//
//

বিশ্বসাহিত্য প্রবন্ধের মূল ভাববস্তু ব্যাখ্যা কর।

  • জগতে সত্যের সঙ্গে আমাদের এই যে যোগ ইহা তিন প্রকারের। বুদ্ধির যোগ, প্রয়োজনের যোগ, আর আনন্দের যোগ।
  • যেখানে মানবের ধর্ম সমুজ্জ্বল হইয়া পূর্ণসুন্দররূপে সবলে নিজেকে প্রকাশ করে সেখানে বড়ো আনন্দ। সেখানে আমরা আপনাকেই বড়ো করিয়া পাই। ‘বিশ্বসাহিত্য’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যদুটি বিচার কর।

উপনিষদের কবি রবীন্দ্রনাথ ‘বিশ্বসাহিত্য’ প্রবন্ধে শুধু বিশ্বসাহিত্যের কথাই বলেননি, সেই সঙ্গে উপনিষদের সত্য উচ্চারণের পাশাপাশি বিশ্ববোধের প্রসঙ্গটিও আলোচনা করে নিয়েছেন। সূচনাতেই বলেছেন আমাদের অন্তঃকরণে যত কিছু বৃত্তি আছে, সে কেবল সকলের সঙ্গে যোগস্থাপনের জন্য। এই যোগের দ্বারাই আমরা সত্য হই, সত্যকে পাই। নহিলে আমি আছি বা কিছু আছে, ইহার অর্থই থাকে না। অর্থাৎ জগতের সত্যের সঙ্গে আমাদের যে যোগ ঘটে তা তিনভাবে ঘটে—বুদ্ধির যোগ, প্রয়োজনের এবং আনন্দের যোগ। শুধু তাই নয় সর্বজনীন সর্বকালীন মানবের কথা বলতে গিয়ে কবি তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে বলেছেন আমাদের অন্তরে কে আছেন যিনি মানব অথচ যিনি ব্যক্তিগত মানবকে অতিক্রম করে সদা জানানং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ। তিনি সর্বজনীন সর্বকালীন মানব। তাঁরই আকর্ষণে মানুষের চিন্তায় ভাবে কর্মে সর্বজনীনতার আবির্ভাব।… সেই মানুষের উপলদ্ধিতেই মানুষ আপন জীবসীমা অতিক্রম করে মানবসীমায় উত্তীর্ণ হয়। সেই মানুষের উপলদ্ধি সর্বত্র সমান নয় ও অনেক স্থলে বিকৃত, বিকৃত বলেই সব মানুষ আজও মানুষ হয়নি। কিন্তু তাঁর আকর্ষণ নিয়ত মানুষের অন্তর থেকে কাজ করছে বলেই আত্মপ্রকাশের প্রত্যাশায় ও প্রয়াসে মানুষ কোথাও সীমাকে স্বীকার করছে না।

জগতে সত্যের পাশাপাশি বিশ্ববোধের প্রসঙ্গটিও আলোচ্য প্রবন্ধে বারেবারে উচ্চারিত হয়েছে। এর সঙ্গেও আছে বুদ্ধির যোগ, প্রয়োজনের যোগ এবং আনন্দের যোগ। শান্তিনিকেতনের রাখি উৎসব সম্পর্কে কবি তাঁর নির্দেশ অজিতকুমার চক্রবর্তীকে এক পত্রে লিখে বলেছেন—“তোমাদের আশ্রমে তোমাদের রাখি বন্ধনের দিনকে খুব একটা বড়োদিন করে তুলো। বড়োদিন মানে প্রেমের দিন, মিলনের দিন—যে-প্রেমে যে মিলনে ভারতের সকলেই আহূত, ভারতবর্ষের যজ্ঞক্ষেত্রে আজ বিধাতা যাদের নিমন্ত্রণ করে এনেছেন আমরা তাদের কাউকে শত্রু বলে দূরে ফেলতে পারবো না।….বঙ্গবিভাগের বিরোধক্ষেত্রে এই যে রাখি বন্ধনের দিনের অভ্যুদয় হয়েছে এর অখণ্ড আলোক এস ক্ষেত্রকে অতিক্রম করে সমস্ত ভারতের মিলনের সুপ্রভাতরূপে পরিণত হোক। তাহলেই এই দিনটি ভারতের বড়োদিন হবে। তাহলেই এই বড়োদিনে বুদ্ধ খৃষ্ট মহম্মদের মিলন হবে। ….যা শ্রেষ্ঠ, যা মহত্মম, যা সত্যতম তার থেকে লক্ষ্য কোনো কারণেই কোনোমতেই ফেরাতে দিয়ো না।

