//
//

রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে বাংলা নাটকের অবদান আলোচনা কর।

রঙ্গমঞ্চ ও নাটক

প্রশ্ন উঠতেই পারে যে নাটক পাঠ ও সমালোচনা করতে গেলে সেই নাটকটির অভিনয়কালীন নাট্যশালার পরিচয় জানার প্রয়োজনীয়তা কতোখানি? কিংবা প্রশ্ন হতে পারে যে, নাটক ও নাট্যশালার পারস্পরিক সম্পর্ক কতোখানি?

সাহিত্যশিল্পের অন্যসব শাখায় স্রষ্টা ও উপভোক্তার মধ্যে সম্পর্ক সরাসরি। উপন্যাস, ছোটগল্প, কাব্য, প্রবন্ধ—ইত্যাদি যাইহোক না কেন, তার সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক সোজাসুজি এবং স্পষ্টতর। কিন্তু লিখিত নাটক রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয়ে দর্শকের সামনে হাজির হয়। দর্শক অভিনয়ের মাধ্যমে সেই নাটকের রস উপভোগ করেন, আনন্দ লাভ করেন। নাটকের এই ‘থিয়েট্রিক্যাল ভ্যাল’ তার সবচেয়ে বড় সম্পদ। অবশ্য নাটকের ‘লিটারারি ভ্যাল’ নির্ণয়ের জন্য ‘রিডিং ড্রামা’ বলে নাটকের বিচার করা হয়। সাহিত্যের শিল্পগত বিচারে সেখানে নাটকের পাঠরূপের বিচার চলে। অভিনয় অর্থাৎ রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই। কিন্তু নাটক যেহেতু ‘মিশ্ৰশিল্প’ (কমপোজিট আর্ট) সেইহেতু নাটকের বিচার শুধুমাত্র সাহিত্যগত দিক দিয়ে করলেই তার বিচার সম্পূর্ণাঙ্গ হয় না।

নাট্যকার নাটক লেখেন, সেই লিখিত নাটক রঙ্গমঞ্চের মাধ্যমে দর্শকের সামনে হাজির হয়। আর নাটক অভিনীত হতে গেলেই, নির্দেশক, রঙ্গমঞ্চ, রঙ্গমঞ্চের নানা উপকরণ ও প্রস্তুতি, অভিনেতা-অভিনেত্রী—এসব কিছুর প্রয়োজন হয়। তাই লিখিত নাটক তার এক-তৃতীয়াংশ মাত্র। দুই-তৃতীয়াংশ রয়েছে নাট্য প্রযোজনার বিবিধ প্রস্তুতি ও সহযোগিতার মধ্যে। নাট্যকারের নাটক তৎকালীন মঞ্চব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে দর্শকের কাছে উপস্থিত হয়। তাহলে নাটক ও দর্শকের মাঝে থেকে যাচ্ছে মঞ্চব্যবস্থা। ‘মঞ্চব্যবস্থা’ কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। সংক্ষেপে ‘মঞ্চব্যবস্থা’ বলতে বোঝায়, সেই যুগের রঙ্গমঞ্চ (Stage), সেই রঙ্গমঞ্চের মধ্যে দৃশ্যসজ্জার বস্থা, রূপসজ্জা, সাজপোশাকের ব্যবস্থা, আলো ও তার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, সেট-সেটিংস, উইংস-এর ব্যবস্থা, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের যোগ্যতা ও প্রতিভা, মঞ্চাধ্যক্ষ তথা পরিচালকের নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, প্রযোজক বা অর্থলগ্নি করেন যে বা যারা তাদের মূলধন বিনিয়োগের প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা এবং সমকালীন দর্শক সম্প্রদায়ের নাট্যরস উপভোগের মানসিক অবস্থা—এইসব নিয়েই গড়ে ওঠে সেই সময়কার ‘মঞ্চব্যবস্থা’। নাটকটি নাট্যকার যখন লিখছেন এবং যে নাট্যমঞ্চের জন্য লিখছেন, তার মঞ্চব্যবস্থা জ্ঞান থাকলে, পরবর্তীকালেও সেই নাটকটি বিচারে সুবিধে হয়।

