ভট্টাচার্য। উল্লেখযোগ্য, চলচ্চিত্রের প্রয়াত অভিনেতা নাট্যপণ্ডিত রাধামোহন ভট্টচার্য এই নাটকেই প্রথম পেশাদার থিয়েটারে আত্মপ্রকাশ করেন। পরে এখানে মঞ্চের বিখ্যাত অভিনেতা মহেন্দ্র গুপ্তকে আনা হয়। এঁরা ছাড়া অন্য অভিনেতৃবৃন্দ হলেন জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, সুনীল বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধায়ক ভট্টাচার্য, অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়শ্রী সেন, গীতা দে।
গিরিশ থিয়েটার-এর অভিনয়ের প্রকল্পে ছিল প্রতি সোম, বুধ, শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় এবং রবিবার ও ছুটির দিনে সকাল সাড়ে দশটায় নাটকাভিনয় হবে। ‘ডাউন ট্রেন’ ৭৩ রাত্রি অভিনীত হয়। কিন্তু খুব বেশি সাফল্য লাভ না করায় প্রকল্পটি বন্ধ করে দিতে হয়।
১৯৫৮-তে শিশুনাট্য শাখাটি গড়ে উঠলেও এবং প্রতি শনি, রবি এবং ছুটির দিন সকালে শিশুদের নিয়ে নাচগান ও নাটকের আয়োজন করা হলেও, শিশু এবং অভিভাবকদের সহযোগিতার অভাবে এই প্রকল্পটিও বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৫৮-এর ২০ ডিসেম্বর থেকে চালু হয় ‘গিরিশ নাট্যপ্রতিযোগিতা’। এতে খুব সাড়া পড়ে। অজস্র সৌখিন নাট্যদল এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় এবং এখান থেকেই অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী উঠে আসেন যারা পরবর্তীকালে বাংলা নাট্যাভিনয়ে খ্যাতিলাভ করেছিলেন।
এবারে পুরনো নাটকের আধুনিক মঞ্চায়নের চেষ্টা করা হয় বিশ্বরূপায়। প্রতি বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় এবং শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অভিনয়ের আয়োজন করা হয়। এই প্রকল্পের প্রথম নাটক অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘কর্ণার্জুন’ নাটক। ১৯৬৩-এর ২৫ জুলাই। এই নাটক দিয়ে, ৩০ জুন, ১৯২৩, আর্ট থিয়েটারের উদ্বোধন হয়েছিল এবং অভূতপূর্ব সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সেই সাফল্যমণ্ডিত পুরনো নাটকটি এখানে অভিনয় করা হলো। যাত্ৰাজগতের খ্যাতিমান অভিনেতা দিলীপ চট্টোপাধ্যায় (কর্ণ) এবং সুজিত পাঠক (অর্জন) অভিনয় করেন। পুরনো নাটকটিকে আধুনিক রূপে সম্পাদনা করেন বিধায়ক ভট্টাচার্য। পরিচালনায় ছিলেন সন্তোষ সিংহ ও কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গীত—রবীন চট্টোপাধ্যায়। আলো—অমর ঘোষ। নৃত্য—অনাদিপ্রসাদ। নিয়তির কণ্ঠে গান গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মঞ্চ—আর. আর. সিন্ধে।
নাটকের বিষয় ভাবনায় যখন নতুন জীবনের ইশারা মিলছে, সেই সময় কর্ণার্জুনের মতো পৌরাণিক নাটক নতুন করে অভিনয় করাকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছিলেন। কেননা, পেশাদার মঞ্চ থেকে পৌরাণিক নাটক তখন বিদায় নিয়েছে। এই অভিনয়ের বিবরণ দিয়ে ‘রূপমঞ্চ’ পত্রিকা তখন লিখেছিল—‘আলোক সম্পাতের অভিনবত্ব’—দৃশ্যপটের মনোহারিত্ব, পোষাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতি সর্ববিষয়ে বিশ্বরূপা কর্তৃপক্ষ, নিজেদের চিন্তাশক্তি ও কর্মক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। এখানে যাত্রা, সৌখিন নাট্যদল এবং গ্রুপ থিয়েটার প্রভৃতি অন্যান্য অভিনয় ক্ষেত্রের শিল্পী বাছাই করেছিলেন। তাতে অভিনয় ততোটা দানা বাঁধলেও, এই প্রয়াসকে সকলে অকুণ্ঠ সাধুবাদ জানিয়েছিলেন।
‘গিরিশ থিয়েটার’-এর নামে ‘ডাউন ট্রেন’ অভিনয়ের পর এখানে বিমল ঘোষের (মৌমাছি) লেখা ‘মায়াময়ুর’ নামে একটি শিশুনাট্য অভিনীত হয়। পরিচালনা করেন নরেশ মিত্র। তাছাড়া ‘কর্ণার্জুন’ নাটকটিও এই নাট্যানুষ্ঠানে অভিনীত হয়েছিল।
বিশ্বরূপার নিয়মিত অভিনয়ের ধারায় এবার শুরু হলো ‘সেতু’ নাটক। কিরণ মৈত্রের ‘বুদবুদ’ একাঙ্ক অবলম্বনে এই পূর্ণাঙ্গ নাটকটি রচনা করেন বিধায়ক ভট্টাচার্য। প্রথম অভিনয় হলো ৮ অক্টোবর, ১৯৫৯। পরিচালনা—নরেশ মিত্র। আলো—তাপস সেন। মঞ্চ—অমর ঘোষ। রূপসজ্জা—শক্তি সেন। ‘ক্ষুধা’ নাটকের পর ‘সেতু’ও অসামান্য সাফল্য লাভ করে। ১০৮২ রাত্রি একটানা অভিনয়ের রেকর্ড সৃষ্টি করে নাটকটির অভিনয় বন্ধ করা হয় ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে।