যে তিন প্রকার যোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার প্রথম হলো বুদ্ধির যোগ। কবির মতে এই বুদ্ধির যোগ একধরনের প্রতিযোগিতা। সে যেন ব্যাধের সঙ্গে শিকারের যোগ। সত্যকে বুদ্ধি যেন প্রতিপক্ষের মতো নিজের রচিত একটি কাঠ গড়ায় দাঁড় করিয়ে জেরা করে করে তার পেটের কথা একটু একটু করে বের করে আনে। এইজন্য সত্যি সম্বন্ধে বুদ্ধির একটা অহংকার থেকে যায়। সে যে পরিমাণে সত্যকে জানে সেই পরিমাণে আপনার শক্তিকে অনুভব করে। পরবর্তী হল প্রয়োজনের যোগ। এই প্রয়োজনের অথাৎ কাজের যোগে সত্যের সংগে আমাদের শক্তির একটা সহযোগিতা জন্মে। এই গরজের সম্পর্কে সত্য আরো বেশি করে আমাদের কাছে আসে। কিন্তু তবু তার সংগে আমাদের পার্থক্য ঘোচে না। ইংরেজ সওদাগর যেমন একদিন নবারের কাছে মাথা নিচু করে ভেট দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করে নিয়ে, শেষে নিজেই একদিন সিংহাসনে চড়ে বসেছে, তেমনি সত্যকে ব্যবহারে লাগিয়ে কাজ উদ্ধার করে শেষে মনে করি, আমরাই যেন জগতের বাদশাগিরি পেয়েছি। তখন আমরা গর্বের্ধত ভঙ্গিতে বলি, প্রকৃতি আমাদের দাসী, জলবায়ু অগ্নি আমাদের বিনা মাইনের চাকর। সবশেষে আনন্দের যোগ। এই আনন্দের যোগেই সমস্ত পার্থক্য ঘুচে যায়, সেখানে আর কোন অহংকার থাকে না, সেখানে নিতান্ত ক্ষুদ্রের কাছে দুর্বলের কাছে নিজেকে একেবারে সঁপে দিতে, আমাদের বাধে না। সেখানে মথুরার রাজা বৃন্দাবনের গোয়ালিনীর কাছে আপন রাজমর্যাদা লুকোবার আর পথ পায় না। যেখানে আমাদের আনন্দের যোগ সেখানে আমাদের বুদ্ধির শক্তিকেও অনুভব করি না, ধর্মের শক্তিকেও অনুভব করিনা, সেখানে কেবল নিজেকেই অনুভব করি, মাঝে কোনো আড়াল বা হিসেব থাকে না।

এখন প্রশ্ন এই আনন্দের যোগ কী? না, পরকে আপন করে জানা, আপনাকে পরের করে জানা। যখন তেমন করে জানি তখন কোনো প্রশ্ন থাকে না। একথা আমরা কখনো জিজ্ঞাসা করি না যে, আমি আমাকে কেন ভালোবাসি। আমার নিজের অনুভূতিতেই যে আনন্দ। সেই আমার অনুভূতিকে অন্যের মধ্যেই যখন পাই তখন একথা আর জিজ্ঞাসা করার কোনো প্রয়োজনই হয় না যে, তাকে কেন আমার ভালো লাগছে। বিষয়টি আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যার দাবী করে। যাজ্ঞবল্ক্য গার্গীকে বলেছিলেন—