সাহিত্যগত দিক দিয়ে লেখা একটি নাট্য সমালোচনা গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে যশস্বী সমালোচক ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন— ‘‘নাটক সাহিত্য হইলেও তদতিরিক্ত আরও কিছু। ইহার সহিত দর্শকের রুচি-চাহিদা, রঙ্গমঞ্চের ব্যবস্থাপনা ও অভিনয়-কৌশল অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত। ইহাকে শুধু সমালোচনা কক্ষের নির্জনতায় সাহিত্যনীতির মানদণ্ডে বিচার করিলে চলিবে না—ইহাকে দর্শক-অভিনেতা-প্রযোজকের জনাকীর্ণ কোলাহল ও পরস্পরবিরোধী দাবির সামঞ্জস্য-সাধন-প্রক্রিয়ার মধ্যে স্থাপন করিয়া ইহার স্বরূপটি উপলব্ধি করিতে হইবে। নাটক যে রূপ লইয়া লেখকের সারস্বত মন্দির হইতে নিষ্ক্রান্ত হয়, দৃশ্যবিন্যাস সৌকর্য, অভিনয়ের সুবিধা ও দর্শকের সম্ভাবিত প্রক্রিয়ার দিকে লক্ষ্য রাখিয়া উপস্থাপনার পূর্বে তাহার বহু পরিমাণ কাট-ছাঁট ও অদলবদল হইয়া থাকে। প্রতিটি অভিনীত নাটকের উপর প্রেক্ষালয়পরিমণ্ডলের একটা বিশেষ প্রভাব থাকে, যাহা দ্বারা নাটকে শেষ রূপটি নির্ণীত হয়।…আমাদের সাধারণ নাট্য-সমালোচনা এই প্রেক্ষালয়, রহস্যের কোনও খোঁজ-খবর রাখে না।’’

নাটক বিচারে তাই অবশ্যম্ভাবিতরূপে ‘প্রেক্ষালয়-পরিমণ্ডল’ বা ‘মঞ্চ ব্যবস্থার পরিচয় জানতে হয়। না জানা থাকলে, সেই নাটকের বিচার স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় না।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই এদেশে রঙ্গালয় ও নাটক পারস্পরিক সম্পর্কায়িত হয়েই এগিয়ে চলেছে। লেবেডেফকে সমকালীন মঞ্চব্যবস্থা এবং বিশেষ করে অভিনেতা-অভিনেত্রী ও দর্শকদের কথা বিচার করেই নাট্যরূপ অভিনয়ের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। ধনী বাঙালির বাড়ির সখের নাট্যশালাগুলি প্রাসাদ-মঞ্চের জৌলুষ, জাঁকজমক এবং অভিজাত হিন্দু জাতীয়তার প্রকাশের বাহন ছিল বলে, সেই নাট্যশালাগুলির পরিমণ্ডলে যেসব নাট্যকার নাটক রচনা করেছেন, তাঁরা তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছেন। অল্প ইংরেজি নাটকের অনুবাদ, অজস্র সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ এবং বেশ কিছু প্রহসন রচনা এই পরিমণ্ডলের প্রভাবজাত। নাটক রচনায় নিযুক্ত নাট্যকার কতোখানি সেই রঙ্গমঞ্চের প্রভাবাধীন হয়ে পড়েন তার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ মধুসূদন। বেলগাছিয়া নাট্যশালার ডাকেই মধুসূদনের বাংলায় নাট্যজীবন তথা সাহিত্য জীবনের শুরু। তার স্ফূরণ ও বিস্তার এই ধনী বাঙালির সখের নাট্যশালাতেই। আবার এই নাট্যশালার, মালিক ও তার সহগামীদের ভাবনা, বেলগাছিয়া মঞ্চে পূর্ব অভিনীত ‘রত্নাবলী’ নাটকের দৃশ্যপট ও সাজসজ্জা এবং অভিনেতাদের সংখ্যা ও কৃতিত্বের দিকে সমান নজর রেখেই মধুসূদনকে ‘শর্মিষ্ঠা’ লিখতে হয়েছে। তাই পাশ্চাত্য অনুগামী ভাবনায় নাট্যরচনা শুরু করলেও, ইউরোপীয় ভাবনায় ভাবিত মানুষজনের জন্য নাটক লেখার স্পর্ধা প্রকাশ করলেও, ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকটি কিন্তু পুরোপুরি সংস্কৃত নাটকের প্রভাবজাত, বিশেষ করে ‘রত্নাবলী’ প্রভাবজাত। ভাব, চরিত্রসৃষ্টি, সংলাপ ও পরোক্ষ নাট্যঘটনা বর্ণনায় ‘শর্মিষ্ঠা’ একেবারেই সংস্কৃত নাট্যানুসারী। পাশ্চাত্যভাবিত মধুসূদন ‘হিন্দুত্ব’’ ভাবনার নাট্যশালার জন্যে ‘হিন্দু-ড্রামা’’ লিখলেন। যেই অন্য ভাবনার নাটক লিখেছেন অমনি বেলগাছিয়া নাট্যশালা সেগুলির অভিনয় করেনি। নাট্যকার হিসেবে মধুসূদনের আক্ষেপ সকলের জানা। বেলগাছিয়া নাট্যশালা মধুসূদনের নাট্যজীবনের সিদ্ধি ও সীমাবদ্ধতাব প্রেক্ষালয় পরিমণ্ডল। তাকে অস্বীকার করে মধুসূদনের নাটকের বিচার সম্ভব নয়। কাব্যের ক্ষেত্রে মধুসূদন স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং তার প্রকাশও অন্য নিরপেক্ষ। কিন্তু নাটকের ক্ষেত্রে তিনি ‘মঞ্চব্যবস্থা’র অধীন হয়ে পড়েছেন।