‘বহুরূপী’ নাট্যদলের অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন। এক বন্ধ্যা নারীর জীবনযন্ত্রণা ও সন্তানহীনা নারীর হৃদয় বেদনা তার অভিনয়ে এতোই স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠেছিল যে, পেশাদার থিয়েটারে নারীচরিত্র অভিনয়ের নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে গিয়েছিল। যুগান্তর পত্রিকা লিখেছিল—‘সেতু’ নাটকের সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ নায়িকা অসীমার ভূমিকায় তৃপ্তি মিত্রের অনিন্দ্যসুন্দর অভিনয়। অন্যান্য শিল্পীরা হলেন—অসিতবরণ (পরে অসীমকুমার), নরেশ মিত্র, তরুণকুমার, সন্তোষ সিংহ, তমাল লাহিড়ী, তারক ঘোষ, মণি শ্রীমানি, মমতাজ আহমেদ খাঁ, জয়শ্রী সেন, আরতি দাস, সুব্রতা সেন প্রমুখ।
এই নাটকের দলগত অভিনয় সকলকে মুগ্ধ করে। তাছাড়া প্রয়োগ-নৈপুণ্যের কুশলতাও নাটকটির সাফল্যের মূলে কাজ করেছিল।
আলোক সম্পাতে তাপস সেনের কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য। তাঁর আলোর কারসাজি সেদিন জনমানসে প্রচণ্ড সাড়া ফেলেছিল। আলোছায়ার মায়াজাল সৃষ্টি করে মঞ্চে চলন্ত ট্রেনগাড়ি এবং সেখানে আত্মহত্যার মূহুর্তে নায়িকার উদ্ধার-এর এফেক্ট সেদিন দর্শক মনে প্রভূত সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তবে এই নিয়ে সেদিন তর্কও উঠেছিল, নাট্যাভিনয়ের ক্ষেত্রে আঙ্গিক বড়ো না বিষয় বড়ো। তাপস সেনের আলোর কারসাজি দেখতেই সেদিন বহু দর্শক ভিড় করেছিল। আবার একথাও ঠিক এক বন্ধ্যা নারীর হৃদয়-বেদনার সেন্টিমেন্ট সাধারণ দর্শককে স্বভাবতই আকর্ষণ করেছিল।
এরপরে ‘লগ্ন’ নাটক। নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য। প্রথম অভিনয়—১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে, বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায়।
‘লগ্ন’ নাটকাভিনয় থেকে বিশ্বরূপা সম্পর্কে দুটি তথ্য উল্লেখযোগ্য। এক. এই নাটক থেকেই থিয়েটারের সব কৃতিত্ব স্বয়ং মালিক রাসবিহারী সরকার গ্রহণ করলেন। এবার থেকে তিনি নাট্যাভিনয়ের সব দায়িত্ব নিজের হাতে নিলেন। খ্যাতকীর্তি যে সব নাট্যব্যক্তিত্বের সহায়তায় বিশ্বরূপা অভিনয়ের রেকর্ড সৃষ্টি করে চলেছিল, তার কৃতিত্বের সবটাই থিয়েটারের কর্ণধার হিসেবে নিজের নামে চালাতে থাকলেন। অন্তত কাগজে কলমে তার নামই প্রকাশিত হতো। ফলে বিশ্বরূপা যে গৌরব দিয়ে শুরু হয়েছিল, সেই গৌরব আর ফিরে এলো না। ‘লগ্ন’ নাটকের বিজ্ঞাপনে দেখা গেল—প্রবর্ধনা, প্রবর্তনা ও পরিচালনা: রাসবিহারী সরকার।
দুই. ‘লগ্ন’ অভিনয় থেকেই বিশ্বরূপায় ‘থিয়েটার স্কোপ’ চালু করা হয়। উদয়শঙ্করের শঙ্করস্কোপের আদলে এই থিয়েটারস্কোপ চালু হলেও, অনেকের কাছেই মনে হয়েছে, এটি বিজ্ঞাপনের চমক ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশ্বরূপা কর্তৃপক্ষ এই থিয়েটারস্কোপের বৈশিষ্ট্য জানিয়ে ছিল—
- ব্যাকস্টেজ বলে কিছু থাকবে না, অন্তত দর্শক তা দেখতে পাবে না।
- নাট্য দৃশ্যগুলিকে বিভিন্ন স্তরে সাজিয়ে এক বা একাধিক স্তরে অভিনয়ের ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ নিরস্ত্র অভিনয় চলবে—কোনো ছেদ পড়বে না।
- পরিবেশ অনুযায়ী আবহসঙ্গীত বেজে চলবে।
- শব্দের সাহায্যে চরিত্রগুলির অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ।
- স্বগতোক্তিকে নাটকীয় অথচ বাস্তবানুগভাবে প্রকাশ করা হবে।
এই বিবৃতি থেকে সব কিছু বুঝে ওঠা যায় না। এতে নতুনত্ব কী হলো। সতু সেন অবশ্য জানিয়েছিলেন যে, তার সৃষ্ট ঘূর্ণায়মান মঞ্চের (রিভলভিং স্টেজ) পরে এই থিয়েটারস্কোপ আরেক নতুন পদক্ষেপ বাংলা মঞ্চের বিবর্তনের ক্ষেত্রে। সতু সেনের এই সার্টিফিকেট বিশ্বরূপা কর্তৃপক্ষের কাজে লাগলেও, দর্শকেরা কিন্তু এমন কিছুই অভিনবত্ব খুঁজে পেলেন না। তবে অনেকটা একই সঙ্গে থিয়েটার এবং সিনেমার মিশ্রণ। এই পদ্ধতিতেই এখানে ‘লগ্ন’, ‘রাধা’ এবং ‘হাসি’ নাটক অভিনীত হয়। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল—‘‘ভারতীয় নাট্যশালার ইতিহাসে বিস্ময়কর উদ্ভাবন / থিয়েটারস্কোপ সমন্বিত বিশ্বরূপা থিয়েটারের / লগ্ন।’’