নবা আর পুত্রস্য কামায় পুত্রঃ প্রিয়ো ভবতি।

আত্মনস্তু কামায় পুত্রঃ প্রিয়ো ভবতি।।

নবা অরে বিত্তস্য কামায় বিত্তং প্রিয়ং ভবতি।

আত্মনস্তু কামায় বিত্তং প্রিয়ং ভবতি।।

পুত্রকে চাই বলেই যে পুত্রপ্রিয় তা নয়, আত্মাকে চাই বলেই পুত্র প্রিয় হয়। বিত্তকে চাই বলেই যে বিত্ত প্রিয় হয় তা নয়, আত্মাকে চাই বলেই বিত্ত প্রিয় হয় প্রভৃতি। এ কথার অর্থ এই, যার মধ্যে আমি নিজেকেই পূর্ণতর বলে বুঝতে পারি আমি তাকেই চাই। পুত্র আমার অভাব দূর করে, তার মানে, আমি পুত্রের মধ্যে আমাকে আরো পাই। তার মধ্যে আমি যেন। আমিতর হয়ে উঠি। এইজন্য সে আমার আত্মীয়, আমার আত্মাকে আমার বাইরেও সে সত্য করে তুলেছে। নিজের মধ্যে যে সত্যকে অত্যন্ত নিশ্চিত রূপে অনুপম করে প্রেম অনুভব করি, পুত্রের মধ্যেও সেই সত্যকে সেই মতই অত্যন্ত অনুভব করাতে আমার সেই প্রেম বেড়ে ওঠে। সেইজন্য একজন মানুষ যে কী তা জানতে গেলে সে কী ভালোবাসে তা জানতে হয়। এতেই বোঝা যায়, এই বিশ্বজগতে কীসের মধ্যে সে নিজেকে লাভ করেছে, কতদূর পর্যন্ত সে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে আমার প্রীতি নেই সেখানে আমার আত্মা তার খণ্ডিত সীমারেখায় এসে পৌঁছেছে।

শিশু বাইরে আলো দেখলে বা কিছু একটা চলাফেরা করছে দেখলে আনন্দে হেসে ওঠে, কলরব করে। সেই এই আলোকে এই চাঞ্চল্যে নিজেরই চেতনাকে অধিকতর করে পায়, এইজন্যই তার আনন্দ। কিন্তু ইন্দ্রিয়বোধ ছাড়াও ক্রমে যখন তার চেতনা হৃদয়মনের নানা স্তরে ব্যাপ্ত হতে থাকে, তখন শুধু এতটুকু আন্দোলনে তার আনন্দ হয় না। একেবারে হয় তা নয়, অল্প হয়। এমনি করে মানুষের বিকাশ হতেই বড়ো হয় সে ততই বড়ো রকম করে আপন সত্যকে অনুভব করতে হয়। এই যে নিজের অন্তরাত্মাকে বাইরে অনুভব করা, এটা প্রথমে মানুষের মধ্যেই মানুষ অতি সহজে এবং সম্পূর্ণরূপে করতে পারে। চোখের দেখায়, কানের শোনায়, মনের ভাষায়, কল্পনার খেলায়, হৃদয়ের নানান টানে মানুষের মধ্যে সে স্বভাবতই নিজেকে পুরোপুরি আদায় করে—