সাধারণ রঙ্গালয়ের যুগে বাংলা নাট্যশালা ক্রমে ব্যবসায়িক ও পেশাদার প্রথায় চালিত হয়েছে। প্রযোজক অর্থলগ্নী করে মুনাফার আশায়। তাই এই যুগে কমার্শিয়াল থিয়েটারের উদ্দেশ্য ও আদর্শেই বাংলা থিয়েটার চলেছে। নাট্য রচনা ও অভিনয়ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এই প্রথায়। সেখানে দর্শক ‘লক্ষ্মী’—লক্ষ্মীকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে শিল্পের ‘সরস্বতী’কে প্রয়োজনে বিসর্জন দিতেও কেউ কুণ্ঠা করেননি। তাদের কাছে একটি নাটকের মঞ্চ-সাফল্যের মূল বিচারই হচ্ছে তার দর্শক আকর্ষণের ক্ষমতা কতোখানি তার ওপর।

ধনীর প্রাসাদে সখের নাট্যশালার দর্শক ছিল নিমন্ত্রিত, তাই নিয়ন্ত্রিত মঞ্চ মালিকের রস রুচির পরিপূরক। সাধারণ রঙ্গালয়ের যুগে সর্বাধারণের প্রবেশমূল্য দিয়ে প্রবেশাধিকারের যুগে দর্শক অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, রুচিশীল ও রুচিহীন, হাল্কা আমোদে প্রমত্ত কিংবা গভীর রসাত্মক নাট্য আস্বাদনে বিভোর, সব শ্রেণীর দর্শকই সাধারণ রঙ্গালয়ে এসেছে। ফলে নানাজাতীয় ভাবাস্বাদনের নাটক তখন লেখা হয়েছে। সেই সময়ে জাতীয় ভাবোদ্দীপনামূলক নাটকও লেখা হয়েছে। নীলদর্পণ ১৮৬০-এ লেখা হলেও, ধনী বাঙালির মঞ্চে অভিনীত হয়নি, তাদের শ্রেণী চরিত্রের জন্যই। আবার ১৮৭২-এ ন্যাশনাল থিয়েটার উদ্বোধনের নাটক হয়েছে ‘নীলদর্পণ’—উদ্যোক্তাদের শ্রেণী-চরিত্রের জন্যই।