অভিনয়ে ছিলেন: জহর গাঙ্গুলি, সন্তোষ সিংহ, অসিতবরণ, তরুণকুমার, শুভেন্দ চট্টোপাধ্যায়, জয়শ্রী সেন, মিতা চট্টোপাধ্যায়, সাধনা রায়চৌধুরী। এই প্রথম মঞ্চে পুরোপুরি অভিনয় শুরু করলেন স্বয়ং নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য। মাঝে তিনি অভিনেতার অনুপস্থিতিতে কখনো কখনো (যেমন ‘ক্ষুধা’ নাটকে) অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
‘রাধা’ প্রথম অভিনীত হয় ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ এপ্রিল। তারাশঙ্করের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস-এর ঘূর্ণায়মান নাট্যরূপ দিলেন বিধায়ক ভট্টাচার্য। থিয়েটারস্কোপ, নাটক ও পরিচালনা রাসবিহারী সরকার। সঙ্গীত—জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। কণ্ঠসঙ্গীত—পান্নালাল ভট্টাচার্য, ছবি বন্দোপাধ্যায়, গৌরী মিত্র, দিলীপ কুমার রায় ও দিলীপ মুখোপাধ্যায়। নৃত্য—অনাদিপ্রসাদ। মঞ্চ—প্রহ্লাদ দাস। আলো—বংশী সাউ। রূপসজ্জা—শক্তিসেন। অভিনয় করেছিলেন: মিহির ভট্টাচার্য, রূপক মজুমদার, বিদ্যুৎ গোস্বামী, শঙ্কর ব্যানার্জী, গঙ্গাপদ বসু, অরুণ মিত্র, গোবিন্দ মুখোপাধ্যায়, নির্মল ঘোষ, শিপ্রা মিত্র, জয়শ্রী সেন।
কোনো কোনো পত্রিকা রাধা নাটক এবং থিয়েটারস্কোপের ব্যবহার নিয়ে খুবই প্রশংসা করেছিল। কোনো কোনো পত্রিকা আবার তীব্র নিন্দা করেছিল—‘‘বিশ্বরূপায় ‘রাধা’ দেখে মনে হল নাটকটি রাম-শ্যাম-যদুচরণ নামে কোনও চতুর্থ শ্রেণীর হস্তিমূর্খের রচনা। কোথায় তারাশঙ্করের রাধা!’’ (প্রসেনিয়াম)।
এরপরের নাটক ‘জাগো’। বনফুলের ‘ত্রিবর্ণ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ। এইবারে নাট্যরূপদাতা হিসেবেও রাসবিহারী সরকারের নাম ঘোষিত হলো। পরিচালনাও তাঁরই। প্রয়োগ প্রধানও তিনি। প্রথম অভিনয় হলো ১২ অক্টোবর, ১৯৬৬।
থিয়েটারস্কোপ পদ্ধতিতে এই নাটকটিরও অভিনয় হলো। অভিনয়ে: অসিতবরণ, নির্মলকুমার, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, গোবিন্দ গাঙ্গুলি, জয়শ্রী সেন, সুমিতা সান্যাল, শ্রাবণী বসু প্রমুখ। সবদিক দিয়েই ‘জাগো’ ব্যর্থ হলো। বিশ্বরূপার পূর্ববর্তী দক্ষ ব্যক্তিরা বিদায় নিয়েছেন। বিধায়ক ভট্টাচার্য নেই, পরিচালনায় নরেশ মিত্রবা কানু বন্দ্যোপাধ্যায় নেই, আলোতে নেই তাপস সেন। সব একা রাসবিহারী। ফলও হলো ব্যর্থতা। সার্বিক ব্যর্থতা।
এবারে বিশ্বরূপায় নিয়ে আসা হলো তরুণ রায়কে। তরুণ রায় এতোদিন তার ‘থিয়েটার সেন্টার’ নাট্যদল নিয়ে নানাধরনের নাটক রচনা ও পরিচালনা করে খ্যাতিলাভ করেছেন। গ্রুপ থিয়েটারের তরুণ রায়কে (অন্য নাম ধনঞ্জয় বৈরাগী) দায়িত্ব দেওয়া হলো নাট্যকার ও পরিচালনার।
প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রের উপন্যাস ‘জব চার্ণকের বিবি’ অবলম্বনে নাট্যরূপ দিলেন তরুণ রায় (ধনঞ্জয় বৈরাগী), প্রতাপচন্দ্রের সহযোগিতায়। নাট্যরূপের নাম ‘রঙ্গিনী’। প্রথম অভিনয় হলো ২০ মে, ১৯৬৭। পরিচালনাও করেন তরুণ রায়। এই নাটকটিও সাফল্য লাভ করতে পারল না।
১৯৬৭-এর ১৫ আগস্ট ধনঞ্জয় বৈরাগীর নাটক ‘এক পেয়ালা কফি’ অভিনীত হয়। পরিচালনাও তারই (তরুণ রায় নামে)। ডিকেটটিভ কাহিনীর ধরনে এই নাটকে রহস্য, রোমাঞ্চ এবং সাসপেন্স—দর্শককে উৎকণ্ঠায় ভরিয়ে রাখতো।
অল্প কিছুদিন চলার পর নাটকটি বন্ধ করে এবারে নামানো হলো ‘আগন্তুক’। ৭ অক্টোবর, ১৯৬৭ প্রথম অভিনয়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহায়তায় ধনঞ্জয় বৈরাগীর নাটক ‘আগন্তুক’ তারই পরিচালনায় অভিনীত হলো। এই নাটকটি খুবই সাফল্য লাভ করে। অভিনয় ও প্রয়োগের কুশলতায় ‘আগন্তুক’ কৃতিত্ব অর্জন করে। প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে (ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ পর্যন্ত) নাটকটি ধারাবাহিক অভিনীত হয়।
রঙ্গিনী, এক পেয়ালা কফি, আগন্তুক—এই তিনটি নাটকেই মূলত তরুণ রায়ের নিজের নাট্যদল থিয়েটার সেন্টারের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অংশ গ্রহণ করে। গ্রুপ থিয়েটারের অভিনয়ের ধরন পেশাদার সাধারণ রঙ্গালয়ে নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা আরোপ করেছিল।