দেশে দেশে মোর দেশ আছে, আমি

সেই দেশ লব বুঝিয়া।

ঘরে ঘরে আছে পরমাত্মীয়

তারে আমি ফিরি খুঁজিয়া।

এইজন্য মানুষকে জেনে, মানুষকে টেনে, মানুষের কাজ করে, সে কানায় কানায় ভরে ওঠে। এই জন্যই দেশে এবং কালে যে মানুষ যত বেশি মানুষের মধ্যে নিজের আত্মাকে মিলিয়ে নিজেকে উপলদ্ধি ও প্রকাশ করতে পেরেছেন তিনি ততই মহৎ মানুষ। তিনি যথার্থই মহাত্মা। ‘বিশ্ববোধ’ প্রবন্ধে কবি বলতে পেরেছেন—‘জিগীষা নয়, জিঘাংসা নয়। প্রভুত্ব নয় প্রবলতা নয়, বর্ণের সঙ্গে বর্ণের, ধর্মের সঙ্গে ধর্মের, সমাজের সঙ্গে সমাজের, স্বদেশের সঙ্গে বিদেশের ভেদ বিরোধ, বিচ্ছেদ নয়—ছোট বড়ো আত্মপর সকলের মধ্যেই উদারভাবে প্রবেশের যে সাধনা সেই সাধনাকে আমরা আনন্দের সঙ্গে বরণ করবো। সমস্ত মানুষেরই মধ্যে নিজের আত্মার সার্থকতা, এ-যে ব্যক্তি কোনো না কোনো সুযোগে কিছু না কিছু বুঝতে পেরেছে তার ভাগ্যে মনুষ্যত্বের ভাগ কম পড়ে গেছে। সে আত্মাকে নিজের মধ্যে জানাতেই আত্মাকে ছোট করে জানে।

সকলের মধ্যেই নিজেকে জানা—আমাদের মানবাত্মার এই যে একটা স্বাভাবিক ধর্ম, স্বার্থ তার একটা বাধা, অহংকার তার একটা বাধা, সংসারে এই সমস্ত বাধায় আমাদের আত্মার সেই স্বাভাবিক গতিস্রোত খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়, মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ সৌন্দর্যকে আমরা অবাধে দেখতে পাই না। কবি প্রশ্ন তুলেছেন—কেউ কেউ তর্ক করবেন, মানবাত্মার যা স্বাভাবিক ধর্ম, সংসারে তার এত লাঞ্ছনা কেন? যেটাকে মানুষ বাধা বলে উড়িয়ে দিচ্ছে, যা স্বার্থ, যা অহংকার তাকেই বা স্বাভাবিক ধর্ম কেন বলবে না? কেননা স্বভাবের চেয়ে স্বভাবের বাধাটাই বেশি করে চোখে পড়ে। দু’চাকার গাড়িতে মানুষ যখন প্রথম চড়া অভ্যেস করে, তখন চলার চেয়ে পড়াটাই তার ভাগ্যে বেশি ঘটে। এ নিয়েও তর্ক করা বৃথা। সংসারে স্বার্থ এবং অহংকারের ধাক্কা তাে পদে পদেই দেখা যায়, কিন্তু তার ভিতর দিয়েও মানুষের নিগূঢ় স্বধর্মরক্ষার চেষ্টা অথাৎ সকলের সংগে মেলবার চেষ্টা যদি না দেখা যায়, যদি পড়াটাকেই স্বাভাবিক বলে তর্ক। চলে, তবে তা নিতান্তই কলহ করা হয়।

সমস্ত মানুষের মধ্যেসম্পূর্ণ রূপে আপন মনুষ্যত্বের মিলনকে পাওয়াই মানবাত্মার স্বাভাবিক ধর্ম এবং তাতেই তার যথার্থ আনন্দ। এই ধর্মকে পূর্ণচেতনরূপে পাবার জন্যই অন্তরে বাইরে কেবলই বিরোধ ও বাধার ভিতর দিয়েই তাকে চলতে হয়। এই জন্যই স্বার্থ এত প্রবল, আত্মাভিমান এত অটল, সংসারের পথ এত দুর্গম। এই সমস্ত বাধার ভিতর দিয়া যেখানে মানবের ধর্ম সমুজ্জ্বল হইয়া পূর্ণসুন্দররূপে সবলে নিজেকে প্রকাশ করে সেখানে বড়ো আনন্দ। সেখানে আমরা আপনাকেই বড়ো করিয়া পাই। এমনি করে বাইরের যে সকল অপরূপ প্রকাশ, তা সূর্যোদয়ের ছটা হোক কিংবা মহৎ চরিত্রের দীপ্তি হোক বা আপন অন্তরের আবেগ হোক, যা কিছু ক্ষণে ক্ষণে আমাদের হৃদয়কে চিতিয়ে তুলছে, হৃদয় তাকে নিজের একটা সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত করে নিজের বলে তাকে আঁকড়ে রাখে। এমনি করে সে সকল উপলক্ষ্যে সে নিজেকেই বিশেষ করে প্রকাশ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!