১৮৭৩-এ মঞ্চে পাকাপাকিভাবে অভিনেত্রী গ্রহণের ফলে নানা তিক্ততার সৃষ্টি হয়। বারাঙ্গনা পল্লী থেকে আনা এইসব অভিনেত্রীর জন্য রঙ্গমঞ্চ একেবারে অপবিত্র ও দুষিত হয়ে পড়েছে—এমন ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। ফলে শিক্ষিত রুচিশীল দর্শক রঙ্গমঞ্চ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সেখানে ক্রমে ভীড় বাড়িয়েছে সাধারণ দর্শক—যার মধ্যে তৎকালীন বাবু সম্প্রদায়ের বেশ কিছু লোক—যাদের পয়সা রয়েছে, নাটক যাদের কাছে আমোদ স্ফূর্তির জায়গা। আর রয়েছে সাধারণ বাঙালি, যাত্রারসে পুষ্ট, ঐতিহ্যলালিত এবং ভাব ও আবেগে তাড়িত, ধর্মাশ্রয়ী ও আনন্দলাভেচ্ছু। পরে এসেছে মহিলা দর্শক। যারা দুঃখবেদনা-হাসিকান্নায় বিভোর, ধর্মবোধে দেবদেবীর অলৌকিকতায় বিশ্বাসী ও ভক্তিভাবে আপ্লুত।

এই অবস্থায় ১৮৭৬-য়ের ‘অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন’ বাংলা নাট্যশালার স্বাধীন ভাবনাকে আরো নিয়ন্ত্রিত করে দিল। ব্রিটিশ-বিরোধী কোনো নাটকেরই মঞ্চে অভিনয়ের অনুমতি রইলো না। বরং রইলো শাস্তি জরিমানার ভয়। বাংলা নাট্যশালা থেকে অচিরাৎ জাতীয় ভাবোদ্দীপক ও স্বদেশানুরাগের নাটক লেখা ও অভিনয় বন্ধ হয়ে গেল। তারপর থেকে ব্যবসায়িক রঙ্গমঞ্চ তার দর্শক সম্প্রদায়ের কথা মাথায় রেখে অবিরত প্রযোজনা করে চলল তাদের মানস উপযোগী নাটক-গীতিনাট্য-প্রহসন-পঞ্চরং। গীতাভিনয় যাত্রার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অভিনীত হলো অজস্র গীতিনাট্য অপেরা। ধর্মাশ্রয়ী দর্শকের জন্য প্রযোজিত হলো পৌরাণিক বিষয়বস্তু নিয়ে দেববাদ ও ভক্তিবাদের নাটক। সুখ-দুঃখ ব্যথা-বেদনার কথা বলতে গিয়ে লিখিত হলো অজস্র সামাজিক বিষয়ের নাটক। কৌতুক ব্যঙ্গ ও কেচ্ছার জন্য লেখা হলো অপরিমিত নক্সা-প্রহসন। বাংলা নাটকের সম্ভার এতেই ভরে উঠলো। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের জন-আন্দোলনের জোয়ারে মঞ্চগুলি আবার স্বদেশপ্রেম ও জাতীয় ভাবানুরাগের দিকে নজর দিল। আইন উপেক্ষা করেও সেই জাতীয় নাটক অভিনয় শুরু হলো। গিরিশ, ক্ষীরোদপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল—তাদের ঐতিহাসিক নাটকগুলিতে এই সময়কার ভাবনা, জাতীয়তাবোধ, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি ও স্বাধীনতার জয়গান গাইলেন।

গিরিশচন্দ্রের শতাধিক নাটকের মধ্যে অর্ধেকই হচ্ছে গীতিনাট্য অপেরা এবং নক্সা-প্রহসন। তাছাড়া নানা উৎসব-অনুষ্ঠানের জন্য লেখা তাৎক্ষণিক নাটিকা। যেমন বড়দিন, দুর্গাপূজা, দোল, জন্মাষ্টমী ইত্যাদি। এরকম নাটক সেই-সময়কার সব নাট্যকারের, যেমন অমৃতলাল বসু, অতুলকৃষ্ণ মিত্র, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, রাজকৃষ্ণ রায় প্রমুখর লেখাতেই রয়েছে। গীতিনাট্য ছাড়াও অন্য নাটকেও অজস্র গান এবং আনুষঙ্গিক নাচ রয়েছে। সামাজিক-পৌরাণিক নাটকগুলিতেই বেশি করে রয়েছে। বোঝা যায় যাত্রারসপুষ্ট দর্শককে টেনে আনার ও খুশি রাখার প্রয়াস রয়েছে এখানে। তাছাড়া এমনি, বাঙালি গান শুনতে ভালবাসে। নাটকে গানের সংখ্যা তাই মাত্রা ছাড়িয়েছে।