‘আগন্তুক’ নাটক চলাকালীনই থিয়েটারের স্বত্ত্বাধিকারী সরকার পরিবারে মৃত্যু ভাঙন-পৃথগন্ন ইত্যাদি কারণে বিশ্বরূপাতেও তার প্রভাব পড়লো। সরকারদের পারিবারিক ভাঙনের কারণে বিশ্বরূপা থিয়েটারের দায়দায়িত্ব সরকার পরিবারের যৌথ দায়িত্ব থেকে এবারে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে রাসবিহারী সরকার এককস্বত্ত্ব গ্রহণ করেন। থিয়েটারের ওপর পরিবারের সামগ্রিক দায়িত্ব আর রইলো না।
এর আগে যেমন সরকার পরিবারের তরফ থেকে দক্ষিণেশ্বর সরকার কিছুদিন বিশ্বরূপা থিয়েটার চালিয়েছিলেন। তাঁরই কর্তৃত্বে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল অভিনীত হয়েছিল ‘সি’ নাটক। নাট্যকার কিরণ মৈত্র। পরিচালনা—দক্ষিণেশ্বর সরকার। নাটকটি সেভাবে জনসম্বর্ধনা লাভ করেনি।
১৯৬৮-এর শেষের দিকে রাসবিহারী পুরোপুরি একক দায়িত্বে বিশ্বরূপা থিয়েটার চালাতে লাগলেন। প্রথমেই তিনি তরুণ রায় এবং তাঁর নাট্যদল থিয়েটার সেন্টারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করলেন।
রাসবিহারী সরকারের একক দায়িত্বে প্রযোজিত হলো ‘ঘর’ নাটক। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মেঘের ওপর প্রাসাদ’ উপন্যাস অবলম্বনে নাট্যরূপ ও পরিচালনা করলেন রাসবিহারী। প্রথম অভিনয় হলো ১৯৬৯-এর ৩ মার্চ। অভিনয়েও অংশ নিলেন প্রায় সব নতুন অভিনেতা—যারা এর আগে বিশ্বরূপার সঙ্গে তেমনভাবে যুক্ত ছিলেন না; একমাত্র কালী ব্যানার্জী ছাড়া। অনুপকুমার, স্বরূপ দত্ত, কণিকা মজুমজার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সর্বেন্দ্র প্রমুখেরা তখন অন্য মঞ্চ ও সিনেমার খ্যাতিমান শিল্পী। এঁরা ছাড়াও অভিনয় করলেন—গোবিন্দ গাঙ্গুলি, সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল ঘোষ, ইন্দ্রজিৎ সেন, তপন গাঙ্গুলি, উমানাথ চৌধুরী। মঞ্চ ও আলো—অমর ঘোষ। আবহ—কমল রায়চৌধুরী।
নাট্যকাহিনীর প্রশংসা হলেও নাট্যপ্রযোজনা ও অভিনয়ের তেমন খ্যাতিলাভ হলো না ।
এইভাবে খ্যাতিমান ঔপন্যাসিকের জনপ্রিয় উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে রাসবিহারী পরপর প্রযোজনা করে চললেন। অভিনীত হলো বিমল মিত্রের উপন্যাস ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’-এর নাট্যরূপ। নাট্যরূপ ও পরিচালনা রাসবিহারীর। প্রথম অভিনয় হলো ৪ জানুয়ারি, ১৯৭০।
এইভাবেই অভিনীত হলো সমরেশ বসুর সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস ‘কোথায় পাবো তারে’র নাট্যরূপ। নাট্যরূপ দিলেন রাসবিহারী নিজে এবং পরিচালনাও তাঁরই। প্রথম অভিনয় হলো ১ জানুয়ারি, ১৯৭১। নাটকটি সুপ্রযোজিত হলেও দর্শক আনুকূল্য লাভ করতে পারেনি।
‘চৌরঙ্গী’ নাটক অভিনয়ে আবার বিশ্বরূপার সাফল্য দেখা গেল। ১১১৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর শঙ্করের লেখা জনপ্রিয় উপন্যাসের নাট্যরূপ অভিনয়ের মাধ্যমে এবারে রাসবিহারীর প্রচেষ্টা সার্থক হলো। নাট্যরূপ ও পরিচালনা তারই। ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘদিন, প্রায় দুই বছর নাটকটি অভিনীত হলো। শেষ অভিনয় ১৯৭৩-এর ১ জুলাই।
‘চৌরঙ্গী’তেই প্রথম পেশাদারি মঞ্চে ক্যাবারে নৃত্যের ব্যবহার করে দর্শক আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রথমে থিয়েটারস্কোপে’র ‘স্টান্ট’ দিয়ে দর্শক আকর্ষণের প্রয়াস দেখা গিয়েছিল। এবারে হোটেলের ক্যাবারে নর্তকীদের থিয়েটারে নিয়ে এসে আবার এক লোক-বিনোদনের সস্তা এবং নাটক বহির্ভূত উপায় ব্যবহার করা হলো। ক্যাবারে নর্তকী ‘মিস শেফালী’ সেদিন নাটকের চেয়েও প্রচারের তুঙ্গে ছিলেন। টানা দুই বছর ‘চৌরঙ্গী’ নাটক একটানা অভিনয়-সাফল্যের পেছনে কাহিনী এবং নাট্যগুণের তুলনায় ক্যাবারে নৃত্যের আকর্ষণ হয়তো বেশি ছিল। বিকাশ রায় প্রমুখ খ্যাতিমান অভিনেতারা সেদিন ম্লান হয়ে গিয়েছিলেন মিস্ শেফালির দাপটে।
‘চৌরঙ্গী’র পর আসামী হাজির। কাহিনী বিমল মিত্রের। নাট্যরূপ—রাসবিহারী সরকার। প্রথম অভিনয়: ৫ জুলাই, ১৯৭৩।
অভিনয়ে ‘চৌরঙ্গী’র প্রায় সব অভিনেতা-অভিনেত্রী। বিকাশ রায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন মজুমদার, তরুণকুমার, অজয় গাঙ্গুলি, নির্মল ঘোষ, প্রমোদ গাঙ্গুলি, কণিকা মজুমদার, রুবি দত্ত, সৈকত পাকড়াশি, কিরণকুমার, মিস শেফালি। পরের দিকে পাহাড়ি সান্যাল, দিলীপ রায়, আরতি ভট্টাচার্য তংশগ্রহণ করেন। এই অভিনয়ের সময়েই পাহাড়ি সান্যালের মৃত্যু হয়। তার পরিবর্তে অভিনয়ে অংশ নেন পান্নালাল চট্টোপাধ্যায়।
ক্যাবারে নৃত্যের যে সূচনা ‘চৌরঙ্গী’তে হয়েছিল, তারই সার্থকতম রূপায়ণ হলো ‘আসামী হাজির’ নাটকে। বিজ্ঞাপনের ভাষা—‘চৌরঙ্গী’র চেয়েও সাড়া জাগানো, মন মাতানো বর্তমান বাংলা নাট্যমঞ্চের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার-পরিচালক রাসবিহারী সরকারের দুর্ধর্ষ প্রচেষ্টা আসামী হাজির।
আসামী হাজির প্রবলভাবে দর্শক আকর্ষণে সফল হলো। চৌরঙ্গী এবং আসামী হাজির-এর জনপ্রিয়তায় উৎসাহিত হয়ে রাসবিহারী আবার নতুন কোনো স্টান্ট ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছিলেন।
থিয়েটারে ক্যাবারে নৃত্য ব্যবহারের প্রচণ্ড সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে অন্যান্য কিছু থিয়েটার যেমন মিনার্ভা, রঙমহল, প্রতাপ মেমোরিয়াল কিংবা বয়েজ ওন লাইব্রেরির মঞ্চ তাদের নাটকে ক্যাবারে নর্তকীদের প্রবলভাবে ব্যবহার করতে লাগলেন। এইসব থিয়েটারে এই ধরনের নৃত্যরতা নর্তকীদের ভিড় বেড়েই চলেছিল। বলা যায়, এতোদিনের বাংলা থিয়েটারের সুস্থ সংস্কৃতির ঐতিহ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে সেদিন বাংলা পেশাদার খিয়েটারগুলির মধ্যে স্টার থিয়েটার পরিচ্ছন্ন নাট্যোপহার দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে প্রশংসাহঁই হয়েছিল। সেদিন সুস্থ সংস্কৃতির সপক্ষের মানুষজনের আন্দোলন থিয়েটারগুলিকে চরম বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করেছিল। ‘বস্ত্র বিপ্লবের’ যে আহ্বান বিশ্বরূপা জানিয়েছিল (তাদের বিজ্ঞাপনে নর্তকীর মঞ্চে এসে একে একে পরিধেয় সব বস্ত্র খুলে ফেলে শুধুমাত্র ‘বিকিনি’ ধারণ করে নৃত্যকে ‘বস্ত্রবিপ্লব’ বলা হচ্ছিল)। তা থেকে বাংলা থিয়েটাব উদ্ধার পেয়েছিল।
সে যাই হোক, ‘আসামী হাজির’ নাটকের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে রাসবিহারী এবারে পরপর বিমল মিত্রের উপন্যাস বেছে বেছে নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় করে চলেছেন। প্রথমে অভিনয় করলেন ‘পরস্ত্রী’ উপন্যাসের নাট্যরূপ। নাট্যরূপ ও পরিচালনা রাসবিহারী সরকার। প্রথম অভিনয়: ২ আগস্ট, ১৯৭৫। এই নাটকে রাসবিহারী আরেক নতুন ধরনের টেকনিক ব্যবহার করলেন। তার নাম দিলেন ‘স্পিডোস্কোপ’। নাটকের দৃশ্যান্তর দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য আলো না নিভিয়ে ঘূর্ণায়মান মঞ্চের সাহায্যে পরের দৃশ্যে নাটক চলে আসছিল। থিয়েটারস্কোপ-এও প্রায় এই পদ্ধতি ছিল। আবার বিজ্ঞাপন দিয়ে লোক টানবার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন রাসবিহারী।
তারপর ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ (২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬) জনগণমন (১২ জানুয়ারি, ১৯৭৮), সাহেব বিবি গোলাম (১৯৭৭), সব ঠিক হ্যায় (৪ অক্টোবর, ১৯৮০) অভিনয় করলেন। সব কয়টিই বিমল মিত্রের উপন্যাস। নাট্যরূপ ও পরিচালনা রাসবিহারীর। কিন্তু কোনো নাট্যরূপের অভিনয়ই সাফল্য লাভ করলো না। ‘সব ঠিক হ্যায়’ নাট্যাভিনয়ে আবার ‘স্পিড রিফ্লেকশান’ রীতি ব্যবহার করা হলো। এ-ও সেই থিয়েটারস্কোপ-এর পুরনো আঙ্গিক নতুন নামের চটকে বিজ্ঞাপিত হলো। কিন্তু তাতেও জনসমর্থন মিললো না।
তাই মাঝে বিমল মিত্র থেকে সরে এসে রাসবিহারী অভিনয় করলেন শরৎচন্দ্রের ‘দেনাপাওনা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ (৩১ মে, ১৯৭৯)। বিগত যুগেও বাংলা মঞ্চের দুর্দশার দিনে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ বাংলা থিয়েটারে সাফল্য এনে দিয়েছিল। এখানে দেনাপাওনা-ও ব্যর্থ হলো। নাট্যরূপ ও পরিচালনা রাসবিহারীর।
এবার দ্বারস্থ হলেন আশাপূর্ণা দেবীর জনপ্রিয় উপন্যাস ‘সুবর্ণলতা’র কাছে। নাট্যরূপ ও পরিচালনা রাসবিহারী। অভিনয় হলো ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭৯।