সারারাত ধরে অভিনয় চালানো হতো বলে, তখনকার নাটকগুলি ছিল আকারে বড়ো। বহু চরিত্র, গান, নাচ ইত্যাদিতে ভরা। তারপরে দৃশ্য-পরিবর্তনে সময় লাগত বেশি। তাই অঙ্কভাগের সাথে দৃশ্যবিভাগ রাখা হতো কম। এইভাবে রাত সাড়ে আটটা ন’টায় অভিনয় শুরু হয়ে ভোর রাতে নাটক শেষ করতে হত। তাই তখনকার নাটক ছিল বৃহদায়তন। পরে বৃহদায়তন নাটকের অভাব মেটানো হতো, একই রাতে একাধিক নাটক-গীতিনাট্য-প্রহসন নক্সার অভিনয় করে। কলকাতা কর্পোরেশন ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে আইন করল, রাত একটার পর নাটক অভিনয় করলে মঞ্চমালিককে পঁচিশ টাকা বা ততোধিক জরিমানা দিতে হবে। শিবরাত্রি, জন্মাষ্টমী, দোল-দুর্গোৎসব উপলক্ষে সারারাত অভিনয়ের জন্য নিয়ম শিথিল করা হতো। অমরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম শুরু করলো, পরে অন্য মঞ্চ মালিকেরাও পঁচিশ টাকা জরিমানা দিয়েও ভোররাত পর্যন্ত নাটক চালিয়ে যেতে লাগলেন। দর্শকের সুবিধে এবং ব্যবসার লাভ এইভাবে নাটককে দীর্ঘাকার করে রেখেছে। যুগীয় পরিবর্তন, সভ্যতার বিস্তার, যানবাহনের সুবিধে, কলকাতার বাইরের বহু মানুষের নিত্য কলকাতা যাতায়াত—সব মিলিয়ে নাটকাভিনয়কে সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার নাটক ছোট হতে হতে আড়াই ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় শুরু করে রাত নয়টায় নাটক শেষ না করলে দর্শকের অসুবিধে। এখন নাট্যকারেরা গিরিশযুগের মতো পাঁচ অঙ্কের দীর্ঘ নাটক লেখেন না, এখন নাটক হয়েছে বিরতির আগে ও পরে ঘণ্টাখানেক ধরে দৃশ্যবিস্তারে তৈরি।