কিন্তু শুধু বিমল মিত্র কেন, কোনো ঔপন্যাসিকের কোনো জনপ্রিয় উপন্যাসের নাট্যরূপই সার্থক হলো না।
১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বরূপা মঞ্চে গ্রুপ থিয়েটার ‘বহুরূপী’ নাট্যসম্প্রদায় তাদের সার্থক প্রযোজনা ‘পুতুলখেলা’ এবং ‘রক্তকরবী’ নাটকের অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছিল নিয়মিতভাবে প্রতি মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায়। তা-ও শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। বহুরূপী তাদের প্রবল খ্যাতি সত্ত্বেও বিশ্বরূপার নিয়মিত দর্শকদের আকর্ষণ করতে পারেনি। তারা ব্যর্থ হয়ে এখানে অভিনয় বন্ধ করে দেয়। পরে অবশ্য তাদের নতুন নাটক ‘কাঞ্চনরঙ্গ’-এর প্রথম অভিনয় এখানে করেছিল বহুরূপী, ২৪ জানুয়ারি, ১৯৬১। মনে রাখতে হবে, বিশ্বরূপাতেই ‘বহুরূপী’র প্রধান অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র ‘সেতু’ সহ একাধিক নাটকে অভিনয় করে খ্যাতি বৃদ্ধি করেছিলেন।
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ১ ডিসেম্বর ‘বিশ্বরূপা’ থিয়েটার বিনা ভাড়ায় বহুরূপীকে তাদের ‘রক্তকরবী’ নাটক অভিনয় করতে দিয়েছিল। কেননা, বহুরূপী এই অভিনয় থেকে সংগৃহীত অর্থ প্রতিরক্ষা তহবিলে দিতে চেয়েছিল। তখন ভারত-চীনের যুদ্ধের নামে সীমান্ত সংঘর্ষ চলছিল। বহুরূপী সংগৃহীত অর্থ থেকে তিন হাজার টাকা দিয়েছিল। আবার অভিনেতা-নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীর সাহায্যার্থে বিশ্বরূপা নাট্যোন্নয়ন পরিকল্পনার অধীনে বহুরূপী এখানে ‘ছেঁড়া তার’ অভিনয় করেছিল।
পরপর ব্যর্থ হয়ে ক্রমাগত লোকসান দিয়ে রাসবিহারী হতোদ্যম হয়ে থিয়েটারের বাইরে নতুন পরিকল্পনা করলেন। থিয়েটারে নাটকাভিনয় পরিত্যাগ করে নেমে পড়লেন প্রোমোটারি ব্যবসায়। তাদের পারিবারিক ব্যবসার অন্যতম ছিল এই ব্যবসা। বিশ্বরূপা রঙ্গমঞ্চের লাগোয়া ফাঁকা জমিতে তিনি ফ্ল্যাটবাড়ি তুলে বিক্রি করার ব্যবস্থা করে ফেললেন। সেইমতো অগ্রিম টাকাও নিতে লাগলেন।
কিন্তু জানা গেল, থিয়েটারের স্বত্ত্ব তাঁর হলেও জমির মালিক তিনি নন। তাই মামলা শুরু হলো। থিয়েটারে লোকসান, অগ্রিম নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার তাগাদা এবং মামলা-মোকদ্দমায় জেরবার হয়ে রাসবিহারী শেষ পর্যন্ত থিয়েটার করা ছেড়ে দিলেন। তার এতোদিনের পরিকল্পনা, স্বপ্ন, উদ্যম এবং নেশা সব নিঃশেষ হয়ে গেল।
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি শুক্লা সেনগুপ্ত নামে একজন বিশ্বরূপার ‘লীজ’ নেন রাসবিহারীর কাছ থেকে।
শুক্লা সেনগুপ্ত উদ্যোগী হয়ে বিশ্বরূপায় সুস্থ রুচির নাটক প্রযোজনা শুরু করলেন। বিশ্বরূপায় এবার নতুন স্বত্ত্বাধিকারীর উদ্যোগে পরপর অভিনীত হলো স্বরলিপি, ফেরা, স্বীকারোক্তি, নীলকণ্ঠ।
মানতেই হবে, সেই সময়ে বিশ্বরূপা এবং তা দেখাদেখি অন্য মঞ্চগুলিতে যেভাবে ক্যাবারে নৃত্য এবং নায়িকার ‘বস্ত্রবিপ্লব’ দেখানো শুরু হয়েছিল, শুক্লা সেনগুপ্ত নিজের উদ্যোগে সেখানে সুস্থ রুচির নাটক অভিনয়ের চেষ্টা চালিয়ে যান। কুরুচির সস্তা বিনোদনকে দূরে ঠেলে দিয়ে তিনি সুস্থ রুচির থিয়েটারে মন দেন। এইভাবে তাঁর প্রযোজনায় স্বরলিপি, ফেরা বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। লোক সমাদর পেয়েছিল। (নাট্যচিন্তা: বর্ষ ২০। সংখ্যা ৭-১২)
তারপরে তিনি প্রযোজনা করেন ঘণ্টা ফটক, ভালো খারাপ মেয়ে। গ্রুপ থিয়েটারের নামী শিল্পী রমাপ্রসাদ বণিককে এনে নাটক দুটির প্রযোজনা করেছিলেন তিনি। তার কথায়—প্রোডাকশনের বিপুল খরচ মাথায় নিয়ে প্রথমদিকে মার খেলেও আমি হতোদ্যম হইনি। ‘ফেরা’-তেও প্রথমে লোক হয়নি, কিন্তু পরে হলো। বিপুল জনপ্রিয়তা পেল দুটি নাটকই। (যুগান্তর: ২৩ জুলাই, ১৯৮৯)
কিন্তু একক প্রচেষ্টায় এইভাবে পেশাদার থিয়েটার চালাতে গিয়ে শুক্লা ক্রমে ঋণভারে জড়িয়ে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন। বিশ্বরূপা তথা বাংলা পেশাদার থিয়েটারকে বাঁচাতে গিয়ে গৃহবধু শুক্লা সেনগুপ্ত শেষ অবধি নিজেকে শেষ করলেন। বিশ্বরূপাও রক্ষা পেল না। এ এক মর্মান্তিক প্রচেষ্টার ইতিহাস।