এইভাবে মঞ্চব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই সমকালীন নাট্যরচনা ও নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রিত হয়। মঞ্চের সঙ্গে চুক্তিতে, অর্থে, বা অন্য যেভাবেই হোক, যুক্ত থেকে যারা নাটক রচনা করেন, ইংরেজিতে তাদের ‘প্লে-রাইট’ (Play-wiight) বলে। বাংলায় বেশীরভাগ নাট্যকারই প্লে-রাইট। সে অর্থে মধুসুদনও প্লে রাইট। গিরিশ এবং অন্যেরা তো বটেই। দীনবন্ধু কোনো মঞ্চের সঙ্গে ওতপ্রোতযুক্ত থেকে নাটক লেখেননি, তবে ধনীর আওতা থেকে নাটককে মুক্তি দিয়ে যখন মধ্যবিত্তের সাধারণ রঙ্গালয় হলো তখন দীনবন্ধুর নাটকগুলিই সবচেয়ে আদৃত হয়েছে। শুধু কাহিনী বা নাট্যগুণ নয়, এইসব নাটকে দৃশ্যসজ্জা সাধারণ, সাজসজ্জা ও পোষাক-পরিচ্ছদ সাধারণ—সেটাও স্বল্পবিত্তের উদ্যোক্তাদের পক্ষে দীনবন্ধুর নাটক গ্রহণের বড়ো কারণ। পরবর্তীকালে গিরিশ একথা স্বীকারও করেছেন, ‘শাস্তি কি শান্তি’ নাটকের ভূমিকায়। দ্বিজেন্দ্রলাল পেশাগতভাবে যুক্ত না থাকলেও কার্যগতভাবে সমকালীন মঞ্চগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং তিনি তাঁর সময়ে আদত নাট্যকার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে সাধারণ রঙ্গালয়ে বেশ আদৃত হয়েছিলেন তাঁর ‘রাজা ও রানী’ এবং ‘রাজা বসন্ত রায়’ (‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসের) নাট্যরূপ-এর জন্য। তখন তিনি এই মঞ্চের উপযোগী নাট্যরচনায় ব্রতী ছিলেন। পরে শান্তিনিকেতন পর্ব থেকে তাঁর যে নতুন নাট্যভাবনা ও নাট্যরচনার শুরু সেখানেও তাঁর নিজস্ব থিয়েটারভাবনা ও মঞ্চভাবনা কার্যকরী হয়েছে। পরবর্তীকালে সাধারণ রঙ্গালয় তার বেশ কয়েকটি নাটক এবং গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপ অভিনয় করেছে। তখন তিনি মঞ্চের প্রয়োজনে তাঁর অনেক নাটকের পরিবর্তন করেছেন, গান সংযোজন করেছেন, দৃশ্যপরিবর্তন ও চরিত্রসৃষ্টি করেছেন। আগের লেখা বেশ কয়েকটি নাটকও তিনি পরবর্তীকালে ‘মঞ্চোপযোগী’ ও ‘অভিনয়োপযোগী’ করে তোলবার জন্য কাটছাঁট করে নতুনভাবে লিখেছেন। ১৯২৯-এর রূপান্তরিত ‘তপতী’ নাটকে তাঁর নিজস্ব থিয়েটারের মঞ্চভাবনা এবং সাধারণ রঙ্গালয়ের দৃশ্যপট-ভাবনা সমান্তরালভাবে কাজ করেছে। ভূমিকায় মঞ্চবাহুল্য তুলে দেবার কথা বলছেন এবং নাটকে দৃশ্যের পর দৃশ্যে দৃশ্যপটের বিবরণ দিয়েছেন। বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনই নাটক রচনা করেছেন কোনো-না-কোনো থিয়েটারের কথা মাথায় রেখেই। সে তাঁর নিজের থিয়েটার হোক, কি অন্য কারো। সেইভাবেই তার নাটকের ভাব, ভাবনা, উপস্থাপনা, চরিত্র, সংলাপ, গান অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।

মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত নাট্যকারই (দু’একজন ব্যতিক্রম) তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন এই প্লে-রাইটের দায়িত্ব পালন করেই। অদ্ভুত হলেও সত্য যে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নাটকগুলি এই প্লে-রাইটদেরই রচনা। আবার প্লে রাইটের কাজ করতে গিয়ে যুগে যুগে দেশে দেশে অসংখ্য নাট্যকার নিঃশেষ হয়ে গেছেন। প্লে-রাইটের এখানেই সীমা ও সিদ্ধি। প্লে-রাইটার হিসেবে নাট্যজীবন শুরু করে শেক্সপীয়র সর্বযুগের নাট্যকারদের আদর্শ হতে পেরেছেন। এইভাবে অনেকেই সীমাবদ্ধতার মধ্যে কালোত্তীর্ণ হয়েছেন।

প্রখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ’-এর কাছে তাঁর প্রিয় শিষ্য উইলিয়াম আর্চার জানতে চান, শ-য়ের জীবনে নাট্যরচনার মূল প্রেরণা কি? উত্তরে শ’ শিষ্যকে একটি চিঠিতে লেখেন—‘‘I have to think of my pocket, of the manager’s pocket, of the spectator’s pocket. It is these factors that decide the playwright’s method leaving him so little room for selection.’’—এই সুরসিক মন্তব্যের পেছনে রয়েছে প্লে-রাইটের তীক্ষ ও স্পষ্ট স্বীকারোক্তি। শ’ তাঁর ‘The Three Unpleasant Plavs’-এর ভূমিকাতেও নাট্যরচনার পেছনে রঙ্গালয়ের মঞ্চব্যবস্থার তাগিদের কথা বলেছেন।

Performing Art বিষয়ে ফরাসি নাট্যকার ও পরিচালক-অভিনেতা মলিয়ের বলেছেন—‘‘Speaking generally, I would place considerable reliance on the applause of the pit.’’