বিশ্বরূপার অভিনয় তারপর থেকে বন্ধই হয়ে পড়েছিল। ২০০১-এর ১৪ নভেম্বর, কালীপূজার দিনে রাত দুটোর সময় বিশ্বরূপা মঞ্চে আগুন লাগে।
আগে থেকেই এই থিয়েটার বন্ধ রেখে পেছনে বহুতল বাড়ি উঠছিল। পরিকল্পনা ছিল, মঞ্চটি ভেঙে ফেলে সেখানে ‘মার্কেট কমপ্লেক্স’ গড়ে উঠবে এবং সেখানেই একটি ৬০০ আসনের থিয়েটার হল তৈরি করা হবে। বর্তমান মালিক রাসবিহারী সরকারের কন্যা জয়ন্তী মিশ্র সেইভাবেই জানান।
কিন্তু তার আগেই বিশ্বরূপা থিয়েটার যেভাবে দাঁড়িয়েছিল, তা-ও আগুন লেগে ভস্মীভূত হয়ে গেল।
রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে বিশ্বরূপা থিয়েটারের অবদান
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বরূপা থিয়েটার যেমন নানাদিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য, তেমনি তার উজ্জ্বলতার মধ্যে বেশ কিছু পরিমাণে মালিন্যের কালিমার ছাপও রয়ে গেছে। গুণে-দোয়ে বিশ্বরূপা বাংলা পেশাদার থিয়েটারের ইতিহাসে অবশ্যই স্মরণীয়—
- বিভিন্ন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিকদের জনপ্রিয় উপন্যাসের নাটরূপ এখানে রীতিমতো অভিনীত হয়েছে। তার একটা ঐতিহ্য বাংলা থিয়েটারে ছিল। বিশ্বরূপা সেই ধারারই সার্থক পুনঃপ্রবর্তন করেছিল। এখানে শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিমল মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ বসুর রচিত কথাসাহিত্যের নাট্যরূপ ধারাবাহিক ও সাফল্যজনকভাবে অভিনয় করা।
- প্রযোজনার আঙ্গিকগত দিক দিয়ে নানা অভিনব প্রয়াস এখানে করা হয়েছিল। থিয়েটারস্কোপ, স্পিডোস্কোপ প্রভৃতি অভিনব নাট্যোপস্থাপনার প্রয়োগকৌশল এখানে ব্যবহৃত হয়েছিল। তাতে নাট্য প্রযোজনা কতো উন্নতমানের হয়েছিল কিংবা এদেশে নাট্য প্রয়োগের অগ্রগতিতে কতোটা সহায়ক হয়েছিল, তা নিয়ে মতান্তর থাকতেই পারে। কিন্তু গতানুগতিক সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রয়োগ প্রাধান্যকে গুরুত্ব না দিয়ে অভিনব এইসব কৌশল অবলম্বন করে সেদিন বিশ্বরূপা জনমনে নিঃসন্দেহে উদ্দীপনা ও উত্তেজনার সঞ্চার করেছিল। সিনেমা ও থিয়েটারের যুগ্ম কৌশলকে এইভাবে ব্যবহার করে নাট্যপ্রয়োগের যে সম্ভাবনা তারা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তা ব্যর্থ হলো। অন্য কোনো থিয়েটার এই পদ্ধতি সেভাবে ব্যবহার বা অনুসরণ করল না, বিশ্বরূপাও তার কোনো প্রযোজনায় এই নব ব্যবহৃত আঙ্গিকের সার্থকতর প্রয়োগ করে উঠতে পারলো না
- নাটকের প্রযোজনার চেয়েও দর্শককে বিষ্মিত-আকর্ষণের প্রচেষ্টা এখানে দেখা গেল, আলোর কারসাজির মধ্যে। আলোর কারুকৃতি দিয়ে দর্শকের মন ভোলানোর একটা প্রয়াস এখানে ছিল। গ্রুপ থিয়েটারের বিখ্যাত আলোকশিল্পী তাপস সেনকে নিয়ে আসা হয়েছিল এখানে অগ্রিম পাঁচশো টাকা এবং মাস মাইনে দেড়শো টাকার চুক্তিতে। ‘আরোগ্য নিকেতনে’ ব্রহ্মলোক, ব্রহ্মর আবির্ভাব, মৃত্যুর প্রতিমূর্তি নর্তকীর নৃত্য, প্রেতলোক ইত্যাদি আলোর কারিকুরিতে এমনভাবে দেখানো হলো যে, মূল নাটকের বাইরে এই চমক নানাভাবে আলোচিত হলো। ‘সেতু’ নাটকে ছুটন্ত ট্রেন মঞ্চে দেখিয়ে সেদিন হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল বিশ্বরূপা। দর্শক নাটকের চেয়েও আলোর এই ম্যাজিক দেখতেই বেশি ভিড় করেছিল। নাটকের চেয়ে তার আঙ্গিক কৌশল প্রাধান্য পেয়ে গেলে, তা নিঃসন্দেহে নাট্য প্রযোজনার ত্রুটি বলেই গণ্য হবে।
- দেহসর্বস্ব ক্যাবারে নৃত্য চালু করে বিশ্বরূপা যেভাবে নায়িকার বস্ত্রবিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিল তার মূল উদ্দেশ্যই ছিল নাট্যাতিরিক্ত অন্য কিছু দিয়ে দর্শকের মনকে আকর্ষণের চেষ্টা। মালিকের লাভালাভের পক্ষে তা সাফল্যজনক হলেও, বাংলা নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে তার কলঙ্কের দাগ কিন্তু রয়ে গেল। তারা যে বিকৃতরুচির প্রবর্তন করেন, পরে সেই ধারাই অন্য অনেক রঙ্গালয়ে প্রবর্তিত হয়ে বাংলা নাট্যাভিনয়কে নিম্নমানের করে তুলেছিল।
- তা সত্ত্বেও বিশ্বরূপার কিছু প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হবে। যেমন—
- বাংলা নাট্যোন্নয়নের নানা চেষ্টা তারা করেছিল। এর জন্যে জ্ঞানীগুণী মানুষজনদের নিয়ে পরিষদ তৈরি করে, তাদের উপদেশ গ্রহণ করে নানা উন্নয়ন মূলক কাজে তারা হাত দিয়েছিল। এর আগে সাধারণ রঙ্গালয়ের ইতিহাসে অন্য কোনো থিয়েটার এইভাবে এগিয়ে আসেনি। তাদের গৃহীত সব কর্মসূচিতে হয়তো তারা সফল হতে পারেনি, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টার মধ্যেই যে সৎ ও আন্তরিক প্রয়াস ছিল, তা কিন্তু নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য।
- শুধু তখনকার চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় ও খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বিশ্বরূপায় নিয়ে এসে অভিনয় করানো হয়েছিল তা-ই নয়, সেই সময়কার গ্রুপ থিয়েটারের শিল্পীদেরও পেশাদার থিয়েটারে এনে অভিনয় করানো হয়েছিল। তৃপ্তি মিত্র, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, অজয় গাঙ্গুলি, তরুণ মিত্র, নির্মল ঘোষ, গোবিন্দ গাঙ্গুলি, সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ রায়, দীপান্বিতা রায়, গঙ্গাপদ বসু, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, সাধনা রায়চৌধুরী, তমাল লাহিড়ী, মমতাজ আহমেদ প্রমুখ শিল্পীরা এখানে অভিনয় করেছিলেন। শুধু অভিনয়ে নয়, আলোকসম্পাতে তাপস সেন, রূপসজ্জায় শক্তি সেন—এদেরকেও বিশ্বরূপা গ্রুপ থিয়েটার থেকে নিয়ে এসে ব্যবহার করেছিল। ফলে, পেশাদার থিয়েটারের প্রচলিত অভিনয়ের রীতি ও মান অনেক পালটে গিয়েছিল। ভিন্ন অভিনয়রীতির উচ্চমান সেখানে তৈরি হয়েছিল। তেমনি এইসব শিল্পীর জনপ্রিয়তা ও জন আকর্ষণের ক্ষমতাকে বিশ্বরূপা ব্যবসায়িকভাবে কাজে লাগিয়েছিল।
- এদেশের যাত্রার উন্নয়নের চেষ্টা বিশ্বরূপা করেছিল। থিয়েটারের মঞ্চে যাত্রাদলকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে শহরবাসীর মনে যাত্রা সম্পর্কে নতুন করে উৎসাহ সৃষ্টি করিয়েছিল। যাত্রার পুনরুজ্জীবনের এই প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল।
- পূর্ণাঙ্গ নাটকের সঙ্গে সঙ্গে একাঙ্ক নাটকের প্রসারেও বিশ্বরূপা উদ্যোগ নিয়েছিল। বিভিন্ন শৌখিন দলকে নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে তাদের উৎসাহিত করার সঙ্গে সঙ্গে নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীর সম্ভাবনাও তারাও তৈরি করেছিল।
- নাট্য-উন্নয়নের প্রকল্পে বিশ্বরূপা একটি লাইব্রেরি চালু করেছিল। সেখানে নাট্যবিষয়ক এদেশ-বিদেশের গ্রন্থাদি রাখা হয়েছিল এবং উৎসাহী পাঠকগবেষকদের সেখানে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাংলার কোনো পেশাদার থিয়েটার কখনো এইভাবে নাট্যাভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নাট্যশিক্ষার প্রসারের ব্যবস্থা করেনি। বিশ্বরূপার এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
মহান প্রযোজক শিশিরকুমারের ‘শ্রীরঙ্গম’ রঙ্গমঞ্চ গ্রহণ করে সেখানে বিশ্বরূপা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রবল উদ্যোগ, উৎসাহ ও আন্তরিকতায় বিশ্বরূপা বাংলা নাট্যাভিনয় ও নাট্যোন্নয়নের প্রসারে উদ্যমী হয়েছিল। সেইভাবে তাদের কাজকর্ম প্রসারিত হচ্ছিল এবং নাট্যাভিনয়ে অগ্রগতির পথও সন্ধান করেছিল। থিয়েটারের ইতিহাসে সেইসব উদ্যোগ স্মরণ রাখতে হবে। আবার দর্শক আকর্ষণের যেসব জনমনোরঞ্জনী কৌশল তারা গ্রহণ করেছিল, তাতে নাট্যাভিনয়ের যে ক্ষতি হয়েছিল; তাও স্মরণ রাখতে হবে।
বিশ্বরূপা প্রতিষ্ঠার প্রায় সমসময়ে (১৯৫৯ থেকে) মিনার্ভা থিয়েটারে উৎপল দত্ত ও তাঁর নাট্য সম্প্রদায় লিটল থিয়েটার গ্রুপ নিয়ে বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ে প্রবলবেগে নাট্যাভিনয়ের যে জোয়ার এনেছিল; বিষয়বস্তু, ভাবনা, উপস্থাপনা এবং অভিনয়ের যে নতুনতর ও অসাধারণ উদ্দীপনা সঞ্চার করেছিল; বিশ্বরূপা তার থেকে অনেক দূরে ছিল। যদিও তারা বহুরূপী নাট্যদলকে দিয়ে সেখানে নাট্যাভিনয়ের একটা চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তা ফলবতী হয়নি। বিশ্বরূপা তার মতো করেই তার নাট্যাভিনয়ের আয়োজন করেছিল।
একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বিশ্বরূপা ভস্মীভূত হয়ে গেল। নতুন কোনো উদ্যম এখনো শুরু হয়নি।
Leave a Reply