ইংলন্ডের ডুরিলেন থিয়েটারের উদ্বোধনী ভাষণে (১৭৪৭) নাট্যকার স্যামুয়েল জনসন ঘোষণা করেছিলেন যে, নাটকের কানুন তৈরি করে মঞ্চের মালিক। আবার রঙ্গমঞ্চও দর্শকের ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হয়। এবং নাট্যকারের বাঁচবার তাগিদে এদের খুশি করেই চলতে হয়।

এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে সব নাটক রচয়িতাই কি মহাভারতের অভিমন্যুর মতো মঞ্চব্যবস্থার চক্রব্যূহে প্রবেশ করে নিজেদের উৎসর্গ করে দেবেন? তা নয়। কেউ কেউ অর্জনের মতো চক্রব্যূহে প্রবেশ করে, তারপরে বিজয়ী বীরের উল্লাসে নিরাপদে বেরিয়ে এসে যুদ্ধ জয় নিশ্চিত করেন। যেমন শেক্সপীয়র, যেমন মলিয়ের, বার্নার্ড শ’, ইবসেন, আর্থার মিলার। যেমন সফোক্লিস, ইউরিপিডিস। এখানে যেমন মধুসূদন, দীনবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, গিরিশচন্দ্র, কিংবা আধুনিক কালের উৎপল দত্ত।

যথার্থ প্লে-রাইট তাই সমসাময়িক যুগের চিন্তা ভাবনা, তদানীন্তন রঙ্গমঞ্চের বিধিব্যবস্থা, সে যুগের ‘ক্রেজ’—এসব কিছুকেই তার নাটকে গ্রহণ করেন। সমকালীন মঞ্চব্যবস্থাকে মেনে না নিলে তিনি বাতিল হয়ে যাবেন। কিন্তু এসব কিছুর মধ্যে থেকেও দর্শকের নাট্যবোধ ও চিন্তা গড়ে তোলার দায়িত্ব তাঁকে নিতে হয়। জানা জগতের ভাবনার মধ্যে শুধুই ঘুরপাক না খেয়ে সতর্ক মুহূর্তে নাট্যকার দর্শককে নতুন ভাবনার তীরে নিয়ে গিয়ে হাজির করেন। এবার নাট্যকারের চিন্তায় দর্শক নিজেকে তৈরি করতে থাকে। এই যে দর্শকের কাছে ধরা দিয়েও তাদের দূর জগতের ভাবনার অজানা, অশ্রুত সুর শুনিয়ে দেওয়া, এইখানেই শক্তিশালী নাটক রচয়িতার কৃতিত্ব। প্রখ্যাত ব্রিটিশ নাট্যসমালোচক এলারডাইস নিকল এই সম্পর্কে যথাযথ উক্তি করেছেন— ‘‘…the really strong playwright is the man who is in tune with the audience, but who may perhaps desire to play some melodies for the reception of which the audience is nearly, but not quite ready’’. (World Drama)

একটি নাটক বিচার করতে হলে, তাই প্রথমেই জানতে হয় তার নাট্যকার কে? তিনি কোন যুগে কোন ধরনের নাট্যশালার সঙ্গে কীভাবে যুক্ত ছিলেন। সেই যুগের রঙ্গালয়ের বিধিব্যবস্থা কেমন ছিল, এবং ‘মঞ্চব্যবস্থা’ কোন অবস্থানে ছিল ও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল কীভাবে? সে যুগের নাট্যশালার পরিচয় এইভাবে জানা থাকলে, সেই নাট্যকার এবং তার নাটকের যথার্থ বিচার সম্ভব হয়। কোন পরিস্থিতিতে এবং কেন এইরকম সব লিখতে হয়েছিল, ত্রুটিগুলির মৌলিক কারণ কী এবং সেই মঞ্চব্যবস্থা অতিক্রম করে অনাগতকালের ভাবী সম্ভাবনার দ্বারোদঘাটন কীভাবে নাটকে হচ্ছে তা বুঝে নেওয়া যায়। শেক্সপীয়র তাঁর যুগীয় ‘মঞ্চব্যবস্থা’র গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ, তাঁর নাটকের বহু অংশই তাঁর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু তাতে তিনি হারিয়ে যাননি। এই গণ্ডীর মধ্যে থেকেই তিনি চিরকালীন মানবসভ্যতার সব প্রকৃতি ও প্রবৃত্তিকে লিপিবদ্ধ করে নাটককে কালজয়ী করেছেন। রাজাসন থেকে নেমে এসে নয়, রাজসিংহাসনে বসেই তিনি জনতার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!